কমলিকা ভট্টাচার্য
গরীব শব্দটি শুনলেই আমরা সাধারণত অর্থহীন, নিঃস্ব, অথবা জীবনের প্রয়োজনীয় চাহিদাগুলি পূরণে অসমর্থ মানুষদের কথা ভাবি। কিন্তু গরীব শব্দটির সংজ্ঞা কি শুধুই এখানেই সীমাবদ্ধ? নাকি এটি মানসিকতার একটি প্রতিচ্ছবি, যেখানে আমরা অর্থ আর ক্ষমতার প্রাচুর্যের আড়ালে লুকিয়ে অন্যের প্রতি আমাদের শোষণ আর নির্লজ্জ আচরণকে বৈধতা দিই?
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আমরা কতো সহজে আমাদের চারপাশের মানুষদের ওপর এই শোষণের ক্ষমতা প্রয়োগ করি, তার উদাহরণ অসংখ্য। আমাদের বাড়িতে যারা সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি আমাদের বাড়ি পরিষ্কার, রান্না, আর অন্যান্য কাজ সামলান—তাদের প্রতি আমরা কতটা ন্যায্য? মাসের শেষে নামমাত্র পারিশ্রমিক হাতে তুলে দিয়ে আমরা ভাবি, আমরা তাদের বড় দয়া করছি। অথচ, তাদের কাজের তুলনায় পারিশ্রমিক একেবারেই সামঞ্জস্যহীন।
একবার ভাবুন রাস্তার ছোট দোকানদার বা ফেরিওয়ালার কথা। যিনি সারা দিন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে একটি পণ্য বিক্রি করে সামান্য কিছু আয়ের আশা করেন। আমরা তার কাছ থেকে দরাদরি করে পণ্য কেনার সময় তার অবস্থার কথা একবারও ভেবে দেখি কি? তার কয়েক টাকা মুনাফা যদি আমাদের ন্যায্য মূল্যের চেয়ে এক পয়সাও বেশি হয়, আমরা তাকে চাতুর্যের দোষ দিই। অথচ বড় বড় শপিং মলে হাজার টাকা খরচ করতে আমাদের কোনো দ্বিধা থাকে না।
অফিস বা অন্যান্য ক্ষুদ্র পরিষেবা ক্ষেত্রে কাজ করা মানুষদের অবস্থাও আলাদা নয়। একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান বা প্লাম্বার যদি তার কাজের সঠিক পারিশ্রমিক চান, আমরা তাকে ঠকানোর চেষ্টা করি। এমনকি তাকে তার কাজের জন্য ধন্যবাদ দেওয়ার বিন্দুমাত্র শিষ্টাচারও অনেক সময় দেখাই না। তারাও একটি জীবনযুদ্ধে লিপ্ত, যেখানে আমাদের মতো মানুষের সম্মান ও সমর্থন তাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে পারত।
🍂
ক্ষমতার শোষণ ও নামযশের লালসা
আজকাল এক নতুন ধরণের শোষণের রূপ আমরা দেখতে পাই। সমাজের উচ্চবিত্ত এবং ক্ষমতাবান মানুষরা গরীবদের সাহায্যের নামে নামযশ অর্জনের খেলায় লিপ্ত। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে দানের ছবি, মানুষের কাছে বাহবা পাওয়ার লোভে সাহায্যপ্রাপ্ত ব্যক্তির লজ্জা আর অপমানের অনুভূতিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা হয়। এই ধরনের শোষণ শুধু আর্থিক নয়, এটি তাদের আত্মসম্মানের উপর সরাসরি আঘাত।
মানসিক দাসত্বের শৃঙ্খলে গরীবদের বেঁধে রাখা
শোষণ এখানেই থেমে থাকে না। এই সমাজের ক্ষমতাবানরা দরিদ্রদের মনের গভীরে ঢুকে তাদের এমন এক মানসিক দাসত্বের শৃঙ্খলে বেঁধে রাখে, যা থেকে মুক্তি প্রায় অসম্ভব। কাজের লোকেরা যতই কঠোর পরিশ্রম করুন না কেন, তাদের বারবার বোঝানো হয় যে তারা আমাদের দয়ার দান। তাদের স্বাভিমানকে ভেঙে ফেলার জন্য এই ধারণাটি তাদের মনের মধ্যে এমনভাবে বসিয়ে দেওয়া হয় যে, তারাও মনে করতে শুরু করে—তাদের এর বেশি কিছু প্রাপ্য নয়।
গরীবরা যেন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ব্যবহারের একটি জিনিসে পরিণত হয়। আমাদের সেবা দিয়ে তারা যদি কোনোকিছু পায়, আমরা তাদেরকে আমাদের প্রতি চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকার দাবি করি। তাদের কাজের অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে দিই, কিন্তু যোগ্য পারিশ্রমিক দিই না। তাদের মুখে হাসি ধরে রাখার জন্য আমরা গরীবদের ব্যর্থতাকেই তাদের প্রাপ্য বলে বুঝিয়ে দিই।
সমাজের পরিবর্তন কোথায়?
আজও আমরা মধ্যযুগের মতোই দরিদ্রের অসহায়তাকে নিজেদের উন্নতির সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করি। সময় বদলেছে, শোষণের ধরন বদলেছে, কিন্তু শোষণের ভিত্তি রয়ে গেছে একই। দরিদ্রতা যেন সমাজের চিরস্থায়ী এক ব্যবস্থা।
গরীবরা থাকবেই, কিন্তু তার চেয়েও ভয়ংকর সত্য হলো, গরীব মনের মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। আমরা নিজেদের ভাবতে শিখেছি ক্ষমতাবান, পরিপূর্ণ, এবং যোগ্য। কিন্তু বাস্তবে আমরা একটি শোষণমূলক মানসিকতার দাস, যেখানে নিজেদের চাওয়া-পাওয়ার আড়ালে আমরা প্রতিনিয়ত দুর্বলদের শোষণ করে চলেছি।
একটি নতুন সমাজ তৈরি করার জন্য প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। প্রয়োজন মানুষের প্রতি মানুষ হিসেবে সম্মান এবং তাদের প্রতি সমব্যথী হওয়ার। আমাদের প্রয়োজন "ক্ষমতা" নয়, বরং মানবিকতাকে বাঁচিয়ে রাখা। সমাজের প্রতি, দরিদ্র মানুষের প্রতি এই দায়বদ্ধতা প্রতিটি মানুষের। শোষণ নয়, তাদের পাশে দাঁড়ানোই হোক আমাদের লক্ষ্য।
0 Comments