জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প (গারো পাহাড়, ঝিনাইগাতি উপত্যকা, জেলা শেরপুর, বাংলাদেশ )ভগবানের ভেক /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প (গারো পাহাড়, ঝিনাইগাতি উপত্যকা, জেলা শেরপুর, বাংলাদেশ )
ভগবানের ভেক

চিন্ময় দাশ

এক জঙ্গলে বাস করত এক পাল ইঁদুর। তাদের ছিল একজন মোড়লও। যেমন বুদ্ধিমান, তেমনি সাহসী। ভারি একটা গুণ ছিল তার। দলের যে কোন বিপদের সময়, একেবারে সামনে গিয়ে, বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত সে। বনের ইঁদুররা যে তাকে মোড়ল বলে মানত, সেটা তার সাহস আর গুণের জন্যই। সবাই মেনে চলত তার কথা।
একদিন তখন সন্ধ্যে হয় হয়। এক শেয়াল বেরিয়েছে শিকার করতে। ঘুরতে ঘুরতে এক পাল ইঁদুর চোখে পড়ে গেল তার। একটু দূরে বটে, তবে চোখ যায়। 
এদিকে পেটে তখন বেদম খিদে। যাকে বলে, একেবারে চুঁই-চুঁই অবস্থা। কী করে পেটে পোরা যায়? মনে মনে ফন্দি আঁটতে লাগল সে। 
আর যাই খামতি থাক, ফন্দি আঁটতে শেয়ালের জুড়ি নাই। নিত্য নতুন বুদ্ধি গজায় শেয়ালের মগজে। অন্যদের বোকা বানাতে সে ওস্তাদ।
আহা, একসাথে অতগুলো ইঁদুর! মোটাসোটা নধর চেহারা সব! তাছাড়া,  বলতে গেলে, একেবারে নাগালের মধ্যে। লোভ সামলান যায় কখনো?
সঙ্গে সঙ্গে একটা ফন্দি এসে গেল মাথায়। আর, যেমন ভাবনা, কাজও তেমনই। ইঁদুরগুলোর বাসার কাছাকাছি হাজির হয়ে গেল শেয়াল। 
ঠিক পেছনেই জঙ্গল। শেয়াল করল কী, সামনের একটা পা একেবারে আকাশের দিকে তুলে ধরল। মুখও হাঁ করা। সেটাও তুলে ধরেছে আকাশের দিকে। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে।
  অন্ধকার নামছে। ঘোরাঘুরি সারা হয়েছে। বাসায় ঢুকে পড়তে হবে এবার। ঘরে ফিরে আসছে ইঁদুরেরা।
শেয়ালকে দেখতে পেয়ে গেল ইঁদুরের দল। সবাই অবাক! এমন বিচিত্র ভঙ্গী কেন শেয়ালের? এভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেন এখানে? একটু ঘাবড়েও গিয়েছে তারা।
খতিয়ে দেখতে হয়, ব্যাপারখানা কী? শেয়ালের সামনে এসে হাজির হয়ে গেল মোড়ল। জিজ্ঞেস করল—তোমার নাম কী গো?
শেয়াল গম্ভীর গলায় জবাব দিল—আমার নাম ভগবান।
--ওহ, তাই বুঝি! মোড়ল ভাবল, একটু মস্করা করি এর সাথে। বলল-- তা, তুমি অমন এক পা তুলে দাঁড়িয়ে আছো কেন? মাটিতে পা রাখবার জায়গা নাই বুঝি?
শেয়াল জবাব দিল—আচ্ছা বেকুব তো! জায়গা থাকবে না কেন? আসলে আমার চারটে পা-ই যদি মাটিতে নামিয়ে রাখি, রক্ষে থাকবে, ভেবেছ? টালমাটাল হয়ে যাবে জগত সংসার। অতো ভার সইতে পারবে না পৃথিবী। 
মোড়ল বলল—তা নয় বুঝলাম। কিন্তু আকাশের দিকে মুখ তুলে রেখেছ কেন?
--আসলে আমি সূজ্জিদেবের বন্দনা করি তো, তাই। স্তব করছি এখন। 
জবাব শুনে, মাথায় কিছু ঢুকল না মোড়লের। আবার প্রশ্ন করল—স্তব করছো যদি, মুখ অমন হাঁ করে রেখেছ কেন? 
একটু মুচকি হেসে নিল শেয়াল। বলল—তাও জানতে চাও? বলি তাহলে। আমি আসলে বাতাস টানছি ভেতরে। বাতাস হোল প্রাণ। যত বেশি টানব, তত বেশি বাঁচব। যত বেশি বাঁচব, তত বেশি পূণ্য। আসলে, এও এক সাধনা, বুঝলে। বলি, মাথায় ঢুকল কিছু?
মোড়ল তো সব শুনে থ। কিছুই ঢোকেনি তার মাথায়। জবাব এলো না মুখে। মনে ভাবল—বাপরে, এ তো দারুণ লোক। কপাল গুণে, এমন মহান একজন সাধকের দেখা পাওয়া গেছে। 
শেয়াল একই ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু চোখ ট্যারচা করে, বুড়োর মনের ভাবটা বোঝার চেষ্টা করছে। ফন্দিটা কাজে লাগলো কি না, জানতে হবে তো! 
মোড়ল করল কী, পেছন ফিরে হাঁক পাড়ল—শোন সবাই। আজ আমাদের কপাল ভালো। কেমন একজন গুণীজনের দেখা পেলাম আমরা। তাও একেবারে ঘরের দোরগোড়ায়।
