অনুশীলন সমিতি : সশস্ত্র বিপ্লবের এক সফরনামা
প্রসূন কাঞ্জিলাল
স্বজাতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে ক্ষুন্ন রবীন্দ্রনাথ তাঁর বঙ্গমাতা কবিতায় ১৮৯৭ সালের এপ্রিল মাসে লিখেছিলেন --- সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালি করে --- মানুষ করনি। রবীন্দ্রনাথের এই আক্ষেপের পাঁচ বছর পরে ১৯০২ সালের মার্চ মাসে দোল পূর্ণিমার দিনে (২৪ মার্চ) কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় অনুশীলন সমিতি। ঐ বছরই জুলাই মাসে প্রয়াত হন স্বামী বিবেকানন্দ যিনি রবীন্দ্রনাথের মতন নির্বীর্য দেশবাসীকে সাহস অবলম্বন করতে, কাপুরুষতা, দুর্বলতা দূর করে মানুষ হওয়ার উপদেশ দিয়েছিলেন। বাঙালি দুর্বল, ভীরু এবং কাপুরুষ --- এই কলঙ্ক মোচনের জন্য কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় আখড়া গড়ে তরুণ ও যুবকদের শারীরিক বলে বলীয়ান করে তুলতে প্রতিষ্ঠিত হয় 'অনুশীলন সমিতি'।
বিশ শতকের একেবারে গোড়ার দিক। কলকতায় এক নতুন রাজনৈতিক ভাব-আবেগের সঞ্চার হয়েছে। জাতীয় সভা, জাতীয় কংগ্রেসের কার্যকলাপে আর ধৈর্য রাখা সম্ভব হচ্ছে না। একটার পর একটা বিল পাস হয়ে যাচ্ছে। তার মধ্যে এন্ড্রু ফ্রেসার এবং রিসিলের কুচক্রে ভাইসরয় কার্জন ঘোষণা করে দিলেন বঙ্গভঙ্গের। সহ্যের বাঁধ ভেঙ্গে গেলো বাঙালি যুবসমাজের। শুরু হয়ে গেলো সশস্ত্র বিপ্লব।
অনুশীলন সমিতি' - এই নামের মধ্যেই এক বিশেষ অদ্ভুত উত্তেজনা রয়েছে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অনুশীলন সমিতির ব্যাপ্তি এত বিশালাকার, সমিতির সমান্তরাল তার ভাগ-উপভাগ এমনভাবে ছড়ানো যে তাকে অল্পে বেঁধে রাখা সম্ভব নয়।
ভারতের স্বাধীনতা ইতিহাসে সমগ্র বাংলাকে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র বলা হয়ে থাকে। কালের নিয়মে ব্রিটিশ অত্যাচার রুখতে ইটালির 'কার্বোনারি', চিনের 'শ্বেতপদ্ম' প্রভৃতি গুপ্ত সমিতির অনুকরণে বাংলায় 'অনুশীলন সমিতি' ও 'যুগান্তর সমিতি' প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯০২ সালের মার্চ মাসে দোল পূর্ণিমার দিনে বাংলার ১০ই চৈত্র (২৪ মার্চ) উত্তর কলকাতার হেদুয়ার কাছে মদন মিত্র লেনে জেনেরাল এসেম্বলি ইনশটিউশনের ছাত্র সতীশচন্দ্র বসুর উদ্যোগে প্রথম প্রতিষ্ঠিত একটি আখড়াকে কেন্দ্র করেই প্রতিষ্ঠিত হলো এক মুভমেন্টের। নাম হলো "অনুশীলন সমিতি "।
পরে তা ৪৯ কর্ণওয়ালিস স্ট্রিটে স্থানান্তরিত হয়। প্রথমে নরেন্দ্রনাথ ভটাচার্য বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের আনন্দমঠের সন্তান দলের অনুশীলনের আঙ্গিকে আখড়ার নাম রাখেন ভারত অনুশীলন সমিতি। পরে ব্যারিস্টার প্রমথনাথ মিত্র 'ভারত' শব্দটি বাদ দিয়ে নাম রাখেন 'অনুশীলন সমিতি'।
১৯০৬ সালে যুগান্তর পত্রিকায় এক সম্পাদকীয়তে লেখা হলো *"দেশের ৩০ কোটি মানুষ যদি তাদের ৬০ কোটি হাত প্রতিরোধের প্রতিজ্ঞায় তুলে ধরে তবেই বন্ধ হবে এ অত্যাচার। একমাত্র শক্তি দিয়েই শক্তির প্রকাশকে স্তব্ধ করা সম্ভব।"* বিশ শতকের প্রথম দশক থেকেই ঘুম কেড়ে নিয়ে ছিলো এই প্রতিরোধের মেজাজ। 'অনুশীলন সমিতি' ঐ সময় ব্রিটিশ রাজের হৃদ স্পন্দন তুঙ্গে করে দিয়েছিলো। সশস্ত্র বিপ্লব ও আন্দোলনে বিশ্বাসী বহু তরুণ, যুবক যুবতী , কিশোর কিশোরী উদ্বুদ্ধ হয়েছিল ' অনুশীলন সমিতির' বিদ্রোহের মূলমন্ত্রে। ১৯০৩ থেকে ১৯০৫ সাল ছিল বাংলাদেশে বিপ্লবের বাণী প্রচারের অধ্যায়। এই সময়েই প্রকাশিত হতে থাকে সন্ধ্যা, বন্দেমাতরম যুগান্তর প্রভৃতি পত্রিকা। সখারাম গনেশ দেউস্কর, পি মিত্র, যতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের নানা তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক দিক সম্পর্কে বিপ্লবী যুবকদের শিক্ষাদান পর্ব চলে।
কলকাতার অনুশীলন সমিতির স্থাপনের উদ্দেশ্য অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা অর্জন। অনুশীলন সমিতি বিংশ শতকের প্রথমভাগে বাংলায় গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনগুলির মধ্যে অন্যতম। এ সমিতি ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। বিংশ শতকের প্রথম দশকে বাংলার যুবকদের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক উন্নয়ন- এ তিন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে নিবেদিত ক্ষুদ্র যুবসংগঠনগুলির মধ্য থেকে বিপ্লবী দলগুলির জন্ম হয়েছে বলে ধরা যায়।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, স্বামী বিবেকানন্দ ও অরবিন্দ ঘোষ কর্তৃক বিকশিত মতবাদের দ্বারা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাঁরা বাঙ্গালীদের আত্মিক, শারীরিক ও বুদ্ধিতে বলিষ্ঠ হওয়ার পরামর্শ দেন। তাঁদের চিন্তা-চেতনাকে কার্যকর করার জন্য প্রকৃত বিপ্লব শুরু হওয়ার বহুপূর্ব হতেই মানসিক যোগাভ্যাস ও শারীরিক ব্যায়ামের জন্য গ্রাম ও শহর এলাকায় অনুশীলন সমিতির নামে অসংখ্য যুব সংগঠন গঠিত হয়।
