জ্বলদর্চি

এক মুঠো রোদ/পর্ব- ১৩/স্বপন কুমার দে

চিত্র- শুভদীপ ঘোষ

এক মুঠো রোদ
পর্ব- ১৩

স্বপন কুমার দে

সন্ধ্যা হওয়ার আগেই মেয়ে বাড়ি ফিরে এল। দেখল, বাবা বাড়িতে নেই। বোধহয় বাইরে কোথাও গেছে। একটু আধটু বাইরে বেরোনো ভালো। বিশেষত, বিকেল বেলায় কাছে পিঠে একটু ঘুরে লোকের সঙ্গে দুটো কথা বললেও মনটা কিছুটা হালকা হয়। সবসময় ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ থেকে থেকে একঘেয়ে ক্লান্তিকর জীবনটাকে বোঝা মনে হয়। তারপর রোগের কামড় শরীরের সাথে সাথে মনটাকেও অবশ করে তোলে। মনেহয়, হঠাৎ করেই তাকে একদিন চলে যেতে হবে। তখন বড় দুশ্চিন্তা হয় মেয়েটার জন্য। মা তো আগেই গেছে,  এবার যদি বাবা চলে যায় তখন ওর কী হবে? কে ওকে দেখবে? মেয়েদের একা একা থাকাটা কতটা বিপদের, কতটা অনিশ্চয়তার তা কি মেয়ে বোঝে? এই সমাজের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে ধূর্ত শেয়ালেরা, তাদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করবে কীভাবে?

ওর এখন কম বয়স, চোখে অনেক স্বপ্ন। তাই বাবার কথা শুনতে চায় না। বিয়ে করতে চায় না। কিন্তু বাবার যন্ত্রণা কি এরা বোঝে না? কত ভালো ভালো সম্বন্ধ ফিরিয়ে দিয়েছে। এসব যন্ত্রণার কথা কাকে বলা যায়,বলে মনটাকে একটু হালকা করা যায়? নিজের বলতে কেউ নেই, পাড়া প্রতিবেশীদেরও বলা যায় না। তারা অবস্থার সুযোগ খুঁজবে। অনেক রকম গল্প তৈরি হবে। বলে কাজ নেই। বরং লোকের সঙ্গে অন্য প্রসঙ্গে কথা বলা যাক।

বাবা সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরে এল।এসে দেখল, মেয়ে  আগেই ফিরেছে। সাধারণত মল্লিকা এই সময় বাড়ি ফেরে না, টিউশন সেরে বাড়ি ফিরতে সাড়ে আটটা, ন'টা বেজে যায়।

" হাত পা ধুয়ে এসো তো বাবা, চাট্টি খেয়ে নেবে।" মেয়ে ব্যবস্থা করে রেখেছিল-- ছোলা সেদ্ধ আর নারকেল কোরা দিয়ে মুড়ি। খাওয়ার শেষে হাত মুখ ধুয়ে মুছে বাবার গলা জড়িয়ে ধরল মেয়ে।
" কেন রে কী হয়েছে মা? এত খুশি কিসের?"
" বাবা, আমার পড়ার আর কোনো চিন্তা নেই। আরও একটা টিউশন পেয়ে গেছি। এবার আর তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমার পড়াশোনা ,তোমার ওষুধপত্র সব কিছুর খরচ জোগাড় হয়ে যাবে।"
" দেখেশুনে কী মনে হচ্ছে জানিস, তুই আমার মা,আর আমি তোর ছেলে। "
" সেটা আর মনে করার কী আছে? আমি তো তোমার মা-ই। সেই কবে থেকে। তাই এবার আমার কথা না শুনলে তোমায় বকবো।"
" কিন্তু মা, এতগুলো টিউশন করে তুই নিজের পড়াশোনার সময় কখন পাবি? এতে কি তোর রেজাল্ট ভালো হবে?"
" দেখাই যাক না বাবা, কী হয়। তবে পড়াশোনা যে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারবো,এটা ভেবেই আমার ভালো লাগছে।"
এরপর থেকে এ বাড়িতে আর ঘটককে আসতে দেখা গেল না।

