জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প—কোরিয়া (এশিয়া)শুকনো খেজুরের খপ্পরে/চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোকগল্প—কোরিয়া (এশিয়া)
শুকনো খেজুরের খপ্পরে
চিন্ময় দাশ

চার দিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা ছোট্ট একটা গ্রাম। একটা বাঘ থাকে সেই পাহাড়ে। পাহাড়ের চুড়ায় উঠে ডাক ছাড়ে যখন, ভয়ে কেঁপে কেঁপে ওঠে গোটা গ্রাম।
এক দিনের ঘটনা। শীতের রাত তখন। বরফ পড়ছে ঝির ঝির করে। যত দূর দেখা যায়, সবাই ঘুমের দেশে। সারা এলাকা নিঝুম। বাঘটা নেমে এল পাহাড়ের চুড়া থেকে। ক’দিন পেটে কিছু পড়েনি তার। খিদেয় পেট জ্বলছে। মরিয়া হয়ে গ্রামেই ঢুকে পড়ল। একটা বাড়ির জানালার বাইরে এসে হাজির। লন্ঠন জ্বলছে ভেতরে। আলোর আভা দেখা যাচ্ছে। 
ভেতরে হঠাৎএকটা বাচ্চা কেঁদে উঠল—ওঁয়াও ওঁয়াও। কাঁদতেই লাগল বাচ্চাটা।  
খানিক বাদে চিৎকার করে কান্না শুরু হোল তার। কেঁদেই চলল সেভাবেই। বাঘ তো রাস্তা খুঁজছে ঘরের ভেতরে ঢোকার। হঠাৎ ভেতর থেকে বাচ্চাটার মায়ের গলা ভেসে এল—চুপ কর বলছি। তাকিয়ে দেখ, জানালার বাইরে একটা ভালুক এসে বসে আছে।
মায়ের কথা কানেই তুলল না। কেঁদেই চলেছে বাচ্চাটা। 
জানালার নীচে হামাগুড়ি দিচ্ছিল বাঘ। বাচ্চার কাণ্ড দেখে সে অবাক—এ কী ভয়াণক বাচ্চা রে, বাবা? শেয়াল কুকুর তো তুচ্ছ। আস্ত একটা ভালুক এসেছে শুনেও ভয় পায় না!
খিদেয় পেট জ্বলছে। মরিয়া হয়ে, দু’পায়ে খাড়া হয়ে উঠেছে বাঘ। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতে চায় সে। তখনই মা বলে উঠল—ঐ দ্যাখ, দ্যাখ। এবার একটা বাঘ এসেছে জানালার বাইরে।  
অবস্থা কিছুই বদলাল না তাতে। কেঁদেই চলেছে বাচ্চা। দেখে শুনে বাঘবাবাজি বেশ ভড়কেই গেল। ধপাস করে বসে পড়েছে মাটিতে।
অবাক হয়ে ভাবতে লাগল, বউটা জানল কী করে, আমি এখানে আছি? ভালো করে দম নিয়ে, আবার ঘরে উঁকি দিতে গেল। বাচ্চাটা কেঁদেই চলেছে। ভালুক বা বাঘে কোন গেরাজ্ঝিই নাই তার।
বাঘ অবাক। সে চিরকাল ভেবে এসেছে, বাঘের নামে সবাই ডরায়। মানুষ হোক, বা বনের পশুপাখি—বাঘের নামটুকু শুনলেই ঘাবড়ে যায় না, এমন তো কেউ নাই। কিন্তু আশ্চর্য এই বাচ্চা! কোন কিছুতেই ভয় পায় না। এমনকি বাঘকেও নয়।
একটু ভয় ধরতে শুরু করেছে বাঘের মনে। তখনই বউটার গলা শোনা গেল—এবার কী হবে? এবার কান্না  থামাবি তো? সামনে চেয়ে দ্যাখ, শুকনো খেজুর হাজির হয়েছে। 
কথা শেষ হতে পেল না। বাচ্চাটা বেমালুম চুপ মেরে গেল। সাড়াই নাই আর তার কোনও। এমনকি নিঃশ্বাস পড়বার শব্দও উধাও।
বাঘ ভেবে ভেবে হয়রাণ হয়ে যাচ্ছ, কে এই খেজুর? তাও আবার শুকনো। কিন্ত সে নিশ্চয় আমার চেয়েও ক্ষমতাবান। আমার চেয়েও ভয়ঙ্কর! নইলে, চুপ করে গেল কেন বাচ্চাটা? কেবল দুশ্চিন্তা নয়, ভয়ও লাগতে শুরু করেছে তার। 
তখনই আচমকা এক কাণ্ড। বাঘ ছিল জানালাটার ঠিক বাইরে। হঠাৎই ভারি কিছু একটা ধপাস করে বাঘের পিঠে এসে পড়ল। বাঘের তো আক্কেল গুড়ুম। এ নির্ঘাৎ সেই ভয়ঙ্কর খেজুর ছাড়া আর কেউ নয়। প্রাণের ভয় কার নাই? লেজ উঁচিয়ে দৌড় লাগাল বাঘ।
আসলে হয়েছে কী, একটা চোর এসেছিল সে বাড়িতে। গরু চুরি করবে বলে। জানালার বাইরে আস্ত একটা বাঘ দাঁড়িয়ে থাকবে, ভাববে কী করে সে? সে বেচারা ঠিকমত ঠাওর করতে পারেনি। সে ভেবেছে গরু। সেই ভেবে,পড়বি তো পড়, লাফ দিয়ে পড়েছে সোজা একেবারে বাঘের পিঠে। 
🍂

