জ্বলদর্চি

ভাঙা আয়নার মন/ পর্ব -১ /মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া

ভাঙা আয়নার মন 
পর্ব -১
                          
 মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া 

 নান্দী অথবা শুভ মহরৎ  

ধবধবে চুল দাড়ি সমেত  ইস্কুলে এক মৌলভী স্যার ছিলেন। চুল দাড়ির সঙ্গে রঙ মিলিয়ে শাদা পাজামা পাঞ্জাবী,মাথায় কালো ফেজ টুপি আর কালো একখানা  জহর কোট পায়ে চামড়ার নাগড়া।শীত গ্রীষ্ম বর্ষা এই পোশাকেই তিনি ইস্কুলে পৌঁছোতেন। 
    বাংলা আর ইংরেজি ছাড়া ক্লাস সেভেন আর এইটে  আমাদের সংস্কৃত বা আরবি যে কোনো একটা ভাষা শিখতে হতো।যেসব মেয়েরা আরবি পড়তে চাইতো মৌলভী স্যার তাদের আরবি শেখাতেন। আমরা যদিও ওই দুবছর সংস্কৃত পড়েছিলাম কিন্তু হাসিখুশি মৌলভী স্যার নিচু ক্লাসেও আমাদের  পড়াতে আসতেন আর চমৎকার তাঁর গপ্পোর জন্য সবার বেজায় পছন্দের ছিলেন।
       ফাইভ সিক্সে রাপিড রিডিং বলে একখানা ক্লাস ছিল। গল্প পড়া হতো সেই ক্লাসে। তাড়াতাড়ি করে সে গল্প খানিকটা পড়ে নিয়েই আমরা গল্প শোনানোর আবদার ধরতাম তাঁর কাছে।এছাড়া  কোনো দিদিমনি হঠাৎ করে না এলে গোলমাল থামাতে তিনি হাজির হতেন। তাঁকে দেখে ক্লাসের গোলমাল অবধারিত ভয়ানক বেড়ে যেত এবং হইচই থামাতে  স্বাভাবিক নিয়মেই  তড়িঘড়ি তাঁকে গল্প বলা শুরু করতে হতো।
       তোরা ছিপ ফেলে মাছ ধরিস?বেমক্কা একদিন স্যারের প্রশ্নে থতমত ক্লাসের ভালমানুষ মেয়েরা বলল না স্যার।যদিও ফাইভ ক্লাস বটি তবে ছোট থেকেই ডানপিটে গেছো টাইপ মেয়ে  পিঠে হাতপাখার ডাঁটি ভাঙার ভয় দেখিয়ে যাকে রোজ পুকুর  থেকে তুলতে  হয়।ছিপ ফেলে, গামছা ছেঁকে,জল কমে এলে পাঁক ঘেঁটে আমি তো মাছ ধরিই।
         কাজে কাজেই আর সবাই তেমন উচ্চ বাচ্য না করলেও আমি দাঁড়িয়ে উঠে ক্যালক্যাল করে নিজের কীর্তি স্যারকে জানাই। শাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে স্যার দুদিকে মাথা নাড়লেন দেখে একটু ভাবনা হলো।
        সাঁতার কাটা, মাছ ধরা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার কিন্তু ছিপ দিয়ে মাছ ধরা একেবারেই কাজের কথা না। কেন স্যার? আমি অবাক।গামছা ছেঁকে,কাদা ঘেঁটে মাছ ধরছিস ধর  কিন্তু খাবার টোপ বেঁধে লোভ দেখিয়ে বঁড়শিতে গেঁথে তোলা একেবারেই ঠিক নয় বুঝলি।এতো ভয়ানক ঠকানো কাউকে।এবার আমিও ভয়ানক চিন্তায় পড়ে গেলাম। এবং বাড়ি ফিরে ছোড়দাকে অনেক তুতিয়ে পাতিয়ে ময়ূর পালক কেটে ফাতনা বানিয়ে নেওয়া সাধের ছিপখানা আর হাতেই ধরলামই না। শুকনো কাঠ রাখার ঘরের কোণে বেচারা ছিপ বাপি আর দাদাদের গোটা তিনেক বড় ছিপের ধারে পলকা কঞ্চির শরীরে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল অনেক কাল‌ নাকি অল্পকাল...!
   দিদুনের মুখে শোনা পরণকথা নাকি? নাকি মায়াবী ছবিসমেত ইভান আর ভ্যাসিলিসার উপকথা? হারা উদ্দেশে রাজপুত্তুর ঘোড়ায় চড়ে চলতে শুরু করত সাথেসাথে চোখ বড়বড় করে তারপর তারপর বলে পিছু ধরতাম আমরাও।আর তেপান্তর বা মাইল মাইল স্তেপভূমি পেরিয়ে গেল অনেক কাল নাকি অল্প কাল...পর্যন্ত পৌঁছে টানটান হয়ে পড়তাম নতুন ঘটনার প্রত্যাশায় আর গীতিকবিতার মতো বারবার দেখা হয়ে যেত রূপবতী রাজকন্যের সাথে।