                                *****

ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এসে মল্লিকা একটা ব্যাপার লক্ষ্য করল ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়েরা একটু অন্যরকম। এখানে সবাই সবাইকে ঠিক মত চেনেও না। যারা যে যে কলেজ থেকে এসেছে তাদের মধ্যেই বেশি মেলামেশা, আড্ডা,বই দেওয়া নেওয়া। কলেজ ভিত্তিক এক একটা গ্রুপ তৈরি হয়ে গেছে। কখনও কখনও এসবের বাইরে গিয়ে তারা কথাবার্তা, ইয়ার্কি করে কিন্তু সিরিয়াস বিষয় কেবল গ্রুপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

মল্লিকার কোনো গ্রুপ নেই। তাদের কলেজের আরও দুটি মেয়ে এখানে ভর্তি হলেও তারা কেউই মল্লিকার সঙ্গী হতে চায় না। তারা একটা গ্রুপে ঢুকে পড়েছে। কোনও গ্রুপে মল্লিকার জায়গা না পাওয়ার দুটো মূল কারণ হল, -- সে অত্যন্ত গরিব, যা তার পোশাক, টিফিন দেখলেই বোঝা যায়। দুই, সে তাদের অতটা সময় দিতে পারে না। ক্লাস শেষ করেই তাকে টিউশন পড়ানোর জন্য ছুটতে হয়। এজন্য আকারে ইঙ্গিতে অনেক বিদ্রূপও সহ্য করতে হয়।

একদিন দীপশিখা ওরফে দীপা নামের একটি মেয়ে ওদের দলে যোগ দেওয়ার জন্য মল্লিকাকে ডেকেছিল। মল্লিকা না বলেনি, সেখানে গিয়েছিল। একটা অফ পিরিয়ড ছিল, সেই ফাঁকে বারান্দায় এসে ওরা দাঁড়াল। দীপার বন্ধুরা খুব ইয়ার্কি,হাসি, ঠাট্টা করছিল। মাঝে মাঝে বেদম হাসির রোল সবাইকে চমকে দিচ্ছিল। মল্লিকাও কিছুটা তাল মেলাচ্ছিল। কিন্তু বাদ সাধল ওদেরই দলের মল্লার সেনগুপ্ত। বড়লোকের আদুরে ছেলে। হঠাৎই বলে ফেলল," দীপা, তোকে একটা কথা বলি, আসলে ব্যাপারটা কী জানিস, বন্ধুত্বটা সমানে সমানে হওয়া উচিত। নইলে, সেটা কখনও কখনও অস্বস্তি বাড়ায়।"

🍂

তার কথার অর্থ বুঝতে পারল না দীপা। সে বলল," কেন? আমরা এখানে সবাই একই ডিপার্টমেন্টের একই ইয়ারের স্টুডেন্ট। সবাই সমান,আলাদা তো কেউ নয়।
মল্লার একটু হেসে অন্যদের দিকে চেয়ে বলল," মাঝে মাঝে দীপা এমন বোকা বোকা কথা বলে না!" তারপর যোগ করল," শিক্ষাগত যোগ্যতাটাই বড় কথা নয়, তার সঙ্গে আর্থিক যোগ্যতাটাও থাকা দরকার। স্টেটাস মেইনটেইন করা দরকার। ধর্, আমরা কোথাও বেড়াতে যাই বা রেস্টুরেন্টে খেতে যাই, সেখানে সবার পকেটের দিকটাও দেখতে হবে। দেখ, আমি স্পষ্ট কথা বলি বলে সকলে পছন্দ নাও করতে পারে, কিন্তু এটাই বাস্তব।"

প্রচন্ড মনোকষ্ট নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছিল মল্লিকা। আর সে কোনদিনও কোনো দলে ভিড়েনি। মল্লিকার সঙ্গে কেবল নির্ভেজাল কথা বলতে আসে অভিরুপ ঘোষ। বাঁকুড়ার একটি কলেজ থেকে অনার্স করে এখানে এসেছে সে। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, বাবা হাইস্কুলের টিচার। সেই অভিরুপই মল্লিকার সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করে। মল্লিকা যেদিন অ্যাবসেন্ট থাকে সেদিনের পড়াটা শেয়ার করে অভিরুপ আর অভিরুপ যেদিন আসে না, সেদিনের পড়াটা বলে দেয় মল্লিকা।

