জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—পর্তুগাল (ইউরোপ)চুল থেকে যার মুক্তো ঝরে /চিন্ময় দাশ

চিত্র- শুভম দাস 

দূরদেশের লোকগল্প—পর্তুগাল (ইউরোপ)
চুল থেকে যার মুক্তো ঝরে
চিন্ময় দাশ

দুটি ছেলে মেয়ে নিয়ে এক গ্রামে থাকে এক বুড়ি। অভাব ছাড়া, সংসারে কিছুই নাই বুড়ির। ভারি কষ্টে দিন কাটে তাদের মা মেয়ের। 
বড় হতে, ছেলেটা একটা জাহাজের কাজে ঢুকে গেল। সাত সমুদ্র পেরিয়ে, দূর দূর দেশে ভেসে বেড়াতে হয় তাকে। মেয়েকে নিয়ে বুড়ি রইল তার নিজের কুঁড়েঘরটিতে।
একবার ভারি অসুখ করল বুড়ির, বাঁচে কি বাঁচে না। বুড়িও বুঝে গিয়েছে, ডাক এসে গিয়েছে। এ যাত্রায় আর রেহাই নাই। 
শেষবেলায় মেয়েকে ডেকে বুড়ি বলল—শোন মা, যাবার সময় হয়ে গিয়েছে আমার। তোর ভাইও নাই ঘরে। অভাব ছাড়া কিছুই দিয়ে যেতে পারলাম না তোকে। থাকবার মধ্যে আছে একটা তোয়ালা আর একটা চিরুনি। এই দুটো রইল তোর জন্য। কোন দিন কোনও কারণে হাতছাড়া করিস না এ দুটো। 
চোখের জল ফেলতে ফেলতে মেয়ে জিজ্ঞেস করল—একথা বলছো কেন গো, মা?
--যা বলছি, শোন। মা বলল—এই তোয়ালে ছাড়া অন্য কিছুতে মাথা মাথা মুছবি না, চুল ঝাড়বি না। এই চিরুনি ছাড়া, অন্য কোনও কিছুতে মাথা আঁচড়াবি না। অভাবী মায়ের এই কথাটুকু মনে রাখিস, মা। 
বুড়ি মারা গেল। মায়ের কথা অমান্য করেনি মেয়েটি। 
কিন্তু অবাক কাণ্ড ঘটে গেল প্রথম বারেই। মেয়েটি স্নান সেরে এলো নদী থেকে। ঝোলা থেকে মায়ের দিয়ে যাওয়া তোয়ালে বের করে, যেই না মাথা ঝাড়তে লেগেছে, অমনি কী অবাক কাণ্ড! মাথা থেকে কয়েকটা ছোট ছোট মুক্তোর দানা ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। 
মেয়েটার মুখ দিয়ে আওয়াজও বের হোল না। চমকেই যায়নি কেবল, একটু ভড়কেও গিয়েছে। এবার থলে থেকে মায়ের দেওয়া চিরুনিটা বের করল। 
আবারও একই কাণ্ড। যেই না চিরুনি বুলিয়েছে মাথায়, আবার কয়েকটা মুক্তো! এবারের দানাগুলো একটু বড়ও বটে।
প্রতিদিন একই ঘটনা। প্রতিদিনই যত্ন করে মুক্তোগুলো কুড়িয়ে যত্ন করে তুলে রাখে মেয়েটি। মুক্তো তুলে রাখে, আর ভাবতে থাকে, কবে ভাই ঘরে ফিরে আসবে।
কত দিন বাদে, একদিন ভাই ঘরে ফিরে এলো। বোনের মুখে শুনে আর মুক্তোগুলো দেখে, সেও অবাক। বলল—এগুলো যত্ন করে তুলে রাখ, বোনটি। এবার যখন বেরোব, কোন দেশের রাজার কাছে বিক্রি করে দেব। আর অভাব থাকবে না আমাদের। 
চোখের জলের বন্যা গড়িয়ে নামছে মেয়ের গাল বেয়ে। বলল—মা তাহলে অনাথ করে যায়নি আমাদের, বল, ভাই!