১৯০২ সাল নাগাদ অরবিন্দ ঘোষ বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথের কলকাতা আসার ব্যবস্থা করার পরে যুব সঙ্ঘ ও ব্যামাগার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির প্রতি মনোনিবেশ করেন। যতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে বিভূতিভূষন ভট্টাচার্য, সরলা দেবী ঘোষাল, প্রমথনাথ মিত্রের যোগাযোগ হয়। তখন কলকাতায় কিছু ক্লাব ও ব্যামাগার ছিল যার মধ্যে অধিক পরিচিত ছিল বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের ব্যামাগার যেটি সরলাদেবী নিজে চালাতেন। এছাড়া ছিল সতীশ চন্দ্র বসু প্রতিষ্ঠিত অনুশীলন সমিতি, আত্মোন্নতি সমিতি ইত্যাদি। সতীশ বসু নিজে জেনারেল এসেম্বলি ইনস্টিটিউশনের ছাত্র ও স্বামী বিবেকানন্দের শাক্ত দর্শন প্রভাবিত ব্যক্তি ছিলেন। বিবেকানন্দের দুই শিষ্য ভগিনী নিবেদিতা ও স্বামী সারদানন্দর সাথে তার সরাসরি যোগাযোগ ছিল। নিবেদিতা জাপানী ব্যক্তিত্ব কাকুজ ওকাকুরার সাথে বিশেষ পরিচিত ছিলেন। শ্রী বসুর ওপর জাতীয়তাবাদী চিন্তা, চেতনার প্রভাব পড়ার ক্ষেত্রে এনাদের অবদান ছিল। লাঠি খেলা, দেহ চর্চা ইত্যাদিতে নিয়োজিত সতীশ বসু স্বদেশী শিল্পের অন্যতম সমর্থক ছিলেন।স্বামী সারদানন্দ ও নিবেদিতার প্রভাবে তার হাত দিয়ে প্রতিষ্ঠা হল অনুশীলন সমিতির। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অনুশীলন তত্ত্ব অনুসারে গঠিত এই সমিতি শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সক্ষমতা উন্নতির জন্যে কাজ করতে থাকে তরুনসমাজের ভেতর। যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের সাথে অনুশীলন সমিতির সংযোগ ঘটে প্রমথনাথ মিত্রের হাত ধরে। সমিতির সদস্য সংগ্রহ শুরু হয় তরুনদের ভেতর থেকে, ছাত্রদের গীতা শপথ রাখতে হত। মা দুর্গার শাক্তমূর্তির আরাধনা ছিল মূল মন্ত্র। এই কারণেই সেযুগের মুসলিম সমাজের কাছে গ্রহণযগ্যতা পায়নি সমিতির কর্মকান্ড। তলোয়ার খেলা, ড্রিল্, মুষ্টিযুদ্ধ ও কুস্তির চর্চা করানো হতো সদস্যদের। সাপ্তাহিক পঠন পাঠনে জাতীয় আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিক উন্নতির কথা বলা হত।
১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'আনন্দমঠ উপন্যাসের সূত্রে তৎকালীন বাঙালি তরুণ সমাজ বিপ্লবের মন্ত্রে উজ্জীবীত হয়ে উঠেছিলেন। সতীশচন্দ্র বসু এঁদেরই একজন ছিলেন। বিশেষ করে দেশের সেবা করার জন্য শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চর্চার ভিতর গড়ে উঠে তরুণ প্রকৃত যোদ্ধা হয়ে উঠতে পারেন। এই আদর্শকে সামনে রেখে তৎকালিন জেনারেল এ্যাসেম্বলিজ ইন্সটিটিউশানের (পরবর্তী সময়ের স্কটিশচার্চ কলেজ) ব্যায়ামাগারে সতীশচন্দ্র বসু প্রথম একটি 'কাশীনাথ সাহিত্য সমিতি' গড়ে তুলেছিলেন। এটি ছিল মূলত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'অনুশীলন' প্রবন্ধের আদর্শে গড়ে ওঠা একটি সংগঠন। তাঁরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এখানে শরীর চর্চার পাশাপশি মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চর্চাকেন্দ্র হিসেব গড়ে উঠেছিল।
১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ড থেকে সদ্য প্রত্যাগত প্রমথনাথ মিত্রের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে। উল্লেখ্য প্রমথনাথ মিত্র আয়ারল্যান্ড এবং রাশিয়ার বিপ্লবীদের কথা জানতে পারেন এবং এ সব আন্দোলোনের মতো করে- ভারতকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি বিপ্লবী দল গঠনের সংকল্প করেন। ভারতে ফিরে আসার পর তিনি দেখলেন স্বাধীনতার জন্য ইতিমধ্যে ছোটো ছোটো গুপ্ত সংগঠন তৈরি হয়েছে। প্রথম দিকে তিনি এসকল গুপ্ত সমিতিগুলোর ভিতরে সমন্বয় করার উদ্যোগ নেন। এ সকল দলের সার্বিক কর্মকাণ্ডে তিনি সন্তুষ্ট হতে না পেরে নিজেই ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে 'নিখিল বঙ্গ বৈপ্লবিক সমিতি' গঠন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রায় একই সময়ে সতীশচন্দ্রের 'কাশীনাথ সাহিত্য সমিতি' এবং 'নিখিল বঙ্গ বৈপ্লবিক সমিতি'র সমন্বয়ে একটি গুপ্ত বিপ্লবী দল গঠন করার উদ্যোগ নেন। ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মার্চ (সোমবার ১০ চৈত্র ১৩০৮) উভয়ের প্রচষ্টায় গড়ে উঠেছিল অনুশীলন সমিতি'। এর কার্যালয় ছিল পূর্বেই উল্লিখিত কলকাতার ১২ নং মদন মিত্র লেনে। এর সভাপতি ছিলেন ব্যারিষ্টার প্রমথনাথ মিত্র, সহ-সভাপতি ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ ও অরবিন্দ ঘোষ আর কোষাধ্যক্ষ ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর।
