জ্বলদর্চি

হাসান সোহরাওয়ার্দী (সার্জন, রাজনীতিবিদ, ভাইস চ্যান্সেলার) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১২৮
হাসান সোহরাওয়ার্দী

হাসান সোহরাওয়ার্দী (সার্জন, রাজনীতিবিদ, ভাইস চ্যান্সেলার) 
ভাস্করব্রত পতি

১৮৮৩ সালের ১৭ ই নভেম্বর মেদিনীপুরের সুপ্রসিদ্ধ সুরাবর্দী বংশে জন্মগ্রহণ করেন হাসান সোহরাওয়ার্দী। তাঁর বাবা ছিলেন উবায়দুল্লাহ আল উবাইদী সোহরাওয়ার্দী (সুরাবর্দী)। তিনি ছিলেন ঢাকা কলেজের আরবী ও ফারসী ভাষার অধ্যাপক। অত্যন্ত কৃতি এবং উচ্চশিক্ষিত বংশের সন্তান ছিলেন হাসান সোহরাওয়ার্দী। 

এই 'সোহরাওয়ার্দী' পরিবারের অন্যান্য বিখ্যাত ব্যক্তিরা হ'লেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (ভাতিজা), আবদুল্লাহ আল মামুন সোহরাওয়ার্দী (ভাই), খুজিস্তা আক্তার বানু (বোন), সাহেবজাদী শাহবানু বেগম (পত্নী), শায়েস্তা সোহরাওয়ার্দী ইকরামুল্লাহ (কন্যা), হাসান মাসুদ সোহরাওয়ার্দী, জাহিদ সোহরাওয়ার্দী (চাচাতো ভাই), ইব্রাহিম সোহরাওয়ার্দী (চাচাতো ভাই), বেগম বদর উন নিসা আক্তার (ভাতিজি) এবং সাইদ হোসেন (শ্বশুর)। এঁদের মধ্যে পাকিস্তানের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী (১২.০৯.১৯৫৬ থেকে ১৭.১০.১৯৫৭) ছিলেন হাসান সোহরাওয়ার্দীর বোন খুজিস্থা আখতার বানুর পুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ইনিও মেদিনীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। এই খুজিস্থা তাঁর চাচাতো ভাই কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি স্যার জাহিদ সোহরাওয়ার্দীকে বিয়ে করেছিলেন। হাসানের দাদা আবদুল্লাহ আল মামুন সোহরাওয়ার্দী ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম পি. এইচ. ডি. ডিগ্রি প্রাপ্ত ব্যক্তি। আর স্বয়ং হাসান সোহরাওয়ার্দী ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ভাইস চ্যান্সেলর (১৯৩০ - ১৯৩৪)। এই পদে মেদিনীপুরবাসীদের মধ্যেও তিনিই প্রথম ব্যক্তি। সেইসাথে তিনি ভারতের দ্বিতীয় মুসলিম, যিনি ইংল্যান্ডের রয়্যাল কলেজ অফ সার্জনসের ফেলো নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯১০ সালে সর্বপ্রথম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ফেলো' নির্বাচিত হন। শুধু চিকিৎসাশাস্ত্রে অসাধারণ পারদর্শিতা নয়, অন্যান্য নানা বিষয়েও অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল তাঁর। আর এজন্যেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য সম্মানের পদ লাভ করেছিলেন। ১৯৪৫ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং জনস্বাস্থ্য ও হাইজিনের চেয়ার বজায় রেখে ১৯৩১ সাল থেকে তিনি এই পদে ছিলেন।

হাসান কৃতিত্বের সঙ্গে প্রবেশিকা এবং এফ এ পরীক্ষায় পাশ করে কলকাতা মেডিক্যালে ভর্তি হন চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনার জন্য। ১৯০৮ এ এল এম এস পাশ করে বিলেত যান। সেখানে চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি অর্জনের পর যান আয়ারল্যাণ্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে পড়াশোনা করে এফ আর সি এস ডিগ্রি লাভ করেন। 

চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ে অসাধারণ জ্ঞান ছিল হাসান সোহরাওয়ার্দীর। মূলতঃ অস্ত্রোপচার বিদ্যায় দারুণ পারদর্শী ছিলেন। তিনিই প্রথম বাঙালি হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের চিফ মেডিকেল ও হেলথ অফিসার হিসেবে রেলওয়ের প্রধান মেডিকেল অফিসার হিসেবে নিয়োগপত্র পেয়েছিলেন। এখানে তিনি রেলওয়ের অ্যাম্বুলেন্স এবং নার্সিং বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন।

চিকিৎসক হিসেবে তিনি ছিলেন অনন্য। ব্রিটিশ ভারতে বাংলার নাম উজ্জ্বলকারী একজন ব্যক্তি। সেসময় তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজ, কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ (আজকের বিখ্যাত আর. জি. কর মেডিকেল কলেজ) সহ আরও নানা হাসপাতালের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। কলকাতা মেডিকেল কলেজে ফ্যাকাল্টির সদস্য হিসেবে তিন বছর অধ্যক্ষ পদে ছিলেন। ১৯৩৪ সালে ইণ্ডিয়ান মেডিকেল কাউন্সিল গড়ে ওঠার পর হাসান সোহরাওয়ার্দী হলেন এই কাউন্সিলের প্রথম সহকারী সভাপতি। 

একসময় লণ্ডনে ইণ্ডিয়া কাউন্সিলের ভারত সচিবের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছিলেন তিনি। সারা বিশ্বের বহু জায়গায় বক্তব্য রাখার জন্য যেতে হয়েছিল তাঁকে। অনেকেই আজ হয়তো তাঁর নাম জানেনা। কিন্তু তিনি সেসময় যেভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তাতে বিস্মিত হতে হয় বৈকি! 'কায়সার ই হিন্দ' পদক তিনি পেয়েছেন। ১৯৩২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হাউসে জনৈক বীণা দাস স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসনকে হত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু তিনি তাঁর জীবন বাঁচাতে সচেষ্ট হন। এজন্য ব্রিটিশ সরকার তাঁকে পুরস্কার স্বরূপ 'নাইট' উপাধি দেয়। যদিও তিনি অনেক পরে ১৯৪৬ এর আগস্ট মাসে তা ফেরত দিয়ে দেন। ১৯৩৩ সালের এপ্রিলে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন পার্ক সার্কাস থেকে কসাইপাড়া লেনের মোড় পর্যন্ত প্রায় ১০০ ফুট রাস্তার নামকরণ করে 'সোহরাওয়ার্দী এভিনিউ'। এই উদ্যোগ ছিল তাঁর প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন। এই রাস্তার পাশে থাকা তাঁর বাড়ি ‘কাশানা’কে ২০২০ সালে বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশন তাঁদের লাইব্রেরি এবং তথ্য কেন্দ্র ভবন হিসাবে ব্যবহৃত করছে। 

কখনও মেদিনীপুরের মানুষকে ভুলে যাননি এই মহান মানুষটি। ছিলেন একজন আদর্শবাদী চিকিৎসক। কেউ কখনো তাঁর সাহায্য চাইলে, তিনি কখনও তাঁদের ফেরাতেন না। সবসময় আন্তরিকভাবে তাঁর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।

পুরস্কার, সম্মাননা অসংখ্য জুটলেও তিনি কখনও মাটির সংস্পর্শ ভোলেননি। তিনি শুধু মেদিনীপুরের গর্ব নন, সারা বাঙালি জাতির গর্ব। এহেন মানুষটি ১৯৪৬ সালের ১৭ ই সেপ্টেম্বর কলকাতার ট্রপিক্যাল স্কুল অফ মেডিসিনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আমরা হারাই এক কর্মময় জীবনের বাঙালিকে।

🍂

Post a Comment

0 Comments