ভাই কাঁদল সে কথা শুনে। তা দেখে বোন আবার কাঁদল। বোন ভাইয়ের চোখের জল মুছিয়ে দিল। ভাই মোছালো বোনের। 
আবার সমুদ্রে ভাসবার দিন এসে গেল ছেলেটার। ছ’ছটা ভাঁড় ভর্তি হয়েছিল মুক্তো জমে জমে। পুঁটলি বেঁধে সেগুলো নিয়ে ভাই বেরুল বাড়ি থেকে। 
প্রথম যে দেশের ঘাটে জাহাজ ভিড়ল, সোজা সে দেশের রাজার বাড়ি গিয়ে হাজির হোল ছেলেটা। সেপাই পাহারায় ছিল দেউড়িতে। সে সব শুনে বলল—তোমার পুঁটলি দাও আমাকে। আমি গিয়ে দেখাই রাজামশাইকে। ডাক পড়লে, তোমাকে ভিতরে নিয়ে যাব। 
জাহাজে কাজ করে, সাত ঘাটের জল খাওয়া হয়ে গিয়েছে তার। সেপাইর মতলব বুঝতে দেরি হোল না। ছেলে বলল—ওটি হচ্ছে না। আমি নিজে গিয়ে দেখাবো রাজামশাইকে। পুঁটলিটা বুকে আঁকড়ে রাখল সে।  
অগত্যা সেপাই ছেলেকে নিয়ে ভেতরে চলল। পুঁটলির মুক্তো দেখে, রাজা ভারি অবাক। সত্যি সত্যি খুব দামী মুক্তো। তাঁর সিন্দুকেও নাই এমন জিনিষ!
রাজা বলল—কার ধন চুরি করে এনেছ?
শুনে আঁতে ঘা লাগল। ছেলেটা বল—অভাবী মায়ের ছেলে আমি। জাহাজে কাজও করি খুব ছোট একটা। তাই বলে চুরি করতে শিখিনি। মিথ্যেও বলি না কখনও।
রাজামশাই ভারি খুশি হলেন জবাব শুনে। ছেলেটি তখন ভরা দরবারে খুলে বলল ঘটনাটা। 
🍂
রাজা বলল—তুমি বাড়ি যাও। তোমার বোনকে নিয়ে এসো এখানে। নিজের চোখে দেখতে চাই আমি। সত্যি হলে, কপাল ফিরে যাবে তোমাদের। বিয়ে করব তোমার বোনকে। তবে বাপু, যদি চালাকি ধরা পড়ে, সবার সামনে শূলে চড়াব দুটিকে। এটা মনে রেখো। 
মুক্তো থাকল রাজার হেফাজতে। তার দাম হিসাবে, রাজা  অনেক টাকা দিল ছেলেকে। এতো টাকা জীবনে দেখেনি সে ছেলে। আনন্দে আত্মহারা হবার জোগাড়। তার দুঃখিনী বোন রাজরানি হবে? স্বপ্ন দেখছে না তো? 
 আনন্দে মাটিতে পা পড়ছে না ছেলের। দেশে ফিরে যেতে হবে এখন। টাকা দিয়ে, আস্ত একটা জাহাজই কিনে ফেলল সে। তার নিজের জাহাজ! জাহাজ ভাসিয়ে ঘরে ফিরে এল বোনকে নিয়ে যাবে বলে। 
বোনের তো বিশ্বাসই হতে চায় না। গরীব মায়ের মেয়ে সে। দু’বেলা রুটি জোটে না ভালো করে। সে হবে একটা দেশের রানি! ভাবতেই পাছে না কোন মতে। 
তোয়ালে আর চিরুনি নিয়ে তৈরি হোল ভাইবোন। মেয়েটি বলল—চিরকালের মতো চলে যাচ্ছি। পড়শি মাসিকে কথাটা বলে যাই। 
পড়শি মাসির তো চোখ নেচে উঠল সব শুনে। মনে লোভ হোল। শয়তানি বুদ্ধি চেপে বসল মাথায়। হাসি মুখ করে বলল—তুমি রানি হবে, কতো আনন্দের কথা। তোমার মা থাকলে, কী খুশিই না হোত? তা বলে চিন্তা কোর না। মাসি তো আছে। আমি যাব তোমার সাথে। বিয়ের সময় মেয়ের পাশে মায়ের থাকাটা কাজে লাগে। 
--তুমি যাবে আমার সাথে?
