জ্বলদর্চি

কবি ও কুঁড়িরা /পুলককান্তি কর

চিত্র- মণিদীপা দাস 

কবি ও কুঁড়িরা

পুলককান্তি কর 


বাড়ীর টবে আজ অনেক চন্দ্রমল্লিকা। সাদা হলুদ। ও ভাই মল্লিকা, আমার সকাল বেলার মল্লিকা্‌, তুই সতেজ থাকবি তো সারাদিন? মঞ্জরীর আসতে আসতে তো ছ’টা-সাতটা! এবেলা রোদ পোওয়া, দুপুর দুপুর তোকে নিয়ে যাবো হলুদ ফুলের বাড়ী। কোথায় রে সে?/ এইখানেতেই মঞ্জরিত পর্দাখানির পাশে/ রাখবো তোকে ঢেকে/ আসবে যখন মঞ্জরী আজ ক্লান্ত বিকেল হয়ে/ দেখবে তোকে চেয়ে/ তখন তার ওই দৃষ্টিসায়র শব্দে দেব পাড়ি/ কোথায় রে সে? নে আজ একটু বেশী করে জল দিলাম তোকে। কোথায় গেলি জুঁই? গন্ধ তোর আজ পাইনি কেন মোটে? কাল মাত্র চারটে গোলাপ ফুটেছিলি ? কেন তোরা এত ত্রাসে মরিস? অলি এখানে আসে না বলে? কী করবি বল! ফ্ল্যাটের মানুষ ভয় পায় ওদের। পাছে কামড়ে দেয়! বাগান বিলাস দাঁড়া। তোর লতাটা তুলে দিই পর্দার রড এ। বেশ খেলিয়ে যেতে পারবি ওদিকে। ওই হলুদ বাগান বিলাসটাতো তোর সাথে চু কিৎ কিৎ খেলবে বলে বসে আছে রে এতদিন! গোপাল কে এতদিন বললাম তোকে কঞ্চি দিয়ে উপরে তুলে দিতে, তা শুনলে তো আমার কথা! চিন্তা নেই। আপনা হাত, জগন্নাথ। আজ তোকে তুলে দেব ঠিক। হ্যাঁ বাবা জবা ! আমার তো মা কালী নেই। কার পায়ে তোকে দেব বল? তুই বরং গাছেই থাক। মঞ্জরী আবার ফুল তোলা সইতে পারে না। ও এতদিন তোকে দেখেনি। আজ এসে এমন চমকে যাবে, কী বলব ? জানিস তো, আজ একটা কবিতা লিখেছি তোকে নিয়ে।এটাই আজ ওকে পড়াব। দ্যাখ কেমন সুন্দর করে একটা কার্ড বানিয়ে তার মধ্যে লিখে রেখেছি! শুনবি? থাক্‌। প্রথমে মঞ্জরীকে শোনাবো। পরে তুই শুনিস। তোরা এখন এ বারান্দায় থাক। সূয্যি দাদা থাকবে এই বারান্দায় সাড়ে বারোটা অব্দি। আমি বরং দেখি, আলোর মা এলো নাকি! কই রে? তোরা কি কলিং বেল শুনেছিস? প্রায় দিনই ও চলে যায়; বলে নাকি আমি বেল শুনতে পাই না! আমি কি কালা? মঞ্জরী অবশ্য বলে, ‘আপনি ভীষণ অন্যমনস্ক, আনন্দ দা’। ও যখন বলছে, নিশ্চয় তাই হবে। ও তো আমার আয়না রে! জানিস তো বিদ্যাপতির পদটা? কতবার তো শুনিয়েছ তোদের! ‘হাথক দরপণ, মাথক চুল/ নয়নক অঞ্জন, মুখক তাম্বুল।‘ আমি এরকমই একটা পদ লিখেছি মঞ্জরীর জন্য, শুনবি? তুমি আমার ঝর্ণা নদী, আকাশ জোড়া ভুল/ তোমার হাতেই মক্‌শ শিখি, পথ চলি নির্ভুল/ তুমিই আমার মায়ার কাজল, তুমিই আমার আলো/ মুক্তি দেবে শব্দ আমায়, ছন্দে আজও কালও। দাঁড়া, দাঁড়া। আসি এবার। কলিং বেল সত্যি বেজেছে রে! তোদের সাথে কথা বললেই দেরী হয়! জানিস তো, পূর্ণেন্দু কী বলেছেন দেরী নিয়ে ? ‘শুনুন মশাই, আর কথা নয় বাড়ী/ আমাদের কথা দূরপাল্লার গাড়ী/ সমুদ্র ফেনা তট মুছে দিয়ে ছোটে/ কথা থেমে যাবে, শব্দ পরাও ঠোঁটে।‘ আরে বাবা, বড়ই অধৈর্য আলোর মা! দাঁড়াও দাঁড়াও, খুলছি!

  • কী ব্যাপার দাদা! আধঘণ্টা হল বেল বাজাচ্ছি। ঘুমোচ্ছিলেন নাকি?

  • না হে আলোর মা। গাছে জল দিচ্ছিলাম।

  • এই তো, এই বারান্দাতেই টব আপনার! শুনতে পাননি এতবার বেল?

  • খেয়াল করিনি গো!

  • আমি ফিরে গেলে আপনি খেতে পান না। আমারও খারাপ লাগে। কিন্তু দাদা, আমিও এ বেলায় তিনবাড়ী রান্না করি। আধঘণ্টা সময় যদি আমার দরজা খোলাতে যায়, আমি কাজ করি কখন বলুন তো?

  • তুমি এক কাজ কর অলোর মা! সব সেদ্ধ বসিয়ে দাও। আর ডাল। অন্য কিছু করতে হবে না। তোমার সময় নেই যখন!

  • সেদ্ধ যে বসাবো, আলু ফালু এনে রেখেছেন তো? আমি কালকেই বলে গেছিলাম – সব বাড়ন্ত!

  • এই যা! একেবারে ভুলে গেছি। তুমি আজ চলে যাও বরং আলোর মা! আমি বাজার টাজার করে না হয় সেদ্ধ ভাত বসিয়ে নেব।

  • আচ্ছা, সে না হয় নিন। আমি বাসন টাসন মেজে ডালটা বরং করে যাই। ডাল এখনো অনেকটাই আছে।

যাক, স্বস্তি পাওয়া গেল। আলোর মা বেরিয়ে গেলে একটু আলু পেঁয়াজ কিনে আনলে হবে। ইচ্ছে না হলে, ডাল দিয়ে মুড়ি খেয়ে নেব। হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই ভালো। কে আর এবেলা বেরোবে? এই ফাঁকে বরং আরও একটা-দুটো কিছু লিখে রাখব মঞ্জরীর জন্য। এবেলা যখন লেখা আসছে, লিখে রাখি সব! লিখে রাখি রাশি রাশি অশোকে পলাশে/ প্রজাপতি ওড়ে ঘাসে ঘাসে। যাঃ। রবি ঠাকুর রাগ করবেন। এ বাবা, আলোর মা আবার চেঁচায় কেন?