      বুঝতেই পারছিস, মৌলভী স্যার বলতেন গপ্পের মজা পেতে গেলে পড়ার বই ছাড়া তোদের অন্য বই পড়তে হবে। তোরা আয়, তোদেরকে আমি বই বেছে দেবখন।স্কুলের লাইব্রেরীর দায়িত্বও ওনার। বুধ বা শনিবার সে ঘর থেকে বই নেওয়া যায়।মৌলভী স্যারের উৎসাহে গল্পের বইয়ের লোভে লোভে আমরা বেশ কয়েকজন সেখানে  লাইন লাগালাম।
    ওমা! কোথায় সে সব ছবিওলা রূপকথার বই গো? উনি মাথা পিছু একখানা করে মণীষীদের জীবনী ধরিয়ে দিতে শুরু করলেন। আগে তো জানতে শেখ এই সব মনিষ্যিরা কিভাবে বড় হলেন। ছোট থাকতেই কত দুঃসাহসিক ঘটনা কত কঠিন লড়াই এঁদের মহৎপ্রাণ গড়ে দিয়েছে সেগুলো আগে জান তবেই না! এমতো তো কথা ছিলনি গোছের ভাব নিয়ে খুব অল্প দিনের মধ্যেই বেশিরভাগ ভালো মানুষ মেয়ে কেটে পড়লো।
     আমরা দুচারটে বোকার হদ্দ সেসব বইয়ে জেদি  দাঁত বসানো চেষ্টা দিতে রয়ে গেলাম যাদেরকে উনি শর্ত দিয়েছিলেন একখানা কড়া ধাতের জীবনী বই শেষ করতে পারল একটা করে  ক্ষীরের পুতুল বা বুড়ো আংলা পড়তে পাবো।  বাধ্যতামূলক সেই পড়াটুকুনিকে ভ্যালা জ্বালাতন মনে হলেও পরে একটা অভ্যেস গড়ে ওঠে।অবশ্য বই গিলবার এক গোগ্ৰাসী খিদে খুব ছোট থাকতেই তৈরি হয়েছিল বাড়িতেই।সে কথা হয়তো বলবোও।
           কিন্তু স্মৃতিলেখা মানেই যে বড় কোনো মানুষের জীবন কথা মৌলভী স্যারের দৌলতে এটা তাই একেবারে গোড়া থেকেই স্পষ্ট আমার কাছে। সবার কাছেই সেটা স্বাভাবিক।
    আমজনতা তেমন তেমন মানুষের স্মৃতিচারণ পড়তেই আগ্ৰহী  যারা সবার থেকে আলাদা।নানা বিষয়ে যারা বেশ কিছুটা এগিয়ে এমনকি  কেউ কেউ সময়কে পিছনে ফেলেও চলেছেন জানা অজানার সীমানা পেরিয়ে। তাঁরা পেরোতে পারেন শিলালিপি থেকে দেশ কালের ভূগোল বা খন্ড ইতিহাস!খ্যাতনামা সেসব গুণীজনদের কিভাবে কে মুখোমুখি হয়েছেন আগুনের অথবা নিজেই জ্বলে উঠেছেন উল্কা হয়ে।তুফানকে হারিয়ে নিজেই হয়েছেন তুমুল ঝড়,চকিত বিদ্যুতে হ্যাঁ রাস্তা দেখিয়েছেন,হেঁটে গেছেন সবার আগে নিরুত্তাপ, যাতে করে অসংখ্য মানুষের বুকে গেঁথে উঠে সেই মেঠো পথ একদিন রাজপথ হয়ে যায়।
        বহু জনতার মাঝে সেই অপূর্ব একা মানুষটি কিভাবে পেরোলেন এত অগাধ জল ,কিভাবে উড়িয়ে দিলেন আশাভঙ্গের খড়কুটো একটার পর একটা হার্ডেলস কিভাবে তুচ্ছ হলো তার কাছে সে সব‌ অভিজ্ঞতাই চিরকাল কৌতুহলী করে সবাইকে।
       অথচ পিঁপড়ে বা শ্রমিক মৌমাছির মতো আমাদের নিজস্বতো স্রেফ  চিনির দানা বা সজনে ফুলের মধু মুখে করে দিনান্তে বাসায় ফেরা আর ভোর বেলা কেবলই উড়ে যাওয়া ফুলভর্তি আগুনের দিগন্তে।
      অবিশ্যি  গা ঘেঁসাঘেঁসি মোমের চাকে উজ্জ্বল রঙ -মুকুলের মতো আমাদের এক রানিও যে ছিল না তাও কিন্তু নয়।ভরা বর্ষার অপেক্ষায় সেসব মধু সংগ্ৰহের দিন কানাঘুষোয় জানতে পেতাম  রাগী এক স্ত্রী মৌমাছি নাকি আমাদের গর্ব।গপ্পকথার মতোই চাকভর্তি অলস পুরুষ শুঁড় নাড়ত পশমের আর ষড় করত বিষ মাখানো তার মস্ত ডানা ঘিরে।বলতো হুল বিষয়ক সমস্ত নীলে সামিল হও।জান দিয়ে ভরাট করো সমস্ত ফাঁপা হাওয়া।      
      বলত ভাইসব! রুখে দাও! বেহদ্দ শ্রমিক মাছির দল আমরা চিনতাম মধু ও মোমের ভাঁড়ার।
রেণুমাখা প্রসূতি সদন থেকে সর্ষেফুলের রসে 
উড়াল দিতাম ঝাঁক ঝাঁক বোয়িং বিমান।
বীজ আর আয়ুর মাঝখানে সময়ের নিপুণ ফোঁড় তুলে দিতাম তাবৎ মৌচাকে। শূন্যর নৌকো ঘিরে ধবধবে মোম পাহাড় আমরা গেঁথে তুলতাম প্রাচীন মানচিত্রের সব লুপ্ত শহরে। আমরাই হয়ে উঠছিলাম কম্পাসের নাবিক ও ক্যাপটেন।
শুধু মাঝেমধ্যেই ধারালো ডানায় ছিপছিপে মেয়ে উড়ে এলে ঘুরে যেত ব্রোঞ্জের যুদ্ধ জাহাজ।
