জ্বলদর্চি

এআই থেকে রেহাই - কল্পকাহিনী। পর্ব ১৫। লক্ষ্মণের বম্বশেল। বাসুদেব গুপ্ত

এআই থেকে রেহাই - কল্পকাহিনী। 
পর্ব ১৫।  লক্ষ্মণের বম্বশেল।  
বাসুদেব গুপ্ত



মাথায় অসহ্য ব্যথা নিয়ে ভোরের আলো ফোটার মত জ্ঞান ফেরে, চারদিকে যেন অনেক চড়াই পাখীর কূজন শোনা যায়। অঝোরে জল ঝরে যাওয়ার শব্দ, যেন কাছেই কোন ঝর্ণা বয়ে চলেছে। ঝাপসা ভাব কেটে গেলে যখন চোখে পুরোটা দেখা যায়, মনে হয় মাথার উপর কোন ছাদ নেই, নীল আকাশ আর তাতে অসংখ্য ফুটকি ফুটকি তারা, কিন্তু আকাশে একটা নয় দু দুটো চাঁদ। আর সেই চাঁদ দুটো দুলে দুলে নীচে নামতে থাকে। কাছে এলে বোঝা যায়, চাঁদ নয় কোন একটা যন্ত্রের আলো, ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়, একটা রোবটের চেহারা, স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চেনা চেনা লাগে। মাথায় কঙ্কাশান হয়েছে কিনা বুঝতে পারে না। বেঁচে? আমি এখন কোথায়? কি হয়েছিল? এটা কোন জায়গা? আরথে না স্পেসে? কিছুই বুঝতে না পেরে অবসন্ন হয়ে চোখ বন্ধ করে, তখনই কেউ কথা বলে ওঠে
“কফিটা খেয়ে নিন। মাঝখানে বাধা পড়ে গেছে একটু।“
দেখা যায় ভিঞ্চি, না না ভিঞ্চি নয়, কারণ, ওর কপালে একটা ছোট্ট টিপ এঁকে দিয়েছিল অনির্বাণ খেলার ছলে, বিশ্বকর্মাপুজোর দিনে, যা এখন ওয়ারল্ড ইঞ্জিনীয়ারিং ডে বলে পালন করা হয়। সে টিপ নেই। এটা ভিঞ্চি নয়। 
“ঠিক বুঝেছেন, এটা ভিঞ্চি নয়, আর আপনি সিলিকন সোয়াম্প বাঙ্গালোর সিটি থেকে চলে এসেছেন বে লেক সিটি তে। এটা সোয়াম্প আইল্যান্ড, আগে ছিল ফিশারি। এই জায়গাটার নাম ছিল কাপ্তান ভেরি। যা শুনছেন দেখছেন সব আরটোরামা দিয়ে সিমুলেটেড। পাখী ঝর্ণা সব। 
-কতক্ষণ আমি অজ্ঞান ছিলাম?
-দু ঘণ্টা। 
- এত তাড়াতাড়ি বে লেক সিটিতে?
- আমাদের চারটারড হাইপার লুপ, ১ ঘণ্টা ৪২ মিনিট। নিন, কফি খান। কথা আছে। ভয় নেই, আপনার ফর্মুলা মতই। ৩০০ সিসি জল পিএইচ ৭। ৫ গ্রাম এরাবিক কফি। ২৫ গ্রাম ইন্ডিয়ান জলি গো মিল্ক শর্করাপুর চিনি ৩ গ্রাম। ঠিক তো?”
হা হা করে হেসে ওঠে অদৃশ্য ব্যক্তি। ইংরিজীতে বললেও তাতে হিন্দী টান পরিষ্কার বুঝতে পারে অনির্বাণ। 
-কে তুমি? 
- আনাড়ী হুঁ। আনাড়ী রোবট, ভিঞ্চিকা বাপ। আবার হা হা করে হেসে ওঠে রোবটের স্পীকার দিয়ে অদৃশ্য ব্যক্তি। লিজিয়ে, কফি পিজিয়ে। এবারে পরিষ্কার দিশি উচ্চারণ।
কে তুমি কে আপনি? আমাকে এখানে আনলেন কেন, কি চান? আমার কাছে তো হীরে, সোনা এসব কিছুই নেই। সামান্য একজন রিপোরটার। 
-আমার নাম গোপীনাথ। 
লক্ষ ভোল্টের শক লাগে যেন অনির্বাণের। 
-গোপীনাথ, মানে আপনিই কি গড। আরেব্বাস। আমি কি স্বর্গে? 
-বলতে পারি না। আপনার ভাগ্য, বলে রোবট চোখ টেপে একবার। 
-তো আমাকে আপনার কি দরকার? আমি তো জাস্ট একজন রিপোরটার।
-হা হা রিপোর্টার সে বড়া জাসুস হ্যায় আপ। আপনি একটু একটু করে অনেক বেশি জেনে ফেলেছিলেন। ডেঞ্জার হয়ে যাচ্ছিল। অতএব, আপনাকে থামাতে বাধ্য হয়েছি আমরা। 
এবারে হাসতে হাসতে রোবট এক পাক নেচে নেয়, গান গায় এক কলি, তু না জানে আস পাস হ্যায় খুদা। দেখে প্রাচীন এক নায়ক সলমন খানের নাচের মত লাগে। একবার ভেরার অনুরোধে এন্টিক মুভি দেখতে বাধ্য হয়েছিল, এখনো মনে লেগে আছে। 
অনির্বাণের অবাক লাগে। গড না হোক গোপীনাথ তো এতবড় ন্যাশনাল ফিগার, দেশের হায়েস্ট নেতাদের সঙ্গে ওঠা বসা, তার এরকম হাব ভাব? পড়াশোনা করেছে বলে তো মনে হয় না। 

