পর্ব- ৩৬
স্বপন কুমার দে
তিন সপ্তাহ পরেই সম্পূরক মাকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে এল। সে এখন পুরোপুরি সুস্থ, কাজেই তার কাছে মায়ের থাকার ততটা প্রয়োজন নেই, যতটা প্রয়োজন বাবাকে দেখভাল করার। বড় বৌমার কাজের চাপ বেড়েছে মন্টিকে স্কুলে পৌঁছানো, নিয়ে আসা, পড়াশোনার নিয়মিত খোঁজ রাখা-- এসব নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত থাকে। বাড়ির সকলের নির্দেশ এবং মল্লিকা ম্যাডামের পরামর্শ মেনে সে মন্টির পুরো দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। সুফলও পেতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। মাঝখানে মন্টিকে নিয়ে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল, সেসব আর নেই। মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য মন্টিও প্রস্তুতির খামতি রাখছে না। পড়ানো না থাকলেও মল্লিকা সময় পেলেই মন্টির কাছে একবার ঘুরে যায়।
কিন্তু অসুবিধা হয়েছে বৃদ্ধ অমরেশবাবুর। মুখে কিছু না বললেও নিজের কষ্টটা তিনি মনে মনে অনুভব করেন। ঠিক ঠিক সময়ে খাবার, ওষুধ না খেলেও বলবার কেউ নেই। মণিদীপা কাছে থাকলে এতটুকু ঘঅনিয়ম হতে দেয় না। ঘুম থেকে ওঠা, ওষুধ নেওয়া, বিশ্রাম, সবকিছুই যেন ঘড়ির কাঁটা ধরে চলে। এখন সেই মানুষটার অভাব হাড়ে হাড়ে টের পান। ফোনে দুজনে যখন কথা হয় তখন কষ্ট চেপে রেখে বলেন," আমি ভালো আছি। আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। তুমি আরও কিছুদিন সমুর কাছে থেকে যাও।" মণিদীপা শোনেন, দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মানুষটা যে একান্তভাবে তাকে কাছে পেতে চায় , তা মণিদীপা বুঝতে পারেন। ভেতরে ভেতরে কষ্ট পান। মনে হয়, এবার ফেরা যাক। ছেলের সামনে সে কথা বলা যায় না। শুধু বলেন," তোর বাবা ঠিকমতো ওষুধপত্র খাচ্ছে কিনা, ভয় হয়।" ছেলে তৎক্ষণাৎ বলে," তুমি চলো না মা, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। আমার তো আর কোনও অসুবিধা নেই।"
" আর কিছুদিন থাকি,"- এই করে করেই তিন সপ্তাহ পরে, সম্পূরকের পর পর দু'দিন ছুটি থাকায় মাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে হাজির হয়।
এসেই সংসারের হাল ধরতে হয় মণিদীপাকে। কাজের লোককে দিয়েও যে সুন্দরভাবে সব কাজ করিয়ে নিতে হয়, তার জন্যও বাড়ির কর্ত্রীর একটা জোরালো ভূমিকা থাকে। মণিদীপা না থাকায় সেটার অভাব ছিল। আবার যখন সব পরিপাটি হল, অমরেশও সময় মত সবকিছুই হাতের কাছে পেতে লাগলেন তখন তাঁর মনে হল,' লক্ষ্মী'। বউকে কাছে পেয়ে চুপি চুপি বললেন," এতদিন মনে হত, অনেক কিছুই আছে, কিন্তু সবকিছু নেই। আজ মনে হচ্ছে সবকিছুই যেন চলে এসেছে।" গিন্নি মৃদু ধমকের সুরে বলেন," বয়সটা কত হল?" বড় বৌমাকে দেখতে পেয়ে এবার লজ্জায় পড়ে গেলেন অমরেশ। জোরালো গলায় বলে উঠলেন," দেখছো বৌমা, আসামাত্রই আমার ওপর চোট পাট আরম্ভ করে দিয়েছে। এতদিন একা একা ছিলাম, ভালোই ছিলাম।" বৌমা মৃদু হেসে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল। শ্বশুর শাশুড়ির রসায়ন বুঝতে সে দেরি করেনি।
