জ্বলদর্চি

প্রণতি নায়েক (ওলিম্পিয়ান জিমন্যাস্ট, পিংলা) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব - ৮১
প্রণতি নায়েক (ওলিম্পিয়ান জিমন্যাস্ট, পিংলা) 

ভাস্করব্রত পতি

'উজবেকিস্তানের জিমন্যাস্ট ওকসানা চুসোভিটিনা যদি ৪৬ বছর বয়সেও মাঠে নেমে পারফরম্যান্স দেখাতে পারে, আটবার ওলিম্পিকে নামতে পারে, তবে আমি ২৮ বছর বয়সেও জিমন্যাস্ট করতে পারবো' --
মেদিনীপুরের পিংলার করকাই গ্রামের গেঁয়ো জিমন্যাস্ট ওলিম্পিয়ান প্রণতি নায়েকের এরকম চ্যালেঞ্জ জিমন্যাস্টিকসের ময়দানে। মেদিনীপুরের মাদুরকাঠির এলাকা থেকে উঠে এসে বিশ্ববন্দিত ঝাঁ চকচকে জিমন্যাস্ট এরিনাতে শরীরী কসরতের নমুনা দেখিয়ে সারা ভারতের মুখ উজ্জ্বলকারী প্রণতি আজ সত্যিকারেরই 'মানুষ রতন'। 

১৯৯৫ এর ৬ ই এপ্রিলে ঝাড়গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন প্রণতি। যদিও ছোটবেলাতেই পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন পশ্চিম মেদিনীপুরের সবংয়ের করকাই গ্রামের মামাবাড়িতে। সেখানেই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যান। তাঁর বাবা শিমন্ত নায়েক ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিবহন সংস্থার বাসচালক। ২০১৭ পর্যন্ত এই কাজ করার পর অফিসের কাজে যোগ দেন। আর মা প্রতিমা ছিলেন আটপৌরে গৃহবধূ। তিন মেয়ে। জয়তী, প্রণতি ও তপতী। দু মেয়ের বিয়ে হলেও প্রণতির এখনও হয়নি। 

নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। হাজার কষ্ট গায়ে মেখেও তাঁরা চেষ্টা করে গিয়েছিলেন মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করার। সে লক্ষ্যে অনেকটাই সফল তাঁরা। মেয়ে সুযোগ পেয়েছিল বিশ্বের অন্যতম সেরা ইভেন্ট ওলিম্পিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করার। 

