জ্বলদর্চি

বনফুলের গল্পে মনস্তত্ত্ব /দেবশ্রী পণ্ডা


বনফুলের গল্পে মনস্তত্ত্ব

দেবশ্রী পণ্ডা 

কার্যকারণ সম্পৃক্ত পরিবর্তনশীল মনের মানচিত্র অঙ্কন করতে গিয়ে মনোবিজ্ঞানীরা ভিন্ন ভিন্ন মতবাদের সুবিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এতদিন পর্যন্ত মনস্তত্ত্বের ব্যাখ্যায় চেতন মনের প্রাধান্য ছিল মূলত আলোচনার বিষয়। শুধু চেতন মনই শেষ কথা নয়। তারও গভীরে মনঃসমীক্ষণের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুভূতি নিরন্তর প্রবহমান। মানব জীবনের সমস্ত মনন, চিন্তন সৃষ্টিশীল ও সৃজনধর্মী কর্মের বীজ বপন হয় মনের গভীরজাত অনুভূতি থেকে। অনুরূপভাবেই অ-সৃজনশীল বা ধ্বংসাত্মক কার্যের কারণও একই সূত্রে গ্রথিত হয়। সভ্যতার উন্নতির ইতিহাস সে তো মানব অন্তরের প্রেরণার ফসল। কর্মের এই যে প্রেষণাও নিরন্তর উদ্যম যা সভ্যতার ধারক ও বাহক--- ফ্রয়েডের মতে তা অবচেতন মন সঞ্জাত বিষয়বস্তু। উনবিংশ শতকের অন্যতম মনস্তত্ত্ববিদ, যিনি মানবমনস্তত্ত্বের বিষয়ে আমাদের চিন্তা ও চেতনার জগতে নবনির্মাণ ঘটিয়েছিলেন তাঁর মতে মানব মনের সচেতন এবং অসচেতন দুই কর্মের গভীর রহস্য প্রোথিত আছে অবচেতন মনের অভ্যন্তরে। 
অবচেতন মনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ আমাদের শারীরবৃত্তীয় বিভিন্ন প্রক্রিয়ার উপর প্রভাব বিস্তার করে। সামাজিক নিয়মনীতি, শৃঙ্খলার পরাকাষ্ঠা আমাদের অবদমিত কামনা বাসনা চরিতার্থ হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সেই সুপ্ত মানস প্রবণতা অবচেতন মনে গিয়ে বাসা বাঁধে। শুরু হয় সত্তা বনাম সমাজের দ্বন্দ্ব (conflict)। এই দ্বন্দ্ব থেকে জটিল মানস ক্রিয়ার সূত্রপাত। চিন্তন, মনন, ইচ্ছাশক্তি, অনুভূতি ইত্যাদি মানস ক্রিয়াকেই একত্রিত রূপে মন হিসাবে পরিগণিত করা যেতে পারে।
ফ্রয়েড মানসিক ক্রিয়া জাত বৃত্তিগুলির উৎস নির্দেশ করে তাকে তিনটি স্তরে ভাগ করেছেন অদ্‌স(Id) অহং (Ego) এবং অধিশাস্তা (Super-ego) এই অদ্‌স(Id) হল মানুষের একান্ত জৈবিক প্রবৃত্তি। সামাজিক বাস্তবতার নিয়ন্ত্রণ যার উপর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। অদ্‌স এর মধ্যে কোনো বিচার বিবেচনা, নীতি-নিয়ম ও পারিপার্শ্বিক ভাবনা কাজ করে না। এর একমাত্র উদ্দেশ্য হল সম্পূর্ণ অন্ধরূপে আত্মসুখ প্রাপ্ত হওয়া।
অদ্‌স প্রবৃত্তির নিয়ন্ত্রক হচ্ছে অহম্‌(Ego)। মানসিক ভারসাম্যকে নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের অহম্ সত্তা।  মানুষ জৈবিক প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে প্রবৃত্তিজাত কুপ্রভাব সমাজ জীবনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি  করবে। ‘অহম্‌’-এর কাজটি হল মানস ক্রিয়ার ভালো ও মন্দদিকটি নির্বাচনে গতিপথ নির্দেশ করা। বাস্তব জীবন ও সমাজ জীবনের সংস্পর্শে এসে অহম্‌ সত্তার দ্বারা অদ্‌স(Id) সত্তা জাত প্রবৃত্তি বা ইচ্ছাকে অবদমন করতে শেখে। অদ্‌স বুঝতে শেখে সমাজবদ্ধ জীব ব্যক্তিগত ইচ্ছা চরিতার্থ করার জন্য যা ইচ্ছে তাই করতে পারে না। তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা অত্যন্ত জরুরী। জীবনের উপর নিয়ন্ত্রণ শক্তি বজায় রাখার পাঠই অদ্‌সকে অহমে উত্তীর্ণ করে। 
🍂
অহমের বিচক্ষণতা বোধ থেকে সৃষ্টি হয় অধিশাস্তার। অধিশাস্ত-নৈতিকতা বোধের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। অহং যখন কোনো কাজকে ভুল বলে পরিগণিত করে তখন অধিশাস্তা সেটিকে  নৈতিক দিক থেকে বিচার করার চেষ্টা করে। এই বিচার ও বিবেচনা করার বোধটিকে আমরা পরিবার ও সমাজের থেকে প্রাপ্ত করি। সু-ভাবনাজাত কোনো কাজের পরিপন্থী ভাবনার ক্ষেত্রেই অধিশাস্তা অপরাধবোধ সৃষ্টি করে এবং তার থেকে বিরত করার চেষ্টা করে।