মন্টির বিষয়ে ফোনে অল্প অল্প শুনছিলেন। এখন অমরেশের কাছ থেকে সবটা শুনলেন। মল্লিকার বিচক্ষণতা এবং বুদ্ধিমত্তা যে দিদিভাইকে খুব বড় বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে তাও জানলেন। মল্লিকা যে এ পরিবারের খুব উপকারী বন্ধু, এটাও শুনলেন স্বামীর কাছ থেকে। অমরেশবাবু বলছিলেন," সাধারণত এইরকম পরিস্থিতিতে লোকে উত্তেজিত হয়ে হঠকারিতা করে। রাগে সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে নিজের সন্তানের ক্ষতি করে। অন্তত বড় বৌমা সেরকম পথেই হাঁটতে চেয়েছিল কিন্তু মল্লিকা তা হতে দেয়নি। বিপদের সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখতে বলেছিল এবং কর্তব্য-কর্ম স্থির রেখে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছিল। সে যে পথে পথ দেখিয়েছিল আমরা সেই পথে উপকৃত হয়েছি। অথচ দেখ, মেয়েটার মধ্যে বিন্দুমাত্র অহংকার নেই। আমরা জানি, নীতি নৈতিকতার আসল শিক্ষাটা সন্তান পায় তার মায়ের কাছ থেকে। ওর তো মাও নেই, বাবাও নেই, তবু দেখ, কী গভীর সমাজ জ্ঞান।"
মণিদীপা অমরেশের থেকে সব কথা গভীর মনোযোগে শুনছিলেন। তার মুখ চোখের অভিব্যক্তিতে মল্লিকার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ ফুটে উঠছিল। বললেন," মেয়েটি সত্যিই খুব ভালো।"
বাড়িতে থাকলে সম্পূরক বিকেলবেলাটায় বন্ধু বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দেয় বা এদিক ওদিক ঘুরে বা সিনেমা দেখে রাতের দিকে বাড়ি ফেরে। আজও বেরিয়েছে। এক বন্ধু থাকে বড়বাজারের দিকে, তার বাড়িতে শুনল, সে বাড়িতে নেই। অগত্যা কী করা যায়? আর একজনের বাড়ি বাস স্ট্যান্ডের পাশাপাশি । কাজেই বাইক স্টার্ট দিল পরবর্তী গন্তব্যের উদ্দেশে। বড় রাস্তায় জ্যাম থাকায় পাশের গলি রাস্তায় ঢুকে পড়ে। গলিটা একটা বস্তির ভেতর দিয়ে গেছে। ঢালাই রাস্তা, বাইক চালানোর অসুবিধা নেই। সরু রাস্তায় যেতে যেতে হঠাৎই একটি ছেলে মাঝ রাস্তায় চলে আসে। সাডেন ব্রেক কষে সম্পূরক। ছেলেটিকে রাস্তা পেরোতে সময় দিতে হল। বাইকের স্টার্ট বন্ধ। বার বার কিক্ করতেও গাড়ি স্টার্ট না নেওয়ায় সে নাজেহাল হয়। এমন সময় অপ্রত্যাশিতভাবে পাশ থেকে জনৈক মহিলা কণ্ঠের সহাস্য উক্তি শোনা গেল," কী ব্যাপার সম্পূরকবাবু, বেপাড়ায় এসে বিপদে পড়লেন নাকি?
সম্পূরক অবাক চোখে দেখল, নারীকণ্ঠের অধিকারিনী মল্লিকা! ততক্ষণে সামনে এসে পড়েছে মল্লিকা," দেখলেন তো সম্পূরকবাবু, অযত্নে গাড়িও কথা শোনে না, মানুষ তো করবেই।"
সম্পূরক ভাবতেও পারেনি এমনিভাবে মল্লিকার দেখা পেয়ে যাবে। অবাক হয়ে দেখছিল মল্লিকাকে। খুব সাধারণ পোশাক, নেভি ব্লু কুর্তার ওপর সাদা রঙের ওড়নাটা বাতাসে মৃদু দোলা খাচ্ছে। মুখে কোনও মেকাপ নেই, কেবল কপালে দুই ভ্রূর মাঝখানে নীল রঙের টিপ। পশ্চিমের লাল রঙ এসে লেগেছে গায়ে। মুখের হাসিটাকে আরও বেশি আকর্ষণীয় করছে ধবধবে সাদা দাঁতের দ্যূতি। সম্পূরক যেন নতুন করে আবিষ্কার করছিল মল্লিকাকে।
" কী ব্যাপার কী? আমি গায়ে পড়ে এতগুলো কথা বলছি, আর আপনি সাড়া দিচ্ছেন না যে? আমার পাড়ার লোকে ভাববে, আমি গায়ে পড়ে আপনার সাথে ভাব জমাচ্ছি। আপনি আমাকে চেনেনই না।"
" না মানে, ঠিক তা নয়। আপনি এখানে থাকেন?"
" হ্যাঁ, ওই তো আমাদের বাড়ি, আর আমি সময় পেলেই এই ক্লাবঘরের সামনে এদের পড়াই।" সম্পূরক এতক্ষণ ওদের লক্ষ্য করেনি। চেয়ে দেখল, একটু দূরেই ক্লাবঘরের সামনে কিছু ছেলেমেয়ে বই খাতা নিয়ে আসন পেতে পড়াশোনা করছে। সম্পূরক কী ভেবে বলে ফেলল," আপনাকে যত দেখছি ততই নতুন নতুন রূপে আবিষ্কার করছি। আপনি না বললেও বুঝতে পারি এটা আপনার সমাজ সেবার একটা দিক।"
" ওসব কথা থাক। বলছি, গাড়ির তেল কি শেষ? তাহলে আমাকে পয়সা দিন, আমিই তেল আনার ব্যবস্থা করি।"
" আপনি?"