একসময় করকাই জনকল্যাণ শিশু শিক্ষা কেন্দ্রতে পড়তেন। তখন সেই স্কুলের শিক্ষিকা সন্ধ্যা মালাকার ছাত্র ছাত্রীদের জন্য জিমন্যাস্ট প্রশিক্ষক শুভাশিস চক্রবর্তীকে নিয়োগ করেন। সেই শুরু। প্রত্যন্ত অজ পাড়া গাঁয়ে চলতো নিবিড় প্রশিক্ষন। পরে ভর্তি হলেন তেমাথানির মনসারাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ২০০৩ তে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়াকালীন জিমন্যাস্টিকসে জেলার সেরা হয়ে রাজ্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। সেসময় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন রাধাকান্ত শীট। কিন্তু রাজ্য প্রতিযোগিতায় সফল হতে পারেননি। তাতে কি? বরং বেড়ে গেল জেদ। বেড়ে গেল খিদে। বেড়ে গেল কিছু করে দেখানোর মানসিকতা। ঐ বছরেই সুযোগ পেলেন সাই কমপ্লেক্সে জিমন্যাস্টিকস প্রশিক্ষন নেওয়ার। এখানেই তিনি পান প্রশিক্ষক মিনারা বেগমকে। এরপর ২০০৪ এ ন্যাশনাল আর্টিস্টিক যোগাতে অংশগ্রহণ করেন। এর চার বছর পর ২০০৮ এ রাশিয়ার মস্কোতে একটি আন্তর্জাতিক জিমন্যাস্টিকসের ভল্ট ইভেন্টে চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। যা তখন তাঁর জীবনের প্রথম বড় সাফল্য। এরপর ক্রমশঃ এগিয়ে যাওয়ার পালা। 
প্রণতির প্রথম বড় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ছিল ২০১৪ কমনওয়েলথ গেমস। সেবার অরুণা রেড্ডি, প্রণতি দাস, রুচা দিবেকর এবং দীপা কর্মকারের সাথে দলগত প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পেয়েছিলেন ১১ তম স্থান। এরপর পায়েল ভট্টাচার্যকে সাথে নিয়ে এই একই দল ২০১৪ এশিয়ান গেমসে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করলেও জোটে অষ্টম স্থান। প্রণতি অলরাউন্ড ফাইনালের জন্য যোগ্যতা অর্জন করেন এবং মোট ৪৩.৮০০ স্কোর করেন। ২০ তম স্থান পান তিনি। এই ভারতীয় দলই ফের ২০১৪ এর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৩৮ দলের মধ্যে সর্বশেষ স্থান পায়। এরপর ২০১৭ এর এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করে অলরাউন্ডে ১৪ তম স্থান অধিকার করেন। আর ভল্ট ইভেন্টে পান চতুর্থ স্থান। সেইসাথে ব্যালেন্স বিম ইভেন্টে পান পঞ্চম স্থান। এই বছরের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অবশ্য অলরাউন্ডে ৬০ তম স্থান অর্জন করেন। পরের বছর মেলবোর্ন বিশ্বকাপে ভল্ট ফাইনালের জন্য যোগ্যতা অর্জন করেন এবং ষষ্ঠ স্থানে শেষ করেন।  তারপরে তিনি অরুণা রেড্ডি এবং প্রণতি দাসের সাথে ২০১৮ কমনওয়েলথ গেমসে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। সেখানে তাঁরা দলগত প্রতিযোগিতায় সপ্তম স্থান অর্জন করেছিলেন। আলাদাভাবে, তিনি ভল্ট ইভেন্টের ফাইনালে যোগ্যতা অর্জন করেন। এরপর এই ২০১৮ তেই এশিয়ান গেমসে প্রণতি নায়েক, প্রণতি দাস, অরুণা রেড্ডি, মন্দিরা চৌধুরী এবং দীপা কর্মকারের সাথে দলগত ইভেন্টের ফাইনালে হয়েছিলেন সপ্তম। আর নিজে ভল্ট ইভেন্টের ফাইনালে উঠে অষ্টম স্থান পান। ২০১৯ এর এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে, তিনি অলরাউন্ডে ১৩ তম স্থান পেলেও ভল্ট ইভেন্টে তাক লাগিয়ে দেন। ভল্টে ব্রোঞ্জ পদক জেতেন ১৩.৩৮৪ পয়েন্ট পেয়ে। 

২০২১ সালের টোকিও অলিম্পিকে ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন প্রণতি। যা ছিল মেদিনীপুরবাসী হিসেবে গর্বের মুহূর্ত। অলিম্পিকের আসরে এই অংশগ্রহণ করায় তিনি ছিলেন যোগ্যতা অর্জনকারী দ্বিতীয় ভারতীয় মহিলা জিমন্যাস্ট। এর আগে ২০১৬ তে রিও ডি জেনেরিওতে দীপা কর্মকার প্রথম এই কৃতিত্ব অর্জন করেন। এই ইভেন্টে ০.১৫ পয়েন্ট কম পেয়ে (১৫.০৬৬) চতুর্থ স্থান পেয়েছিলেন দীপা। তাই সকলের নজর ছিল প্রণতির ওপর। কিন্তু চূড়ান্ত ভাবে আশাহত করেন গোটা ভারতকে। তবুও তাঁর কৃতিত্বকে একটুও খাটো করা যায়না। আসলে জিমন্যাস্টিকস করেও ওলিম্পিক পদক পাওয়া যায়, সেই বিশ্বাসের বীজ ভারতবাসীর মনে রোপন করতে পেরেছিলেন মেদিনীপুরের এই দামাল মেয়েটি। প্রণতি তাঁর ক্যারিয়ারে ২০১৯ সালে ভারতীয় অলরাউন্ড চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। এর আগে ২০১৪ এবং ২০১৮ এর কমনওয়েলথ গেমস ও ২০১৪ এবং ২০১৮ এর এশিয়ান গেমসে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। সেইসাথে ২০১৪, ২০১৭ ও ২০১৯ এর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপেও অংশগ্রহণ করার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। 