ফ্রয়েড মনস্তত্ত্বের বিজ্ঞানসম্মত আধুনিক ব্যাখ্যার দ্বারা আমাদের চেতনালোককে বিশ্লেষণমুখী মনন  সমৃদ্ধ করলেন। ফলতঃ পাশ্চাত্য প্রভাব দীপ্ত আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও সেই কার্য ও কারণ অনুসন্ধিৎসু চিন্তাচেতনার উৎস সন্ধানের প্রভাবকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। যার ফলস্বরূপ মধ্যযুগীয় দেববাদের গণ্ডী পেরিয়ে বাংলা সাহিত্যের প্রকৃতি ও প্রকরণের বিশ্বায়ন ঘটেছে। আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলনে পাশ্চাত্য ও বিশ্বের বিবিধ শিল্পসৃষ্টির সম্বন্ধে জ্ঞানার্জনের সূত্রে বাংলা সাহিত্য প্রভাবিত ও সমৃদ্ধিলাভ করেছে। আগেও যে সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য সাহিত্য সংস্কৃতির প্রভাব ছিল না, এমনটা নয়। বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কারণে তা অনেকটাই দুর্বল ছিল। যাইহোক মনস্তত্ত্বের বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা বা আলোচনার সূত্রপাত পাশ্চাত্য লেখকদের হাত ধরেই। যার ফলস্বরূপ আমাদের অবচেতন মনের বিপুল ও বিচিত্রামুখী যাত্রার যাত্রার উৎস সন্ধানের ইতিহাসের সূচনা হয়। শরীর ও মনের নিবিড় সম্পৃক্তি ও ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার পারস্পরিক অন্বয় এরই একটি অংশস্বরূপ। 
আমাদের আচরণগত বাহ্যিক কার্যালাপ ও কর্মকাণ্ড সে তো সচেতন মন দ্বারা কিঞ্চিৎ প্রভাবিত। বাকিটা প্রভাবিত অবচেতন মন সমুদ্ররূপ চেতনার চলিষ্ণু অভিঘাত দ্বারা। এই চলিষ্ণুমনের অতলস্পর্শী বিচিত্র রঙের রামধনুর ছটা সবচেয়ে বেশি প্রতিকায়িত সাহিত্য ও দর্শনে। 
ফ্রয়েড মনস্তত্ত্বকে বিজ্ঞান দৃষ্টির আলোকে উদ্ভাসিত করেছিলেন। কিন্তু তাকে শিল্পিত রূপ দিয়েছিলেন সাহিত্যিকরা ঠিক যেমন করে কাঠামোর উপর মৃত্তিকার প্রলেপ ও অলঙ্কার সজ্জার দ্বারা মূর্ত্তি গড়ে ওঠে। বলা যেতে পারে যথার্থ শিল্পী বা সাহিত্যিক হয়ে উঠতে গেলে মানব মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে সম্যক ও নিবিড় জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। লেখকের অন্তঃসত্ত্বায় (চেতন ও অবচেতন) জারিত হয় প্রবহমান জীবনের অনুভব মালা। মগ্ন চৈতন্যের গভীরে ডুব দিয়ে সাহিত্যিক তুলে আনেন ব্যক্তি ও সমাজ মনস্তত্ত্বকে। সাহিত্য মনোগহনের বিচিত্ররূপের নন্দিত প্রকাশ মাধ্যম হয়ে ওঠে।
ফ্রয়েড সাহিত্য ও দর্শন থেকে মনঃসমীক্ষণের প্রেরণা প্রাপ্ত হয়েছিলেন। সাহিত্যেও এই প্রভাব অনস্বীকার্য। বাংলা সাহিত্যও তার ব্যতিক্রম নয়। 
পাশ্চাত্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে বাংলা সাহিত্যের প্রকৃতি ও প্রকরণের পরিবর্তন সাহিত্য সম্ভারকে শুধু সমৃদ্ধই করেনি বিচিত্র পথমুখী গতিপথ নির্দেশ করেছিল। রেঁনেসাসের দখিনা বাতাসের নব সঞ্জীবনী মন্ত্রের বাণীবাহক হয়ে উঠলেন সাহিত্যিকরা। বাংলা সাহিত্য বিশ্বায়িত হয়েছে নব ভাবনাজাত মননশীল প্রকাশভঙ্গীর গুণে।  

বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকেই বাংলা সাহিত্যের দিক পরিবর্তনের আভাস সূচিত হয়। উপন্যাস, ছোটগল্প, কাব্যকবিতা, নাটক সবদিক থেকেই সামাজিক মূল্যমান পরিবর্তনের সাথে নিরন্তর সৃজনশীল পরীক্ষা নিরীক্ষা সাহিত্যের রঙ্গভূমিতে নব মাধুকরী রচনা করে। এই নব জাগৃতির সমৃদ্ধিশীল সৃষ্টিসম্ভারের অন্যতম স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত সৃষ্টিশীল ব্যতিক্রমী প্রতিভা হলেন বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। ফ্রয়েডও একান্তভাবে উপলব্ধি করেছিলেন মনের বিচিত্র লুকোচুরি খেলার বর্ণিল বিশ্লেষণ সম্বন্ধে সাহিত্যিকরা যতটা অবগত ততটা মনোবিজ্ঞানীরা নন। বলাইচাঁদের ক্ষেত্রেও একথা সমভাবে প্রযোজ্য। জীবনের সুখদুঃখ হাসিকান্নার পালাবদলের রহস্য উন্মোচনে বনফুলের শিল্পী সত্তা সদা জাগ্রত এবং অক্লান্ত। মানবমনের দুর্জ্ঞেয় রহস্যের বিচিত্র দিককে বনফুল কীভাবে তাঁর গল্পে চিত্রিত করেছেন আমরা তার একটি আলোচনার প্রয়াস রাখব।
বনফুলের পুত্র চিরন্তন মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বনফুলের ছোটগল্প সমগ্র’ প্রথম খণ্ডের ৩০ সংখ্যক ‘ভিতর ও বাহির’ গল্পটি আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা গল্পগুলি পর্যায়ক্রমিক বিশ্লেষণ শুরু করব। গল্পটির সূচনা কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সমৃদ্ধ ভাষা দিয়ে নয়। আঁতের গভীরজাত অনুভূতির বর্ণনা বনফুলের লেখনীতে প্রাণময় রূপ পেয়েছে। জীবন অভিজ্ঞতালব্ধ মনের নিবিড় অনুভূতি সাবলীলভাবে বর্ণিত হয়েছে। ‘মনস্তত্ত্ব’ এই শব্দটি সম্পর্কে অবগত নন এমন ব্যক্তিও এই ভাবনার অনুভব গ্রাহী হয়ে ওঠেন। বনফুলের শিল্পীসত্তা নিরন্তর অন্বেষণ করে গেছে বিবিধ চরিত্রের বিচিত্ররূপকে। এই বিবিধরূপই মানব অবয়বের বৈপরীত্যকে উপস্থাপিত করে। যার নিপুণ রূপঅঙ্কনে শিল্পী আত্মা থাকেন সংযত ও মিতবাক্। এই রকম ভাবনার নিখুঁত রূপায়ন দেখা যায় ‘ভিতর ও বাহির’ গল্পটিতে।
রামকিশোরবাবু প্রথিতযশা উকিল। আইনের মার প্যাঁচের সঙ্গে জীবনযাপন করতে করতে তাঁর ভিতরের মন মৃতপ্রায়। বাইরের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রথম সে তীব্র প্রতিবাদ করে উঠত। কিন্তু সে ও তাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। একজন অপরিচিত ব্যক্তি তাঁর কাছে আইনি পরামর্শ নিতে এসেছেন---
নিম্নরূপ বিষয়ে---
