জ্বলদর্চি

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত /বংশীবাবুর খবর এলো পর্ব ১

গল্প ধারাবাহিক। বাসুদেব গুপ্ত
বংশীবাবুর খবর এলো পর্ব ১ 
 
রিপোর্টটা এলো রাত আটটায়। 
সারাদিন ছটফট ছটফট করে গেছেন বংশীবাবু। জল খেয়েছেন গ্লাস গ্লাস। তিনটে জেলুসিল গেছে তার সংগে। পাঁচবার হার্ট রেট চেক করেছেন। মাথা ঠান্ডা করার জন্য ইউটিউবে এক সৌম্য হাস্যময় শ্বশ্রুমুখ ঝানু সন্ন্যাসীকে দেখে দেখে প্রাণায়াম করেছেন দুবার। ডিপ্রেশান কমাতে সিংহাসন করেছেন পাঁচ মিনিট। বেশ বিশদ নিয়ম, প্রথমে মাথাটা ঝুঁকিয়ে দিন পিছনে, চোখগুলোকে ভাঁটার মত বড় করে সোজা সামনে তাকান, তারপর হাঁ করে যতটা পারেন জিভটা বাইরে ঝুলিয়ে দিন টিউবওয়েলের হ্যান্ডেলের মত, তারপর নিজের ভ্রূসন্ধিতে মনোনিবেশ করে আহ আহ করে হাওয়া ছাড়ুন। সব করেছেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় নি। পেট কনকনটা তো ছিলোই। সেটা আরো বেড়ে গেল। এইসময় কাউকে ফোন করলে ভাল হতো। একটু কথা বললে …. । কিন্তু বংশীবাবুর কোন ফোনবন্ধু নেই। ফোনাত্মীয়ও দূর দূর পর্যন্ত কেউ জানা নেই। বংশী মাথাটা হাঁটুর মধ্যে গুঁজে যখন ঘোরা বন্ধ করার চেষ্টা করছেন, ঠিক তখনি একটা ফোন এলো। 

শ্রী চাচারিয়া। ভিনোদ চাচারিয়া। এই বিশাল হাউসিং সোসাইটির সভাপতি। 
=কি দাদা আপনে গাছমে জল দিচ্ছিলেন কেন? জল নষ্ট করছেন বুঝছেন না?
=কে আপনি?
= চাচারিয়া। 
=কে চাচারিয়া? ঠিক চিনলাম না তো। আর আমার গাছে আমি জল দেব জল দিচ্ছে কর্পোরেশন তাতে আপনার কি? কি মুশকিল, আমার নিজের মাথা নিয়ে আমি হিমশিম আর আপনি আমাকে জল দেখাচ্ছেন? 
বংশী উষ্মা গলায় যতটা পেরে ঢেলে দিয়েই বললেন। কিন্তু বিধি বাম। ফোনোপারে যিনি তিনি শক্ত ঘাঁটি। 
= আপনি আমাকে চিনেন না বলে অপ্মান করলেন। জানেন জলের কোতো অভাব? পরিয়াওয়ারণের ক্ষতি করছেন জল নষ্ট করে!
=তা তো জানি। তবে পরিয়াবরণের জন্য গাছও তো দরকার। তারপর শাক সব্জী না খেলে আপনারই বা পুষ্টি হবে কি করে?
=কি আমাকে আপনি কি ভেজ বলে আবার অপ্মান করছেন
=যাচ্চলে অপ্মান কেন! আপনাকে তো আমি চিনিই না, আপনাকে অপমান করে আমার কি লাভ। আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেল তো। 
=আবার অপ্মান। আমি এক সাল হাউসিংএর কারিয়াকর্তা আর আমাকে জানেন না?
বংশীবাবুর পেটে ব্যথাটা বাড়তে শুরু করল। ওঁর জন্য এরকম সব ফোনকলই ভাগ্য বরাদ্দ করেছে। ভুল করে কোন সুধাকন্ঠী মাঝে মাঝে স্যার আপনার জন্য পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে আমরা তৈরী, আপনি কখন চান শুধু বলুন। এরকম কল এলেই বংশী প্রচুর জোরে কাশতে থাকেন আর বলে দেন, মাগো, আমার আর বেশি দিন নেই, আমাকে লোন দিলে যে আর ফেরত নাও পেতে পারো। কিন্তু এই বিদ্ঘুটে ফোন পেয়ে মাথাটা একেবারেই বিগড়ে গেল। মনে মনে সেই প্রশ্ন যা সবাই করে কিন্তু উত্তর পায় না, সেটা একবার মনে মনে বললেন- “হোয়াই মি?” 
এই অদ্ভুত ফোন্তর্ক থেকে বেরোবার পথ খুঁজে যখন বংশী জেরবার, মেসেজটা টুং করে বাজল। 
ইয়র রিপোর্ট ইজ রেডি। প্লীজ ট্যাপ হিয়ার টু কালেকট ইয়োর রিপোরট।
ব্যাস বংশী এক মুহূর্তেই বরফ। বা বলা যায় মমীভূত। তাড়াতাড়ি ফোনটা শেষ করার জন্য বলেন,
 = আমায় মাফ করবেন। আপনাকে তো চিনতাম না। আজ চেনা হয়ে গেল। আপনিই তো হাউসিংএ কমিটির সেক্রেটারী। খুব ভালো। পরে কথা বলব হ্যাঁ। একটু তাড়াতাড়ি আছে। কিছু মনে করবেন না আমার একটা জরুরী মেসেজ এসেছে ফোনটা একটু রাখছি। 
ওদিক থেকে যেন ফ ও ব শব্দের একটা মিশ্রণ ভেসে এল। শব্দ যে বিষ্ঠার মত হয় ও তার গায়ে অসুগন্ধ লেগে থাকে সেটা আবার জানলেন বংশীবাবু। মনে মনে ভাবলেন, যাক গে। আর কটা দিন। করুক আনন্দ ওস্তাদেরা সব। আমাকে বেশীদিন হয়ত আর দেখতে হবে না।