পড়শি বলল—গরীব জীবনে তো আর এমন অনুষ্ঠান চোখে দেখতে পাবো না। এই সুযোগে, দেখন সুখটা তো হয়ে যাবে আমাদের মা মেয়ের। চলো বাছা, আনন্দের দিনে আমরা থাকব তোমার সাথে। 
ভাই বোন সাথে নিয়েছে তাদের পোষা কুকুরটাকেও। আর নিয়েছে পড়শি মা মেয়েকে। মাসির মনে একটাই চিন্তা, কী করে হাতানো যায় তোয়ালে আর চিরুনিটাকে। কী করে নিজের মেয়েকে রানি করে ফেলা যায়। 
জাহাজ চলেছে মাঝ দরিয়া বেয়ে। দুর্জনের ছলের অভাব হয় না। আঁচলের আড়াল করে, বিষের শিশি এনেছিল মাসি। মেয়েটার জলের সাথে, এক ফোঁটা বিষ মিশিয়ে দিল সে।
অসুস্থ হয়ে পড়ল মেয়েটা। ঝিমিয়ে আসতে লাগল একটু একটু করে। ছেলেটা ভয় পেয়ে গেল। বোনের কিছু হয়ে যাবে না তো? 
পর দিন। আরও এক ফোঁটা বিষ মেশাল মাসি। ধীরে ধীরে একেবারে নেতিয়ে পড়ল মেয়েটা। এক সময় মনে হোল, মরেই গেছে। 
মাসি প্রবোধ দিয়ে বলল—দুঃখ কোর না, বাবা। রাজসুখ সবার কপালে সয় না। তোমার মা নিজেই কোলে তুলে নিয়েছে মেয়েকে। তুমি কষ্ট পেয়ে কী করবে?
এদিকে মরা মানুষ জাহাজে বইবার নিয়ম নাই। মাঝিমাল্লারা আপত্তি শুরু করল। বুক ফেটে যাচ্ছে ছেলেটার। কিন্তু করবার কিছু নাই। সমুদ্রের জলে ফেলে দেওয়া হোল অচেতন মেয়েটাকে।
এবার ভয় শুরু হোল ছেলেটার মনে। এসব গল্প রাজা বিশ্বাস করবে না। নির্ঘাত শূলে চড়িয়ে দেবে। পড়শি শুনে বলল—তা কী করে হয়, বাবা? আমরা থাকতে, তুমি মরবে কেন? 
ছেলে বলল—রাজা কোন কথাই শুনবে না। 
মাসি বলল—তুমি দয়া করে এনেছ আমাদের। তোমার জন্য আমরা সব করতে রাজি। বাঁচবার একটা রাস্তা দেখতে পাচ্ছি। বোন গিয়েছে। তোয়ালে আর চিরুনি তো যায়নি? সে তো তোমার হেফাজতেই আছে। 
ছেলেটা বলল—তোয়ালে চিরুনি দিয়ে কী হবে? 