  • এই যে দাদা, আলু-পেঁয়াজ সব্জি সবই তো এনে রেখেছেন দেখছি! একটু আগে যে বললেন আনেন নি?

  • ভুলে গিয়েছিলাম গো।

  • একটা কথা বলব দাদা, আপনি বরং একটা কানের আর মনের ডাক্তার দেখিয়ে নিন।

বাঃ। ভালো বলেছে তো! কানের সাথেই তো মনের মিতালি! কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো/ আকূল করিল মন প্রাণ! ও বাঁশিতে ডাকে সে/ শুনেছি যে আজ মোর/ পরাণ কাড়িতে চায়/ সে রাখাল রাজ। বাঃ বাঃ!

  • দাদা, রাগ করলেন নাকি?

  • অ্যাঁ, কিছু বললে?

  • বলছি যে ছোটমুখে বড় কথা বললাম বলে কি রাগ করলেন ?

  • না না। ভালোই তো বললে! কান আর মন – এই তো?

  • কাল বাজার করে এনে আজই ভুলে গেছিলেন?

তাইতো ভাবছি। সত্যি, কাল কখন বাজার করলাম? মুখে একটা ‘হুঁ’ মেরে মুক্তি পেলাম বটে, তবে মনের খোঁচটা গেল না। ওঃ আবার মন? ভালো একটা লাইন এলো তো মাথায়!

মনে মনে কত হাত ছুঁয়ে থাকা শোকে

মনে মনে কত বৃষ্টি অঝোর ঝোর

মনে মনে কত আদর অসংকোচে

মনে মনে শুধু আমার, নয়তো তোর। বাঃ বাঃ, বেশ সুন্দর হলো তো! আলোর মা, তুমি ধন্য! কিন্তু সত্যি তো, আমি তো বহুদিন বাজারে গেছি বলে তো মনে পড়ে না! আলোর মা ও তো আমাকে বাজার আনতে বলে না! তবে বাজার আসে কোত্থেকে? ও! মঞ্জরী নিয়ে আসে রোজ? হ্যাঁ, তাইতো। ওর হাতে একটা বাজারের থলে থাকে তো রোজ! ছিঃ ছিঃ। কত টাকা মেয়েটা খরচা করছে এতদিন! ভদ্রতা করে একবার বলাও হয়নি ওকে। ছিঃ। সত্যি, একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে দেখাতে হবে মনে হচ্ছে! ওহো, আবার একটা চার লাইন আসছে যে!

মন, মন, তুমি যদি গ্রস্ত

🍂

 আছো রোগে।

শব্দ সব এরপর কোথায় দাঁড়াবে?

মন তুমি দ্বারী মাত্র! ভেতরে অধীশ

ইচ্ছেরা কোথায় এসে পরিত্রাণ পাবে?

দাঁড়াও, দাঁড়াও। শব্দেরা একটু দাঁড়াও। লিখে নিতে দাও। ততক্ষণ স্থির থাকো শব্দ ও অক্ষর/ কাগজে ছোঁয়াবো কালি মন/ ততোক্ষণ প্রাণে থাকো কবিতা ঈশ্বর/ আমাকে বাঁচাও অণুক্ষণ। ঠিক লিখলাম তো? না না, কবিতা ঈশ্বর না ঈশ্বরী? তিনি আমার মাতৃরূপা, ভতৃরূপা, কন্যারূপা। আমি তাঁর স্তন্য পান করি, তাঁকে রমন করি, তাঁকে স্নেহ করি। অবশ্য ঈশ্বর হলে, অক্ষরের কী হবে? ছন্দ মিলবে না তো! দাঁড়াও কলিরা! আগেরটা লিখে নিই, তারপর তোমাদেরটা ভাববো। আচ্ছা, ঈশ্বর তো উভলিঙ্গ? যাক্‌ বাবা, আর ভাবতে হবে না। তোমরা তো জানোই বাবা, আমি ভেবে চিন্তে লিখি না! যেমন লেখা আসে, তেমনি লিখি। কবিতারও নিশ্চয়ই ঈশ্বর রূপই পছন্দ। নইলে এমনটা মনে হল কেন?


  • দাদা, আপনি চানটান করে নেন না! আমার ঘর মোছা হয়ে গেছে। আমি আর বাথরুমে যাবো না। সেদ্ধভাত হয়ে গেলে গরম গরম খেয়ে নিতেন।

  • ও আমি নেবো’খন। তুমি যাও।

  • খেয়ে নেবেন মনে করে। ভুলে যাবেন না।

  • না না, ভুলবো কেন? ভুল যদি পরিত্রান/ ভুল তবে আকাশের কুয়াশা কোরক/ মোহ যদি পরিধান/ শব্দ চোখের জলে আরো স্থায়ী হোক।

  • কিছু বললেন দাদা?

  • না, না। কাল আসবে তো?

  • হ্যাঁ। সাড়ে ন’টাতেই আসবো। মনে করে দরজাটা খুলবেন! বাড়ীতে ডিম আরও ক’খানা আছে। আপনি কি আনবেন? নাকি আমি নিয়ে আসবো?

  • আনবে? আচ্ছা, নিয়ে এসো। টাকা নিয়ে যাও। ঘরে চা-চিনি সব আছে তো? আমি বেশ সংসারী হয়ে উঠলাম মনে মনে।

  • হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওতে আপনার ভুল হয় না। সব সময়েই ভরা থাকে দেখি। সারাদিন ক’কাপ চা খান দাদা?

সত্যি কতবার চা খাই আমি দিনে? মনে মনে ভাবতে বসলাম। মুখে বললাম, ‘দু-তিনবার’। সকালে একবার আলোর মা’ই করে দেয়। মঞ্জরী এলে দুবার করে। এসেই একবার, যাবার আগে একবার। মাঝে কি আমি করে খাই?

  • দরজাটা লাগিয়ে দেন দাদা। টাকাটা তো দিলেন না?

  • ও হ্যাঁ। কিসের টাকা বলো তো? মাসের টাকা?

  • সে তো দিয়ে দিয়েছেন। ডিম আনতে টাকা দেবেন বললেন না?

  • হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিয়ে যাও।

  • পাঁচশো টাকার নোট দিচ্ছেন কেন? পাঁচটা ডিমে এত বড় টাকার খুচরো দেবে না!

  • কত দেব তবে?

  • আপনি কেনেন জানেন না?

  • আরে বাপু বলোই না!

  • ত্রিশটা টাকা দেন।

  • আচ্ছা নিয়ে যাও। এসো কাল, সময় মতো। ‘এসো বকুল বিছানো পথে/ এসো নির্মল রথ রথে’ – কোন কবিতায় যেন এটা? আজকাল ভারি ভুল হয়ে যাচ্ছে হে আনন্দ। বয়স পঞ্চাশ ছুঁলো যে! গ্রে ম্যাটার ক্ষয়ে যাচ্ছে বুঝি! বয়স বাড়ছে বয়সের মতো, আমরা তো দিনে বাঁচি/ ঝর্ণা নিয়েছে নদীর ছন্দ …. কে আবার এ সময়ে বেল বাজালো? দিলো তো ছন্দের বারোটা বাজিয়ে! ও মা! মঞ্জরী! তোমার এমন অকালে বোধন কেন? ঠিকমতো দেখি একটা বাজেনি এখনো!

  • আজ অফিস বেরিয়েছিলাম। মাঝপথে গিয়ে যেতে ইচ্ছে করলো না। ভাবলাম, আপনার উপন্যাসটা যতটা অব্দি লিখেছেন – কাল পড়া হয়ে উঠলো না। তাই অসময়ে চলে এলাম। অসুবিধা হল কি আপনার?

  • অসুবিধা? তোমাকে তো সূর্যাস্তেই চিনি/যখন গোধূলি/ রাঙা করে মেঘ, তুমি এসে/ রাঙা করো আমার জীবন/ সন্ধ্যা নয় – তুমি এলেই সব কিছু ভোর, সব ভোর  …. / যেটুকু সময় থাকো, সেটুকুই আমার অঝোর!

  • খুব সুন্দর! কবে লিখলেন?

  • আমার না। জয়দা’র। জয় গোস্বামী।

  • আগে পড়িনি তো!

  • দেশে বেরিয়েছিল। তাও হয়ে গেল বেশ কয়েক বছর। তোমায় শোনাইনি?

  • শুনিয়েছেন নিশ্চই, এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।

  • ওই যে কাঁচা কবিতার গুচ্ছ!

  • ওঃ হো! মনে পড়েছে। আপনি শুনিয়েছিলেন একদিন।

  • নামেই কাঁচা। জানো মঞ্জরী, জয়দা এমন কবিতা লিখে বাংলা কবিতার একেবারে দিশা বদলে দিয়েছেন। এমন বিষয় নিয়ে যে কবিতা লেখা যায়, সে সাহস বহু অনামা কবিদের আগে ছিল না। আমিও অনেক কাঁচা লিখে ফেলেছি এই ঝটকায়!

  • তাই নাকি? একটা শোনান না!

  • যেমন ধরো গত সপ্তাহে শুক্রবার দিন তুমি আসো নি। সেদিনই লিখেছি এটা –

এসো। না এলে আমার মন খারাপ হয়

জানোই তো, তখন আর চিনি না নিজেকে

কী করবে? 

ভাগ্য বলে মেনে নাও একে !

  • এ রকম আরো কত কবিতা আছে, আমি পড়িনি?

  • ভালোই তো। কী হবে ওসব পুরোনো কবিতা শুনে?/নতুন কবিতা গুচ্ছ শোনাতে পারি/ প্রতি চুম্বনে কালিদাস ভবভূতি/ করে দাও যদি কিংবা কৃত্তিবাস/ কবিতা গুচ্ছ, নতূন ছবির ফ্রেম/ কবিতা গুচ্ছ, শৃঙ্খলে ঝঙ্কার/ কবিতা গুচ্ছ, ঘাস ও ফড়িং এ প্রেম/ কবিতা গুচ্ছ, তোমাকে আবিস্কার।

  • এটা আমার পড়া। পূর্ণেন্দু পত্রী’র কথোপকথন।

  • হ্যাঁ। চার নম্বরে আছে।

  • এই লাইনটা ভারী সুন্দর! কবিতা গুচ্ছ, তোমাকে আবিস্কার।

  • হ্যাঁ। কবিতা তো একপ্রকার তোমাকে আবিস্কারই। মঞ্জরী, আমি সব কবিতাতেই তো তোমাকেই আবিস্কার করি! খুশী হও? খুশী হও কি কখনও/ নিজেকে খুঁজতে পেরে শব্দে অক্ষরে?/ কবি খ্যাতিমান নয়/ কবিতাও সেরকমই/ হয়তো ছাপাই হবে না কখনও/ শুধু পাণ্ডুলিপি রয়ে যাবে উত্তরে উত্তরে….

  • খুব সুন্দর এটা। লিখে রাখুন। নইলে ভুলে যাবেন।

  • তুমি কি সত্যি খুশী হও মঞ্জরী, নিজেকে খুঁজতে পেরে শব্দে অক্ষরে? খ্যাতিহীন কবির জন্য কেন সময় নষ্ট করো?

  • সময় নষ্ট হয় আপনি কী করে বুঝলেন?

  • নষ্ট নয় তো কী? তোমার এই বয়স কি একজন প্রৌঢ়কে দেবার?

  • কাকে দিতাম?

  • তোমার বয়সী কাউকে!

  • কী হতো তাতে?

  • তোমার একটা ঘর হোতো, সংসার হোতো। একটা নিশ্চিন্ত জীবন হোতো!

  • এখানে অনিশ্চিৎ কী?

কী করে বোঝাবো ? আমি কি ছাই নিজে জানি?

  • কী হলো? কিছু বললেন না তো?

  • কী নিয়ে?

  • ওই যে, নিশ্চিৎ-অনিশ্চিৎ জীবন...

  • কার?

  • আপনি কোথায় চলে গেছিলেন মনে মনে?

  • মনে মনে সহস্রার টান বুঝি ছিঁড়ে দেয় আনন্দ ভৈরব/ দুঃখ দ্বেষ জরাগতি কাল বড় নিরুপায়, সঙ্গহীন শব।

  • মানে?

  • মণ্ডক উপনিষদ পড়েছ?

  • না।

  • তাহলে আজ থাক, অন্যদিন বলবো।

  • আপনার চান হয়েছে?