অনেকে বলে থাকেন যে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অহিংস আন্দোলনের ভূমিকাটাই প্রধান, সশস্ত্র বিপ্লবীদের কোনো ভূমিকাই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ছিল না। এই বক্তব্যকে পুরপুরি মেনে নেওয়া যায়না। খোলা মন নিয়ে ইতিহাসের পাতা উলটালেই দেখা যাবে যে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সশস্ত্র বিপ্লবীদের বিরাট ভূমিকা ছিল।ভারতে জাতীয় কংগ্রেসের হাত ধরে জাতীয় আন্দোলনের সুচনা হয়েছিল একথা সত্য কিন্তু প্রথম যুগের কংগ্রেস নেতাদের লক্ষ্য ছিল আবেদন নিবেদন নীতির মাধ্যমে কিছু দাবিদাওয়া আদায় করা এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যেই ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস লাভ করা। তাঁরা বলতেন যে, এই ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস লাভ করার জন্য আবেদন নিবেদনের পথে অগ্রসর হতে হবে পিটিশনের মাধ্যমেই ডমিনিয়ন স্ট্যাটাস লাভ করতে হবে। যদিও শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসকে আবেদন-নিবেদন স্তরে আটকে রাখা সম্ভব হয়নি। কংগ্রেসের মধ্যেই আবির্ভাব ঘটল লোকমান্য তিলক, বিপিনচন্দ্র পাল, লালা লাজপত রায়ের মতো নেতার যাঁরা ভারতকে শোনালেন বিদ্রোহের বাণী এবং অনুশীলন সমিতি হয়ে উঠলো বাঙালি স্বাধীনতাকামী যুবকদের প্রাণকেন্দ্র।
অনুশীলন সমিতির অন্যতম প্রাণ পুরুষ শ্রী অরবিন্দ ঘোষ। অরবিন্দ ঘোষ বিলেত থেকেই আই. সী. এস হয়ে দেশে ফেরেন এবং ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রাইপস বৃত্তি লাভ করেন। তারপর বরোদা কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে তিনি ভারতে আসেন। এই সময়ে তিনি মহারাষ্ট্রের বিপ্লবী সমিতির নেতা ঠাকুরসাহেবের (উদয়পুরের এক অভিজাত পুরুষ) সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। তখনকার দিনে এই ঠাকুরসাহেবের উপরই ভারতের বৈপ্লবিক সংগঠন ও কার্যকলাপের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। ঠাকুরসাহেবের প্রেরণায় তিনি বোম্বাইয়ের এক বিপ্লবী সংগঠনে যোগ দেন। সেই সময় থেকে তাঁর মনে এই দৃঢ় প্রত্যয় জন্মাল যে, বিপ্লবী সংগঠন গড়তে না পারলে বিপ্লব সংগঠিত করা যাবে না। তখনকার রাজনৈতিক অবস্থা পর্যালোচনা করে তিনি এটাও উপলব্ধি করলেন যে, বিপ্লবী সংগঠন গড়ার উর্বর ক্ষেত্র হচ্ছে বাংলাদেশ। এই সংগঠন গড়ার জন্য তিনি ১৯০২ সালে বাংলাদেশে এলেন। এই সময়ে বাংলাদেশে ব্যারিস্টার পি মিত্র ‘অনুশীলন সমিতি' গঠন করেন। বাংলাদেশে এসে অরবিন্দ অনুশীলন সমিতির সংস্পর্শে আসেন। এই ১৯০২ সালেই তিনি হেম কানুনগো ও সত্যেন বসুকে বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষিত করেন।১৯০৪ সালে অরবিন্দ ঘোষ আবার বাংলাদেশে আসেন। তখন তাঁর ভ্রাতা বারীন ঘোষ অনুশীলন সমিতিতে যোগ দান করেন।
'অনুশীলন সমিতির' আদর্শকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য, বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের সুযোগ্য ভাই বারীন্দ্র নাথ ঘোষ একটি পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তাব করেন। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই মার্চ থেকে অরবিন্দের সমর্থনে সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে 'যুগান্তর' প্রকাশিত হতে থাকে। যুগান্তর ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা লাভ করলে, ব্রিটিশ কর্মকর্তারা এই পত্রিকার উপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। এই সূত্রে বেশ কয়েকবার তিনি রাজনৈতিক হয়রানির স্বীকারও হন।
🍂
১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কলকাতাস্থ মানিকতলায় মুরারীপুকুরে বারীন ঘোষদের বাগান বাড়িতে এই সশস্ত্র বিপ্লবী দলটি গঠিত হয়। এই দলটি পরবর্তী সময়ে 'যুগান্তর বিপ্লবী দল' নামে পরিচিতি লাভ করে। সাধারণভাবে এরপর তিনি সংগোপনে অস্ত্র সংগ্রহ ও বিস্ফোরক তৈরি করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই পরিকল্পনার সূত্রে বিপ্লবীদের অত্যাধুনিক অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