মাসি বলল—এক কাজ করো তুমি। আমার এই মেয়েকে বোন বলে হাজির করে দাও রাজার কাছে। সে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছুক। মাথা আঁচড়াক চিরুনি দিয়ে। বেঁচে গেল তোমার প্রাণ। শূলে চড়ে বেঘোরে প্রাণ দিতে হোল না।  
ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করছে ছেলের। কিন্তু অন্য কোন উপায়ও নাই প্রাণ বাঁচাবার। তিনজনে এসে হাজির হোল দরবারে। 
আজ দরবার ভরা লোক। এমন আশ্চর্য ঘটনা কে না দেখতে চায়! পড়শির মেয়েকে নিয়ে রাজার সামনে দাঁড়িয়েছে ছেলেটি। রাজার হুকুম পেয়ে, তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছল মেয়েটি। মাথা মোছাই হোল শুধু। কোনও চমৎকার ঘটল না। কোন কিছুই ঝরল না মাথা থেকে। 
এবার চিরুনি দিতে বলা হোল। তাতে কিছু খুসকিই উড়ল বাতাসে। মণিমুক্তোর নামগন্ধটিও নাই।
রাজা রাগে অগ্নিশর্মা। হুকুম দিল—গরাদে ভরে রাখ ছেলেটাকে। সাত দিন বাদে শূলে চড়াব হতভাগাকে। রাজার সাথে ফেরেব্বাজি! হাতে হাতে ফল পাবে বাছাধন। 
রাগে গরগর করছে রাজার গলা। ছেলেটাকে টেনে হিঁচড়ে গরাদে ভরে দেওয়া হোল। আটকে রাখা হোল মা মেয়েকেও।
এদিকে হয়েছে আর এক কাণ্ড। রাজার ছিল এক মাইনে করা জেলে। সব রাজারই থাকে। নিত্যদিন রাজার ভোজের পাতে মাছের জোগান দেওয়া তার কাজ। দূর দেশের ছেলের যখন বিচার চলেছে রাজসভায়, জেলে গিয়েছে নিজের কাজে। সমুদ্রের পাড়ে এসে হাজির হয়েছে জেলে।
বালিতে নেমে জেলের চোখ ছানাবড়া। বিশাল এক তিমি পড়ে আছে জলের কিনারায়। ভারি কষ্ট হোল জেলের। আহারে বেচারা! বেসামাল দৌড়ে, জলের রাজা উঠে পড়েছে ডাঙায়। ভারি শরীর নিয়ে আর নামতে পারেনি। বেঘোরে প্রাণ গিয়েছে ডাঙায় উঠে।
মাঝির ডিঙিখানা উলটে রাখা ছিল বালির চড়ায়। আফশোষ করতে করতে, ডিঙি ভাসাতে যাবে, থমকে গেল লোকটা। কার একটা গোঙানি কানে আসছে তার। কেউ কি বলছে—কে আছো, বাঁচাও আমাকে। বের করে দাও এখান থেকে। 
কান খাড়া করতেই বোঝা গেল, মেয়ের গলার কান্না। আর সেটা আসছে তিমিটার পেটের ভিতর থেকে। নিশ্চয় কিছু একটা ঘটেছে। ডিঙি থেকে ছুরি এনে, চটপট তিমির পেটটা চিরে ফেলতে লাগল।
তিমির পেট থেকে সত্যি সত্যি একটা মেয়েকে বেরোতে দেখে, লোকটা থ’ হয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল—এ শয়তানের পেটে গেলে কী করে তুমি?
--কাকে শয়তান বলছো তুমি, বাবা? মেয়েটা বলল—এ জীবটা ভগবানের চেয়েও বড়। এর জন্যই তো বেঁচে গেলাম আমি। 
নিজের জীবনের সব কথা বুড়োকে খুলে বলল মেয়ে। বলল—বিষের জ্বালায় ঝিমিয়ে গিয়েছিলাম। মরে গিয়েছি ভেবে, জলে ফেলে দিয়েছিল ভাই। জলে পড়তেই চেতনা ফিরে আসে আমার। সাথে সাথে হাঙর কুমিরের দল ঘিরে ফেলেছিল আমাকে। ছিঁড়ে খেয়ে ফেলত সবাই মিলে। এই তিমিই তাদের হঠিয়েছে। সব শুনে, বলেছে—রাজার দরবার পর্যন্ত যাবার উপায় নাই আমার। তবে, ডাঙায় পৌঁছে দিয়ে আসব তোমাকে। কোন বিপদ হবে না তোমার। 
মেয়েটা বলল—এই বলে, আমাকে পেটের মধ্যে নিয়ে, এক সাঁতারে এখানে এসে উঠেছে বেচারা। আমাকে বাঁচাতেই, নিজের জীবন দিয়েছে তিমি।
রইল পড়ে মাছ ধরা। মেয়েটাকে নিয়ে ঘরে ফিরে চলল জেলে। রাজার প্রাসাদেরই একটেরে, জেলের জন্য একটা ঘর বরাদ্দ আছে। মেয়েটাকে ঘরে ঢুকিয়ে, জেলে বলল—শোন গো, মেয়ে। চুপটি করে থাকবে এখানে। কেউ যেন টেরটিও না পায়।
ছোট্ট খুপরি মতো একটা ঘর। তার ভিতর আটকে থাকে মেয়েটি। জানালায় চোখ রেখে দিন কেটে যায় তার। একদিন হঠাৎ তাদেরই কুকুরটা জানালার কাছে এসে হাজির। মেয়েটা বলল—হ্যাঁরে, ভাইয়ের খবর জানিস কিছু? 