এক, দু্‌ই, তিন করে, সবাই এসে জুটল শেয়ালের সামনে। শেয়াল তো সেই একই ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। একটা পা আর মাথা আকাশের দিকে উঁচিয়ে আছে। কিন্তু বাঁকা চোখে জরীপ করে নিচ্ছে ইঁদুরের পালটাকে। আহা, কী নধর নধর চেহারা এদের। জিভে জল চলে আসছে একেবারে। 
ইঁদুরদের মোড়ল বলল—শোন তোমরা। একেবারে সাক্ষাৎ ভগবান ইনি। প্রতিদিন এঁর পূজা করব আমরা। সকাল আর সন্ধ্যায়। খুব পূণ্যের কাজ হবে সেটা। কাল থেকেই পূজা শুরু হবে আমাদের। 
পরের দিন। আলো ফুটেছে, কি ফোটেনি। শেয়াল সাত তাড়াতাড়ি এসে একই ভঙ্গীমায় দাঁড়িয়ে পড়েছে। পা আর মাথা আকাশের দিকে তোলা। আড় চোখ দুটো কিন্তু নীচের দিকে।
ইঁদুরের পাল বের হচ্ছে গর্ত থেকে। এক একজন বেরোচ্ছে, শেয়ালকে প্রণাম করে চলে যাচ্ছে। শেয়ালের লক্ষ্য ইঁদুরের সারির দিকে। 
এক সময় শেষের জন এসে পেন্নাম ঠুকেছে, পেছনে আর কেউ নাই তার। অমনি কপ করে, ইঁদুরটাকে ধরে ফেলল শেয়াল। চালান করে দিলে মুখের ভিতর।
সন্ধ্যেতেও একই ঘটনা। ঘরে ফিরে এলো সবাই। আবার পেন্নাম করে যাচ্ছে শেয়ালকে। আবার শেষের জনকে মুখে পুরে দিল শেয়াল। 
সকাল সন্ধ্যে দু’বেলা পেটের যোগাড় হয়ে গিয়েছে কিছুদিনের জন্য। মনে খুশি যেন ধরে না শেয়ালের। আনন্দে টইটুম্বুর অবস্থা তার।  
এদিকে হয়েছে কী, ক’দিন না যেতেই মোড়ল বুড়োর মনে কেমন সন্দেহ হতে লাগল। ইঁদুরের সংখ্যা যেন একটু কম কম মনে হচ্ছে। ব্যাপারখানা কী? শেয়ালের কোন চালাকি নাই তো এতে? একটু খোঁজখবর রাখা দরকার,।
পরদিন একটু আগেভাগেই গর্ত থেকে বেরিয়ে পড়েছে মোড়ল। শেয়াল তখনও আসেনি। একটা উইঢিবিতে উঠে, তার উপর থেকে নজর করতে লাগল চার দিকে।
একটু বাদে শেয়াল এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে রোজকার মতো। ইঁদুরেরাও বেরোতে শুরু করল। এক একজন ইঁদুর সামনে আসছে, শেয়ালকে পেন্নাম ঠুকে চলে যাচ্ছে। তখন পরের জন এগিয়ে আসছে। 
মোড়ল অবাক হয়ে দেখল, শেষ ইঁদুরটাকে খপ করে ধরে, কপ করে মুখে পুরে দিল শেয়াল। এমন চুপিসারে হচ্ছে কাজটা, কিছু বুঝতেই পারছে না এগিয়ে যাওয়া ইঁদুরের দল। 
মোড়লের তো চোখ ছানাবড়া। আরে, তাহলে এজন্যই  অমন ভগবানের ভেক ধরে দাঁড়িয়ে থাকে শেয়াল! বন্দনা, স্তব সবই তাহলে তার ধোঁকাবাজী! সবই ভাঁওতা আর ধূর্তামির নাটক!
মোড়ল বুড়োর মনে খেদ হোল খুব। এতোদিন প্রণাম করবার কোন বিধিবিধান ছিল না তাদের সমাজে। তার পরামর্শেই ভগবানকে প্রণাম করতে যেত সবাই। অতএব এতজনের সর্বনাশের দায় তাকেই নিতে হবে। সে নিজেই এর জন্য দায়ী। তাহলে, তাকে নিজেকেই এর বিহিত করতে হবে। 
সারাটা দিন গেল। রাতেও  ঘুম নেই মোড়লের। শেষমেশ একটা বুদ্ধি বের করল বুড়ো। ভোরবেলা বেরোবার আগে, সব ইঁদুরকে ডেকে একটা আলোচনা করল সে--  আজও সবাই বেরোবার সময় ভগবানকে প্রণাম করবে। প্রতিদিন যেমন করো। কিন্তু আজ চলে যাবে না কেউ। কাছাকাছিই থাকবে। একটা ভোজের ব্যবস্থা করা হয়েছে সবার জন্য। একেবারে ভূরিভোজ। 
ভোজের কথায় মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল সবাই। সবাই খুশি। 
মোড়ল সাবধান করে দিল সকলকে—সবাই চুপ করে থাকবে। টুঁ শব্দটিও করবে না কিন্তু কেউ। 
সেদিনও শেয়াল এসে দাঁড়িয়েছে একই ভাবে। একটা পা উপর দিকে তোলা। হাঁ করা মুখটাও উঁচিয়ে আছে উপর দিকে। গলা টানটান। এক এক করে পেন্নাম ঠুকে যাচ্ছে ইঁদুরগুলো। 
তাদের মোড়ল এলো একেবারে শেষের দিকে। প্রণাম সেরে, ফিসফিস করে বলল—একটা কথা ছিল, ঠাকুর। গোপন কথা। শেয়ালও তেমনি ফিসফিস করে বলল—কী কথা? বলে ফ্যাল।
🍂