‘‘আমার একজন আত্মীয় আছেন, তাঁর একমাত্র ছেলের বিবাহ হয়েছে আজ প্রায় দশবৎসর। সন্তানাদি আজও কিছু হয়নি সম্ভাবনাও কম।’’
‘‘ডাক্তার দেখিয়েছিলেন?’’
‘‘হ্যাঁ তাঁদেরও মত যে, ছেলে পিলে হওয়া শক্ত।’’
‘‘ছেলেটি বেশ স্বাস্থ্যবান তো?’’
‘‘হ্যাঁ, ছেলের কোনও রোগ নেই।’’
‘‘আমার কাছে কোন বিষয়ে পরামর্শ চান?’’ বলিয়া রামকিশোর বাবু একটি নস্যদানি হইতে এক টিপ নস্য গ্রহণ করিলেন। 
‘‘এ সম্বন্ধে আপনার কাছে শুধু এইটুকু জানতে আসা যে যদি বংশ লোপই পায় তা হলে শেষপর্যন্ত সম্পত্তিটা কারা পাবে?’’
নস্যের টিপটা নাসারন্ধ্রে টানিয়া লইয়া রামকিশোর বাবু বলিলেন---
‘‘ছেলে যখন স্বাস্থ্যবান তখন সে আবার স্বচ্ছন্দে বিয়ে করতে পারে। হিন্দু ল’ অনুসারে তাতে কোনও বাধা নেই।’’
‘‘তা তো নেই। কিন্তু আইনের বাধা না থাকলেও সবসময় কি সব জিনিস করা সম্ভব?’’
রামকিশোর বাবু সেন্টিমেন্টের অপকারিতা সম্বন্ধে নাতিদীর্ঘ একটি বক্তৃতা দিলেন। বাইরের মন তাঁহার যুক্তি ও কথা যোগাইল। ভিতরের মন নির্বাক। আগন্তুক তখন বলিলেন--- ধরুন যদি ওরা ছেলের বিয়ে আর না দেন তা হলে সম্পত্তি কারা পাবে? আইন অনুযায়ী যাহারা উত্তরাধিকারী হইতে পারে--- রামকিশোর বাবু তাহা গড়গড় করিয়া বলিয়া গেলেন। পরিশেষে তাঁহার স্বকীয় মতটা পুনরায় ছাড়িলেন না---
‘‘ছেলের আবার বিয়ে দিন মশাই। বাঁজা বউ নিয়ে সংসার সুখের হয় কি?ছেলেপিলে  না থাকলে সংসার তো শ্মশান। আমি মশাই যেটা উচিত মনে করছি, তাই আপনাদের বললাম--- আপনার সেন্টিমেন্টে যদি আঘাত লেগে থাকে মাপ করবেন।’’
কিছুদিন পর রামকিশোর বাবুর মেয়ে সরোজিনী তাঁর কাছে ফিরে এল। 
রাম কিশোরবাবু কোর্ট হইতে ফিরিয়া অবাক হইয়া গেলেন---
‘‘এ কি সরি, তুই হঠাৎ খবর না দিয়ে এলি যে?’’
‘‘ও বাড়িতে থাকা আর পোষাবে না’’।
‘‘কেন?ব্যাপার কি?’’
রামকিশোরবাবু কন্যার ব্যবহারে ক্রমশই বিস্মিত হইতেছিলেন। 
‘‘পোষাবে না, মানে?’’
‘‘ওরা ছেলের আবার বিয়ে দিচ্ছে। তুমিও তো মত দিয়েছ।’’
‘‘আমি মত দিয়েছি মানে?’’
‘‘ওরা একজন অচেনা লোক তোমার কাছে পাঠিয়ে তোমার ঠিক মতটা জেনে নিয়ে গেছে। তুমি নাকি বলিছ---ছেলের বিয়ে দেওয়াই ভালো।’’
রামকিশোরের নেপথ্যবাসী ভিতরের মনটা বাহিরের মনের টুঁটি চাপিয়া ধরিয়াছে।’’
মনোবিজ্ঞান অনুসারে আমাদের প্রত্যেকটি আচরণের মধ্যে কোনো না কোনো উদ্দেশ্য নিহিত থাকে। কোনো কারণ ছাড়া আমাদের বাহ্যিক আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটে না। 
