'একুশ' যাপন : ভাষা আন্দোলন , বীরত্বের কিন্তু বিস্মৃত ইতিহাস
প্রসূন কাঞ্জিলাল
মাতৃভাষার বিপন্নতার দিনে 'একুশের' লড়াই-এর ইতিহাস আজ নতুন প্রজন্মের কাছে অন্যতম দৃষ্টান্ত স্বরূপ, যেখানে মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে বাংলার কিছু মহান সন্তান প্রাণদানেও পিছু পা হননি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখনীতে -
"কেহ নাহি জানে, কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে, সমুদ্রে হল হারা। হেথায় আৰ্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড়-চীন শক-হুন-দল পাঠান-মোঘল এক দেহে হল লীন।”
এই রক্ত মিশ্রণে বাঙালীকে দিয়েছে অনার্যের শিল্পকৌশল আর ভাবপ্রবণতা। আর্যের সংস্কৃতি, তার তীক্ষ্ণ ও সূক্ষ্ম চিন্তাশক্তি এবং মিশ্রণের উদারতা। বাঙালীর নেতৃত্বে জাতি সমন্বয়ের প্রাচুর্য্য, তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের একটি প্রধান কারণ।পট পরিবর্তন আসে আঠারো শতকের শেষার্ধে। নতুন ঐতিহাসিক শক্তির আবির্ভাব হয় এবার আর উত্তর পশ্চিমে নয়, পূর্ব ভারতে এবং বাংলায়। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আধুনিক জন্ম নিল বাংলাদেশে। বদলে গেল ইতিহাসের ছন্দ। অজস্র গ্লানির ভিতর দিয়ে, নতুন সভ্যতার আভাস এসেছে। আর সেই গ্লানিতেই আজও অবসন্ন বাঙালী। উদাহরণ স্বরূপ আমরা মনে রাখতে পারি যে, প্রাক-১৯৭১ এর সময়ে যখন পূর্ববাংলা ইস্ট পাকিস্তান ছিল, তখন সেই দেশের মানুষদের অনেক গ্লানি সহ্য করতে হয়েছিল, বাংলাভাষার কারণে।
"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো,
একুশে ফেব্রুয়ারী
আমি কি ভুলিতে পারি ।।
ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু
গড়ায়ে ফেব্রুয়ারী ।।
আমার সোনার দেশের
রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী ।।"
এ যুগ নেতার যুগ নয়- কর্মীর যুগ। বহু অখ্যাত অজ্ঞাত লোক গভীর আদর্শবাদ নিয়ে নিঃস্বার্থভাবে তিলে তিলে খেটে চলেছে তলায় তলায়। তাঁদের সাধনার যৌথশক্তি একদিন নিশ্চয়ই আসমুদ্র হিমাচল বাংলাকে, সমূলে পরিবর্তন করতে পারবেই। কারণ সংকটের চরম প্রহরেই নেতৃত্ব, আপনিই আসে। উদাহরণ স্বরূপ এথেনীয়েরা নতুনকে অস্বীকার করেছিল বলে, তাই তারা মারা গেছে। কিন্তু বাঙালী তার নতুনকে গ্রহণ করে, নিজের করে বেঁচে থাকবে। কারণ বাংলার পূর্ণজাগরণের সময় পাশ্চাত্য ভাষা ও সংস্কৃতিকে তৎকালীন বাঙালীরা শুধু গ্রহণই করেননি বরং সেগুলোকে নিজের করে নিয়েছিলেন এবং এটাও লক্ষ্য করা যে বাংলাভাষার মধ্যে অন্যভাষাকে গ্রাস করার কোন মনোবৃত্তিও থাকেনা। কেননা বাংলাভাষার মধ্যে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার শক্তি আছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪ - ১৮৪৬), রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২ - ১৮৩৩), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০ - ১৮৯১), মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪ - ১৮৭৩), হরিশ্চন্দ্র মুখার্জী (১৮২৪ - ১৮৬১), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮ - ১৮৯৪) প্রভৃতি মনীষীদের কথা মনে পড়ে। প্রাদেশিকতা, সাম্প্রদায়িকতা এমনকি অন্ধজাতীয়তাও হবে যুগবিরোধী। স্বাতন্ত্র্য থাকবে, বৈচিত্র্য থাকবে কিন্তু তা যেন সমন্বয় বিরোধী না হয়। স্বার্থ যেন সুবুদ্ধিকে গ্রাস না করে।
🍂
