দূর দেশের লোকগল্প— ২৩৫
নাইজেরিয়া (আফ্রিকা)
মুরগিরা কেন বনে থাকে না
চিন্ময় দাশ
অনেক অনেক কাল আগের কথা। আর সব পাখি যেমন বনেজঙ্গলে থাকে, তেমনই থাকত মোরগ মুরগিরাও। গ্রামের জীবন কেমন, জানাই ছিল না তাদের।
বনে বেশ দাপটের সাথেই থাকত মোরগেরা। অন্য সব জীব ভয় করতো তাদের। সহজে কাছে ঘেঁষতে চাইত না কেউ। হবে না কেন? মোরগ-মুরগিরা যে ছিল আগুনের মালিক।
মাথায় লম্বা একটা চিরুনি (আসলে, সেটা হোল তাদের মাথার ঝুঁটি) গেঁথে রাখে তারা। রঙের কী বাহার সে চিরুনির! টকটকে লাল আগুন একেবারে। বনের অন্য সবাই ভাবতো, ওই চিরুনিটার ভেতরে আগুন ভরে রাখে মুরগিরা।
বনের অন্য কারও কাছেই আগুন নাই। আছে কেবল মুরগিদের। সেই গুমোরে, বাকি সবার ওপর হম্বিতম্বি করে মুরগিরা। কেউ সামান্য অবাধ্য হলেই, ধমক দেয়—আগুনটা দেখতে পাস না? পুড়ে মরবার সাধ হয়েছে, না কি?
এ ভাবেই চলছিল মুরগিদের রাজত্ব। তাদের ভয়ে, অন্য সবাই তটস্থ হয়ে থাকে সব সময়।
এক দিন সন্ধ্যে হয়েছে সবে। একটা নেকড়ে বাঘ ঘরে ফিরেছে শিকার সেরে। দেখল, তার উনুনের আগুন নিভে গিয়েছে। ছেলেকে ডেকে বলল—দৌড়ে যা তো একবার। মোরগের কাছ থেকে এক্টু আগুন চেয়ে নিয়ে আয়। দেখবি, হম্বি-তম্বি করতে যাস না যেন। কথা বলবি খুব মোলায়েম গলায়।
ছানাটা মোরগের বাড়ি গিয়ে হাজির। উঁকি মেরে দেখল, মোরগ মুরগি দুজনেই তারা ঘুমাচ্ছে। ডাকাডাকি না করে, ঘরে ফিরে এলো সে।
ছেলেকে খালি হাতে ফিরতে দেখে, মা বলল—কীরে, আগুন দিল না বুঝি?
--না, মা। দুজনেই তারা ঘুমিয়ে আছে। তাই, আর ডাকিনি আমি।
মা নেকড়ে বলল—ঠিক বলছিস, দুজনেই ঘুমিয়ে আছে?
--নিজেই তো দেখে এলাম আমি। দুজনেই ঘুমাচ্ছে।
নেকড়ে ভারি খুশি সে কথা শুনে। বলল—তাহলে তো ভালোই হয়েছে। আবার একবার যা। এক গোছা শুকনো খড় নিয়ে যা সাথে। আলতো করে মোরগের চিরুণিটার ওপর ধরে রাখবি। যেই আগুন জ্বলে উঠবে, টুক করে সরে আসবি ওখান থেকে।
ছেলেটার সাহস হোল না। সে বলল—আমি একা যাব না, মা। যদি জেগে ওঠে।
কী আর করে? মা নেকড়েও বেরুল ছেলের সাথে। একটা চাটানের (পাথরের চাতাল) খাঁজে ঘুমিয়ে আছে মোরগ আর মুরগি। পা টিপে টিপে হাজির হোল দুজনে। ভালো করে দেখে নিল, ঘুম গভীর কি না।
সাবধানে খড়ের গোছাটা বাড়িয়ে মোরগের মাথার উপর ধরল মা-নেকড়ে। মোরগের মাথার ঝুঁটি, কানের লম্বা লতি দুটো-- সব টকটকে লাল। নেকড়ে তৈরি হয়ে আছে, সামান্য একটু ফুলকি জ্বলে উঠলেই, খড়গোছাটা সরিয়ে সরে পড়বে। নইলে জেগে উঠবে দুজনে।
ছেলেকে ফিসফিস করে বলল—তুই এগিয়ে থাক। আগুন জ্বলে উঠলেই, লাফ দিয়ে বেরিয়ে যেতে হবে।
