চত্ত্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ
আবীর ভট্টাচার্য্য চক্রবর্তী
কোন কোন সময় বা ঘটনা কাল নির্দেশক হয়। কারো কারো জীবন বা পারিবারিক ক্ষেত্রেও কখনও কখনও তার ছায়া পড়ে। সত্তরের দশকের নকশাল আন্দোলন তেমনি এক গুরুগম্ভীর বিষয়,বুঝে অথবা না বুঝে সারা বাংলা তাতে সংক্রামিত হয়েছিল।
এবং সমস্যার কথা, চক্রবর্তী পরিবারেও সে ঢেউ এসে লেগেছিল বেশ। সেই সদ্য সদ্য বিবাহ হয়েছে বড় খোকার,বৌমা ছিলেন বাঁকুড়া শহরের মেয়ে।এমনিতে বেশ লক্ষ্মীমন্ত হলেও মাতৃহীনা মেয়েটির পরিবারে বিশেষ কেউ ছিল না,বাপ-মেয়ের সংসার, কিন্তু মেয়েটি মেধাবিনী;সে সময়কার মাধ্যমিক পাশ।ঐ দেখেই পছন্দ করেছিলেন বড়ো দাদা।তবে মেয়ের বাড়ির অবস্থা ভালো না হওয়ায় নমো নমো করেই বিবাহ হয়েছিল। এমনকি,শোনা যাচ্ছিল বৌমার নাকি এক দাদাও আছে,পড়াশোনায় খুব ভালো,কলকাতায় থাকে। একমাত্র বোনের বিয়েতে যদিও সে আসতে পারেনি,পরেও আসেনি।
ব্যাপারটা কেমন যেন অদ্ভুত লেগেছিল সবার কাছেই।তবে কেউ কিছুই বলেনি, দাদার বারণ ছিল, নতুন বৌমাকে সাদরে গ্রহণও করেছিলেন সবাই।
এ পর্যন্ত গল্পটা ঠিকই ছিল,তবে তখনকার দিনে স্বাভাবিক না হলেও বিয়ে ইস্তক বৌমা খোকার কাছেই থাকবে,এমনটাই ইচ্ছে ছিল বড় বৌদিদির।মেজদাদা এবং মেজবৌদিদির প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও এ ব্যাপারে তিনি ছিলেন ঋজু।কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছিল, তাঁদের পেটরোগা ছেলেটির খাওয়া দাওয়ার সুবিধের কথা। আসলে,সেযুগের মানুষ হলেও ছেলে-বৌকে নবদাম্পত্যে খানিক দায়মুক্ত স্বস্তি দিতে হয়তো চেয়েছিলেন সেই ব্যাতিক্রমী মা!
এদিকে বৌটি শহুরে হলেও নিতান্তই ছেলেমানুষ।শহরে একা ছেড়ে দেওয়া শোভন নয়। অগত্যা আবার সেই বিরজার ওপরেই ভার পড়েছিল বৌমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে দেওয়ার। সেই মতো,বেশ কয়েকদিন,বলতে গেলে প্রায় বছর তিনেক তিনি ছিলেন মেদিনীপুর শহরে।
নামে শহর হলেও তখনকার মেদিনীপুর ছিল অলিগলিময় ঘিঞ্জি বসবাসের জায়গা, পথঘাট মোরাম বিছানো।যাতায়াতের মাধ্যম ছিল রিক্সা।কলকাতার মতো পাকা রাস্তা,ঢাকা নালা তখনও মেদিনীপুরে ছিল না। সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিকর ছিল খাটা পায়খানা।বিরজা গ্রামের মানুষ, বনে জঙ্গলে প্রাত্যকৃত্যে অভ্যস্ত, কিন্তু একটি বদ্ধ কুঠরীতে বসে সেকাজ সারা এবং তলা দিয়ে অন্য কোন মানুষ সে মল প্রতি সকালে পরিস্কার করে রাস্তা দিয়ে বয়ে নিয়ে যাবে,এ যেন ভয়ানক বিশ্রী ঘটনা বলে মনে হয় তাঁর। বিশেষতঃ বর্ষাকালে যখন খোলা নালার জল খসবে মিশে যাওয়ার সম্ভাবনা হো’ত,গাঁ যেন ঘিনঘিনিয়ে উঠতো তাঁদের।তবে বাসা বাড়ি তো,ভাইপোকে বলতেন, নিজের বাড়ি হলে যেন অবশ্যই কলকাতার মতো স্যানিটারি পায়খানার ব্যবস্থা করে। স্বল্পভাষী ছেলেটি হাসতো, ভবিষ্যতে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে পিসিমাকে কিন্তু বাথরুমটিই প্রথমে দেখিয়েছিল…
আনমনে হেসে ওঠেন গর্বিত মা!