মাতৃভাষায় মানুষের জন্মগত অধিকার এবং এ ভাষায় কথা বলে মনের ভাব আদান প্রদান করে মানুষ সবচেয়ে বেশী তৃপ্তি লাভ করে। বিশ্বজুড়ে হাজার ভাষা প্রচলিত থাকলেও মায়েরভাষায় তথা স্বদেশী ভাষায় যে কী তৃপ্তি ,কী সুখ তা কেবল অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করার যোগ্য। আশা আকাঙ্খার সঠিক বহিপ্রকাশ কেবল মাত্র সে ভাষাতেই সম্ভব। যে ভাষায় প্রাণের আরাম, মনের বিকাশ, চেতনা চর্চা চরৈবেতির দোসর, সেই সৃষ্টি সুখের ভাষা দিয়ে "ছোট প্রাণ ,ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা দিয়ে গড়ে তোলা আলাপ আলোচনা। বইয়ের পাতায় লিখে যাওয়া মানবিক চিন্তার পিরামিড।
বিভিন্ন ভাষা বিজ্ঞানী ভাষার সম্বন্ধে তাঁদের মতামত বিভিন্ন ভাবে দিয়েছেন এদের মধ্যে ভাষাবিজ্ঞানী স্টার্টেভান্ট বলেছেন --'' A language is a system of arbitrary vocal symbols by which members of a social group co-operate and interact''.
ড; সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ভাষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন -- ''মনের ভাব প্রকাশের জন্য ,বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনি দ্বারা নিস্পন্ন ,কোন বিশেষ জনসমাজে ব্যবহৃত , স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত তথ্য বাক্যে প্রযুক্ত শব্দ সমষ্টিই ভাষা।
আবার ভাষা তত্ত্ববিদ ড; সুকুমার সেন বলেছেন --''মানুষের বাক যন্ত্র দ্বারা উচ্চারিত অর্থবহ বহুজনবোধ্য ধ্বনিসমষ্টিই ভাষা। '' অর্থাৎ ভাষা বলতে বোঝা যায় যে ,মানুষের বাগযন্ত্র দ্বারা উচ্চারিত কোন জনসমাজে ব্যবহৃত ধ্বনিসমষ্টিই যার দ্বারা মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করে তাকে ভাষা বলে। সুতরাং ভাষার বৈশিষ্টগুলি আলোচনা করলে সহজেই খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে-- সেই আদি বাণী যা মানুষের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এসে বাগযন্ত্র দ্বারা উচ্চারিত হবে,বহুজনবোধ্য হবে। প্রসারিত হবে সময়ের সাথে দেশ কালের গন্ডি পেরিয়ে। অনেক মানুষ এর দ্বারা মনের ভাব আদান প্রদান করবে।
মানুষ চিন্তাশীল প্রাণী। তাঁর চিন্তা ভাবনা আনন্দ বেদনা অন্যের কাছে পৌঁছে দিতে পারে একমাত্র ভাষার মাধ্যমেই। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই কবেই তো বলেছিলেন আলো দিয়ে আলো জ্বালা। এভাবেই তো পূর্ববর্তী মানুষের ভাব ভাবনা ভাষায় লিখিত রূপের মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যায়। এভাবেই একের জ্ঞান অন্যে উপলব্ধি করে গড়ে তুলেছে সভ্যতা এবং সভ্যতার বিকাশ ঘটেছে যুগের সাথে অহর্নিশি পাল্লা দিয়ে। পৃথিবীতে এক দেশের মানুষের সাথে যেমন অন্য আর এক দেশের মানুষের চেহারার বেশ পার্থক্য দেখা যায় তেমনি তাদের মুখ নিঃসৃত ভাষার ও রয়েছে নানান পার্থক্য।
''নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান'' দিয়ে গড়া এই মনুষ্য জাতি। তার রুচিতে আহারে আছে নানা বৈচিত্র্য তেমনি ভাষাতেও রয়েছে বিস্তর বৈচিত্র্য। একেক দেশের মানুষ একেক ভাষা ব্যবহার করে। শিশুটির জন্মভূমির আলো বাতাস,পরিবেশ ,তার মাতাপিতার ব্যবহৃত মুখের ভাষাতেই শিশুর বিকাশ গড়ে ওঠা সহজ ও সরল হয়। তাই তো মাতৃ ভাষার মাধ্যমেই মানুষ সমস্ত জ্ঞানের বিষয় সবচেয়ে বেশী উপলদ্ধি করে এবং প্রকাশে সক্ষম হয়। মানুষ তার নিজস্ব ভাষাটির সাথে পরের দেশের ভাষাটি ও আয়ত্ব করে । কিন্ত অপরের ভাষায় কিছু বুঝতে হলেও মাতৃভাষার মাধ্যমেই প্রথমে নিজেকে বুঝে নিতে হয় । তাই আপন অন্তরের ভাষা দিয়েই সম্প্রীতি রক্ষা অবশ্যই তাকে করতে হবে। কারণ এই জেডযুগে মানুষ আজ নিজের ছোট্ট গন্ডিতে আবদ্ধ নয়।