কুকুরে চোখ জলে ভেজা। সে বলল—গারদে আটকে আছে তোমার ভাই। দু’দিন বাদে শূলে চড়ানো হবে। এটা রাজাকে ঠকানোর সাজা।
জেলে বুড়ো ছিল দরজার বাইরে। কথাগুলো সব গেল জেলের কানে। 
পরদিন আবার এসেছে কুকুর। বলল-- আজ ঢেঁড়া পেটানো হয়েছে নগরে। কাল শূলে চড়াবার সময়, প্রজারা আসবে দল বেঁধে। 
সেদিনও জেলেবুড়ো শুনল কথাগুলো। সেদিন ইচ্ছে করে সমুদ্রে গেল না বুড়ো। ফলে, হোল কী, রাজার পাতে মাছ নাই। এমন সৃষ্টিছাড়া কাণ্ড ঘটেনি কোন দিন। দরবারে সমন হয়েছে জেলের।
জেলে দরবারে গেল না। সোজা রাজার কাছে গিয়ে হাজির। তার মুখে ঘটনা শুনল রাজা। বলল—আমাকে নিয়ে চল তো তোমার ঘরে। আমি নিজের কানে শুনব কুকুরের কথা।
সেদিনও কুকুর এসেছে। রাজা নিজে আড়ালে থেকে কান পেতে আছে, কেউ জানে না। কুকুর বলল—আজই শূলে চড়ানো হবে তোমার ভাইকে। কী কপাল দেখো। কে করল লোভ, কপাল পুড়ল কার! একজনের শয়তানিতে শাস্তি হচ্ছে তোমাদের দুটি ভাইবোনের। কেন যে তুমি সাথে আনতে গেলে পড়শিকে, বুঝি না, বাপু। এখন বোঝ ঠেলা। 
রাজা শুনে চমকে গেল। এমন শয়তান হতে পারে মানুষ? আর আমি কি না একজন নির্দোষীকে শূলে চড়াতে যাচ্ছিলাম! মাথা চুলকাতে চুলকাতে রাজা ফিরে চলল।
দরবার শুরু হয়েছে। সেদিন ভরা দরবার। রাজবাড়ির সামনের মাঠ লোকে লোকারণ্য। থইথই করছে লোক। একজন মানুষকে শূলে চড়ানো হবে। এমন দৃশ্য দেখার সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি নয় কেউ। 
গারদ থেকে ছেলেটাকে এনে দাঁড় করান হয়েছে রাজার সামনে। আনা হয়েছে মা মেয়েকেও। রজা ছেলেটিকে বলল—সত্যি করে বল তো, জাহাজে এদেরকে কেন এনেছিলে তুমি?
এরা আমার পড়শি। আমার বোনের বিয়ে দেখতে চেয়েছিল। ছেলেটা বলল—আর বলেছিল, তোমাদের মা নাই, তাতে কী হয়েছে। এই মাসি তো আছে।
রাজা বলল—মরে গেছে কি না, সঠিক না জেনে, বোনকে জলে ফেলে দিয়ে এলে! 
ছেলেটা চুপ করে আছে। রাজা হুকুম করল—আমার জেলেকে ডেকে নিয়ে এসো এখানে। বলবে, একা না আসে যেন। 
সেপাই ছুটল সাথে সাথে। একটু বাদে মেয়েটিকে সাথে নিয়ে, জেলে এসে ঢুকল দরবারে। ছেলেটি বা তার পড়শি কেউ যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। মেয়েটি দৌড়ে গিয়ে দাদাকে জড়িয়ে ধরল। অঝোরে কাঁদতে লাগল দুজনে। তারা তো আর জানে না, কী ঘটতে চলেছে এর পর। 
রাজা হুকুম করল—শোন, মেয়ে। কান্নাকাটি পরে করবে। এখন ঐ তোয়ালে দিয়ে নিজের মাথা মোছ তো দেখি। 
রাজার হুকুম। তোয়ালে তুলে মাথা মুছল মেয়েটি। আর যায় কোথায়? যেই না মাথায় তোয়ালে বুলিয়েছে, অমনি ঝরঝর করে মুক্তোর দানা ঝরে পড়তে লাগল মেঝেয়। যেন কতো দিনের কতো রত্ন জমা হয়ে ছিল মাথাটাতে!