তবে মল্লিকা অনেকটা সাবধানী। সে জানে, অনেক সময়ই অযাচিত বন্ধুত্ব স্বার্থান্বেষী হতে পারে। সুযোগসন্ধানীরা উদ্দেশ্য নিয়ে হাজির হয়। সেটা আড়ালে থাকে, তাই ধরা যায় না। বন্ধুত্বের ভান করে প্রয়োজনীয় সাহায্য নিয়ে সরে পড়ে। এরা প্রকাশ্য শত্রুর চেয়েও ভয়ংকর। আবার কিছু কিছু ছেলের অন্যরকম উদ্দেশ্য থাকে। এরকম অনুভূতি বোঝার বয়স তার হয়েছে, তাদের থেকে দূরে থাকে। তবে সবাই যে একরকম, তা নয়, উল্টোদিকটাও সে দেখেছে। দু'একবার সমস্যায় পড়ে দেখেছে কারো করো অনাকাঙ্খিত সাহায্যের হাত তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে।

দু'একদিন ক্লাস করেই মল্লিকা বুঝতে পারল, সিলেবাস অনেকটাই কঠিন,কম্পিটিশনও ভীষণ টাফ। বিভিন্ন কলেজ থেকে সব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টরা ভর্তি হয়েছে। তারা মল্লিকার চেয়ে এগিয়ে। বিশেষত,  প্রবলেম সলিউশনের ব্যাপারে কিছুজন অনেক বেশি প্রম্পট। মল্লিকা এটাও বুঝল, লড়াইয়ে টিকে থাকতে গেলে আরও অনেক বেশি স্টাডি করতে হবে। কিন্তু হাতে সময় কই? ক্লাস, টিউশন, রান্না বান্না করার পর ক্লান্তি আসাটাই স্বাভাবিক। তারও মানুষের শরীর। তাছাড়াও অসুখ বিসুখ, বাবার পরিচর্যা ইত্যাদি।

ছুটির পর ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে অভি বলল," আয়, আমরা রুটি ঘুগনি খাই। আমার খুব খিদে পেয়েছে। "
মল্লিকা বলল," না, খেতে হয় তুই খা। আমি যাই, আমার তাড়া আছে।"
" দশ মিনিট লেট হলে খুব কি ক্ষতি হয়ে যাবে? আমি বলছি যখন, খাবি আয়।"
" ব্যস, তাহলে আজ আমি পয়সা দিই।"
" না, আজ আমি বলেছি, আমি পয়সা দেবো। তুই অন্যদিন খাওয়াবি।"
" না না, তা হবে না, আমি দেবো।"
" তাহলে থাক,খেয়ে কাজ নেই। "
" ঠিক আছে নে, আজ তুই দিবি। আমারটা কিন্তু ডিউ রইল।"
" ওকে ম্যাডাম!"

গেট দিয়ে বেরিয়ে রাস্তায় নিমাইকাকুর সঙ্গে দেখা।মল্লিকা দেখেনি, নিমাইকাকুই পেছন থেকে তার নাম ধরে ডাকল। মল্লিকা বলল," কী ব্যাপার কাকু, তুমি এখানে?"
" হ্যাঁ, এই  ভাড়া নিয়ে এসেছিলাম। তোর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তা, তোর পড়াশোনা ঠিক ঠাক চলছে তো?"
" হ্যাঁ কাকু,সব ঠিক ঠাক। তোমার শরীর ভালো আছে?"
" গরিব মানুষের শরীর কখনো খারাপ থাকে রে মা? ওটাই তো আমাদের মূলধন। তুই তো সাইকেলে এসেছিস। নাহলে, আমার রিক্সাতে যেতিস। যেতে যেতে বাপ বেটিতে গল্পও হত।"
" না কাকু,আমাকে এখন পড়াতে যেতে হবে। একদিন এসো না আমাদের বাড়ি। বাবা দেখলে খুশি হবে।"
" ঠিক আছে, যাবো, যাবো। তুই তাহলে আয়।"
মল্লিকার সহপাঠিরা দেখছিল ব্যাপারটা। মুখ টিপে টিপে কেউ কেউ হাসছিল। একজন তো শুনতে পাওয়ার মত জোরেই বলল,' স্টেটাস '। মল্লিকা কথাটা না শোনার ভান করেই চলে গেল।

Post a Comment

0 Comments