সে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রত্যেকের মাতৃভাষা প্রাণের ভাষাটি তার কাছে তাই সমান দামী হওয়া উচিত । তাকে শ্রদ্ধা সম্মান জানানো প্রতিটি বিবেক বান বুদ্ধি সম্পন্ন মানুষের অবশ্যই কর্তব্য। অন্যের ভাষা কে উপযুক্ত শ্রদ্ধা সম্মান জানালে একমাত্র ভাষা দ্বারাই সম্ভব হয় বিশ্বশান্তি বজায় রাখা।
একুশ আমাদের এগিয়ে চলার অনুপ্রেরণা। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে বাংলাদেশের জন্ম , তা আমাদের চেতনাকে শানিত করে। একুশের আছে নানা কবিতা ও গান। এ দেশের কবি, সাহিত্যিক, সুরকার, গীতিকাররা একুশকে ধারণ করেছেন তাদের লেখায়, সুরে ও কণ্ঠে। আর সেই সব গান, কবিতা আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়। একুশকে সাথে নিয়ে সামনে এগিয়ে চলতে পথ দেখায়।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি/ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি/
আমি কি ভুলিতে পারি।’
একুশের এই একটি গান আমাদের একুশের চেতনার সঙ্গে এমনভাবে মিশে আছে, যা আমরা কখনই ভুলতে পারি না। এ গান শুনলেই মনে হয় আমরা ১৯৫২ সালের সেই দিনটিতে ফিরে যাই যেদিন সালাম, রফিক, জব্বারেরা মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত এ গান তাই চির অম্লান।
আরেকটি গান এখনও সবার মুখে মুখে ফেরে। সেটি হল ---
‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়।’
গানের মতো কবিতায়ও বারবার উঠে এসেছে অমর একুশ। একুশের প্রথম কবিতাটি লিখেছেন মাহবুব উল আলম চৌধুরী। সেই কবিতার চরণে আছে, ----
‘এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে/রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়/ সেখানে আগুনের ফুলকির মতো/ এখানে ওখানে জ্বলছে অসংখ্য রক্তের ছাপ/ সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি।’
কবিতাটির আরেকটি জায়গায় আছে --
‘যারা আমার অসংখ্য ভাইবোনকে/যারা আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে চেয়েছে/তাদের জন্য আমি ফাঁসির দাবি করছি।’
শামসুর রাহমানের "বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা" কবিতার একটি চরণে আছে,- --
‘তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো, কি থাকে আমার? উনিশশো বাহান্নর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি/বুকে নিয়ে আছে সগৌরবে মহীয়সী।/ সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হলে আমার সত্তার দিকে/কত নোংরা হাতের হিংস্রতা ধেয়ে আসে।’
আহসান হাবীব তার "মিছিলে অনেক মুখ" কবিতায় লিখেছেন ---
‘মিছিলে অনেক মুখ/ দেখো দেখো প্রতি মুখে তার/সমস্ত দেশের বুক থরো থরো/উত্তেজিত/শপথে উজ্জ্বল!’/সূর্যের দীপ্তিতে আঁকা মিছিলের মুখগুলি দেখো/ দেখো দৃপ্ত বুক তার/ দেখো তার পায়ের রেখায়/ দেশের প্রাণের বন্যা উচ্ছল উত্তাল।’
কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ তার "স্মৃতিস্তম্ভ" কবিতায় লিখছেন, ----
‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার ? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো/চার কোটি পরিবার/খাড়া রয়েছি তো। যে ভিৎ কখনো কোনো রাজন্য/পারেনি ভাঙতে।’