১৯০৫ সালে ঢাকায় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে বিপিনচন্দ্র পালের জ্বালাময়ী বক্তৃতা শ্রোতাদেরকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে এবং এতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিপিনচন্দ্র পালের বক্তৃতার পর ঢাকা সরকারি কলেজের এককালের শিক্ষক ও পরবর্তী সময়ে ঢাকায় ‘ন্যাশনাল স্কুলে’র প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক পুলিনবিহারী দাসের নেতৃত্বে ৮০ জন যুবক ১৯০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় 'ঢাকা অনুশীলন সমিতি' গঠন করে। এর প্রধান কার্যালয় ছিল ঢাকাতে। পুলিনবিহারী দাস কর্তৃক ঢাকা অনুশীলন সমিতি পরিচালিত হয়।
সমিতি ও স্বদেশী আন্দোলনের লক্ষ্য ও কার্যপদ্ধতি প্রায় একই রকম ছিল। কলকাতা অনুশীলন সমিতি ও ঢাকা অনুশীলন সমিতি অনেকটা রাশিয়া ও ইতালির গুপ্ত সংগঠন গুলির আদলেই গড়ে উঠেছিল।
১৯০৭ সাল হতে অনুশীলন সমিতির সদস্যগণ বিপ্লবী কর্মকান্ডে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। ১৯০৭ সালের ৬ ডিসেম্বর নব প্রতিষ্ঠিত পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নর যে ট্রেনে ভ্রমণ করছিলেন সেটি বোমা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এর অল্প কয়েকদিন পর ২৩ ডিসেম্বর তারা ঢাকার প্রাক্তন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. অ্যালেনকে হত্যা করার চেষ্টা করে। ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল তারা ভুলবশত দুজন নিরপরাধী মহিলা মিসেস ও মিস কেনেডিকে হত্যা করে। অথচ তাদের টার্গেট ছিল কলকাতার ম্যাজিস্ট্রেট ও পরবর্তীকালে বিহারের মুজাফ্ফরপুরের জেলা জজ ডগলাস কিংসফোর্ড। মুজাফ্ফরপুরের ঘটনার সাথে জড়িত প্রফুল্ল চাকি পরবর্তীসময়ে ধরা না দিয়ে আত্মহত্যা করেন এবং তাঁর সহযোগী ক্ষুদিরাম বসু ধরা পড়েন ও বিচারে তাঁর ফাঁসি হয়। বাংলার বিপ্লবের ইতিহাসে মুজাফ্ফরপুরের হত্যাকান্ড একটি বিখ্যাত ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত। এ ঘটনার পর থেকে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী বাংলার জনগণের নায়কে পরিণত হন। পরবর্তী সময়ে কলকাতার মানিকতলার বাগানে একটি বোমা তৈরীর কারখানা আবিষ্কার হয়। অনুশীলন সমিতির নেতা বারীন্দ্রকুমার ঘোষকে তথাকথিত আলীপুর ষড়যন্ত্র মামলার আওতায় বিচারাধীনে আনা হয়।মুজাফ্ফরপুরের বোমা হামলার এই সূত্র ধরেই ২ মে, ১৯০৮, ৩২নং মুরারিপুকুরের বাগানবাড়ি তল্লাশি করে পুলিশ (পুলিশ অফিসার মধুসূদন ভট্টাচার্য) বোমার কারখানা আবিষ্কার করে। বাগানবাড়ি থেকে গুপ্ত সমিতির সদস্যদের গ্রেন্তার করা হয়৷ যাদের মধ্যে অরবিন্দ ঘোষ ও তাঁর ভাই বারীন্দ্র কুমার ঘোষ সহ মোট ৩৬ জনের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মামলা দায়ের করা হয়৷
আলিপুর বোমা মামলা সংক্রান্ত হৃদয়স্পর্শী ঘটনা-
‘আমার সামনে আজ সাক্ষাৎ নারায়ণ দাঁড়িয়েছেন’, বক্তা অরবিন্দ ঘোষ। ‘আলিপুর বোমা ষড়যন্ত্র মামলা’য় অভিযুক্ত অরবিন্দের চিত্তরঞ্জন দাশকে দেখেই নারায়ণ-উপলব্ধি। তাই বোধহয়, মামলার খুঁটিনাটি বিষয় লিখতে শুরু করেও ‘হৃদয়ের অন্তর্দেশ’-এর কথায় তার প্রয়োজনীয়তা আর নেই, বুঝলেন অরবিন্দ। এই মামলা হাতে নেওয়ার কিছু দিন আগে এক মা এসে চিত্তরঞ্জনকে বলে গিয়েছেন, ‘আমি শুধু আমার ছেলের জন্য আসিনি, সব ছেলেদের বাঁচাবার ভার তুমি নাও, বাবা।’ ওই মা হলেন বিপ্লবী উল্লাসকর দত্তের জন্মদাত্রী।
পারিশ্রমিক নিয়েই আইনজীবী চিত্তরঞ্জন তাঁর রসা রোডের বাড়িতে দিন-রাত এক করে আইনের বইপত্রের মধ্যে ডুবে থাকেন। আদালতে সওয়াল করার সময়ে তাঁর মনে হয়, তিনি নিজেই অভিযুক্ত। নিজেই নিজের অভিযোগ খণ্ডন করছেন।