জ্বলদর্চি

আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস(১৫ই মে)/দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে

আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস(১৫ই মে)
দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে

 মানুষ সামাজিক জীব, তাই মানুষকে সমাজে বসবাস করতে হলে পারিবারিক পরিচয় বহন করতে হয়। মানুষ হিসেবে সকলে কোন না কোন পরিবারের সদস্য। এর মাধ্যমেই আমরা জন্মগ্রহণ করি, বড় হই, নিজেও পরিবার গঠন করি এবং মৃত্যুবরণ করি। পরিবার হচ্ছে, সমাজের মৌলিক ও ক্ষুদ্রতম আদিম সামাজিক প্রতিষ্ঠান। মানব সৃষ্টির আদি থেকেই সমাজে পরিবার বিদ্যমান এবং সমাজের প্রাথমিক সাংগঠনিক প্রতিষ্ঠান হলো পরিবার । পরিবার হলো, একটি প্রাচীনতম সংগঠন। 

আজ ১৫ই মে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস। ১৯৯৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদের এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৫ই মে দিনটি "আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস" হিসেবে ঘোষিত হয় এবং রাষ্ট্রসংঘ ১৯৯৪ সালকে আন্তর্জাতিক পরিবার বর্ষ ঘোষণা করেছিল।

পরিবার কি?এর উত্তরে বলা যায়,
নৃবিজ্ঞানী ম্যালিনোস্কির মতে,  *"পরিবার হলো,একটি গোষ্ঠী বা সংগঠন"*। 
সমাজ বিজ্ঞানী সামনার ও কেলারের মতে, *‘পরিবার হলো ক্ষুদ্র, সামাজিক সংগঠন, যা কমপক্ষে দু’ পুরুষকাল পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে”*
এ সংজ্ঞার প্রেক্ষিতে বোঝা যায়, বিবাহপ্রথার আগেও সমাজে পরিবারের সৃষ্টি হয়েছিল- কারণ কোন সম্পর্কে আবদ্ধ হওয়ার আগে থেকেই, মানুষ দলবদ্ধ জীবনযাত্রা করতো, যা পারিবারিক জীবনযাপনের স্বাক্ষর বহন করে।

 বিভিন্ন সমাজে,বিভিন্ন সংস্কৃতির পরিবারের ভূমিকা ভিন্ন, ভিন্ন ভাবে পরিলক্ষিত হয়,এর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো,বৈচিত্র্যপূর্ণ নানামুখী ধারা, যে কারণে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় সামাজিক, সাংস্কৃতিক,রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের সঙ্গে এর গঠন ও অন্যান্য অবস্থার পরিবর্তন হয়ে চলেছে।

শিল্প বিপ্লবের পরে পরিবারের ধরন ও ভূমিকা পাল্টাতে থাকে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে পিতৃতান্ত্রিক পারিবারিক ব্যবস্থা থেকে ক্রমশ ব্যক্তিকেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক পরিবার বা যৌথ পরিবার ব্যবস্থা থেকে একক বা নিউক্লিয়ার পরিবার তৈরী হয়েছে।


পরিবারের মৌলিক কাজ অনেক।এক দিকে জৈবিক, অপর দিকে মনস্তাত্ত্বিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাদান ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে সব থেকে বড় দায়িত্ব শিশুর আচরণ  তথা সামাজিকীকরণ এবং সংস্কৃতির সংরক্ষণ। যে শিশুটি ভবিষ্যতের নাগরিক, তার মনোজগত প্রস্তুত হয় পরিবারে। পরিবারের ধারা কেমন, কী ধরনের প্রথা,রীতি-নীতি, এ সবের উপর ভিত্তি করে শিশুর জীবন শৈলী গড়ে ওঠে। তাই শিশুর সুষ্ঠু পারিবারিক শিক্ষা শৈশবে শিশুর মনে তথা ছোটবেলায় যে ছাপ রাখে, তা তার পরবর্তী জীবনে অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। সেজন্য রাষ্ট্র পরিচালনায় যেমন কিছু সংবিধান আছে, তেমনি পারিবারিক সংবিধানও থাকা উচিত। যেমন, পরিবারের সবার সঙ্গে সদ্ভাব গড়ে তোলা, সাংসারিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা, মিথ্যে কথা না বলা, গুরুজনদের শ্রদ্ধা করা, নির্দিষ্ট সময়ে ঘরে ফেরা, নিজের কাজ নিজে সম্পন্ন করা, এবং সর্বোপরি মানবিক মূল্যবোধগুলো চর্চার মাধ্যমে অন্তরকে বিকশিত করা।