এভাবেই কবি-সাহিত্যিকরা আমাদের চেতনার বুদবুদে একুশের চেতনাকে শানিত করেছেন বারবার। এসব গান, কবিতা এখনও আমাদের মধ্যে চিন্তার খোরাক জোগায়। ভাষা সংগ্রামের একুশের চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
একুশের বাংলা সাহিত্য এই অঙ্গনকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। ভাষার জন্য যে জাতি প্রাণ দিয়েছে, তার ইতিহাস বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি পরতে পরতে লেখা আছে। মায়ের মুখের ভাষা রক্ষায় বাংলার দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্তে পিচঢালা কালাে রাজপথ রঞ্জিত করেছিল। তাদের এ আত্মত্যাগের ফসল বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। দেশ, দেশের মানুষ বা মাতৃভাষার জন্য এ আত্মত্যাগ পৃথিবীর অন্য কোনাে দেশের ইতিহাসে নেই। তাই একুশ জড়িয়ে আছে আমাদের সামগ্রিক ও জাতীয় চেতনায়। সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন কবি-লেখকগণ তাদের সাহিত্যের মুখ্য উপকরণ হিসেবে একুশকে গ্রহণ করেছেন। আর সেসব মনীষীরা হলেন- ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মুনীর চৌধুরী, জহির রায়হান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হুমায়ুন আজাদ, শওকত ওসমান, কবি শামসুর রাহমান প্রমুখ।
একুশ সম্পর্কে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন --
'মাতা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি প্রত্যেক জাতির কাছে পরম শ্রদ্ধার বিষয়।' তিনি আরও বলেছেন, বাঙালির প্রাণের দাবি, মনের দাবি বাংলা ভাষা। এ ভাষায় তাদের কথা বলতে না দিলে তারা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হবে।'
"মােদের ভাষার প্রাণ
একুশ করেছে দান
একুশ মােদের পাথেয়
একুশকে করাে নাকো হেয়।"
---- একুশ সম্পর্কে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর উক্তিটি বাংলা সাহিত্যে একুশের অবস্থানকে আরও দৃঢ় করেছে।
বাহান্নর একুশে ফেরুয়ারিতে মাতৃভাষার জন্য যেসব তরুণ নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেছিল, স্বাধীনতা উত্তরকালেও সে মাতৃভাষা বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্যের শিরায় শিরায় প্রবহমান। শামসুর রাহমান, মােহাম্মদ মনিরুজ্জামান, সিকান্দার আবু জাফর, মুনীর চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশ-কাল ও সমাজের সমকালীন আবহে বিভিন্ন সাহিত্যকর্ম সৃষ্টি করেছেন। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সিকান্দার আবু জাফর তার "সংগ্রাম চলবেই" কবিতায় লিখেছেন —
"জনতার সংগ্রাম চলবেই।
আমাদের সংগ্রাম চলবেই ।"
কবির এ সংগ্রাম ছিল পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে, নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ। একুশ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে প্রথম কবিতা লেখেন কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী। তাঁর রচিত "কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি" কবিতাটি একুশের অন্যতম সেরা কবিতা। "স্বাধীনতা তুমি" কবিতায়ও কবি শামসুর রাহমান একুশের চেতনা ফুটিয়ে তুলেছেন। কবি লিখেছেন —
"স্বাধীনতা তুমি
শহিদ মিনারে অমর একুশে ফেব্রুয়ারির উজ্জ্বল সভা !"
ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রখ্যাত নাট্যকার মুনীর চৌধুরী লিখেছেন --
‘কবর’ নাটক । একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে রচিত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে- জহির রায়হানের 'আরেক ফাল্গুন', শওকত ওসমানের 'আর্তনাদ', সেলিনা হােসেনের "নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনি"। একুশ নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে- জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া' এবং 'Let there be Light' । এছাড়াও একুশ নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক ছােটোগল্পও ।
একুশের চেতনা দেশের সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিবিদদের সাহিত্য রচনা করার প্রেরণা যুগিয়েছে। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা স্বীকৃত হওয়ার পর বাংলা ভাষার পঠন-পাঠন ও চর্চার প্রতি আগ্রহ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে। সেই সাথে শিল্পী ও সাহিত্যিকগণ বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গােষ্ঠীর উদ্ভব, নানা পত্র-পত্রিকার জন্ম, গল্প-কবিতা, প্রবন্ধ উপন্যাস-নাটকে স্বাধিকার অর্জনে দীপ্ত মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে। বাংলার তেজোময় সাহিত্যিকবৃন্দ তাঁদের সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম দিয়ে জাতির বিবেককে বারবার নাড়া দিয়েছেন। বর্তমান বাংলা সাহিত্যে ভাষা আন্দোলনের অতীত স্মৃতিকে অধিকতর উজ্জ্বল করে তুলেছেন কবি শামসুর রাহমান, শওকত ওসমান, ড. নীলিমা ইব্রাহীম, হুমায়ুন আজাদ, আল-মাহমুদ, জাহানারা আরজু, আব্দুল মান্নান সৈয়দ প্রমুখ সাহিত্যিক । ওদেশের সাহিত্যিকগণ একুশের চেতনাকে অন্তরে ধারণ করে বাংলা সাহিত্যের পরিধিকে বর্ধিত করেছেন।
ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি চির অম্লান ঘটনা। একুশের চেতনা বা প্রভাব আমাদের সাহিত্যের ভান্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ। একুশ কেন্দ্রিক সাহিত্য আমাদের এনে দিয়েছে আত্মপরিচয়ের প্রেরণা ও আত্মনির্মাণের যােজনা। বর্তমান প্রজন্মের কাছে একুশের তাৎপর্য সঠিকভাবে তুলে ধরার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আব্দুল গাফফার চৌধুরী কলম ধরেছেন।
আমরা জানি ভাষা আন্দোলন ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু হয়ে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস একদিকে যেমন আনন্দের তেমনি অন্যদিকে বেদনার। ১৯৪৭ সালে এ উপমহাদেশ থেকে ইংরেজরা বিদায় নিলে শুরু হয় পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর অমানবিক অত্যাচার । পাকিস্তানিরা এদেশকে শােষণ করার জন্য প্রথমে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির প্রাণপ্রিয় মুখের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছে। তারা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে। কিন্তু বাঙালি তা মেনে নিতে পারেনি। গড়ে তুলেছে তীব্র প্রতিবাদ। ক্রমে ক্রমে এ আন্দোলন বাড়তে থাকে এবং ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি এক প্রবল বিস্ফোরণে পরিণত হয়। এ আন্দোলনে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর ও আরও অনেকে জীবন দিয়ে মাতৃভাষাকে রক্ষা করার ও ভাষার মর্যাদাকে অক্ষুন্ন রাখার প্রয়াস চালিয়েছেন। এই আন্দোলনের ফলে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। একুশ উন্নীত হয় এক স্বতন্ত্র মর্যাদায়। সেই থেকে একুশ হয়ে ওঠে সংগ্রামের উৎস, চেতনার অধ্যায় । মহান একুশ শিখিয়েছে জাতীয় স্বার্থে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতে। এমনকি একুশের মধ্য দিয়ে বাঙালি তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েছে ও অধিকার রক্ষা করে মাথা উচু করে বাঁচার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই করতে শিখেছে। এক কথায় বলা যায়, একুশই বাংলার সকল আন্দোলনের পেছনে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