১৯০৮ সালের ২ মে থেকে ১৯১০ সালের ৫ নভেম্বর পর্যন্ত চলা এই মামলায় ২০৬ জন সাক্ষ্য দেন৷ ১৫৭৫টি নথি জমা পড়ে৷ প্রথম রায় ঘোষণা হয় ১৯০৯ সালের ৬ মে। রায়ে বিচারক বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, ও উল্লাসকর দত্তকে মৃত্যুদণ্ড দেন। উপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, হেমচন্দ্র কানুনগো, বিভূতিভূষণ সরকার, বীরেন্দ্র সেন, সুধীর ঘোষ, ইন্দ্রনাথ নন্দী, অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য, শৈলেন্দ্রনাথ বসু, হৃষিকেশ কাঞ্জিলাল, ইন্দুভূষণ রায়ের - দ্বীপান্তর দণ্ড হয়। ১০ বছর দ্বীপান্তর দণ্ড হয় পরেশ মৌলিক, শিশির ঘোষ, ৭ বছর দ্বীপান্তর দণ্ড হয় নিরাপদ রায় , অশোক নন্দী, বালকৃষ্ণ হরিকোণে, শিশির কুমার সেন এবং কৃষ্ণজীবন সান্যাল ১ বছর কারাদণ্ড প্রাপ্ত হন। এরপর রায়ের বিরুদ্ধে আপিলে দ্বিতীয়বার মামলা শুরু হয়। এরমধ্যে মামলা চলাকালীন জেলের ভেতর থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে বয়ান দেওয়ার অপরাধে রাজসাক্ষী নরেন গোঁসাইকে হত্যা করেন কানাইলাল দত্ত এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু (৩১ আগস্ট ১৯০৮)। মামলা চলাকালিন ১১ আগষ্ট, ১৯০৮ ফাঁসি হয় বাংলার প্রথম শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর এবং ১০ নভেম্বর, ১৯০৮ তারিখে ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ করেন কানাইলাল দত্ত। অপর বিপ্লবী সত্যেন বসুও ফাঁসির মঞ্চে শহীদ হন। এবার আদালতে জোরালো সওয়াল করেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ৷ মূলত তাঁর সওয়ালের জেরে মাত্র ১৪ জনের শাস্তির আদেশ হয়৷ আপিলে বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও উল্লাসকর দত্তের মৃত্যুদণ্ড রদ হয় এবং তার বদলে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দণ্ড হয়।
আইনজীবী চিত্তরঞ্জনের এমন দীর্ঘ ‘তপস্যায়’ অরবিন্দ মুক্ত হলেন। ‘দ্বীপান্তরের কথা’-য় নেতা হিসেবে বারীন স্পষ্ট করে দেন তাঁদের লক্ষ্য। ভারতবর্ষ এবং তার বাইরেও বৃহৎ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে বিপ্লবের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেওয়া। মানিকতলা বাগানবাড়ির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রোপাগান্ডা এবং বিজ্ঞাপন। বারীন মানিকতলা গোষ্ঠীর অন্যতম মাথা। তাঁর জন্ম ইংল্যান্ডের ক্রয়ডন-এ। সে জন্যই তিনি ব্রিটিশ নাগরিক। অতএব তাঁকে প্রস্তাব দেওয়া হয়, বন্ধ দরজার পিছনে ইউরোপিয়ান আদালতে ইংরেজ উকিল ও বিশেষ বিচারপতি দিয়ে তাঁর বিচার করা হবে। বারীন বললেন, তিনি বাকিদের সঙ্গে একই আদালতে পেশ হতে চান। তাঁর নেতৃত্বেই পরে আন্দামানের রাজনৈতিক বন্দিরা একাধিক বার ধর্মঘট করে, অনেকাংশে সফলও হয়।
আলীপুর মামলার কারণে ধরপাকড় ও পুলিশি হানা ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকে। ফলে অনুশীলন সমিতিতে বিভাজন দেখা দেয়। যদিও সমিতিগুলি একটির থেকে অন্যটি স্বাধীন ছিল, তবুও প্রমথনাথ মিত্র, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং পুলিনবিহারী দাসের যৌথ পরিচালনায় সেখানে কেন্দ্রীয় অ্যাকশন কমিটির মতো একটি কমিটি ছিল। সরকার সমিতিগুলিকে দুটি প্রধান দলে চিহ্নিত করে- যুগান্তর দল ও ঢাকা অনুশীলন দল। মোটামুটিভাবে পুলিশ পশ্চিমবঙ্গের বিপ্লবীদেরকে যুগান্তরের নামানুসারে যুগান্তর দল এবং পূর্ববঙ্গের বিপ্লবীদেরকে ঢাকা অনুশীলন সমিতি বলে চিহ্নিত করে। পশ্চিমবঙ্গের বৈপ্লবিক কর্মকান্ড ১৯১০ সালের পর হতে কিছু কালের জন্য কার্যত বন্ধ হয়ে যায় এবং তখন থেকে বৈপ্লবিক কর্মকান্ডের কেন্দ্র পূর্ববঙ্গে স্থানান্তরিত করা হয়।
সাংগঠনিকভাবে ঢাকা অনুশীলন সমিতি পুলিনবিহারী দাসের পরিচালনাধীনে একটি স্বাধীন সংগঠন ছিল। কিন্তু প্রমথনাথ মিত্রের কলকাতা অনুশীলন সমিতির সঙ্গে এর সংযোগ ছিল এবং পুলিনবিহারী দাস কলকাতা গেলে সেখানেই অবস্থান করতেন।
সদস্যদের অধ্যয়ন তালিকায় প্রধানত পৌরাণিক কাহিনীভিত্তিক রচনাই বেশি ছিল। তাদের জন্য সুপারিশকৃত বইগুলির মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দের গ্রন্থসমূহকে প্রথম স্থান দেওয়া হয়েছে। অনুশীলন সমিতিতে কেউ যখন ভর্তি হতো, তখন শপথ নিতে হতো।
ঢাকা অনুশীলন সমিতি শীঘ্রই এর কলকাতার মূল সংগঠনকে গুরুত্বহীন করে দেয়। পূর্ববঙ্গের অন্যান্য জেলাসমূহে এটি বিস্তার লাভ করে এবং ১৯৩২ সালের মধ্যে এর শাখার সংখ্যা হয় ৫০০। পুলিনবিহারী দাসের সাংগঠনিক দক্ষতার জন্য ঢাকা অনুশীলন সমিতি দ্রুত প্রসার লাভ করেছিল।অতি শীঘ্রই পুলিনবাবুর কর্মকুশলতা, যোগ্য নেতৃত্বে ঢাকা অনুশীলন সমিতির যে ৫০০টি শাখা গড়ে ওঠে, সেক্ষেত্রে বিক্রমপুর ও বরিশাল জেলার সাফল্য হিতৈষী ও বৈরী দুপক্ষকেই স্তম্ভিত করে। ১৯১০ সালে গঠিত ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলা ও তার সাথে সমিতির কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির সম্বন্ধ সমিতির ভবিষ্যতের সম্মুখে এক প্রশ্নচিহ্ন দাঁড় করায়। অনুশীলন সমিতির দ্রুত বৃদ্ধি ব্রিটিশ প্রশাসন কে শঙ্কিত করে ও এর রোধে এক কমিশন সৃষ্টি করা হয়। কমিশনের কর্তব্য ছিল বৈপ্লবিক সংগ্রামের প্রভাবের বৃদ্ধির কারণ, বাঙালী হিন্দুর জাতিগত স্বার্থের সাথে তার সংযোগ অন্বেষণ করা ও এটিকে ধ্বংস করার এক নির্দিষ্ট পদ্ধতি নির্ধারণ করা। ১৯১৮ সালে এই সিডিশন কমিটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়।