কিন্তু কোথায় আগুন? একটা ফুলকিও জ্বলে উঠছে না। যেমন খড় তেমনিই আছে। একটু হতভম্ব হয়ে গেল নেকড়ে। ব্যাপারটা কী? এগিয়ে গিয়ে থাবা বাড়িয়ে দিল। আলতো করে মোরগের মাথায়, ঝুঁটির চিরুনি, কানের লম্বা লতি—সব ছুঁয়ে দেখল । দেখতে টকটকে লাল। একেবারে জ্বলন্ত আঙরারই মতো। কিন্তু গরমের তো নামগন্ধই নাই! একেবারেই ঠাণ্ডা।
নেকড়ের বুঝতে বাকি রইল না, বনের সবাইকে মিথ্যে ভয় দেখিয়েছে মোরগ। বোকা বানিয়ে রেখেছে এতোদিন। ভয়াণক রাগে গরগর করে উঠল নেকড়ে—তবে রে, হতভাগা। দেখাচ্ছি মজা।
নেকড়ের চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেছে মোরগ আর মুরগির। সাক্ষাত যম সামনে। ধড়মড়িয়ে উঠে পড়েছে দুজনে। কিছু বলতে গেল মোরগ। সে সুযোগ হোল না।
নেকড়ে চিৎকার করে উঠল—আজই তোদের ঠগবাজির শেষ দিন। রাতটা কাটুক। কাল সকালেই বনের সবাইকে এনে জড়ো করব এই ময়দানে। সবার সামনে বিচার হবে তোদের।
মোরগ বলল—চটে যাচ্ছো কেন? কী বলছি শোন তো।
--কাল শনব রে, হতভাগা। আগুনের ভয় দেখিয়ে রেখেছিলি এতোদিন। আগুন জ্বেলেই পুড়িয়ে মারব তোদের। বলেই নেকড়ে বেরিয়ে গেল।
ভয়ে সারা শরীর কাঁপছে। মোরগ বলল—হায়, হায় গিন্নি। কী করা যায় এখন বলো তো?
মুরগি বলল—আমি আর কী বলব? আমার কথা কি আর তুমি শোন কখনো? সারা জীবনেই তো দেখলাম, আমার একটা কথাও কানে তোল না তুমি। বলে আর কী লাভ?
--এখন বিপদের সময়। এসব পুরাণো কথা তুলে বাদ-বিবাদের সময় নয় এখন। কাজের কথা কিছু বলো বরং।
--তাহলে, আমি বলি কি, চলো পালাই এখান থেকে।
--সে নয় পালালাম। কিন্তু যাবো কোথায়? নেকড়ে তো সবখানেই যেতে পারবে। লুকিয়েও তো থাকা যাবে না। খাবার খুঁটতে বেরোতে তো হবেই। তখন কে বাঁচাবে আমাদের?
--আমার কথা শোন। এখন রাত নেমেছে। গাঁয়ে গিয়ে ঢুকে পড়ি, চলো। সেখানে যাওয়ার সাহস হবে না শয়তানটার।
--কিন্তু থাকবো কোথায় আমরা সেখানে?
--কোনও একটা গেরস্ত বাড়ি দেখে ঢুকে পড়ব। মিটে গেল ঝামেলা।
--মিটে গেল ঝামেলা? বললেই হয়ে গেল? গেরস্তই বা থাকতে দেবে কেন আমাদের?
--সেটা তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও। গেরস্তকে রাজি করাবার ভার আমার। তুমি চুপটি করে থাকবে। রা-টিও কাড়বে না। গেরস্তের মাথা কী করে নাড়াতে হয়, সে আমি দেখে নেব।
নিজের মাথায় কোনও উপায় আসছে না। মোরগ তার বউয়ের কথায় রাজি হয়ে গেল। জীবনে এই প্রথমবার এমনটা হোল তার।
রাত একটু গভীর হতেই বেরিয়ে পড়েছে দুজনে। বনে সবাই তখন ঘুমিয়ে।
রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও, প্যাঁচারা জেগে থাকে। খানিক দূর গিয়েছে। প্যাঁচা দেখতে পেয়ে গেছে দুজনকে। বলে উঠল—এই রাতে তোমরা আবার কোথায় বেরিয়েছ?
