জ্বলদর্চি

জবা/ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৪৩
জবা

ভাস্করব্রত পতি

ভাগবতের কাহিনী অনুসারে জবা বা যসুম (Josum) দেবী দুর্গার জন্য উৎসর্গীকৃত একজন একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। যখন ভগবান দেবীকে বললেন কালীরূপ ধারণ করে অসুর বধ করতে, তখন এই যসুম তথা জবা তাঁর নিজের পাঁপড়ির লাল রং মায়ের দু'চোখে দান করে দিলেন। যার মাধ্যমে দেবী মা তাঁর প্রকট রাগ প্রকাশ করতে পারেন অসুরকুলের সামনে। 

পরম ভক্তের এহেন কাণ্ড কারখানা দেখে দারুণ খুশি হলেন মা কালী। প্রীত হয়ে মা কালী তখন জবাকে (যসুম) বললেন, 'হে আমার প্রিয় ভক্ত, তোমার এই অসাধারণ আচরণে আমি খুব খুশি হয়েছি। তুমি আমার কাছে তোমার পছন্দের বর প্রার্থনা চেয়ে নাও। আজ আমি তোমার সেই মনোবাসনা পূরণ করে দেবো'।
মা কালীর গলায় জবাফুলের মালা

তখন জবা (যসুম) ভক্তিতে আপ্লুত হয়ে মা কালীকে বললেন, 'মা গো, তুমি হলে পরম করুণাময়ী। তোমার জন্য আমি নিবেদিত। আমার কিছু চাওয়ার নেই। আমি শুধু চাই -- আমি যেন সবসময় তোমার পদতলে থেকে তোমার সেবায় নিয়োজিত থাকতে পারি। ব্যাস, এটুকুই'।

অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে মা কালী তাঁকে সেই অভয়বাণী দিয়ে বললেন, 'তবে তাই হোক। তুমি চিরদিন আমার জন্য নিবেদিত ফুল হয়েই বেঁচে থাকবে। আর আজ থেকেই তুমি পরিচিত হয়ে উঠবে দেবীফুল, জবাকুসুম, যঠন (Jothon) নামেও। তোমাকে দিয়ে এই ধরাধামের যে ব্যক্তি আমার পূজা করবে, সেও আমার পরম আশীর্বাদ লাভ করবে'। এরপর থেকে এই লাল রঙের জবাফুল দিয়েই দেবী মা কালীর পূজার্চনা হয়ে আসছে। 
'মায়ের পায়ের জবা হয়ে
ওঠনা ফুটে মন। 
তার গন্ধ না থাক
যা আছে সে নয়রে ভুয়ো আবরণ। 
জানি জুঁই মালতী হায়
কত গন্ধ যে ছড়ায়
তবু ঘরের ফেলে পরের কাছে
নিজেরে বিলায়
ওরে তোর মতো যে নেইকো তাদের
মায়েপোয়ে আলাপন। 
আমার তাইতো লাগে ভয়
প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে
হই বুঝিবা ক্ষয়
ওরে যেন ভুলিস না
তোর দয়াময়ী মা, 
তাঁর রক্তমাখা কালো রূপে
ঘুচায় কালিমা। 
ও মন তাই বলি আয়
ঐ রাঙা পায়ে করি আত্মসমর্পণ। 
তাই বলি আয়
ও মন তাই বলি আয়
ঐ রাঙা পায়ে করি আত্মসমর্পণ। 
মায়ের পায়ের জবা হয়ে
ওঠনা ফুটে মন'। 