নতুন রানিকে ঘিরে উড়ত বেহদ্দ তরুণ মাছির দল
পুরনো চাকে তারা ফেলে যেত গলানো সময়
তুসোর মিউজিয়াম ও বিষণ্ণ সম্রাজ্ঞী!
       অগত্যা ধ্বংসস্তূপে ফের গড়ে তুলতে হতো ঘর বসতের খেত খামার। জলের ধারে কাছে নগর সভ্যতার নয়া পত্তনি।
ঘুরে ঘুরে লাভার যুগ বৃষ্টি যুগ বরফ যুগ নিদেন পাথরযুগেও গোড়ালি উঁচু করে ডিঙিয়ে পৃথিবী নামের ছোট এই গ্ৰহ কবে থেকে বুড়ি হলো আমার মতই কবে থেকে বুকের অসুখ ধরল তার,কবে থেকে আমরা পুড়িয়ে দিলাম তার সবুজ আয়ুটুকু কংক্রিটের জংলি মরুভূমিতে বসে এখন হিসেব কষেন কোনো রোবট মার্কা বড়বাবু স্যার। 
         ভুল অংকের তো আর নিকেষ হয় না ডেবিট ক্রেডিটের ফারাকও বেড়েই চলে।যতই কিনা পাঠশালা বসান সাঁই, মরমিয়া নিদান হাঁকেন দরবেশ, ফকির মিশকিনের  মুশকিলের তবু আসান হয় না আর।
     আমরাও আশ্চর্য প্রত্যেকে হুবহু একই রকম।বামন জোকারের খেলা দেখি বা রঙ মেখে রণ পায় চড়ি,পোশাক বা সংলাপ তো সত্যি করে আর পাল্টে যায় না।
ফলে  পিছলে পড়তে পড়তে  আঁকড়ে ধরা কাছিমের পিঠে ছাপোষা জীবনের আটপৌরে জলছবি তো সকলেরই চেনা!
 জল রঙে ওয়াশের কাজের মতো নিতান্ত চেনা পাশের বাড়ির মেয়েটির গেরস্থালির কাজ গুটোতে গুটোতে ঝুরো চুলের অগোছালো কপাল,অল্প ঘেমে ওঠা তার উলোঝুলো শাড়ি আর লেপ্টে যাওয়া ব্লাউজের ভেতর ফুটে ওঠা  শরীরের বাঁকে মৃদু খুঁজে নিতে হবে কোনো বিমূর্ত শিল্পের আঁকিবুঁকি। খুঁজতে হবে পরিত্যক্ত ফোয়ারায়  ছড়িয়ে পড়া জলকণার গল্প কিংবা পাথরের ভাঙা মূর্তির কোমোরের খাঁজে খড়কুটো গেঁথে গড়ে তোলা পরিপাটি পাখিদের গ্ৰাম।
    অর্থাৎ সব কিছুতেই মিশিয়ে নিতে হবে পাঠকের অতিরিক্ত কল্পনা কিংবা রঙচটা সেই সেলুনের আয়নায় দাঁড়াতে হবে পাঠককেই!
    কেননা পিছনে ফিরলে তো দৃশ্যের জন্ম হবেই। সামনে তাকালেও। শুধু কান পেতে শোনার, অপেক্ষাতেই চলতে শুরু করবে অক্ষর।
        এই যেমন ঝড় উঠলেই দুমদাম আছড়ে পড়ে দোর জানলা সবাই পড়িমড়ি করে ছোটে তাদের বন্ধ করতে। আমিও  দৌড় দিই আবার সব খুলে দিতে। 
             ভেবে কুল কিনারাই পাই না যদি আমার বাদামি চামড়া না শুষে নেয় রোদ ঝলসানো  দুপুরের  গনগনে লাল চোখ,যদি আঁধিতে ঘুরপাক খাওয়া ধুলো বালি আছড়ে না পড়ে আর বিঁধে যায় তার তীক্ষ্ণ, বিষ্টির অঝোর যদি ধুয়ে না দেয় সেসব,  যদি বৃষ্টি ফুরোনোর পরপরই কচি লেবুপাতা রঙের আলো যদি শরীর পেতে না নিই না আ্যবজর্ব করি সেই অনুভব তবে কিভাবে জানবো আমার এই ছোট আধারে জুড়ে এত কথা ছবি এত শুদ্ধতম সুর আমি নেবো কোন পথে?
      সারা শরীরে  নীল নীল শিরা যদি নদীর মতোই বাঁক নিয়ে কোন মাটির মোহনায় মেশে আর দু পায়ের পাতার ফাঁকে ভিজে ভিজে শেকড় বেরিয়ে আসে তৎক্ষণাৎ কচি পেয়ারার ডালের মতো তরতরিয়ে ওঠে দুই হাত, ঝাঁকড়া মাথাভর্তি পাতা নিয়ে  আসমান জমিনের মাঝে হাওয়ায় ভেসে থাকার নিরুপায় সমর্পন ছাড়া আমি করবো
কী?
       জল খাবলে খাবলে হঠাৎই পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাওয়া বা স্মরণ বিস্মরণের খড় আঁকড়ে ভেসে ওঠা আহ্ জীবন নিতান্ত ধুলোর কণাটুকু মেখে ক্ষুদে পিঁপড়ের চলার মতোই  তুচ্ছ নির্ভর এই বেঁচে থাকা তবে কোনো ছাপছবি বা লিনোকাট নয়। কুয়াশায় ঘেমে উঠছে ভাঙা আয়নার কাঁচ বলে ঢেকে রাখছি বারবার দু মলাটের মধ্যিখানে যাকে ধরবে না জেনেই আমি লিখে লিখে মুখের ভাঁপ দিয়ে দুহাতের চেটোয় তাকে মুছে ফেলছি প্রতি মুহূর্তে?