বাঘের প্রথম লাফ দেখেই, লোকটা বুঝতে পেরে গেছে, কী ভয়াণক ভুলই না করে ফেলেছে। একেবারে সাক্ষাৎ যমের পিঠে চড়ে বসে আছে এখন। আজ আর রেহাই নাই।
এদিকে বাঘও দৌড়াচ্ছে মরিয়া হয়ে। যেভাবেই হোক প্রাণ বাঁচাতে হবে এই ভয়ঙ্কর শুকনো খেজুর জীবটার হাত থেকে। দৌড়চ্ছে, আর মাঝে মাঝে মোচড় লাগাচ্ছে শিরদাঁড়ায়। যাতে পিঠ থেকে বিপদটাকে ফেলে দিয়ে, সরে পড়া যায়।
এদিকে চোরেরও অবস্থা কাহিল। সে ভালো করেই জানে, পিঠ থেকে পড়ে যাওয়া মানে, নির্ঘাত মৃত্যু। মূহুর্তে ফালা ফালা করে ফেলবে বাঘ। বাঘের পিঠে কি আর অমনি অমনি বসে থাকা যায়? দু’হাতে শক্ত করে বাঘের কান দুটোকেই পাকড়ে রেখে টাল সামলাচ্ছে বেচারা। 
দুজনেই কাঁপছে ভয়ে। একটাই ভাবনা দুজনের, কী করে রেহাই পাওয়া যায় এই বিপদ থেকে। এদিকে ভোর হয়ে আসছে ছুটতে ছুটতে। আলো ফুটে উঠছে বন পাহাড় জুড়ে।
 কপাল ভালো বলতে হবে চোরের। একটা ঝাঁকড়া গাছের তলা দিয়ে পার হচ্ছে বাঘ। একটা নীচু ডাল হাতের নাগালে পেয়ে গেল লোকটা। খপ করে ধরে নিয়ে ঝুলে পড়েছে। সাথে সাথে লুকিয়ে পড়েছে ঘণ পাতার আড়ালে। বাঘ যদি ফিরে আসে খোঁজার জন্য?
পিঠের বোঝা হঠাৎ করে উধাও। বাঘ থতমত খেয়েছে যতটা, নিশ্চিন্ত হয়েছে তার চেয়ে বেশি। কপাল ভালো  বলতেই হবে। বড় জোর বাঁচা গেছে ভয়ঙ্কর খেজুরটার হাত থেকে। 
রইল পেটের খিদে, রইল শিকার। নিজের ডেরার দিকে মুখ ঘুরিয়ে ছুটতে লাগল সে। একবার পৌঁছতে পারলে, সেখানে কোন বিপদ নাই বাঘের।

Post a Comment

0 Comments