  • না।

  • করে আসুন। আমি বরং দেখি আপনার কী খাবার বানিয়েছে।

  • সেদ্ধভাত।

  • রোজ রোজ কী সেদ্ধভাত খান? দাঁড়ান! ফ্রীজে মাছ-টাছ আছে? অবশ্য থাকবেই বা কী করে? যান, আপনি চানে যান। আমি বরং একটু ডিমের ঝোল বানিয়ে দিই।

  • তুমি খাবে তো?

  • আমি তো খেয়েই বেরিয়েছি।

  • তা হোক। আহার পার্বণ হবে তুমি সাথে খেলে/ ডাল ভাত ও তুমিময়, অমৃতে কি মেলে?

  • আচ্ছা বেশ! যান, চান করে আসুন।

  • আজ চান করবো না।

  • কেন? গরম লাগবে তো!

  • এটুকু সময় নষ্ট করতে চাই না। আমি দেখবো তোমায় রান্নাঘরে পাচক বেশে কেমন লাগে/ আগুন ঘামে জর্জরিত চশমা খোঁপা কেমন সাজে!

  • বেশ তো! চান করেই আসুন। তারপরেই না হয় রান্না চাপাবো।

  • সেই ভালো।

যা বাবা। রবি ঠাকুর, তুমি আবার কেন এলে? ‘মোর বসন্তে লেগেছে তো সুর – বেণু বন ছায়া হয়েছে মধুর/ থাক না এমনি গন্ধে-বিধুর মিলন কুঞ্জ সাজানো/ সেই ভালো, সেই ভালো ...

  • কী হলো ? কী বিড়বিড় করছেন?

  • না না, এই যাচ্ছি। যাচ্ছি বটে জল ঢালতে/ শাওয়ার জলে চান/ চান তো আমার হয়েই ছিল/ কৃষ্ণসায়র চোখে/ ঝর্ণা যেটি শান্ত ছিল/ হঠাৎ এলো বান/ হড়কা টানে ডুবরী ভাসে/ স্পর্শ জ্বালাও শোকে

  • এর মধ্যে চান হয়ে গেল?

  • হ্যাঁ। আবার কতক্ষণ করবো?

  • গায়ে সাবান-টাবান কিছু দিয়েছেন? মাথায় শ্যাম্পু?

  • আমি কি নোংরা থাকি মঞ্জরী?

  • তা কেন? আপনি কবি মানুষ। আপনার তো মন জুড়ে আলো! তবে কিনা শরীর তো এসব শোনে না! ভালো করে সাবান ঘষে ঘষে চান না করলে স্কিন ডিজিজ হবে, মাথায় খুস্কি হবে।

  • এতদিন হয়নি তো!

  • হয়নি বলে হবে না, এমন তো নয়! চলুন, আপনাকে চান করিয়ে দিই। ছোবড়া আছে?

  • জানি না।

  • আচ্ছা, আমি কাল নিয়ে আসবো’খন। চলুন ভালো করে পিঠে মাথায় সাবান দিয়ে দিই।

মনে মনে লজ্জা পেলাম। লজ্জাই তো কামনা ঢেকে রাখে মানুষের! সে দ্বার আর খুলে লাভ কী? মুখে বললাম, ‘থাক না মঞ্জরী! ও আমি নিজেই করে নিতে পারবো।

  • তাহলে যান। করুন।

  • আজ না মঞ্জরী। কাল করবো। চলো, তোমার রান্না দেখি।

  • একটা বিয়ে করে নিলেই তো পারতেন আনন্দদা! রোজ রোজ বৌদিকে এভাবে দেখতে পেতেন!

  • জয়দা এই নিয়ে একটা কাঁচা লিখেছেন শুনবে?

  • বলুন না!

  • মনে মনে সংসার করেছি। মনে মনে

কফি করে এনেছি দুকাপ।

মনে মনে এক টেবিলে খেতে বসে হাতা দিয়ে ভাত

এগিয়েছি তোমার থালায়…

সমস্তই মনে মনে, তাই

সংসার করেছি শুধু

- দগ্ধ হইনি সংসার জ্বালায়

        - আগুন ছুঁলে একটু আধটু ছ্যাঁকা তো লাগেই আনন্দদা। সংসার চাইলে সংসার জ্বালা তো মানতেই হবে!

        - আমি তো তাই চাইনি কখনও।

        - তাহলে আমাকে এতক্ষণ সংসার করার পরামর্শ দিচ্ছিলেন কেন? মেয়ে বলে?

        - তুমি ও কি মনে মনেই চাও ঘরগেরস্তি?

একটু দীর্ঘ শ্বাস ফেলল মঞ্জরী। কিছুক্ষণের মধ্যে রান্নাবাড়ী শেষ করে বললো, ‘চলুন। মনে মনে নয়, সত্যি সত্যি এক টেবিলে বসে খাব আমরা।

  • চলো।

অল্প আয়োজন। তবু সব স্বল্পতাকে যেন যত্ন দিয়ে ভরিয়ে দিল মঞ্জরী। বললাম, ‘পল্লীসমাজ পড়েছ?’

  • হ্যাঁ।

  • তারকেশ্বরে রমার বাড়ীতে রমেশকে খাওয়ানোর কথাটা মনে পড়ছে?

  • একটু একটু। আপনি বলুন যেটা বলতে চাইছিলেন।

  • রমার সাথে রমেশের বিয়ের ঠিক ছিল, তা তো জানোই। যাইহোক, নানান কারনে তা হয় নি। রমার অন্যত্র বিয়ে হয় এবং অল্প দিন পরে সে বিধবা ও হয়ে যায়। তখন থেকে রমা রমেশের সামনে কখনো আসতো না। অথচ তারকেশ্বরে রমেশ কে হঠাৎ করে দেখতে পেয়ে রমা যখন ওকে খেতে নেমন্তন্ন করে বসল, তখন আহার্যের স্বল্পতা ঢাকতে রমার সামনে এসে বসা ছাড়া আর অন্য কোনও উপায় রইল না। সে যেন সব  ত্রটি কেবল যত্ন দিয়েই পূর্ণ করতে চায়!

  • আমি তো আপনার সামনে পূর্ণ প্রকটিত। এই প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বললেন কেন?

  • এটা গৌরচন্দ্রিকা, আসল কথাটা তো বলিনি।

  • কী সেটা?