🍂

-কেমন জোকটা খেলেন বলুন তো। এখনো যারা ধার্মিক তারা তো বলেই দিল, সত্যযুগ আ গয়া, সাক্ষাৎ ভগবান দেশ মে রাজ করেগা। দেশ ভগবানকা হো জায়েগা। 
-আপনি রোবটের মধ্যে দিয়ে কথা বলছেন কেন? সামনে আসুন না। আমিও ভগবানকে দেখি। কফি খেয়ে এতক্ষণ অনির্বাণের একটু সাহস বেড়েছে। ওর হাত পাও বাঁধা নেই, একটা গেম খেলার চেয়ারে ও বসে আছে, ইচ্ছে করলে দৌড় লাগাতে পারে, এই রোবট ছাড়া কেউ আটকাতে পারবে না 
-ওসব ভাবতে যাবেন না। সব শুনতে পাচ্ছি। আপনার বিম্লিংক এখন আমাদের ডাইরেক্ট ট্যাপ করা। গড বলে ওঠে ও গম্ভীর হয়ে যায়। তারপর বলে,
- আমার বডিটাই শালা আর নেই। আমি এখন ভারচুয়াল গোপী। বুদ্ধি লাগাতে পারি, কিন্তু একটু পান খাব পান মশলা দিয়ে তার উপায় নেই। মুন্নি অবশ্য বারণ করত খেতে, বলত ক্যান্সার হবে। আর ক্যান্সার, বডিটাই নেই। 
-কেন বডি কি হল, ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে অনির্বাণ, মুন্নি কে? আপনার মেয়ে?
গড অনেকক্ষণ চুপ, সাড়া নেই। অনির্বাণ আবার জানতে চায়।
-মুন্নি কে? আপনার মেয়ে? সে কোথায়? 
-তাকে আমিই উড়িয়ে দিয়েছি ভাই। আমাকে জেলে পোরার জন্য একদল বাঁদর ছেলেমেয়ে চুপিচুপি সব ইনফারমেসান জোগাড় করছিল, সে সব বেরিয়ে গেলে আমাদের বিজিনেস চৌপট হয়ে যেত। 
-তার পর
-আমি কি জানতাম মুন্নি এ দলে আছে। একটা এনকাউন্টারের ব্যবস্থা করলাম, বড় কর্তারা আমার হাতের মুঠোয়। উড়িয়ে দিল। বলা হল আজাদী জেহাদ। ওর বডি এলো বাড়িতে, দশটা বুলেট টিপ করে করে মারা ঠিক একটা স্বস্তিকা চিহ্ন যেন। 
-বাহ, আপনি যেমন মানুষ তেমনি আপনার কর্মফল। তো আপনি রোবট হয়ে গেলেন কি করে?
-আমি ঠিক করলাম আমাকে এবার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। লাখমান আর আমি দুজনে সবটা চালাতাম, ওকে জানতে না দিয়ে আমি ঠিক করলাম একদিন টুগ্লে প্রেস রিলিজ করে সব বলে দেব, তারপর আমার যা হয় তা হবে। 