বরোদির (ঢাকা জেলা) ভূপেশচন্দ্র নাগ পুলিনবিহারী দাসের যোগ্যতম সহকর্মী ছিলেন এবং পুলিনবিহারী দাস গ্রেপ্তার হলে তিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। যশোরের শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু ছিলেন একজন বিপ্লবী এবং শুরু থেকেই ঢাকা অনুশীলন সমিতির ‘শাখাসমূহের পরিদর্শক’ ছিলেন। এসব সমিতির সদস্যবৃন্দ অধিকাংশই ছিল ভদ্র পরিবার হতে আগত স্কুল ও কলেজের ছাত্র। ভর্তিকৃত সদস্যদের দুটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়, যথা: সন্ন্যাসী ও গৃহী (পরিবারের লোক)।
পুলিন দাস ঢাকায় ন্যাশনাল স্কুল প্রতিষ্ঠার সময় মনে করেছিলেন যে, এটি হবে বৈপ্লবিক শক্তি গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। পুলিনবিহারীর বৈপ্লবিক তৎপরতার সাফল্যের মূলে রয়েছে তাদের অনুশীন পদ্ধতি। তাঁর ছাত্ররা প্রথমে লাঠি ও কাঠের তরবারি দিয়ে অনুশীলন করত। পরে তারা অনুশীলন করত ছোরা ও পিস্তল দিয়ে।
পুলিনবিহারী দাস যখন গ্রেফতার হন এবং ডাকাতির দায়ে অভিযুক্ত করে তাঁকে যখন যাবজ্জীবন নির্বাসন দেওয়া হয়, বাহ্যত তখন থেকেই ঢাকা অনুশীলন সমিতি ভেঙ্গে যায়। এর পর সমিতি সম্পূর্ণরূপে গা ঢাকা দেয় এবং মফস্বলের সমিতির সদস্যদের সঙ্গে সাময়িককালের জন্য সমস্ত যোগাযোগ স্থগিত করে দেয়। কিন্তু ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী ও প্রতুলচন্দ্র গাঙ্গুলির নতুন নেতৃত্বে সমিতি শীঘ্রই তার কর্মকান্ড পুনরায় শুরু করে। ১৯১৩ সালের বিখ্যাত বরিশাল ষড়যন্ত্র মামলা প্রমাণ করে যে, শুধু বরিশাল জেলাতেই সমিতির শত শত বিপ্লবী অনুসারী ছিল।
প্রথম মহাযুদ্ধ পর্যন্ত যুগান্তর দলের সঙ্গে ঢাকা অনুশীলন সমিতির সম্পর্ক ছিল দুর্বল। মহাযুদ্ধের পরিস্থিতি বাংলার বিপ্লবীদেরকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করার সুযোগ করে দেয়। যুগান্তর বৈপ্লবিক কেন্দ্রসমূহের জোট (ফেডারেশন) হিসেবে সারাদেশে আবার আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু সরকার সন্দেহভাজনদের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখত। নিরাপত্তা গোয়েন্দাদেরকে সহজেই স্থানীয় পর্যায়ে নিয়োজিত করা যেত বলে তাদের দৃষ্টি এড়িয়ে সন্দেহভাজন লোকজন কদাচিৎই চলাফেরা করতে পারত। অসহযোগ আন্দোলনের সময় যুগান্তর দল গান্ধীর সাথে সহযোগিতা করে, কিন্তু ঢাকা অনুশীলনদল তাদের বৈপ্লবিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে। ১৯২৪ সালে মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় জেলখানায় উভয় দলের বিপ্লবী হাজতিদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু নেতাদের একটানা বন্দিত্বের কারণে স্থানীয় পর্যায়ে এ ঐক্য কার্যকর করা যায় নি।
মাস্টারদা সূর্যসেন পূর্ববঙ্গে শেষ বৈপ্লবিক কর্মকান্ড চালান। ঢাকা অনুশীলন সমিতি এবং যুগান্তর উভয় দলের সদস্য সূর্যসেন ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন-এর কাজ পরিচালনা করেন। এ ঘটনা সাংগঠনিক দিক ও শৌর্য-বীর্যে বিপ্লবী আন্দোলনের ইতিহাসে অতুলনীয় ছিল। সূর্যসেনের বিচার হয় এবং ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি তারিখে তাঁকে ফাঁসিতে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। কিন্তু সূর্যসেনের যশ এবং সফলতা এমন এক সময়ে আসে যখন বিপ্লবী আন্দোলন তাঁর আদর্শ পরিবর্তন করে ফেলে এবং তা আংশিকভাবে কংগ্রেসের সাথে ও আংশিকভাবে সমাজতান্ত্রিক দলের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। সূর্যসেনের ওই ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপের পর তীব্র আঘাতহানী বিপ্লবী কর্মকান্ড তেমন উল্লেখযোগ্য হয়নি।
অনুশীলন সমিতির বিশিষ্ট সভ্য:
ভারতের বিপ্লব আন্দোলনে যোগদান করে বিভিন্ন প্রদেশে বিভিন্ন দলের কয়েক সহস্র নির্ভিক যুবক নানা ভাবে অত্যাচার নির্যাতন ভোগ করেছেন, সুদীর্ঘ কাল কারাবাসে কাটিয়েছেন। সকলের নাম সংগ্রহ করা সম্ভবপর হয় নাই। যাদের নাম সংগ্রহ করতে পেরেছি,তাদের বিবরণ দেওয়া হলো।
.
অনুশীলন সমিতি - জেলা ঢাকা ।
.