🍂
তবে মেদিনীপুরের স্মৃতি বলতে এখনও মনে ভাসে রোদেলা উঠোন জুড়ে চড়াই পাখির কিচিরমিচির…সত্যিই,এতো চড়াই আর কাক দেশে ঘরে তখন কিন্তু দেখা যেতনা।যে বাড়ীটিতে তাঁরা থাকতেন, একতলা হলেও রাস্তা থেকে তা ছিল বেশ উঁচুতে, সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হতো,সামনে ছিল রোয়াক অর্থাৎ সরু খোলা বারান্দা।তার পরে দুটি বড়ো বড়ো ঘর;তার কোলে ঢাকা বারান্দা,তারপরে উঠোন পেরিয়ে রান্নাঘর,কুয়ো,চানঘর।একটু দূরে খাটা পায়খানা।কড়ি-বরগার ছাদের বেশ খোলামেলা বাড়িখানির উঠোনে শ্যামসোহাগী, নয়নতারা আর তুলসীর গাছ লাগিয়েছিলেন তিনি নিত্য পূজার জন্য।কুয়োতলায় ছিল একখানি পঞ্চমুখী জবার গাছ,তাঁকে জড়িয়ে নীল অপরাজিতা…ভোরের বেলা ঝুঁজকো আঁধারে কুয়ো পাড়ে বসে বিরজা কুঁড়ি থেকে ফুলের ফুটে ওঠা দেখতেন, বাড়ির কথা মনে পড়তো তাঁর। ক্রমে সকাল হোত,কুয়োর ভেতরে দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা সবজীর ঝুড়ি তুলে নিত্যকর্মে যেতেন ।তখন তো এখনকার মতো ফ্রিজ ছিলনা,পাশের বাড়ির দিদির কাছে শিখেছিলেন কুয়োর দড়িতে সবজীর ঝুড়ি ঝুলিয়ে তরী তরকারি টাটকা রাখার কৌশল। এখনও মেদিনীপুরে কুয়ো আছে কিনা বা সেখানে কেউ সবজী ঝোলায় কিনা,চরকি দিয়ে জল তোলে কিনা কে জানে!
কতো কিছুই তো হারিয়ে গেছে, যাচ্ছে,কে বা আর ঠেকাতে পারে তাকে!
একবার হয়েছিল কি, বৌমা তখন প্রায় আট মাসের পোয়াতি, ভরা বর্ষার কাল।সকাল থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। বড়ো দাদা-বৌদিদি এসেছেন বৌমাকে দেখতে।বাড়ি থেকে পাকা কইমাছ এনেছেন,পাঁক আর কুঁড়ো মাখিয়ে,খড়ের বিঁড়েয়। সেদিন কই মাছের হরগৌরী হবে,বোনের হাতে এই রান্নাটি দাদা খুব ভালোবাসতেন।বিরজা আবার এটি শিখেছিলেন তাঁর স্বল্পস্হায়ী শ্বশুরবাড়ির মায়ের কাছে।সকালের চা খেতে সেই সব গল্প হচ্ছে,ভাইপোও আদালতে যাবেনা, আপিসের ভাত দেওয়ার তাড়া নেই,বাড়িতে ছুটির মেজাজ।এমন সময় হঠাৎ সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ,
কে এলো?
তখনও বাড়িতে কেউ এলে পুরুষরাই দরজা খুলতে যেত,তায় ঐ শহরে তো পরিচিত বলতে ভাইপোরই সব,তাই সেই গেল। পরমুহুর্তেই বিরজাকে ডাক,
-’একবার তোমার বৌমাকে নিয়ে এখানে এসো তো পিসিমা!’
-’কেন রে!কে এলো!’
বলেই একগলা ঘোমটা টেনে বাইরের ঘরে গিয়ে দেখেন,বাইরের রোয়াকের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে এক ছিপছিপে তরুণ।একেবারে কাকভেজা ভিজেছে,সারা গা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।মুখে বৌমার মুখে ছাপ স্পষ্ট…
-’তুমি কে বাবা?বাইরে দাঁড়িয়ে ভিজছো কেন?ভেতরে এসো।’
-’উনি বলছেন, উনি তোমাদের বৌমার ভাই, আমি তো চিনিনা…’
-’চিনতে হবেনা। তুমি ভেতরে এসো…’
ইতিমধ্যে কথোপকথন শুনে বাইরের ঘরে এসে দাঁড়িয়েছেন বড়োদাদা, ঘোমটা টেনে দরজা মুখে বৌদিদি ও বৌমা…একটু পরেই বৌমা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলে ছেলেটিকে,
-দাদা! তুমি এসেছ!কি করে চিনলে!কি করে এলে!’ সঙ্গে অঝোর কান্না… ছেলেটির চোখেও শ্রাবণ
কিছু কিছু মুহূর্ত বড়ো স্ব-বাঙ্ময়,বাইরের কথা সেখানে খাটেনা। খানিক এমন হিরন্ময় দোলাচলের পরে,জানা হয়েছিল,ছেলেটি বাড়ি ফিরে বোনের খবর পেয়েই দেখা করতে এসেছে, কয়দিন থাকতে চায়।
0 Comments