গুজরাটে ৩৬ তম জাতীয় গেমসে আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিকস প্রতিযোগিতায় প্রণতি পান মোট পাঁচটি পদক। আনইভেন বার এবং ফ্লোর এক্সারসাইজে সোনা জেতেন। অলরাউন্ড ইভেন্ট ও ভল্টিং ইভেন্টে রৌপ্যপদক জেতেন। সেইসাথে দলগত ইভেন্টে বাংলার মেয়েদের দল চ্যাম্পিয়ন হয়। সব মিলিয়ে মোট পাঁচটি পদক তাঁর ঝুলিতে ঢোকে। অলিম্পিয়ান জিমন্যাস্ট প্রণতি নায়েক সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে ওড়িশার হয়ে ন্যাশনাল গেমসে অংশ নেন। এই গেমসে সফলদের জন্য ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক ঘোষণা করেছিলেন সরকারি পুরস্কার। সোনা পেলে ৫ লাখ, রুপোর জন্য ৩ লক্ষ এবং ব্রোঞ্জের জন্য ২ লাখ টাকা দেওয়া হবে। গত ২৩ - ২৮ শে অক্টোবর গোয়ার মাপুসা শহরের পেড্ডেম মাল্টিপারপাস ইণ্ডোর স্টেডিয়ামে আয়োজিত ন্যাশনাল গেমসে প্রণতি ভল্টিং, বিম, ভল্টিং ব্যালেন্সিং বিম, আনইভেন বার এবং ফ্লোর ইভেন্টে পায় মোট ৪ টি সোনা এবং ১ টি রুপোর পদক। সেই হিসেবে মোট পুরস্কারমূল্য ২৩ লাখ টাকা দিয়েছে ওড়িশা সরকার। গোয়ার এই প্রতিযোগিতায় অন্য একজন জিমন্যাস্ট সংযুক্তা প্রসেন কালের সাথে যুগ্মভাবে প্রণতি নায়েক পেয়েছেন 'সেরা মহিলা অ্যাথলিট' এর সম্মান। 

তবে ওলিম্পিকে চূড়ান্ত ব্যার্থতার পরেও ভেঙে পড়েননি প্রণতি। দিল্লির সাইতে গিয়ে নিবিড় প্রশিক্ষন নেন এরপর। দুই প্রশিক্ষক অশোক মিশ্র এবং রোহিত জয়সওয়াল সবসময় ছিলেন তাঁর পাশে। এরপরই কাতারের দোহাতে গিয়ে এশীয় চ্যাম্পিয়নশিপের ভল্ট ইভেন্টে ব্রোঞ্জ পদক পান। যা ছিল তাঁর মানসিক জোর বাড়ানোর অন্যতম ক্ষেত্র। 

গত ২০২৩ এর ৮ - ১০ ই সেপ্টেম্বর হাঙ্গেরির জোম্বাথেলেতে ওয়ার্ল্ড চ্যালেঞ্জ কাপ আয়োজন করে ইন্টারন্যাশনাল জিমন্যাস্টিকস ফেডারেশন। সেখানে অ্যারোবিক্স জিমন্যাস্টিক্সে ভল্ট ইভেন্টে ব্রোঞ্জ পদক পায় প্রণতি। প্রাথমিকভাবে বাছাই পর্বের ইভেন্টে প্রথম পাঁচ জনের মধ্যে স্থান পায়। এরপর ফাইনালে ১৩.১৪৯ পয়েন্ট পেয়ে প্রথম হয় হাঙ্গেরির গ্রেটা মায়ার। দ্বিতীয় হন ১২.৯৯ পয়েন্ট পেয়ে চেকোস্লোভাকিয়ার অ্যালিস ভোকোভা। কিন্তু ১২.৯৬৬ পেয়ে তৃতীয় স্থান পান ভারতের প্রণতি নায়েক এবং গ্রিসের অ্যাথেনসিয়া মেসিরি। এরপর এই দুজনের মধ্যে টাইব্রেকার হয়। সেখানে ব্যাকওয়ার্ড সুকুহারা ভল্ট দিয়ে গ্রিসের প্রতিদ্বন্দীকে হারিয়ে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। ত্রিপুরার দীপা কর্মকার এবং হায়দরাবাদের বুড্ডা অরুণা রেড্ডির পর তিনি তৃতীয় ভারতীয় জিমন্যাস্ট হিসেবে ভল্টে আন্তর্জাতিক পদক জিতলেন। 