এই গল্পের ক্ষেত্রেও রামকিশোর বাবুর Id ও super ego-র দ্বন্দ্ব প্রকাশিত হয়েছে। রামকিশোর বাবুর সুপার ইগো প্রবৃত্তিকে অবদমিত করে এখানে Id প্রবৃত্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। মনের সমস্ত গভীরজাত সূক্ষ্ম অনুভূতিকে অন্তরের গোপন কুঠুরিতে আবদ্ধ রেখে প্রেমের চেয়ে প্রয়োজনীয়তাকে বেশী প্রাধান্য দিয়েছেন উকিল রামকিশোরবাবু। বাস্তব জীবনের নিরন্তর জটিলতার সঙ্গে সহাবস্থান তাঁকে মানবিক অনুভূতি থেকে বিচ্ছিন্ন রেখেছে। 
রামকিশোর বাবুর সচেতন মনের প্রহরা দ্বিমত প্রকাশ করেনি নিঃসন্তান ব্যক্তির দ্বিতীয় বিবাহের প্রস্তাবে। কিন্তু যখন জানতে পারেন এই ঘটনা নিজের মেয়ে সরোজিনীর সাথে ঘটেছে তখন তাঁর ভেতরের মন বাইরের মনের টুঁটি টিপে ধরেছে।
এক্ষেত্রে আমরা রামকিশোর বাবুর মধ্যে নার্সিসিজিম্  এর (Narcissism) এর প্রকাশ দেখতে পাই। মানব মন প্রথম থেকেই স্ব-প্রেম ধর্মী। নিজের শারীরিক অসুস্থতায় যেমন আমরা শুধু নিজেকে ভালোবাসি, ঠিক তেমনি প্রিয়জনের দুঃখ ও আমাদের অনুভূতির মর্মমূলে নাড়া দেয়। বাবা-মা, স্বামী সন্তান পরিজনের সঙ্গে আমরা আত্মস্থ হই। এই সম্পর্কগুলোও বিশেষ মূল্যবান আমাদের কাছে। একে মনস্তত্ত্বের ক্ষেত্রে Narcissistic supply বলি। গল্পের শেষে রামকিশোর বাবুর অন্তরাত্মাও একই ভাবনার দ্বারা তাড়িত হন।
ব্যক্তিগত অনুভূতির সঙ্গে অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে চরিত্রের আঁতের কথাকে সাবলীলভাবে চিত্রিত করেছেন বনফুল। ফ্যান্টাসী আর অতিপ্রাকৃত ভাবনা কোথাও কোথাও গল্পের শিল্প মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করেছে। কিন্তু সার্বিক বিচারে তাঁর মানব মন রহস্যসন্ধানী গল্পগুলি হয়ে উঠেছে ভিন্নস্বাদধর্মী।  মানব মনের ভেতরে সঞ্চিত রহস্যময় ভাণ্ডারের রহস্য উন্মোচনের চেষ্টায় নিরন্তর ব্যাপৃত মনোবিদ, দার্শনিক ও চিকিৎসকরা। তাঁদের জীবনব্যাপী অক্লান্ত গবেষণার ফসল হিসাবে আমরা মনোগহনের বিচিত্র দিক সম্বন্ধে অবহিত হতে পেরেছি। বর্তমানে মনস্তত্ত্ব নিয়ে বিস্তৃত পড়াশুনাও বাস্তব জীবনে তার সফল প্রয়োগের ক্ষেত্রে নেপথ্যচারী ভূমিকা নেন এই মনোবিদরা। সৃজনশীল ও সুস্থ সমাজ গঠনের বীজনিহিত আছে সুস্থ মানব চেতনার প্রকাশের মধ্য দিয়ে। বর্তমান কালে তত্ত্ব মনোবিদ এবং চিকিৎসকরা মনোগহনের বিচিত্র দিক নিয়ে নিরন্তর গবেষণায় রত। আগামী দিনে মনস্তত্ত্বের আরও নতুন দিগন্ত উন্মোচনের আশায় আমরা রইলাম।

জ্বলদর্চি অ্যাপ ডাউনলোড করুন। 👇

Post a Comment

0 Comments