জবাগাছকে সংস্কৃতে ওড্রপুষ্প (পিচ্ছিল পুষ্প), রক্তপুষ্পী, অর্কপ্রিয়া, হরিবল্লভা, সূর্যারাধনসাধনী নামেও পরিচিত। এছাড়াও জবাকে গুজরাটিতে জাসুম, উর্দুতে মন্দার, কন্নড়ে দাসনল, হিন্দিতে ওডহল, ওচুল, জবা, ওডহর, জবাকুসুম, মারাঠীতে জামবন্দ, তেলুগুতে মন্দরপু, তামিলে সেম্বারুথি, মালয়লামে সেম্পারাত্তি, হাইতির ক্রেওল ভাষায় চোব্ল্যাক বা রোজ কেয়েন এবং ইংরেজিতে shoe flower এবং rose mallow ও বলে। এছাড়াও চিনা হিবিস্কাস, চায়না রোজ, হাওয়াইয়ান হিবিস্কাস বলা হয়ে থাকে। জবা অন্যান্য যেসব নামেও পরিচিত, সেগুলি হল -- রাগপুষ্পী, রক্তপুষ্পী, অর্ক'পুষ্পী, ওড্রপুষ্প, ওড্রা, অতিরঙ্গ, অর্কপ্রিয়া,জপা, প্রতিকা এবং হরিবল্পতা। জবাকে দক্ষিণ ভারতে 'ওড্র পুষ্প' বলে, অর্থাৎ 'ওড় ফুল'। এটির বিজ্ঞানসম্মত নাম Hibiscus rosa sinensis Linn। এটি Malvaceae পরিবারের অন্তর্গত। এখানে ল্যাটিন শব্দ 'রোসা সাইনেন্সিস'-এর অর্থ 'চীন দেশের গোলাপ'। যদিও এর সাথে গোলাপ ফুলের কোনও সম্পর্ক নেই। সাধারণত জবার প্রকারভেদ তিনটি। তথা-- (১) শ্বেতজবা, Hibiscus syriacus. ছোট গাছ, ফুল সাদা। (২) রক্তজবা, (৩) পঞ্চমুখী জবা, বহুদল জবা। এছাড়াও বর্তমানে শংকর প্রজাতির কল্যাণে জবা গাছের অসংখ্য প্রজাতির খোঁজ মেলে। বিভিন্ন রঙের এবং বিভিন্ন ধরনের জবাফুলের সম্ভারে বাগানপ্রিয়দের বাগান পরিপূর্ণ। কিন্তু লাল রঙের জবাফুলের মাহাত্ম্য এবং ঐতিহ্যটাই আলাদা। একে বলে 'রক্তজবা'। আর জবাগাছের পুংদন্ড মিলিতভাবে একটি নলের সৃষ্টি করে। সেটি ঝুলে থাকে। পরাগধানী মুক্ত ও বৃক্কাকার, স্ত্রী কেশর ৫ টি, গর্ভদন্ডটি পুং নলের মধ্যেই থাকে। এদের কোনও ফল হয় না। গাছের ডাল ভেঙে মাটিতে পুঁতে দিলে নতুন শিকড় গজায় এবং বংশবিস্তার করে। 

'জবা' নামটি সংস্কৃত 'জপা' শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ প্রার্থনা। অর্থাৎ মাকালীর কাছে প্রার্থনা করা। ঋগ্বেদের ১।৫১।২ সুক্তের ভাষ্যে 'জবা' শব্দের অর্থ করা হয়েছে 'গতি'। আবার অন্য দিকে অমরকোষের (৬ষ্ঠ শতকের অভিধান) টীকার বলা হ'য়েছে- 'ওড্রকুসুমম্'। তাই কবিরাজ শিবকালী ভট্টাচার্যের মতে, জবাকুসুম হবে না, বরং জপাকুসুম হবে। অর্থাৎ আলতা রাঙা রঙ। রামায়ণের উত্তর কাণ্ডের ৩৫ অধ্যায়ের ২৩ নম্বর শ্লোকে বলা হ'য়েছে-
'জপাকুসুম সংকীর্ণে তীরং লোহিতং মীক্ষতে'। 
এখানে 'জপা' অর্থে আলতা (জপা অলক্তকং)। 
আমরা সূর্যপ্রনাম মন্ত্রপাঠের সময় বলি --
'ওঁং নমঃ জবাকুসুম সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিং 
ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্ন প্ৰণতোঽস্মি দিবাকরং, ওঁং'।  
জবাফুলের মালা

১৯৬০ এর ২৮ শে জুলাই থেকে মালয়েশিয়ার জাতীয় ফুল হল জবাফুল। একে মালয় ভাষায় বলে বুঙ্গা রায়া। অর্থাৎ 'বড় ফুল' বা 'উদযাপনকারী ফুল'। মালয়েশিয়ার টাকা এবং মুদ্রায় এই জবা ফুলের ছবি পাওয়া যায়। জবাফুলের লাল পাঁপড়ি মালয়েশিয়ার মানুষের সাহস, জীবন এবং দ্রুত বৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। আর এই পাঁচটি পাঁপড়ি মালয়েশিয়ার পাঁচটি রুকুন নেগারাকে প্রতিনিধিত্ব করে। মালয়েশিয়া ছাড়াও হাইতির জাতীয় ফুলও জবা। এখানে জবাকে পর্যটনের প্রচারের প্রতীক হিসাবে বিবেচিত করা হয়েছে। এখানকার ফিউশন অফ হাইতিয়ান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটস নামক একটি রাজনৈতিক দলের প্রতীকচিহ্ন এই জবাফুল। হিন্দু সংস্কৃতিতে জবাফুলের স্থানের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। জবাফুল শুকিয়ে গেলে আপনা আপনিই ঝরে যায়। তা নিয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগণায় আছে ধাঁধা --
'গাছটিতে ধরে শত শত ফুল
ফুল এমনি ঝরে যায়, 
ধরে না ফল, 
তুলে আনলে তাতে হয় কালীমার পূজা'।
বাংলায় চড়ক উৎসবের সময় ভক্তবৃন্দ যখন বাণফোঁড় করে, তখন শলাকার অন্য তীক্ষ্ণ প্রান্তে একটি জবাফুল গুঁজে দেয়। এতে নাকি পাপস্খলন ঘটে। আবার দেবদেবীর সামনে বলিদানের সময় প্রদত্ত বস্তুর গলায় ঝোলানো হয় জবাফুলের মালা। কাজী নজরুল ইসলামের গানের ভাষায় পাই --
'বল্ রে জবা বল্-
কোন্ সাধনায় পেলি শ্যামা মায়ের চরণতল॥
মায়া-তরুর বাঁধন টু'টে মায়ের পায়ে পড়লি লু'টে
মুক্তি পেলি, উঠলি ফুটে আনন্দ-বিহ্‌বল।
তোর সাধনা আমায় শেখা (জবা) 
জীবন হোক সফল॥
কোটি গন্ধ-কুসুম ফোটে, বনে মনোলোভা -
কেমনে মা'র চরণ পেলি, তুই তামসী জবা।
তোর মত মা'র পায়ে রাতুল হবো কবে প্রসাদী ফুল,
কবে উঠবে রেঙে
ওরে মায়ের পায়ের ছোঁয়া লেগে উঠবে রেঙে,
কবে তোরই মত রাঙবে রে মোর মলিন চিত্তদল'॥     
  