২০১৯ এ মঙ্গোলিয়াতে এশীয় চ্যাম্পিয়নশিপের ভল্ট ইভেন্টে প্রথমবার ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছিল প্রণতি। এরপর কাতারের দোহাতে এই প্রতিযোগিতায় ভল্ট বিভাগে দ্বিতীয়বার ব্রোঞ্জ পদক পায়। তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা জিমন্যাস্ট, যিনি এশীয় চ্যাম্পিয়নশিপে দুবার পদক পেলেন। গত ২০১৯ এ মেদিনীপুর কুইজ কেন্দ্র সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির পক্ষ থেকে প্রণতিকে দেওয়া হয়েছে 'মেদিনীপুর রত্ন' সম্মাননা। 

চিনের হ্যানঝাওতে আয়োজিত এশিয়ান গেমসে (২০২৩) অংশগ্রহণের জন্য ভারতের জিমন্যাস্টিক্স ফেডারেশন প্রাক্তন অলিম্পিয়ান দীপা কর্মকার সহ মোট ৯ জন জিমন্যাস্টকে প্রাথমিকভাবে বেছে নেয়। কিন্তু পারফরমেন্সের ভিত্তিতে ভারতীয় ক্রিড়া মন্ত্রক কেবল প্রণতিকেই বেছে নেয়। উল্লেখ্য, এর আগে এশিয়ান গেমসের জিমন্যাস্টিক্স ইভেন্টে ভারতের হয়ে একমাত্র পদকজয়ী ছিলেন আশিস কুমার। তিনি ২০১০ এর এশিয়ান গেমসে ফ্লোর এক্সারসাইজে ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছিলেন। সেই রেকর্ড ছোঁয়ার সুযোগ ছিল প্রণতির। কিন্তু ব্যর্থতা তাঁকে স্বপ্নপূরণ করতে দেয়নি। এই এশিয়ান গেমসে মেয়েদের ভল্ট এবং অল অ্যারাউন্ডের ফাইনালে পৌঁছেছিলেন প্রণতি নায়েক। কিন্তু তিনি অল অ্যারাউন্ডের ফাইনাল থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। কেবল মেয়েদের ভল্ট ফাইনালে অংশগ্রহণ করেন। এবং যথারীতি শেষ করেন সবার শেষে। প্রথম ভল্টে প্রণতি স্কোর করেছিলেন ১২.১০০। এই ভল্টে তিনি 'সুকাহারা ৭২০ ডিগ্রি' ভল্ট দিয়েছিলেন। কিন্তু নিখুঁত ল্যান্ডিং ছিলনা তাঁর। এজন্য ০.৩ পয়েন্ট কেটে নেওয়া হয়। দ্বিতীয় ভল্টে তিনি অর্জন করেন ১২.৬০০। সবমিলিয়ে তিনি করেন ১২.৩৫০ স্কোর। এই ইভেন্টে উত্তর কোরিয়ার আন চাঙ্গোক স্বর্ণপদক পান ১৪.০৯০ স্কোর করে। এই উত্তর কোরিয়ারই কিম সনহিয়াং ১৩.৬০০ স্কোর করে পান রৌপ্যপদক। আর চিনের ইউ লিনমিন ব্রোঞ্জ পদক পান ১৩.৫৩৩ স্কোর করে। আপাতত প্রণতি এখন ওড়িশা রাজ্যের প্রতিনিধি হয়ে ভূবনেশ্বরে নিবিড় অনুশীলনে ব্যস্ত। তাঁর লক্ষ্য সামনের দিকে। সেই লক্ষ্যে অবিচল প্রণতি।
🍂
সংগ্রহ করতে পারেন। হোয়াটসঅ্যাপ -৯৭৩২৫৩৪৪৮৪

Post a Comment

0 Comments