দেশভাগ হবার পরেই পূর্ব পাকিস্তানে দাবি উঠেছিল বাংলা ভাষাকে উর্দু ভাষার সমান মর্যাদা দিতে হবে। পাকিস্তানের গণপরিষদে প্রতিটি বাঙালি সদস্যকে মাতৃভাষায় বক্তব্য রাখার সুযোগ দিতে হবে। সেই দাবি মতো প্রস্তাব উঠেছিল গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তর নেতৃত্বে। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনমুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ চেয়েছিলেন ধর্মের আড়ালে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠা কায়েম করতে। সেই সংকীর্ণ স্বার্থেই ১৯৫২র ২৬ শে জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঘোষণা করেন 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু'। এই ঘোষণার কয়েক দিন পর একুশে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার ছাত্রছাত্রীরা বিশাল মিছিল বের করেন। সরকারও নীরব থাকে না। উত্তাল মিছিলে সেনাবাহিনী বর্বর আক্রমণ হানে। গুলি চালায় এলোপাথাড়ি। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে বেশ ক'টি তরতাজা প্রাণ। এই মর্মান্তিক ঘটনায় আন্দোলন থেমে তো যায়ই না, বরং অগ্নিতে ঘৃতাহুতির মতো আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হয়। শুধু ঢাকায় নয়, গোটা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে বিক্ষোভ আন্দোলন প্রসারিত হয়। অবশেষে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়েই উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়। প্রথমে আরবি হরফে বাংলা লেখার মতো হাস্যকর ঘটনা ঘটলেও শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি বাংলাকে মেনে নেওয়া হয়।
তবে এই বাংলায় সামগ্রিক সাংস্কৃতিক চিত্রটা কেমন ? অতিশয়োক্তির মতো শোনাবে, তবু বাস্তব সত্য এটাই নিজেদের সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পর্কে এ বঙ্গের বাসিন্দারা ক্রমশই অমনোযোগী হয়ে পড়ছেন। গ্রাম-মফস্বলে একটা সুস্থ বাংলা সংস্কৃতি চর্চা থাকলেও কলকাতা-কেন্দ্রিক এলিট-ঘেঁষা বলয়টি যেন কিছুটা উন্নাসিক। নির্বিচারে মেনে নিচ্ছেন হিন্দি সংস্কৃতির দাপট। এর একটা কারণ হয়তো রাষ্ট্রীয় কাঠামো। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সর্বত্রই এই একটি ভাষাতেই কথা বলা, পথ চলা। কিন্তু ভারতবর্ষের একটি অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গে তো তা নয়। সুতরাং কিছু অসুবিধা এখানে আছেই। কিন্তু সর্বোপরি যে সমস্যা তা হল মানসিকতার অভাব। বাংলা যে শুধু কোটি কোটি মানুষের মুখের ভাষা নয়, একটি মুক্তমনা জাতির দীর্ঘদিনের শিল্প ও সাহিত্য চর্চার আদরের মাধ্যম এবং পৃথিবীর উন্নত ও সমৃদ্ধ ভাষাগুলির সম-পংক্তিতেই যে এর স্থান, এই মোদ্দা কথাটাই স্মরণে থাকছে না এই বঙ্গের বাসিন্দাদের। বাংলায় কথা বলতে, গান করতে তাঁরা আর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না। রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত সন্ধ্যা এখন আর তাঁদের টানে না। দ্বিজেন্দ্র রজনীকান্ত অতুলপ্রসাদের গানে তাঁরা ক্লান্তি অনুভব করেন। বাংলা আধুনিক গানে, লোকসংগীতে, গণসঙ্গীতে তাঁরা মনের শান্তি, প্রাণের আরাম, প্রেরণার রসদ পান না।
ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। প্রথমত নতুন প্রজন্মের একটা বড় অংশ ক্রমশই বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এমন প্রতিবেশ গড়ে উঠছে না যাতে তারা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে, নিজেদের ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন হয়। সাম্প্রতিক বাংলা ব্যান্ড ও কয়েকটি ভালো মানের বাংলা সিনেমার কথা মাথায় রেখেও এ কথা বলা যায়। শুধু উচ্চবিত্ত বাড়ির ছেলে-মেয়েরাই নয়, মধ্যবিত্ত বাড়ির পড়ুয়ারাও বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চাটা লজ্জার ব্যাপার বলে গণ্য করছে। আর নিম্নবিত্ত বা দরিদ্র শ্রেণীর পড়ুয়ারা, সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর যারা পুরোপুরি নির্ভরশীল, তারা সরকারি শিক্ষানীতির দোলায়িত-চিত্ততার কারণে বাংলা ইংরেজি কোনওটাই ভালো ভাবে শিখছে না।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, সময়ের অভিঘাতে সবকিছু পালটাচ্ছে। মানুষের রুচি ও মূল্যবোধও পালটাচ্ছে। যে কারণে এর সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য বইমেলার চেতনা, উদ্দেশ্য ও কর্মপরিকল্পনায়ও পরিবর্তন আনতে হবে, পরিবর্তন আনতে হবে শিক্ষা ব্যবস্থায়, নতুন প্রজন্মকে বাংলার প্রতি মননশীল করে গড়ে তোলবার জন্য প্রয়োজন ভালো ভালো বাংলা সিনেমা, ওয়েব সিরিজ বা অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমকে কাজে লাগাতে হবে। তবে সেক্ষেত্রেও নজর রাখতে হবে ব্যবহৃত বাংলাদেশ ভাষার শুদ্ধতার ওপর। হিন্দি, বাংলা, ইংরেজি মেশানো এক পাঁচমিশালী ভাষা মনোরঞ্জনের মাধ্যম গুলোকে গ্রাস করেছে। বইকেন্দ্রিক একটি সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণে বইমেলার সঙ্গে সঙ্গে বাকি সকল মাধ্যম গুলো যেন আরো বেশি ইতিবাচক অবদান রাখতে পারে, সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে।
এই অন্তরের ভাষাকে প্রাণ দিয়ে ভালবেসে রক্ষা করার জন্য বাংলার মানুষ রক্ত দিয়েছে , হাসিমুখে উৎসর্গ করেছে তাঁদের জীবন। সেই মহান ভাষা শহীদদের যথার্থ সম্মান জানানো হবে যখন পৃথিবী জুড়ে বাঙালীরা বাংলা ভাষা রক্ষার্থে, তার স্বকীয়তা বজায় রাখতে অন্তর থেকে এগিয়ে আসবে, পরবর্তী প্রজন্মকে উৎসাহিত করবে। যারা দেশ ছেড়ে বিদেশে থাকে ,বিদেশী ভাষায় কথা বলে কাজ চালালেও , তাদের আত্মতৃপ্তি ঘটে স্বদেশী ভাষাভাষীর সাথে কথা বলেই । আত্মবিকাশে মাতৃ ভাষার কোনো বিকল্প নেই। মানব জীবনে ,জাতীয় জীবনে ভাষা এত গুরুত্বপূর্ন বলেই তাঁকে রক্ষার্থে নিজের শরীরের শেষ রক্তবিন্দু টুকু দান করতে শহীদ হয়েছেন মানুষ। সর্বোপরি একটি মানুষ নানা ভাষাতে পারদর্শী হলেও তাঁর একমাত্র পরিতৃপ্ত হয় যখন সে নিজের ভাষায় মনের ভাব টি প্রকাশ করতে পারে। মাতৃভাষার মাধ্যমেই যে তাঁর পূর্ণ বিকাশ সম্ভব হয়।
মধ্যযুগে এবং পরাধীন ইংরেজ আমলে মাতৃভাষা বাংলার গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে কবি ও মনীষীগণ এমন সিদ্ধান্ত লিখিত ভাষ্যে জানিয়েছেন যে, স্বদেশী ভাষা ছাড়া কখনো মনে আশা পূর্ণ হয় না। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে নানা ভাষার পরিমণ্ডলে বসবাস করে এই সত্যটি আবার নতুন করে উপলব্ধি করা সম্ভব হচ্ছে। বৈশ্বিক স্তরে বসবাসকারী বাংলাভাষী মানুষের চরম গতিশীল জীবনে হৃৎস্পন্দনের মতো বক্তব্যটি আজকাল প্রতিনিয়ত মন কে আন্দোলিত করে। চেতনায় অবশ্যম্ভাবি ভাবে নাড়া দিয়ে যায়।
বহু জাতি গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা থাকলেও এদের মধ্যে বেশির ভাগের ভাষারই নেই নিজস্ব বর্ণমালা। লিখিত রূপ না থাকায় তাদের ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে তাদের অবলুপ্তিও যেন ত্বরান্বিত হচ্ছে। অথচ একুশের চেতনাই হচ্ছে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী গুলোর ভাষা হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না। এ দায়িত্ব শুধু বাঙালির নয়, পৃথিবীর সব মানুষের। আমরা যেন শুধু আবেগতাড়িত না হয়ে অমর একুশের কথা না বলি। একুশ তখনই সার্থক হবে, যখন প্রতিটি জনগোষ্ঠী তার নিজের মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারবে। এ ভাষায় শিক্ষা লাভ করতে পারবে। শিল্প-সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারবে। ভাষাচেতনার মাসে এই বোধ জেগে উঠুক সবার মধ্যে ।।
0 Comments