তাপসদের তপস্যা
দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে
আজকে চা ঘুগনি একটু কমই বিক্রি হয়েছে। এই কাট ফাঁটা রোদ্দুরে বাড়ি থেকে সাধারণত কেউ বেরোই না, কিন্তু তাকে তো বেরোতেই হবে, না হলে সংসার চলবে কি করে? সংসারের একমাত্র রোজগেরে ব্যক্তি শুধুমাত্র সেই। একদিন না বেরোলে পরের দিন কি খাবে, কি করে সংসার চলবে ভাবতে হয় তাকে। তাই রোদ- বৃষ্টি-জল মাথায় নিয়ে হলেও তাকে টলি টা নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয়।
আজ শরীরটা ভালো নেই তাপসের।দুবার বমি করেছে সে, হয়তো প্রচণ্ড রোদ্দুর থাকার কারণে। মনে মনে তাপস ভাবছে বোধহয় ডিহাইড্রেশন হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে বাড়ি পর্যন্ত যাওয়া তো দূরের কথা টলি টাকে যে ঠেলে একটু ছাঁওয়া তে এগিয়ে নিয়ে যাবে সেই ক্ষমতা টুকুও নেই তার।
বাড়িতে আছে স্ত্রী ও দুই মেয়ে। বড় মেয়ে মাধ্যমিক দেবে সামনের বছর আর ছোটটা এই ছয় বছরের। কোন রকমে টেনেটুনে তাদের দিন চলে যায়। নতুন জামা কাপড় কেনা, ভালো খাবার খাওয়া তাদের কাছে এখন যেন বিলাসিতা। এখন এই টলি টাই তাদের অন্ন দাতা।
একজন সহৃদয় ব্যক্তি দূর থেকে তাপস কে টলোমলো পায়ে এগিয়ে ড্রেনের ধারে আবার বমি করতে দেখে বলল, 'দাদা টলিটা কে আমি পরে তোমার বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছি। চলো, তোমাকে বাড়িতে আগে পৌঁছে দিয়ে আসি'।
🍂
তাপস খুব বড় বাড়ির ছেলে। পড়াশোনাতেও খুব একটা খারাপ ছিল না, প্রত্যেক বছরই মোটামুটি ভালো রেজাল্ট করে পাস করে গেছে।১৯ ৮৮- ৮৯ সালে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে সে। আঁকতেও পারতো খুব সুন্দর। অনেক কম্পিটিশনে এঁকে ফাস্ট প্রাইজও নিয়ে এসেছে। শুধু তাই নয় আঁকার কম্পিটিশনে তাপসের নাম থাকলে অনেকে নিজের নাম সরিয়ে নিতো কারনটা ওরা জানত, আঁকাতে তাপস মানেই ফার্স্ট।সেই সময় একটু গাইডেন্স পেলে হয়তো আজ ড্রইং এর সাম্রাজ্যে নামকরা কেউ হতো।
সহৃদয় ব্যক্তিটি তাপস কে তার বাড়িতে গিয়ে ঢোকার সময় তাপসের স্ত্রী তার উষ্কো খুস্কো অবস্থা দেখে ব্যাকুল হয়ে পড়ে, কি হয়েছে, না হয়েছে জানার চেষ্টা করে। সব কথা শুনে নিজেদের কপাল কে দোষ দেয়। তাপস সেই ভোর চারটের সময় বের হয় আর বাড়িতে ঢুকে বেলা দুটোই। ওই সময়ের মধ্যে একটুখানি চা বিস্কুট আর একটু মুড়ি খাই শুধু, কেননা ওকে এখন টাকা জমিয়ে মেয়ে দুটোকে পড়াতে হবে মানুষ করতে হবে। তাপসদের অবস্থা তো এরকম ছিল না লকডাউন এর আগে পর্যন্ত।
বিকেলের দিকে শুয়ে শুয়ে তাপস ভাবে আগের দিনগুলো কি সুন্দরই না ছিল। ঘরভর্তি লোকজন একান্নবর্তী পরিবার। তাদের পরিবারের আভিজাত্যই আলাদা ছিল। বাবার চাকুরী ছিল, কাকাদের ছিল বড় ব্যবসা। অত্যন্ত স্বচ্ছল অবস্থা ছিল তাদের। তাপসদের গ্রামে তাদের পরিবারের খুব নাম ছিল। কোনদিনও ভাবেনি তার এরকম দিন আসবে।
করোনা র আগে সে শহরের একটি জনপ্রিয় প্রাইভেট হসপিটালের ডায়ালিসিস বিভাগের হেড ছিল। খুব সততার সঙ্গেই কাজ করতো সে, তায় সুনাম ও যথেষ্ট ছিল।তাপসের ডিপার্টমেন্টের সকলেই তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতো। তার আন্ডারে থাকা ছেলে-মেয়েদেরও অনেক স্নেহ করতো তাপস। সবকিছু মিলিয়ে যেন একটা পরিবারের মত কাজ করতো তারা। এদিকে তার পরিবারের কাছে সে পনের দিন বা এক মাস ছাড়া আসতো। সুন্দর একটা ছোট পরিবার খুব ভালো ভাবে চলে যেত।
কিন্তু করোনার পর অনেকের মত তারও চাকরি চলে যায়, আর ডাক আসে না হসপিটাল থেকে। অনেক জায়গায় তার গ্রাজুয়েশনের ডিগ্রি সার্টিফিকেট এবং কাজের অভিজ্ঞতার সার্টিফিকেট নিয়ে ঘোরাফেরা করেছে কিন্তু বাজারের এই দুর্দিনে তাকে কাজ দেবে কে?পেট তো আর কথা শুনবে না। নিজে, স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে কি করবে? ভেবে পায়না তাপস। এই ভেবে সে রাতের পর রাত ঘুমোতে পারেনি। চোখের সামনে যেন অন্ধকার হয়ে আসেছে। নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথাও ভেবেছে সে ,কিন্তু বাচ্চাগুলোর কথা ভেবে মনকে শান্ত করেছে। অবশেষে কোন পথ না পেয়ে একটা টলি কিনে আজ সে চা ঘুগনি বিক্রি করে। অভিজাত পরিবারের ছেলে বলেই হয়তো কোন খারাপ কাজ করতে পারেনি। সেই শিক্ষায় যে, সে শিক্ষিত হয়নি।আজকের তাপসেরা তপস্যা তো করে কিন্তু সাধনার ফল পায় না।
কাল কি করবে ভাবতে ভাবতে তাপস ঘুমিয়ে পড়ে।
0 Comments