  • দাঁড়াও। ওটা শরৎবাবুকেই বলতে দাও। ওনাকে আলমারি থেকে বরং বার করি। শোনো, উনি রমেশের মুখ দিয়ে কি বলছেন! ‘আমার সমস্ত জীবনটি যেন তুমি এই একটি বেলার মধ্যে আগাগোড়া বদলে দিয়েছ। এমন করে কেউ আমাকে কখনো খেতে বলেনি, এত যত্ন করে আমাকে কেউ কোন দিন খাওয়ায় নি। খাওয়ার মধ্যে যে এত আনন্দ আছে, আজ তোমার কাছ থেকে প্রথম জানলাম রমা।‘


বেশ বুঝতে পারলাম, রমার মতো মঞ্জরীও একবুক পরিতৃপ্তির শ্বাস নিল এই কথায়। বললাম, ‘রমা ঘোষের ‘’গোপন বিবাহ’ কবিতাটা পড়েছ?’

  • মনে পড়ছে না। পড়িনি বোধহয়! আপনি বলুন।

  • মোটা ভাত, লাল শাক দিলাম আমার অন্ন দুঃখের হাঁড়ির/ আহার পার্বণ হলো কি ভাবে যে তুমিই তা জানো!/ কাকে বলি, কাছেপিঠে কেউ নেই, রাত্তিরকে ডেকে/ বললাম, জানো নিশা, ও আমাকে দিয়েছে সিঁদুর।

  • এই সিঁদুর দেওয়াটা ও কি মনে মনে, আনন্দদা?

  • ভালো বলেছ তো! এভাবে তো ভাবিনি আগে! এভাবে ভাবলেও বেশ হয়! তবে সাক্ষীহীন সিঁদুর দান ও হতে পারে ওখানে। মঞ্জরী, আমি বেনারস থেকে যে পান-মশলা এনেছিলাম, তুমি কি তুলে রেখেছ কোথাও?

  • কবে বেনারস গিয়েছিলেন মনে আছে?

  • কতদিন হবে? মাস কয়েক?

  • দেড় বছর হয়ে গেল আনন্দদা। আপনি খান না বলে, কবেই ফেলে দিয়েছি। তা পান মশলা নিয়ে কী করবেন?

  • না মানে আজ এত ভারী খাওয়া হল তো! মুখশুদ্ধি হোতো বেশ!

  • ডালসেদ্ধ ডিমের ঝোলে ভারী খাওয়া হয়ে গেল আপনার?

  • আসলে তৃপ্তিটাই তো বৃংহণ!

  • আমার কাছে ভাজা জোয়ান আছে, খাবেন?

‘কে আছো জোয়ান, হও আগুয়ান’ বলে হাত বাড়ালাম আমি।

  • কোন কবিতাকে কোথায় লাগান আনন্দদা! হাসতে লাগল মঞ্জরী। ঝকঝকে মুক্তোর মত দাঁত। কতদিন এমন করে হাসো না/ শুধু হাসি, হাসি আর হাসি/ পাহাড়ী নদীর মতো তারা উচ্ছল/ চলার স্রোতে যেতে যেতে ভেঙে দেয় শব্দ/ ডাঙা, খড়কুটো/ এমনকি কবির মনখারাপ/ ভুলিয়ে দেয় চুপিসারে গভীর সময়/ সময়ের নীচে জমে থাকে বড় ছোট নুড়ি .../ সময় তো নয়, হাসির পরত দিয়ে বয়ে যায় জল/ আর জলের ভেতর সাত সতেরো কুঁড়ি....

  • কী ভাবছেন আনন্দদা?

  • তোমার হাসি। বহুদিন এমন করে হাসো না। সেই প্রথম যখন দেখা হল, খুব উচ্ছল ছিলে তুমি।

  • এখনও তাই আছি আনন্দদা।

  • না হে! মনের কারবারি আমি। ‘বিষাদ ছুঁয়েছে তোকে, বড় অসময়!’

  • দেখতে দেখতে তিন বছর হয়ে গেল!

  • কিসের?

  • আপনার সাথে দেখা হওয়ার।

  • তিইইন বছর! ‘একদিন দেখা দৈববশে/ তারপর আজও কার দোষে/ বহাল রইল সেই দেখাশোনা?/ তোমার না আমার?/ কার গুণে?/ এতই আনন্দ আছে অফুরন্ত তোমার আগুনে?’ দ্যাখো মঞ্জরী, তোমার গুণ নাকি আমার গুণ –এই নিয়ে যতই জয় দা প্রশ্ন তুলুন না কেন, আমি জানি, আমাদের সম্পর্কে সবটাই তোমারই গুণ। ভাগ্যিস তুমি আসো মঞ্জরী! তুমি এলে ফুল ফোটে/ জ্যোৎস্নার গন্ধ আসে আঁচল উজানে/ তুমি এলে ভোর হয়/ শব্দ ছুটে যায় শুধু তোমার সন্ধানে।

  • সত্যি কি আমার সন্ধানে শব্দ ছোটে আপনার?

  • কেন, বোঝ না তুমি?

  • ফুল দেখাবেন বলেছিলেন আজ।

  • ওরাই দেখা দিত। তুমি আগাম এলে, তাই প্রস্তুতিতে ঘাটতি হল মেলা।

  • চলুন না, আমিই যাই ওদের দেখতে।

  • না গো, লজ্জা পাবে ওরা।

  • তাহলে আপনার উপন্যাসটা দিন, পড়ি।

  • পড়ো আরেকদিন। এখন বরং ইচ্ছে আমার সামনে তোমার বসে/ আঙুল নিয়ে খেলি/ সম্মতি দাও শব্দেরা সব ঝর্ণা নদীর স্রোতে/ করছে জলকেলি…

  • হঠাৎ এমন ইচ্ছে? মন ভালো নেই?

  • আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, আজ তোমার কিছু হয়েছে মঞ্জরী! তুমি বলবে কিছু আমায়?

  • না না, সেরকম কিছু বলার নেই আমার।

  • তবে? মা’র সাথে ঝগড়া করেছ?

  • ও তো লেগেই আছে আনন্দদা।

  • ওনার আর দোষ কী বলো? এই বয়সের মেয়ে অবিবাহিতা থাকলে মায়েদের তো চিন্তা হয়ই। তাঁরা তো সাহস করে মরতে ও পারবেন না এই চিন্তায়!

  • আগেকার মতো কি দিন আছে আনন্দদা? এখন তো কত মেয়ে বিয়ে না করে সারা জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে। আমি সরকারী চাকরী করি। টাকারও সমস্যা নেই। সারাক্ষণ এই নিয়ে কিচকিচ করার কি আছে বলুন তো? তাছাড়া একটা কথা যখন আমি পরিস্কার করে জানিয়ে দিয়েছি, রোজ রোজ একই কথা ঘেংটি পাড়ার তো মানে হয় না!

