সুমিত্রা ঘোষ
দৈব নির্দেশ পেয়ে রানির কাশী যাওয়া হল না। খাদ্যদ্রব্য, জামা কাপড়, বিভিন্ন সামগ্রী যা সঙ্গে নিয়েছিলেন তা ব্রাহ্মণ ও স্থানীয় দরিদ্রদের মধ্যে বিলি করে দিতে বললেন, তীর্থযাত্রার জন্য সঞ্চিত অর্থ জমি কেনা এবং মায়ের মন্দির নির্মাণের কাজে খরচ করার জন্য আদেশ দিলেন। মা-ভবতারিণী রানিকে যে জায়গায় স্বপ্ন দিলেন, সেই জায়গা গঙ্গার পশ্চিমকূল বলে জানা যায়। কথায় বলে , ' গঙ্গার পশ্চিম উপকূল, বারানসী সমতুল' —এই প্রবাদবাক্য মাথার রেখে মথুরামোহন বিশ্বাস মায়ের মন্দিরের জন্য ভূমি কেনার ব্যবস্থা করেছেন। মা ভবতারিণী যে জায়গায় মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে আদেশ দিয়েছিলেন রানি রাসমণিকে, সে জায়গার একটু বিবরণ দেওয়া হচ্ছে, জমির গঠন কূর্মপৃষ্ঠের মতো। এই জমির একদিকে সাহেবদের কুঠিবাড়ি, অন্যদিকে মুসলমানদের কবরস্থান ও গাজি সাহেবের দরগা। এমন ধরনের জমিকে শ্মশানও বলা চলে, কাছে পিঠে হিন্দুদের মৃতদেহ দাহ করার ব্যবস্থা ছিল বলে জানা যায় অর্থাৎ তিন সম্প্রদায়ের মিলিত পবিত্র স্থান ছিল ঐ জমি, তন্ত্রসাধনার শ্রেষ্ঠ স্থান হিসেবে বেছে নেওয়া হয় শ্মশানের মতো পবিত্রস্থানকে । তন্ত্রসাধনায় বলা আছে কূর্মপৃষ্ঠের মতো জমি শক্তিসাধনার পক্ষে উপযুক্ত স্থান। জানা যায় ১৮৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ইংরেজ সরকারের বারুদখানার দক্ষিণে এক লপ্তে ষাট বিঘা জমি কেনা হল। এখানে ইংরেজ সরকারের কুঠিবাড়ি ছিল। জমির দাম দিতে হল পঞ্চান্ন হাজার টাকা। জমি ছিল গঙ্গার তীরে, মা ভবতারিণী রাসমণিকে স্বপ্নে বলেছিলেন ভাগরথীর তীরে মন্দির তৈরি করে আমায় প্রতিষ্ঠা কর, আমি তোর হাতে নিত্যপূজা গ্রহণ করব। স্বপ্ন পেয়ে রানি কাশী যাওয়া স্থগিত রেখেছিলেন। রানি রাসমণি সমভিব্যাহারে যখন কাশী যাত্রা করেন এবং মায়ের স্বপ্ন পেয়ে তীর্থযাত্রা যে জায়গায় স্থগিত রাখেন সেই জায়গা ছিল ভাগরথীর পশ্চিম উপকূল।
🍂
রানিরা সদলবলে জানবাজারে ফিরে চলেছেন বজরা ঠিকমত সাজানো হয়েছে এমন সময় রানি অপরিচিত একজনের কন্ঠে মা ভবতারিণীর মধুর সংগীত শুনতে পেলেন। কালী মায়ের আশীর্বাদধন্য রানি বজরা থেকে নেমে এলেন এবং পায়ে পায়ে সেই সঙ্গীতের সন্ধানে এগিয়ে চলেছেন। হঠাৎ রানি দেখতে পেলেন একটা- বিশাল অশ্বত্থ গাছের নীচে বসে একজন কালী মায়ের গান গাইছেন। গানটা ছিল -- 'সদানন্দ জয়ী কালী, তুমি আপনি নাচ আপনি গাও মা, আপনি দাও মা করতালি, সদানন্দ ময়ী কালী।' রানি একটু এগিয়ে গিয়ে ঐ গায়কের পরিচয় জানতে চাইলেন। গায়ক বললেন- আমার নাম রামকুমার চট্টোপাধ্যায়। দেশবাড়ি কামারপুকুরে, কলকাতায় ঝামাপুকরে থাকি এবং টোলে ছেলেদের পড়াই, রানি রামকুমারের গানের খুব প্রশংসা করলেন। কালীমায়ের গান শুনে রানি মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন কারণ রানি মায়ের আশীর্বাদধন্য অষ্টসখীর একসখী ছিলেন। ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণদেব অনেকবার বলেছেন যে রানি যে সে রানি নয়, ও মায়ের অষ্টসখীর এক সখি। ঐ স্থানের উপর রানির আকর্ষণ জন্মাল। প্রথমকথা ঐ গান শোনা এবং পরে রানি কূর্মপৃষ্ঠের মত জায়গায় মহাদেবের শিলামূর্তি দেখেছিলেন। মা কালী স্বপ্ন দিয়ে রানিকে ঐ স্থানে নিয়ে গিয়ে দেখা দিয়ে বলেছিলেন আমায় এইখানে প্রতিষ্ঠা কর। তখন থেকে রানির মন চঞ্চল হয়ে রইল কবে কীভাবে মন্দির প্রতিষ্ঠা করে মাকে প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন। প্রথম কথা একসঙ্গে বিশাল পরিমাণ জায়গা পাওয়া যাবে কিনা? তারপর চারিদিকে শত্রু, তাদের শান্ত করে মন্দির প্রতিষ্ঠা করা সহজ ব্যাপার নয়। রামকুমার মাঝে মাঝে জানবাজারে এসে রানির সঙ্গে দেখা করতেন।
ক্রমশ
ক্রমশ
0 Comments