🍂
" আপনি ততক্ষণ বরং এখানটায় বসুন।" বলে নিজের জন্য রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারটাতে বসতে বলল।
" এরা সব স্কুলে পড়ে?"
" হ্যাঁ। তবে একই স্কুলে বা একই ক্লাসে পড়েনা।"
ছেলেমেয়েগুলোর শরীরের রুগ্নতা, পোশাকের জীর্ণতা দেখে সম্পূরক বুঝতে পারল ফিজ দিয়ে টিউশন পড়ার ক্ষমতা এদের নেই। তবু একটু ঘুরিয়ে জানতে চাইল," নিজের জন্য সময় রাখেন না? সবসময় টিউশন পড়িয়ে অর্থ হয়তো কিছুটা আসে কিন্তু নিজের দিকটা ভাবেন কখন? পি এইচ ডি'র জন্য কি অনেক অর্থের প্রয়োজন?"
" সম্পূরকবাবু, এরা আমার অযত্নের না ফোটা ফুলের কুঁড়ি। এদের কাছ থেকে টাকা পয়সা চাইব কোন লজ্জায়? এদের নিজেদেরই ভালো করে খাবার জোটে না। আমিও এদের ঠিক মত যত্ন করতে পারি না। মাঝেমধ্যে একটু আধটু গোড়ায় জল দিই।"
লজ্জা পায় সম্পূরক। মনে মনে বুঝল, মল্লিকার সঙ্গে খুব সাবধানে কথা বলতে হবে, নইলে ঠকতে হবে। মল্লিকাই প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলল," হ্যাঁ, তারপর বলুন, কবে এলেন। আপনি সম্পূর্ণ সেরে উঠেছেন তো? জেঠিমার শরীর ভালো আছে? মন্টি মন দিয়ে পড়াশোনা করছে?"
" আস্তে, আস্তে, একসঙ্গে এতগুলো প্রশ্ন করবেন না। আমি কীভাবে উত্তর দেবো? এক কথায় বলছি, আমি আর মা গতকাল সন্ধ্যায় বাড়ি এসেছি। বাকি সব প্রশ্নের উত্তর, 'ভালো '।
সম্পূরকের একটু লজ্জা লজ্জা লাগছিল। একেবারে নতুন পরিবেশে একজন মহিলার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলতে গিয়ে পাড়ার লোকের কৌতূহলের কারণ হচ্ছিল। তাদের মধ্যে দু'একজন অতি কৌতূহলী মহিলা কাজের অছিলায় এদিকটায় ঘুরেও গেল। একজন তো বলেই ফেলল," এনাকে এই পাড়ায় দেখিনি কোনোদিন। কারোর খোঁজে এসেছেন বুঝি?"
মল্লিকাই সে কথার উত্তর দেয়," না কাকিমা, উনি আমার পরিচিত। আমি ওনাদের বাড়িতে পড়াতে যাই। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন, গাড়ির তেল শেষ। সুবোধকে পাঠিয়েছি তেল আনতে, তাই একটুক্ষণ ওনার সাথে কথা বলছি।"
কৌতূহলী মহিলা হেসে বলেছিল," তা বেশ, তোমরা গল্প করো বাপু, আমি আসি।"
এইসব কথা বলতে বলতেই সুবোধ পেট্রোল নিয়ে হাজির। গাড়ির ট্যাঙ্কে তেল ঢেলে সম্পূরক বলল," আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। সত্যি আপনার সঙ্গে দেখা না হলে আরও অনেক হ্যাপা পোয়াতে হত। চলি ম্যাডাম।"
" কোথায় যাচ্ছেন?"
" এক বন্ধুর বাড়ি।"
" বন্ধু না বান্ধবী?"
" না। আপাতত কোনো বান্ধবী নেই। খুঁজে দেখি, পাই কিনা। "
" দেখুন, এবার আর ঠকবেন না যেন।"
" না, এবার আর ঠকবার ভয় নেই।"
" কোথাও দেখেছেন নাকি?"
" হ্যাঁ, কিন্তু সাহস করে তাকে আর বলতে পারছি না।"
" পুরুষ মানুষ হয়ে এত ভয় কীসের? বলেই ফেলুন।"
" আজ নয়, আরেক দিন।" সম্পূরকের মুখ থেকে হঠাৎ কথাটা বেরিয়ে গেল।
" এই রে! এতক্ষণ হয়ে গেল। একটা অঙ্কও কারও হয়নি। আচ্ছা সম্পূরকবাবু, সাবধানে আসুন। রাত করবেন না। বাড়িতে চিন্তা করবে।" মল্লিকা বাচ্চাদের দিকে মন দিল।
" আপনি আজ আমাদের বাড়ি যাবেন না?"
" কাল সন্ধ্যায় যাবো।"
সম্পূরক খুব কম সময়ের জন্য মল্লিকার চোখে চোখ রেখে আবার সরিয়ে নিল। গাড়িতে স্টার্ট দিল, 'আসছি' বলে চলে গেল।
0 Comments