  • তা ঠিক। তবে মায়েরা ওসব নিয়ে ভাবেন না। তুমি যতই রাগ করো, ওনারা গায়েই মাখেন না। যদি গায়ে মাখতেন, তবে হয়তো একই কথা বারবার বলতেন না।

  • উনি হয়তো গায়ে মাখেন না, কিন্তু আমি তো স্ট্রেস্‌ড হয়ে যাচ্ছি। আগে আপনার এখান থেকে গিয়ে চান-টান করে কোনও বই-টই নিয়ে বসতাম। আজকাল একটা লাইন ও পড়তে ইচ্ছে করে না।

এই জন্যই তোমার মন ভালো নেই মঞ্জরী? কী করি? তোমার মন ভালো করি কী করে? আমার তো শুধু শব্দ আছে। দাঁড়াও দেখি মন ভালো করার কবিতা মনে পড়ে কি না! এ মা, এমন কিছু একটাও লিখেনি আমি? ‘যবে থেকে আমি হৃদয় দিয়েছি তোকে/ বিষাদ প্রাচীরে দুঃখ ছুঁয়েছি রোজই।/ কপট খেলায় পণ সেজে থাকা ঝোঁকে/ বেঁচে আছি কিনা রাখি না নিজের খোঁজই। ‘কতখানি শ্রাবণ আজ তোমার মনে! রোদ্দুর কোথা থেকে এনে দেব মঞ্জরী? তার চেয়ে বরং শ্রাবণ মেঘের দুয়ারে দিই ঘা! ‘শ্রাবণ মেঘের দুয়ার খুলে বাইরে আসো যদি/ তোমার সাথে বৃষ্টিধারায় ভিজবো নিরবধি।‘ মাথা নীচু করে কেন বসে আছো মঞ্জরী? তোমায় এমনটা দেখতে একটুও ভালো লাগে না আমার! তোমার এলোচুল কেমন করে তোমার বুকে লুটিয়ে পড়েছে – যেন কোনও সহায় নেই তার! যেন ছায়াপথে হারিয়ে গেছে কোনও তারা! চশমাটা মুছে নাও গো! কেমন বাষ্প বাষ্প হয়ে গেছে ওটা! অমন দীঘল চোখ ডুবে যায় যে ওতে! 

  • কী ভাবছেন আনন্দদা?

  • কী ভাবছি বলো তো? ও হ্যাঁ, তোমার চোখ।

  • চোখে আবার কী হলো? আমার মা’কে নিয়ে কথা হচ্ছিল।

  • হ্যাঁ হ্যাঁ। জানো মঞ্জরী, মা’রা সব এরকমই। আমার মা ও যখন বেঁচে ছিল, আমার বিয়ে নিয়ে পাগল ছিল। কতবার রাগ করে আমার সাথে কথা বন্ধ হয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। তখন আমি দিল্লিতে চাকরী করতাম জানো তো?

  • কবে?

  • ওই বছর কুড়ি আগে।

  • বলেন নি তো কখনও।

  • আসলে প্রসঙ্গ আসে নি বলেই বলি নি।

  • বা রে! আমি আপনাকে কতবার জিজ্ঞাসা করেছি –আপনি পড়াশুনো ছেড়ে কী করতেন, কবে থেকে লেখা শুরু করলেন –এ রকম কতকথা! আপনি কলকাতায় আ্যড-এজেন্সিতে চাকরীর কথা বলেছেন, দু একটা বেসরকারী চাকরীর কথাও বলেছেন, দিল্লির কথা তো বলেন নি কখনও।

  • আসলে তুমি যখন থাকো, এসব কথা অকিঞ্চিৎকর মনে হয় মঞ্জরী।

  • হলই বা! তা বলে জানবো না? আচ্ছা বলুন দিল্লিতে কী চাকরী করতেন?

  • কী যে করতাম, বুঝি না গো! ভুলে গেছি। কী যেন সব করতে হতো, লিখতে হতো।

  • আচ্ছা, আপনি যা বলছিলেন, বলুন।

  • কী প্রসঙ্গে বলছিলাম যেন?

  • ওই যে, মাসিমা ফোন করতেন।

  • ওঃ। জানো তো, ফোন করলেই খালি বাড়ী আয়, বিয়ে কর! আমি কিছু বললেই কান্নাকাটি শুরু হতো। মাঝে তো বাড়ীতে ফোন করাটাই একটা স্ট্রেসের ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল। জানো মঞ্জরী, এখন বুঝি, মা তো জানতেন, ছেলে বাউণ্ডলে। তাই একটা শক্ত নোংর বেঁধে দিতে ভারী আগ্রহ ছিল তাঁর।

  • সে আগ্রহ পূর্ণ হলো না কেন?

  • আমি দিল্লিতে থাকতে থাকতেই মা’র সেরিব্রাল হলো। কথা বন্ধ হয়ে গেল চিরতরে। আমি দিল্লি ছেড়ে কলকাতায় চলে এলাম পাকাপাকি। ওই যে উল্টোদিকের ফ্ল্যাটটা দেখছ, আমাদের দোতলা বাড়ীর ওইখানটাতেই মা’র ঘরটা ছিল। একটা মাধবীলতা উঠে এসে ওই ঘরটার সামনের বারান্দায় লতিয়ে মায়ের জানালায় উঁকি মারতো মাঝে মাঝে। মা প্রায়ই ওই মাধবীলতার দিকে উদাস হয়ে চেয়ে থাকতেন। মায়ের এক বান্ধবী ছিলেন। ওঁর মেয়ের নাম ছিল মাধবী। মায়ের খুব ইচ্ছে ছিল, আমি যেন মাধবীকে বিবাহ করি।

  • করলেন না কেন?

  • আমি তো শব্দদের নিয়ে থাকি। ওরা তো থিতু থাকে না। উড়ে উড়ে বেড়ায় মাঠে, গাছে, তারায়। শেকল পায়ে তাদের ধরবো কী করে?

  • কবি সাহিত্যিকরা কি বিয়ে করেন না?

  • তাঁরা মহাপুরুষ গো! শিকল পায়ে নিয়ে যারা উড়তে পারে, তারাই তো প্রকৃত পাখি!

  • বিয়ে করলে তবেই না সেই অনুশীলন চালানো যায়!

  • তাতে অবশ্য তোমার লাভ হতো মঞ্জরী। এমন যৌবনে এক প্রৌঢ়ের তত্ত্বতালাশ করতে তাহলে আর তোমাকে আসতে হতো না এতখানি উজিয়ে।

  • আমার লাভক্ষতি নিয়ে আপনাকে আর মাথা ঘামাতে হবে না আনন্দদা। এমনি অনেক শব্দে গিজগিজ করছে আপনার মাথা, সেখানে আর আন্দোলন বাড়িয়ে লাভ নেই!