তান্ত্রিকদের উপাসনায় দেবী অর্চনার সময় কাপালিকগণই প্রথম জপাকুসুমকে বশীকরণ ও মারণকার্যে ব্যবহার করতেন। ভবভূতির 'মালতীমাধব' এবং বাণভট্টের 'কাদম্বরী'তে জপাকুসুমকে বশীকরণ ও মারণ কার্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেখা যায়। 

প্রাচীন শাস্ত্রে জবাফুলের কথা তেমন পাওয়া যায় না। তবে একাদশ শতকে চক্রপানি দত্তের গ্রন্থে চুল কালো করার উপায় হিসেবে জবাফুলের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লিখিত রয়েছে। 
'না-ই পরিলে নোটন খোঁপায় ঝুমকো জবার ফুল (রানী)
এমনি এসো (ওগো) লুটিয়ে পিঠে আকুল এলোচুল।।
সজ্জা বিহীন লজ্জা নিয়ে
এমনি তুমি এসো প্রিয়ে
গোলাপ ফুলের রঙ মাখাতে হয় যদি হোক ভুল'।।
       -- কাজী নজরুল ইসলাম
বিভিন্ন ধরনের জবাফুল

জবাফুলের মধ্যে থাকে Quercetin 3 diglucoside, Quercetin 3, 7 diglucoside, Cyaniding 3, 5 diglucoside, Querectin 3 sophorotrioside, Kaempferol 3 xylosylglucoside ইত্যাদি। এছাড়াও থাকে Cyclopeptide alkaloid, Cyanidin chloride, Hentriacontane, Riboflavin, Ascorbic acid, Thiamine, Taraxeryl accetate, ẞ sitosterol, Cyclic acids, Sterculic এবং Malvalic acid। 

জপাকুসুমের ভেষজ শক্তির ব্যবহার নবম শতাব্দীতে ধরা পড়ে। জবাফুল বেটে খেলে অধিক রজঃস্রাবে খুব উপকারী। জবা ফুলের অংশকে বেটে সরবতের মত ক'রে খেতে দিলে বমি হ'য়ে পেট থেকে অহেতুক প্রবেশ করা অখাদ্য তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে যাবে। জবা ফুলকে ঢেকিছাঁটা আতপ চালের জলে চটকে নিয়ে ছেঁকে ঐ পিচ্ছিল জলটা আধ ঘণ্টা অন্তর দু'ই বার করে খেলে ভেদ হওয়া কমে যাবে। এছাড়াও টাকপোকা লাগা থেকে রেহাই পেতে, চোখের কোনের ক্ষত থেকে মুক্তি লাভ, অনিয়মিত মাসিক, ঘন ঘন মুত্র পাওয়া, অধিক মাসিক স্রাব সমস্যার সমাধানে জবা গাছের বিভিন্ন অংশ খুব উপকারী। ভারতের কোথাও কোথাও জু্তা চকচকে করতেও ব্যবহৃত হয় জবা ফুল। তাই একে বলে জুতা পরিষ্কারক ফুল। চীনেও এই ফুলের পাঁপড়ি দিয়ে জুতো পালিশের বস্তু তৈরি হয়। ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়াতে বলে কেম্বাং সেপাতু বা বুঙ্গা সেপাতু। অর্থাৎ 'জুতার ফুল'। এই ফুল আসলে পিএইচ সূচক। কেননা কোনও অ্যাসিডিক দ্রবণে ডুবানো হলে এটি গাঢ় গোলাপী বা ম্যাজেন্টা রঙে পরিণত হয় এবং ক্ষারীয় দ্রবণে এটি সবুজ রঙে পরিণত হয়। জবাফুল থেকে প্রাপ্ত একপ্রকার নির্যাস অতিবেগুনী রশ্মি শোষণ করতে পারে। তাই জবাফুলকে ইদানিং প্রসাধনী দ্রব্য হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যা আসলে অ্যান্টি সোলার এজেন্ট।

🍂

Post a Comment

0 Comments