১) প্রতুলচন্দ্র গাঙ্গুলি,চুড়াইন - জেল ২৮ বছর,৮০ দিন অনশন,১৪ মাস পলাতক।
২) রমেশচন্দ্র আচার্য,বানরী - জেল ২৭ বছর,২৬ দিন অনশন,১০ মাস পলাতক।
৩) রবীন্দ্রমোহন সেন,বজ্রযোগিনী - জেল ২৭ বছর,১২০ দিন অনশন,১৮ মাস পলাতক।
৪) যোগেশচন্দ্র চ্যাটার্জি,গাউদিয়া - জেল ২৪ বছর,১৫০ দিন অনশন,২৮ মাস পলাতক।
৫) গোবিন্দ কর, কায়েতপাড়া - জেল ২২ বছর,২৪ দিন অনশন,৮০ মাস পলাতক।
৬) তরণী সোম,টাউন - জেল ২২ বছর।
৭) সতীশচন্দ্র পাকড়াশী,মাধবদী - জেল ২১ বছর,১৮ দিন অনশন,২৪ মাস পলাতক।
৮) মদনমোহন ভৌমিক,ডুমনী- জেল ১৬ বছর,২৪ দিন অনশন,৩৮ মাস পলাতক।
৯) নরেন্দ্রমোহন সেন,আমিনপুর - জেল ১৫ বছর,২২ দিন অনশন,৪২ মাস পলাতক।
১০) অমৃত হাজরা,দোগাছি - জেল ১৫ বছর,৬০ মাস পলাতক।
১১) চিরঞ্জীব মিশ্র,একরামপুর - জেল ১৫ বছর,৬০ মাস পলাতক।
১২) স্বদেশ নাই, শুভাঢ্যা - জেল ১১ বছর,জেলে অনশন, দুইবারে ২১ দিন।
১৩) পূর্ণানন্দ দাশগুপ্ত,ফেগুণাসার - জেল ১৪ বছর,২৪ দিন অনশন।
১৪) চারুচন্দ্র রায়,দক্ষিণ মৈশুন্ডী - জেল ১৪ বছর,১০ দিন অনশন।
১৫)খগেন্দ্র চৌধুরী,মানিকগঞ্জ - জেল ১৩ বছর,২৪ মাস পলাতক।
১৬) সুশীলচন্দ্র ঘোষ,টিকাটুলী - জেল ১৩ বছর,১৮ দিন অনশন,১২ মাস পলাতক।
১৭) হীরেন্দ্র মজুমদার(জুমু),একরামপুর - জেল ১২ বছর,১২ দিন অনশন।
১৮) দুর্গেশ ভট্টাচার্য, দক্ষিণ মৈশুন্ডী- জেল ১২ বছর,২২ দিন অনশন,১৩ মাস পলাতক।
১৯) বীরেন্দ্র গাঙ্গুলি,হেমেন্দ্র দাস রোড - জেল ১২ বছর।
২০) সরল সেন,টাউন - জেল ১২ বছর।
২১) মাখনলাল দত্ত,ঠাটারী বাজার - জেল ১২ বছর।
২২) স্বদেশ ধর - জেল ১০ বছর।
২৩) রবীন্দ্র ধর - জেল ১০ বছর,১২ মাস পলাতক।
২৪) আশুতোষ দাশগুপ্ত,গাডুর গাঁ - জেল ১১ বছর।
২৫) বিজয়কৃষ্ণ ব্যানার্জি,দিঘলী - জেল ১১ বছর,৭ মাস পলাতক।
২৬) তারাপ্রসাদ চক্রবর্তী,বনগ্রাম - জেল ১২ বছর।
২৭) নলিনীকান্ত ঘোষ,ঝাউগাড়া - জেল ১০ বছর,১৪ দিন অনশন,৪৬ মাস পলাতক।
২৮) নলিনীকিশোর গুহ,বজ্রযোগিনী - জেল ১০ বছর।
২৯) আদিত্য দত্ত,বরুণা - জেল ১০ বছর,৩৬ মাস পলাতক।
৩০) অধীর মুখার্জি,বেজগাঁও - জেল ১০ বছর,২৯ দিন অনশন।
৩১) সতীশচন্দ্র রায়,সাটির পাড়া - জেল ১০ বছর।
৩২) ধনেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য,ঢাকা টাউন - জেল ১০ বছর, পলাতক ২ বছর।
৩৩) বিনোদ চক্রবর্তী,সুভঢ্যা - জেল ১০ বছর।
৩৪) সুধীর কুশারী,ফরিদাবাদ - জেল ১০ বছর।
.
অন্যান্য যারা জেলে ছিলেন :
১) অনাথবন্ধু চক্রবর্তী - সুভঢ্যা ।
২) নীরদ দত্ত - ঐ ।
৩) তারাপ্রসন্ন দে - লাদুরচর ।
৪) সুবোধ নাগ - বারদী ।
৫) সীতানাথ দাস - নারায়ণগঞ্জ ।
৬) লালমোহন দে - মধ্যপাড়া ।
৭) যোগেন্দ্র ভট্টাচার্য - ঐ ।
৮) মাখনলাল সেন - সোনারং ।
৯) ডঃ গুরুগোবিন্দ মজুমদার - কোন্ডা ।
১০) যতীন্দ্র চক্রবর্তী - শেখর নগর ।
১১) ডঃ প্রফুল্ল দত্ত - সেচর ।
১২) ধীরেন্দ্র গাঙ্গুলি - হেমেন্দ্র দাস রোড ।
১৩) দীনেশচন্দ্র মস্তফী(স্বামী তুরিয়ানন্দ) - ঢাকা ।
১৪) সতীন্দ্র রায় - আটপাইকা ।
১৫) ব্রজেন্দ্র দাস - নারায়ণগঞ্জ ।
১৬) জিতেন মুখার্জি (দাদু) - টিকাটুলী ।
১৭) সুকুমার বিশ্বাস - ঐ ।
১৮) দেবেন দত্ত - নারায়ণগঞ্জ ।
১৯) তারকেশ্বর গুহ - বজ্রযোগিনী ।
২০) অরবিন্দ বসু - টাউন ।
২১) নলিনী দত্ত - ঐ ।
২২) সুধীর বসু - ঐ ।
২৩) হরিশ সরকার - ঐ ।
২৪) অসিত ভট্টাচার্য - ঐ ।
২৫) মাখন মিশ্র - ঐ ।
২৬) বলাই দাসগুপ্ত - ঐ ।
২৭) কেদারেশ্বর গুহ - বজ্রযোগিনী ।
২৮) অনিল দাসগুপ্ত - ওয়ারী ।
২৯) সুশীল সরকার - তাঁতিবাজার ।
৩০) অজিতানন্দ দাসগুপ্ত - টিকাটুলী ।
৩১) অমর ব্যানার্জি(ক্লিষ্ট) - ঐ ।
৩২) সন্তোষ গাঙ্গুলি - বজ্রযোগিনী ।
৩৩) মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য - স্বর্ণগ্রাম ।
৩৪) জ্ঞান ঘোষ - রাউতভোগ ।
৩৫) শ্যামবিনোদ পাল,মণীন্দ্রচন্দ্র দত্ত - নারায়ণগঞ্জ ।
৩৬) মণীন্দ্র রায় (টুলু)- আটপাইকা ।
৩৭) রবীন্দ্র সুত্রধর - ঢাকা ।
৩৮) মণীন্দ্র ধর - নারায়ণগঞ্জ ।
৩৯) রবি বসু (ফটিক) ।
৪০) রাখাল ঘোষ ।
৪১) দেবেন্দ্র বণিক ।
৪২) উমাপ্রসাদ চক্রবর্তী ।
৪৩) সুসময় চাকলাদার ।
৪৪) সুপতি পাল - বেলতলী ।
৪৫) সুধীর ঘোষ - চাষারা ।
৪৬) সুরেন্দ্রনাথ রায় - সাটিরপাড়া ।
৪৭) নৃপেন্দ্রচন্দ্র রায়(বঙ্কুবাবু) - ঐ ।
৪৮) ভুপেন রায় - ঐ ।
৪৯) হাসিময় সেন - আমিনপুর ।
৫০) সুরপতি চক্রবর্তী ।
.