  • মঞ্জরী আন্দোলিত হলেই তো সম্ভাবনা জাগে!

  • তারপর কী হলো বলুন।

  • কিসের?

  • মাধবীর?

  • সেই মাধবীলতা যেদিন কাটা পড়লো, মাধবীর নামও আর রইলো না ঘরে।

  • মানে?

  • জানোই তো আমার মা ডিভোর্সি ছিলেন।

  • তাই নাকি? জানতাম না তো!

  • আচ্ছা, পরে বলবো কখনও। তা আমি যখন দিল্লিতে ছিলাম, মা আমাদের পাড়ারই এক প্রোমোটারের সাথে কথা বলে রেখেছিলেন। মায়ের মৃত্যুর পরে ওই দোতলা বাড়ী, সাথে পাঁচ কাঠা জায়গায় ফ্ল্যাট হবে। এই যে ফ্ল্যাটটায় আমি আছি এইটা আর নগদ অনেক লক্ষ টাকা আমার নামে ব্যাঙ্কে জমা করার ব্যবস্থা করে মা বিদায় নিলেন বছর দুই পরে। তখন মায়ের সেবা করার অছিলায় আমি আর কোনও কাজকর্ম খুঁজি নি। মায়ের মৃত্যুর পরে প্রয়োজনও কমলো, তাছাড়া, মাসিক ইনকাম স্কীমে অনেকগুলো টাকাও আমার ব্যাঙ্কে জমা হতে লাগলো –ফলে খাই দাই গান গাই তাইরে নাইরে না।

  • টাকা পয়সার ঠিকঠাক হিসাব রাখেন তো আনন্দদা ?

  • ও আর আমি কী রাখবো? ব্যাঙ্কের লোকেরা এসব বিষয়ে পড়াশুনো করে ট্রেনিং পাওয়া। ওরা সব ঠিকঠাক দেখেশুনেই রাখবে।

  • মাসের টাকা আপনার কে তোলে? আপনি নিজে যান ?

  • মাঝে মাঝে যাই। গোপালও তুলে দেয় মাঝে মাঝে।

  • কিভাবে দেয়? এ. টি.এম কার্ড দিয়ে দেন নাকি ?

  • দিতে আপত্তি ছিল না। তবে কিনা ও এ. টি.এম কার্ড চালাতে জানে না।

  • তাও বাবা রক্ষা! একটু নিজেও তো বেরোতে পারেন? প্রকৃতির রোদ-হাওয়া ও তো লাগবে তাতে !

  • ‘তোমার গা ছুঁয়ে রৌদ্র বলি/ তোমার গা ছুঁয়ে জল

তোমার স্পর্শে আমি প্রকৃতি পেয়েছি অবিরল।‘ কার লেখা বলো তো?

  • আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, জয় গোস্বামী।

  • ঠিক বলেছো। এখন আমায় জয়দা’য় পেয়েছে।

  • আর আপনার বাবা?

  • দোহাই মঞ্জরী! এখন শুধু তোমাকে নিয়ে কথা বলবো। বাবা-টাবা নয়!

  • স্যরি! আসলে প্রসঙ্গ এলো বলে জিজ্ঞাসা করলাম।

  • এতে স্যরি বলার কিছু নেই মঞ্জরী। এ কৌতুহল স্বাভাবিক। অনাবশ্যক ও নয়। আমি মায়ের ডিভোর্সি হওয়ার কথা বলবো বলেছিলাম, বাবার কথা নয়।

  • কেন? বাবার উপর রাগ?

  • না না। একেবারেই না। দ্যাখো আমি ওনার নাম জানি বটে, তবে চিনি না। উনি কি পরিস্থিতিতে মা’কে বা মা কি পরিস্থিতিতে বাবাকে ত্যাগ করেছিলেন তা আমার  অজানা। যখন ব্যাপারটা ঘটেছিল, আমি তখন ছয় কি সাত। আবছা কিছু আগে মাথায় ভাসতো বটে, এখন আর কোনও স্মৃতি নেই। মা ও বলতেন না, আমিও জিজ্ঞাসা করতাম না।

  • আর মাধবী?

  • মাধবী মধুপে হল মিতালি, নিশ্চই হয়ে গেছে মধু গিতালী।

  • কেন, আপনি কোনও খোঁজ নেন নি?

  • অকারণ কেন খোঁজ নেব মঞ্জরী ? আগেই যার খোঁজ নিই নি, পরেই বা নেব কেন ?

  • মানুষের তো মন বদলায় !

  • মন বদলের তো কোনও কারণ থাকা দরকার !

  • এই মা মারা গেলেন। শূন্যতা, মাতৃ-বাক্য পালন –সব মিলিয়ে আর কী!

  • হ্যাঁ। একেবারে মেলোড্রামাটিক।

রবি বাবু, তুমি আবার কী খোঁচা দিচ্ছ? কোনটা? ‘সে ঢেউ এর মতন ভেসে গেছে, চাঁদের আলোর দেশে গেছে/ যেখান দিয়ে হেসে গেছে, হাসি তার রেখে গেছে রে’। দূর, আমিই বা আপন মনে কবে কুসুম বনে বসেছিলাম? এটা না। বরং ‘অনেক কথা বলেছিলেম কবে তোমার কানে কানে/ কত নিশীথ অন্ধকারে, কত গোপন গানে গানে’ –এইটা বেশ! এটা চলতে পারে!  তবে থামো এখন ! সময় নেই ভাবার। দেখছো না, মঞ্জরীর সাথে কথা বলছি! ‘হ্যাঁ মঞ্জরী, কী যেন বলছিলে?’

  • কাকে পাশ কাটিয়ে এলেন?

  • ও কিছু না। তুমি বলো।

  • আপনার কত কথা জানি না, অথচ মন ভাবে সব জানি।

  • জেনে আর কী করবে?

  • আরও ভালো করে আপনার লেখাকে বুঝবো।

  • আমাকে জানার সাথে লেখার কী সম্পর্ক? ওরা আলাদা লোক, আলাদা তাদের স্বভাব – গোত্র – জাতি!

  • তবু! আপনার চোখ দিয়ে যদি বুঝতে পারতাম! চিনতে পারতাম ওদের!

  • নিজের চোখ দিয়ে চেনাটাই তো সবথেকে শ্রেয়, মঞ্জরী! অন্যের চোখে দেখলে আবরণ পড়ে।

  • তা ঠিক! তবে আপনাকে বুঝতে ইচ্ছে হয় খুব!