ট্যাব একটা ছোট্ট নাম, কিন্তু আসলে এটি একটা জ্যান্ত সজ্ঞান জিনিস। হাত কাঁপলেও ট্যাপ হয়ে যায়। রিপোরটটা খোলে। অনেক হিজিবিজি অংক লেখার মধ্যে একটা কথা চোখ খুঁজে ফেরে। Positive পজিটিভ, প। বা পি। সব লেখা কালো। শুধু একটা লেখা লাল। সব দিন ভালো। শুধু একটা দিন কালো। না কি উল্টো? 
বংশী খেয়াল করেন তিনি কবিতা বলছেন। ক্যান্সারটা তাহলে সত্যিই হলো। 

ধূমপান ক্যান্সারের কারণ। তিনি ধূমপান করেন না। তামাক খাওয়া মুখে ক্যান্সারের কারণ। তিনি জর্দা খান না। শুধু এই পেট কনকন। তাঁর চিরকালের অভ্যেস। ইন্টারভিউ দিতে গেলেও পেট কনকন আবার কোন সুন্দরী মেয়ের চোখে চোখ পড়লেও হৃদয়কম্পনের সংগে পেট কনকন। এই বাড়ন্ত বয়সেও। বাড়ন্ত মানে যে আসলে কমন্ত সেটা এই বয়সে বোঝা যায়। 

কি কুক্ষণেই ডাক্তার বন্ধুকে বলেছিলেন কথাটা। নববর্ষের রিইউনিয়নে প্রতিবারই স্কুলের পাঠসাথীরা এসে জড়ো হয়। ভূরিভোজ থেকে জমাট আড্ডায় হৈ চৈ করে একটা দিন কাটে। সেখানেই সুদাম, এমডি, গাই, এসে সবার স্বাস্থ্য নিয়ে পড়ে। যেমন কেউ হাত দেখতে পারে জানলে সবাই ঘিরে বসে পড়ে হাত দেখাতে তেমনি সুদামকেও সবার স্বাস্থ্য, নাকে তিল, স্পন্ডিলোসিস থেকে বদহজম সব কিছুর ফ্রি পরামর্শ দিতে হয়। বংশীও বলে ফেলেছিলেন পেট কনকনের কথা। সুদাম ভুরু কুঁচকে শুনলো। একবার জিজ্ঞেস করল, এখানে কারো কঙ্কণ দেখে কনকন বাড়ছে না তো। অর্পিতা কে ইঙ্গিত। স্কুলে খ্যাপানো হত, সে তো কত দশক আগে। 

খসখস করে কাগজে লিখে দিল ইউ এস জি। তারপর আরো কি সব। ল্যাবে যাওয়া গ্লাস গ্লাস জল খাওয়ার অত্যাচার আর দুশ্চিন্তা। চিকিৎসা করাতে গিয়ে থেকে তো পেট কনকন বেড়েই চলে বংশীর। 
রিপোর্ট আসা পর্যন্ত। 

আজ এই রিপোর্ট এলো। রিপোরট দেখেই বংশীবাবুর একটা অদ্ভুত পরিবর্তন হয়ে গেল। অবাক কান্ড। পেট কনকন একদম মিলিয়ে গেল। আর তারপর যিনি কোনদিন কাব্যচর্চার ত্রিসীমানায় যান নি, হোয়া গ্রুপে অনর্গল কবিতা লেখার ধুম তাঁকে গিয়ে এক লাইন বার করতে পারে নি। তাঁর মুখে হঠাৎ বাল্মিকীর মত কাব্য নিসৃত হতে শুরু করল। 

পজিটিভ যখন নিশ্চয়ই এটা বেশ সিরিয়াস খারাপ খবর। শোনা যায় তেমন শক পেলে অনেকে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। মাথার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে ওঠে এক অসম্ভব দুঃখ, শ্রী শ্যামল মিত্রের গান মনে পড়ে, “আমি নেই, ভাবতেও ব্যথায় ব্যথায়…” অনেকে গায় শ্রী সুবীর সেনের গান “এত সুর আর এত গান”। অথবা দ্বিজেন মুখারজীর “একদিন ফিরে যাবো চলে, এই ঘর শূন্য করে” আহা। 