গৃহী সভ্য - ঢাকা :
১) সুশীল ঘোষ - চুড়াইল,টালা জলের কলের সুপারিন্টেডেন্ট ।
২) ডঃ মোহিনীমোহন দাস - চাঁদসী ।
৩) কবিরাজ প্রফুল্ল সেন - ঢাকা ।
৪) ডঃ জিতেন দত্ত - রামকৃষ্ণ আশ্রম,বজ্রযোগিনী ।
৫) বিন্দুবাসিনী সোম - (তরণী সোমের মা) ।
৬) লবঙ্গলতা দাসগুপ্ত - (পূর্ণানন্দের মা) ।
৭) ব্রম্হময়ী সেনগুপ্ত - (রবি সেনের মা) ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রাজত্ব উচ্ছেদ হেতু অনুশীলন সমিতির মহা-পরিকল্পনা, ইতিহাসে খ্যাত হিন্দু-জার্মান ষড়যন্ত্র হিসেবে, এবং তার ব্যর্থতা ব্রিটিশ সরকারকে সমিতির প্রতি ক্রমশ প্রতিশোধপরায়ণ করে তোলে। ভয়ঙ্করতম নিষ্পেষণের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ প্রশাসন অনুশীলন সমিতি, তার ভিত্তি, ব্যাপ্তি ও বিচারধারাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সর্বোত্তম প্রয়াস করে। শত শত যুবক গ্রেপ্তার হয়, নির্যাতিত হয়, ফাঁসিকাষ্ঠে নিজেকে উৎসর্গ করে – সমিতির বহু শাখা বন্ধ হয়ে যায়। নিঃসন্দেহে, এই বিশাল ক্ষতি অনুশীলন সমিতির কার্যপ্রবাহে নিদারুণ সমস্যা সৃষ্টি করে। বাঙালী হিন্দু জাতির ওপর তার সক্রিয় প্রভাব হ্রাসও হয় যথেষ্ট পরিমাণে। ফলতঃ এক শূন্যতার সৃষ্টি হয় সমাজের মধ্যে যা পূর্ণ করার লক্ষ্যে দ্রুত এগিয়ে আসে জাতীয় কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি। ১৯৩০ সালের মধ্যে সরকারী নিষ্পেষণ, নতুন বিচারাধারার প্রভাবে সমিতির সদস্যসংখ্যায় দ্রুত ধস নামে। সমাজতন্ত্র ও সোভিয়েত বিপ্লবের প্রতি অখণ্ড বিশ্বাসে সমিতির বহু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি অন্যান্য গণসংগঠনে যোগদান করেন। অবশ্যই উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রমও ছিল। শ্রী পুলিনবিহারী দাশের মত বেশ কয়েকজন প্রণম্য বিপ্লবী চিরদিনই অনুশীলন সমিতির মূল আদর্শের প্রতি , যা মূলত বাঙালী হিন্দুর শিরদাঁড়া হিসেবে প্রখ্যাত ইতিহাসে,তারই অনুরক্ত থেকে যান। ‘৪৬ র মহাসমর ও তদপরবর্তী ‘৪৭ র দেশভাগে তাঁদের সিংহসদৃশ পরাক্রম পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করে। আবার কালের অমোঘ নিয়মে তার দীপ্তি ক্ষীণও হয়ে আসে।
বহু তরুণ প্রাণের আত্মবলিদান, শহীদ বেদীতে শেষ যাত্রা, দ্বীপান্তরে শাস্তিগ্রহণ আরও কত রক্তক্ষয়ী ঘটনাবলী লেখা আছে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পাতায় পাতায়,আর অধিকাংশই কালের অতলে হারিয়ে গেছে বা মুছে ফেলা হয়েছে । কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র বিপ্লবের শুরুয়াতের ইতিহাসে 'অনুশীলন সমিতি'র ভূমিকা চিরকাল স্বর্ণ অক্ষরে লেখা থাকবে।
তথ্যসূত্র
১)শ্রীঅরবিন্দ ও বাংলায় স্বদেশীযুগ - গিরিজাশঙ্কর রায়চৌধুরী।
২)অগ্নিযুগের অগ্নিকথা - 'যুগান্তর': অংশমান রায়।
৩) ‘আলিপুর বম্ব ট্রায়াল, ১৯০৮ - ১৯১০' : অমিয় সামন্ত।
৪) আ.বা.পত্রিকা (26.01.2012)
৫)জেলে ত্রিশ বছর ও পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ।
লেখক - শ্রী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী (মহারাজ)।
৬) ইন্টারনেট ও অন্যান্য সূত্র
0 Comments