  • এতখানি আমি মহার্ঘ্য বুঝি? এতটা মূল্য দিও না কো সখী, কুটিরে শব্দ চষি/ চেয়ে ফেলি যদি তোমার হৃদয়, করো নাকো মিছে দোষী!

  • চেয়ে তো দেখতেন একবার!


কী করে চাইবো তোমায় মঞ্জরী? আমি তো জানি তোমার মন!

‘তুমি কবিতা ভালোবাসো

কোনওমতে কবিকে বাসো না।

অথচ ওই লোকটি প্রতিদিন শব্দ পরায় তোমার পায়ের গোছে

বর্ণমালা দিয়ে গড়ে তোমার নেলপালিশ

ছন্দ দিয়ে বাঁধে তোমার চলা,কথা বলা

তোমার বুকের তিলটকে দেয় উড়ে যাওয়ার আনন্দ

কবি জানে, তার শব্দে তুমি গড়ে ওঠো

    তার হাতে কখনও বাজো না...

কী করে তোমায় চাইবো, মঞ্জরী? চাইতে গেলে অনেক জোর লাগে যে! সব থেকে বড় জোর যে বয়সের! ‘কেন যে প্রৌঢ় হলো বেলা/ ভারী হলো আরও মোহভার/ চোখের কাজলে লিখে দিলে/ পাল্কিতে নেই যে কাহার! - ‘কোথায় যাচ্ছো, মঞ্জরী?’

  • একটু চা করে আনি। খাবেন তো?

  • চা এ না বলেছি কবে?

  • সেই ভরসাতেই যাচ্ছি। দেখালেন না তো কি লিখেছেন  আজকে?

  • চা নিয়ে এসো। খেতে খেতে শোনাবো।

কোন লেখাটা শোনাবো তোমায় মঞ্জরী? এইটা? না না, মন ভালো নেই তোমার! এটা পড়লে আরও বিষন্ন হবে তুমি! চার লাইন গুলো? অনেক আমি ওতে! নাকি বড় দেখে এইটা, কাল রাতে যেটা লিখেছি?

  • লেখা দেখাবেন, এটা নিয়ে এত কী  ভাবার আছে আনন্দদা?

  • কোন লেখাটা তোমায় শোনাবো, ধন্দে পড়ে গেছি যে!

  • ধন্দের কী হলো? সবগুলোই শোনাবেন! আমার বেলায় আপনার এত র‍্যাশনিং কেন?

  • তা নয়। কোনটা প্রাসঙ্গিক হবে, তাই ভাবছি। আর তাছাড়া সব লেখা তো আর কবিতা হয়ে ওঠে না! নিজের মনে যেসব লিখি, সব কি আর পড়াবার মতো?

  • তা হোক। আমি ওগুলো ও পড়তে চাই।

  • আচ্ছা। এইটা পড়ো।

‘পথে দেখি, অল্প বয়সী সব ছেলে ছোকরা

তোমার সাথে ওদেরকেই তো মানাবে ভালো!

পাল্লা দিয়ে তাদের সাথে হাসবে, গাইবে

ফূর্তি করবে সারারাত

তা না করে এক প্রায় পঞ্চাশের মন খারাপের খবর নাও

তাকে পৌঁছে দাও সকাল বেলার রোদ

রোজ বিকেলে অফিস ফেরৎ এসে

চা খেতে খেতে জিজ্ঞেস করো

‘আজ নতূন কী লিখলে?’

ভয় হয়।

যখন শব্দেরা পথ ভুলে যাবে

তখন তোমাকে কী দেব চায়ের সাথে

প্রতিটি বিকেলে?

  • এত ভয় কেন আনন্দদা?

  • যদি লেখা ফুরিয়ে যায় কোনওদিন?

  • লেখা ফুরোবে কেন? শব্দ নিয়েই তো আপনার ঘর-বাড়ী! আপনাকে ছেড়ে ওরাই বা যাবে কোথায়?

  • তবু যদি!

  • আমি থাকবো সাথে। তখনও যদি আপনি আমায় ভাবেন নদী! 

‘তুমি আমার আলোর নদী করবো পারাপার/ ডুবতে জানি মন্ত্র শেখাও বিদ্যা-অবিদ্যার।‘ আমি তো আজকাল তোমায় ছাড়া কিছু আর ভাবতে পারি না মঞ্জরী!

  • কি  আনন্দদা? আপনি তখন বুঝি আমায় আর গড়বেন না অক্ষরে?

  • এমন কথা কেন?

  • অন্য কেউ যদি কবিতা দেয় তখন?

  • দূর পাগলী!

  • সম্ভাবনা কি নেই?

  • কার কাছে যাব সখী বল্‌/ তুই তুই তুই অবিরল! আমার প্রতিটি কলাকোষে যে তুমি মঞ্জরী!

  • বিশ্বাস হয় না!

  • একটুখানি হাতটা ছুঁতে দেবে মঞ্জরী?

  • কখন থেকে আমি তো হাত বাড়িয়েই আছি আনন্দদা!

দাঁড়াও মঞ্জরী! পূর্ণেন্দু যেন কী বলছেন! ‘কে দেবে দাও বাড়িয়ে আছি মুঠো/ ভালোবাসার সামান্য খড়কুটো/ কে দেবে দাও বাড়িয়ে আছি ক্ষুধা/ স্পর্শ, গন্ধ পরিতৃপ্তির সুধা... ভারী সুন্দর! ভারী সুন্দর!

  • মঞ্জরী, কী দেবে দাও –বাড়িয়ে আছি হাত…

  • চা নিন।

  • এইতো ছিলে এখানে। চা আবার  কখন বানাতে উঠলে?

  • যখন হাত চেয়ে আপনি কোন রাজকন্যাকে ছুঁয়ে এলেন! আমি ভাবলাম, যাই এই ফাঁকে চা টা বানিয়ে আনি। সাতটা বাজে প্রায়। চা টা খেয়ে নিন। এবার উঠবো।

আলতো করে মঞ্জরীর ডান হাতটা চেপে ধরলাম আমার মুঠোয়। বললাম,

থাকো। থাকো।

একটুখানি থাকো আর !

আমাকে প্রস্তুত হতে দাও।

উপায় তো নেই, তোমায় আটকাবার !

রবিদাদা, যাও তুমি এখন! দেখছো না, মঞ্জরীর মস্ত এক দীর্ঘশ্বাস এসে নাড়া দিল আমার পিনাকে! ওর যাওয়ার আয়োজন বাকী আছে যে মেলা! শব্দেরা সব যাও। টবের ওপর বসো গিয়ে। আজকে হবো মঞ্জরিত সকল রাত্রি বেলা! 

Post a Comment

0 Comments