বংশীও উচ্চারণ করলেন বাল্মিকীর মত,
নিজের দুঃখে বুক ভাসিয়ে যাই, 
এই আছি এই নেই কবে যাই
এই তো জীবন কালীনাথ ভাই
ব্যাংকে আর কে ওয়াই সি নাই।।

🍂

 অবাক কান্ড বংশী বাবুর কোন দুঃখ তো হচ্ছেই না, বরং তিনি উল্লসিত হয়ে গেলেন যে তাঁরো একটা লোককে বলার মত খবর হল। আসলে তাঁর জীবনযাত্রাটা এমন কিছু না, যে গেল গেল বলে দুঃখ পেতে হবে। আছে ভাল, না থাকলেই ঠিক আছে। কিন্তু এই যে একটা উল্লেখযোগ্য সংবাদ হবার মত খবর হল সেটা ভেবেই বংশীর মনে টিং টং বাজে উল্লাসের কলিং বেল । 

কতদিন হলো বংশীর জীবনে তেমন কোন খবর আর হয় না। যত ভুলভাল খবর খালি, পায়ে ছুরি পড়ে গিয়ে টিটেনাস নেওয়া, পার্কের বেদীর নীচে একটা পুরনো অকেজো মোবাইল কুড়িয়ে পাওয়া, আর সকালে রান্নাঘরে দু দুটো মরা ইঁদুর আবিষ্কার। বিপরীত ফ্ল্যাটের বিশ্বহ্যাংলা হুলো বেড়ালটাও সেটা খেতে অস্বীকৃত। এগুলো কি কোন খবর? অথচ দিন রাত সবাই ফেসবুক পোস্ট করছে দারুন দারুন সব খবর। শয়ে শয়ে আহা উহু কি মিত্তি কি মিত্তির ধুম মচে যাচ্ছে। গেট টুগেদারে রাশিয়ার গল্প বলছে একজন, চীনের টেরাকোটা সৈনিক দেখাচ্ছে কেউ, কেউ ট্রাফালগার স্কোয়ারে ফরফর ফর ফর করে পায়রা ওড়াচ্ছে। আর সবাই সারাক্ষণ খুব খাচ্ছে। দিল্লী বম্বে দুবাই সিংগাপুর যাচ্ছে খাচ্ছে আর খাবারের ছবি। পোস্টাচ্ছে। কি সুন্দর মোটা সোটা সুখী মানুষজন। বংশীর এই খ্যাংরা কাঠির মত চেহারা দেখে অনেকে তাকে খাড়ুশ বুড়ো বলে। খাড়ূশ মানে কি জানা নেই, তবে বিশেষণটা ভালোই লাগে। সজনে ডাঁটার মত। সজনার এখন অনেক দাম, পঞ্চাশ টাকায় একটা, সজনা সজনা বলে গান গাওয়া ছাড়া উপায় নেই। সজনা একটা খটখটে শক্ত লাঠি, অথচ তার ভিতরে লুকিয়ে থাকা ফ্লেভার, সম্বরে দিলে বাঙ্গালোরের সহকর্মীরা সেদিন খুব  মন দিয়ে কাজ করত মনে আছে। 

সবার খবর হয়, একা বংশীর কোন খবর হয় না। পরিচিত মানুষজন আর জানতেও চায় না, হঠাৎ সন্ধ্যায় ফোন করে না,  কি খবর বল! সবাই জানে ওর কোন খবর নেই, হবেও না। নেহাত অল্পপরিচিত কেউ হঠাৎ খবর জানতে চেয়ে ফেললে তো ভীষণ মুস্কিল। ভেবে ভেবে বানিয়ে বললে সেই খবর থেকে যেন ভ্যাপসা গন্ধ বেরোয়। হ্যাঁ অফিস খুলেছে করোনার পরে। ছেলে আমেরিকার সিয়াটলে, ভালো। বাস এই। বংশী জানেন শুধু আমেরিকা বললে ঠিক জোশ আসে না, শহরের নাম বলতে হয়, শিকাগো সিয়াটল সিনসিনাটি বললে মনে হয় মেপল পাতা ঝরে যাচ্ছে। চারদিকে টুং টাং ডাইম ডলার ডায়মন্ড বাজছে। কেউ শুধু গাড়ী কিনেছে বললে হবে না, টেসলা বা লেক্সাস বলতে হবে। খবর জানতে চাইলে বংশী তাই সাজিয়ে গুছিয়ে বলেন। কিন্তু কবার আর এক কথা বলবেন। বংশীর উত্তর শুনে কেউ আর প্রত্যুত্তর করে না। আচ্ছা বলে চলে যায়।  বংশীর ঘোরের বাইরে শুধু তেঁতুল পাতা ঝরে ঝরে পড়ে, আর মাঝে মাঝে পাশের গাছের পড়শী কাকা আর কাকী সেই তেঁতুল পাতা মাথায় করে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকে। 

-ক্রমশঃ-

Post a Comment

0 Comments