🍂

Post a Comment

5 Comments

  1. 'ভাঙা আয়নার মন' : পর্ব ১ পড়লাম। খুবই ভালো লাগল। যেন ‌একবার ছোটোবেলা থেকে ঘুরে এলাম। নাটকীয় উপস্থাপন ভঙ্গি, স্বাদু গদ্য পাঠককে টেনে রাখে।
    পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

    ReplyDelete
  2. চমৎকার লাগলো। স্মৃতিপথ পেয়ে ভ্রমণ করে এলাম যেন পুরনো সেই দিনের কথা।

    ReplyDelete
  3. আহা,এক অপরূপ জার্নি। শব্দের পিঠে চড়ে এভাবে শৈশবসাফারিতে মন সবুজ হয়ে উঠলো।অপেক্ষায় থাকলাম দিদিভাই।

    ReplyDelete
  4. তোর লেখার প্রশংসা কি ভাবে করবো বুঝিনা। ভাষা হারিয়ে ফেলি মনি সত্যি সেই ছোটবেলা কোথায় যেন হারিয়ে যাওয়া । অন্তত আবার একবার ফিরে গেলাম তোর হাত ধরে। একা বসে পড়লে আরোই ভালো লাগে।

    ReplyDelete
  5. ভারি ভারি কথাগুলো সুপাঠকদের জন্য থাকুক। আমি কিছুক্ষণের জন্য ছোটোবেলাটা খুঁজে এলার - সেই কঞ্চির ছিপ, এঁদো পুকুর আর তালপাখার ডান্টি হাতে মা.... ।
    একটা সত্যিকারের টাইম মেশিন যদি পেতাম....

    ReplyDelete