দরবার ঘরের মেঝেয় গড়িয়ে যাচ্ছে মুক্তোর দানা। ঝলমলিয়ে উঠছে সারা দরবার। চোখ ঝলসে যাচ্ছে রাজামশাইরও। রাজা বলল—আরে, থামো থামো। এবার মাথায় চিরুনি দাও তুমি। সেটাও দেখি নিজের চোখে। 
এবারেও একই ঘটনা। একটা আঁচড় কেটেছে মাথায়। অমনি টপটপ করে কতকগুলো মুক্তো গড়িয়ে পড়ল মাথা থেকে। যেমনি বড়, তেমনি তাদের বাহার! 
দরবার শুদ্ধ লোকের মুখ হাঁ। এমন ঘটনাও ঘটে দুনিয়ায়। রাজা খাজাঞ্চিকে ডেকে বলল—এই ছেলে যে মুক্তো বেচে গিয়েছিল, সেই পুঁটলিটা আনো। মিলিয়ে দেখো তো, এক জিনিষ কি না। 
পুঁটলি আনা হোল। রাজার স্যাকরা পরীক্ষা করে, বলল—এক্কেবারে একই জিনিষ, হুজুর। এক্টুও ফারাক নাই। 
ধুমধাম করে মেয়েটার সাথে রাজার বিয়ে হয়ে গেল। দেশ শুদ্ধ লোক সাতদিন ধরে ভোজ খেল রাজার বাড়িতে। 
ছেলেটার তো আনন্দ ধরে না। রাজা তাকে থাকবার জন্য আস্ত একটা মহল বরাদ্দ করে দিয়েছে। রাজ্যশুদ্ধ লোকের কাছে ভারি খাতির এখন ছেলেটার।
গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু মজা হোল, আমরা যা ভাবি, সব সময় তা কি আর হয়?
সব গল্পে সব রাজারই একজন বুড়ো মন্ত্রী থাকে। এই রাজারও ছিল। সব মন্ত্রীদের একজন করে ছেলেও থাকে। কিন্তু এই মন্ত্রীর কোন ছেলে নাই। তবে, ঘরে একটি মেয়ে ছিল মন্ত্রীর।
রাজার বিয়ে হোল ধুমধাম করে। প্রজারা সাত দিন ধরে ভোজ খেল। মন্ত্রীর মন নেচে উঠল দেখে শুনে। একদিন দরবার শেষ হয়েছে। মন্ত্রী ধরে পড়ল রাজাকে—ঘরে একটা মেয়ে আছে আমার। আপনার শালার গলায় ঝুলিয়ে দিন মেয়েটাকে।
কথাটা বেশ পছন্দ হোল রাজার। বুড়োটা ছিল মন্ত্রী। হয়ে যাবে কুটুম! মন্দ কী? এক কথায় সায় দিয়ে দিল রাজা। বিশাল একটা প্রাসাদ বানিয়ে দিল শালার জন্য। 
আবার একটা বিয়েবাড়ির হুল্লোড় শুরু হয়ে গেল। রাজসভার কাজকম্ম শিকেয় ওঠার জোগাড়! সবাই বিয়েবাড়ির আনন্দে মেতে আছে। 
রজা কিন্তু সেই পড়শি মা আর তার মেয়ের কথা ভোলেনি। একদিন ঢেঁড়া পিটিয়ে লোক জড়ো করা হোল রাজবাড়ির মাঠে। শূলে চাপিয়ে দেওয়া হোল মা মেয়েকে।
ধন্য ধন্য করল লোকেরা। সকলের একটাই কথা। শয়তানি করলে, শাস্তি পেতেই হবে।

Post a Comment

0 Comments