মোড়ল বলল—জোরে বলা যাবে না। অতি গোপনীয়। কানটা নামিয়ে আনুন এক্টুখানি
শেয়াল বলল—তা হয় নাকি রে, বেকুব? স্তবের সময় মুখ বা মাথা আমি নামাই না। বিঘ্ন হয় তাতে।
মোড়ল বলল—ঠিক আছে। আমিই কানের কাছে গিয়ে বলে আসছি। আজ সামনে এক বিরাট দাঁও। 
শুনে তো শেয়ালের মন আনচান। সে ধমকে উঠল—তাহলে খামোকা বেলা গড়িয়ে দিচ্ছিস কেন? নিজে এসে, কানের কাছে বলে যা।
মোড়ল তো এটাই চাইছিল। এমন মওকা ছাড়া যায় না। সে তরতর করে উঠে গেল শেয়ালের পা বেয়ে, গা বেয়ে। একেবারে কানের কাছে গিয়ে হাজির। 
ইঁদুরের দলটা দাঁড়িয়ে আছে একটু দূরেই। তারা তো মোড়লের কাণ্ড দেখে থ’। কিছুই মাথায় ঢুকল না তাদের। কিছু ঠাওর করতে পারল না শেয়ালও। 
একেবারে কানের কাছে উঠে এসছে মোড়ল। কানের ঠিক নীচেই তো শেয়ালের গলাখানা। মোড়ল বুড়ো আচমকা দিল এক মরণ কামড়। শেয়ালের একেবারে টুঁটি কামড়ে ধরেছে সে। 
ভয়াণক যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠল শেয়াল। ধপাস করে আছড়ে পড়ল মাটিতে। অমনি এক পাল ইঁদুর ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর। কোথায় উবে গেল তার সূর্যের স্তব। থেমে গেল মুখ হাঁ করে বেশি বাতাস টেনে নেওয়া। যন্ত্রনায় ছটফট করতে করতে নেতিয়ে পড়ল শেয়াল। একটু বাদেই প্রাণ বায়ু বেরিয়ে গেল বেচারার। ভগবানের ভেক ঘুচে গেল এ জীবনের মতো। 
আর ইঁদুরের দল? এটা ভগবান, না কি নেহাতই একটা ধূর্ত শেয়াল—সে বিচারের সময় নাই তাদের। এমন নাদুস-নুদুস আস্ত একখানা শেয়াল, তাও আবার একেবারে জ্যান্ত! কোনদিন জোটেনি তাদের কপালে। তারা ভূরিভোজে মশগুল। মহাভোজ শুরু হয়ে গেল ইঁদুরদের। 
এজন্যই বলে, মিথ্যা বা চলাকি দিয়ে সাময়িক সুবিধাই পাওয়া যায় কেবল। চিরদিন সুফল পাওয়া যায় না তা থেকে। গর্ত খুঁড়লে, একদিন নিজেকেই তাতে পড়তে হয়।

Post a Comment

0 Comments