-তারপর?
-লাখমান আমার বাড়িতেই যে পেলিকান বসিয়ে রেখেছিল আমিও জানতাম না। আমার ড্রাফটটা পেলিকান ওর কাছে পাঠিয়ে দিল। ও আমাকে ডাকলো একটা জরুরী মিটিঙ্গের জন্য। রাস্তায় এম্বুশ। আমি ডেড, তারপর আমার ব্রেনটাকে ক্রায়োতে দু বছর রেখে সুপার সারভারে আপলোড করে দিল। গল্প শেষ। এখন তো এরকম আকছার হচ্ছে। 
- তা অবশ্য ঠিক। এই তো সেদিন আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে ক্রায়ো করা হল। তো এখন আপনার আর কোন স্বাধীনতা নেই?
- না। আমি ওর ক্রীতদাস। যা বলে করতে হয়। 
-আপনাকে বলেছে আমাকে এসব বলতে? ও তো সব জানতে পারবে। 
-জানলে কি হবে? আমাকে ডেস্ট্রয় করবে? আমার তো বডিই নেই। আমাকে কি দুবার মারতে পারবে?
-আপনি আমাকে বেরোতে সাহায্য করতে পারবেন? 
- না। আমার এলগরিদমে আটকে যাবে, আমি লাখমানকে বিট্রে করতে পারব না। আপনি যা পারেন আপনাকেই করতে হবে। 
-কি মুশকিল, এখনো তো জানলামই না আমাকে আপনারা ধরে এনেছেন কেন। 
গড বা গোপীনাথের রোবট এতক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, হঠাত যেন ভোল্টেজ কমে গিয়ে বসে পড়ল একটা চারজিং স্টেশনে। আর ঝকঝকে কাঁচের পারটিশানে ভেসে উঠল একটা সাড়ে ছ ফুট দীর্ঘ ছায়া। অটোম্যাটিক দরজা সরে গিয়ে যে ঢুকলো তাকে যীশু খ্রীষ্টের অবতার বললেও ভুল বলা হবে না। দীর্ঘ টানা টানা নীল চোখ, লম্বা বাবরি করা চুল ঘাড়ের দুপাশে গলা সোনার মত নেমে শাল্প্রাংশু কাঁধের মালভূমিতে আশ্রয় নিয়েছে, অল্প অল্প দাড়ি সুবিন্যস্ত ও ডাই করা। হাতে একটা ছোট্ট লাঠি, কুচকুচে কালো আর চকচকে। 
-ওয়েল্কাম মিস্টার রিপোর্টার। ডুইং  রিপোরটিং হিয়ার অলসো।
ইংরাজীতে মধ্য প্রাচ্যের টান পরিষ্কার, ট গুলো ত শোনালো, ও একটু সুর করে টেনে কথা শেষ করার। ইনিই যে শ্রী লাখমান বুঝতে একটুও দেরী হল না । 
-নাইস টু মিট ইউ, মিস্টার লক্ষণ!
(ক্রমশ)

Post a Comment

0 Comments