প্রতি বছর ১৫ই মে দিনটিতে "আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস" পালন করা হয়। দিবসটি ১৯৯৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ A/RES/47/237 রেজুলেশনের মাধ্যমে ঘোষণা করেছিল এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পরিবারগুলির প্রতি যে গুরুত্ব দেয়, তা এই ঘোষণার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়।

আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস বিশ্ব প্রেক্ষাপটে পরিবারের ক্রমবর্ধমান বোঝাপড়ার সাথে জড়িত একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস নিয়ে গর্ব করে।যেমন বলা যায়,১৯৮৯সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১৯৯৪সালকে পরিবারের আন্তর্জাতিক বছর (IYF) হিসাবে ঘোষণা করে , সমাজে পরিবারের মৌলিক ভূমিকা এবং সহায়ক নীতির প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে। শুধু তাই নয়,১৯৯৩ সালে পারিবারিক সমস্যাগুলির প্রচারের ক্রমাগত গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে, সাধারণ পরিষদ ১৫ই মে দিনটিকে "আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস" হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে ৷ এটি মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণার একটি দিন, যা পারিবারিক অধিকারের সুরক্ষার উপর জোর দেয়।


প্রত্যেকটি দিবসে একটি করে থিম থাকে। ১৯৯৪ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত থিম গুলি হলো,বিশ্বব্যাপী পরিবারগুলির মুখোমুখি হওয়া বিশেষ চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগগুলিকে হাইলাইট করে। এছাড়াও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি এবং সামাজিক অন্তর্ভুক্তির মতো বিষয়গুলিকেও সংযুক্তি করেছে,যেমন,
সচেতনতা বৃদ্ধি, দারিদ্র্য এবং সহিংসতা থেকে শুরু করে অভিবাসন এবং জলবায়ু পরিবর্তন পর্যন্ত পরিবারগুলিকে প্রভাবিত করে, এমন সমস্যাগুলি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে দিবসটি একটি বিশ্বব্যাপী 
প্ল্যাটফর্ম হিসাবে কাজ করে।

২০২৪ সালের IYF-এর ৩০তম বার্ষিকীকে চিহ্নিত করে, একটি দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে পারিবারিক কাঠামোর বিবর্তন এবং উদীয়মান চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করার সুযোগ করে দেয়।

আমাদের মনে রাখা উচিত, আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস শুধু একটি উদযাপন নয়, এর মাধ্যমে পারিবারিক বন্ধনকে আরও শক্তিশালী করে, আমরা এমন একটি বিশ্ব তৈরি করতে পারি, যেখানে সমস্ত পরিবারের বিকাশের সুযোগ থাকবে।


পারিবারিক দিবসের তাৎপর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।১৫০টিরও বেশি দেশে আন্তর্জাতিক পরিবার দিবস উদযাপিত হয়, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি এবং পরিবার-সম্পর্কিত বিষয়ে ধারণা,বিনিময়ের জন্য। এই দিনটি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে পরিবার-বান্ধব নীতি এবং এই  ধরনের প্রোগ্রামগুলির বিকাশকে উৎসাহিত করে।
এই দিবসটি পালনের মধ্য দিয়ে পারিবারিক কাঠামোর বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং নিশ্চিত করে যে, সমস্ত পরিবার, মূল্যবান পারিবারিক বন্ধনের গুরুত্বের উপর জোর দিয়ে সামগ্রিকভাবে পরিবার তথা সমাজকে শক্তিশালী করে।
 এই দিনটি জাতিসংঘের পালন এবং সমাজের লালন-পালনে পরিবারগুলি যে অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে, তার উপর জোর দেয়। এই দিনটি উদযাপনের মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী পারিবারিক একককে শক্তিশালী করে এবং সেই সঙ্গে একতার আদর্শ প্রচারের জন্য নিখুঁত উপলক্ষ প্রদান করে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়গুলি ১৫ই মে দিবসটি স্মরণ করার জন্য একত্রিত হওয়ার সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী সংহতি এবং "ফ্যামিলি ফার্স্ট" নীতিগুলির প্রতি একটি নতুন প্রতিশ্রুতি গ্ৰহণ করে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, "পরিবার দিবস"দিনটি পালনের মাধ্যমে আমরা যেন আরও বেশি করে পারিবারিক হতে পারি এবং যথার্থ অর্থেই যেন মনে করি, "বাসুদেব কুটুম্বকম"।

🍂

Post a Comment

0 Comments