মোরগকে কিছু বলতে দিল না। মুরগি বলল—আর বোল না, দিদি। সারা দিন শয়তান নেকড়েটা বড্ড জ্বালিয়েছে আজ। পেটে কিছু দিতে পারিনি। তাই বেরিয়েছি। দেখি, দু-চার দানা জোটে না কি কোথাও।
--কিন্তু আঁধার রাতে দানা খুঁজে পাবে কী করে?
এতক্ষণ চুপ করে থাকার পাত্র মোরগ নয়। সে বলে ফেলেছে—ভেবেছি সোজা গ্রামে গিয়ে ঢুকে পড়ব। পেয়ে যাবো কিছু নিশ্চয়।
মুরগি চমকে উঠেছে শুনে। সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল—চলি গো, দিদি। ফিরে এসে বলব তোমাকে, কিছু জুটল কি না।
মোরগকে সঙ্গে নিয়ে পা চালিয়ে সরে পড়ল মুরগি। --তুমি কেন বলতে গেলে, আমরা গাঁয়ে যাচ্ছি। পইপই করে বারণ করেছিলেম তোমাকে, মুখ খুলবে না। স্বভাব যাবে না তোমার। এই বিপদের সময়েও --স্বামীকে বকাঝকা করতে করতে, গাঁয়ে পৌঁছে গেল দুজনে।
তারপর শুরু হোল খোঁজা। ঘুরে ঘুরে সবগুলো বাড়ি দেখে নেওয়া হোল। তার মধ্যে যে বাড়িটা বেশ বড়সড়, সেটাই পছন্দ হোল মুরগির। মোরগকে বলল—শোন, এটাতেই থাকব আমরা। দেখেই মনে হচ্ছে, খাবার দাবারের অভাব নাই এদের। অতো বড় বাড়ি, এক্টুখানি জায়গা হয়ে যাবে নিশ্চয়।
🍂
মোরগ বলল—আমি তাহলে, কথাই বলব না?
--না। যা বলবার, যা করবার আমিই করব। তুমি শুধু ভোরবেলা একবার ডেকে উঠবে। তারপর দেখবে আমার কথার কেরামতি।
উঠোনের এক কোণে ঘাপটি মেরে বসে রইল দুটিতে। মোরগের একটু ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। মুরগি বলল—ফরসা আকাশে লাল রঙ লাগতে লেগেছে। এক বার গলা ছেড়ে ডেকে ওঠো দেখি।
ভোরের বেলা মোরগের গলা ছেড়ে ডাক বিখ্যাত। একবার ডাকতে বলেছিল বউ। মওকা পেয়ে তিন বার ডেকে উঠল মোরগ—কোঁকর কোঁ, কোঁকর কোঁ, কোঁকর কোঁ।
বাড়িটা ছিল গ্রামের মোড়লের। ভোরের বেলায় এমন বিদ্ঘুটে একটা আওয়াজ! আগে তো কখনো শোনা যায়নি এটা। বিছানা ছেড়ে উঠে এলো মোড়ল।
দরজা খুলে আবার অবাক। বনের দু’দুটো মুরগি তার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। এমনটাও আগে ঘটেনি কখনো। ব্যাপার কী!
মোড়ল বুড়ো বলল—কী ব্যাপার? তোমরা এখানে যে বড়? ভয়-ডর নাই?
--ভয়ের তাড়া খেয়েই তো এলাম গো। একটু থাকতে দাও তোমার বাড়িতে? মুরগি বলে উঠল।
দু’দুটো মুরগি ঘরে এসে হাজির। এমন কপাল কজনের হয়। মোড়ল বলল-- দেবই তো থাকতে। একটু দাঁড়াও আসছি।
ভেতর থেকে একটা বড় ঝুড়ি নিয়ে এলো বুড়ো। মুরগি দুটোকে চাপা দিতে যাবে, মুরগি বলল—এটা কী করছো গো?
--কী আর করছি? ঘর শুদ্ধু সবাই পেট ভরে মাংস খাবো আজ, তার ব্যবস্থা করছি। এখন তো চাপা দিয়ে রাখি। সবাই ঘুম থেকে উঠুক। দেখুক সবাই আগে।
মুরগি বলল—আজই যদি কেটে খেয়ে ফেলো, কাল কী খাবে?
--মানে? মোড়ল কিছু বুঝতেপারছে না।
--কেটে না খেয়ে রেখে দাও আমাদের। আমরাও বেঁচে গেলাম। তোমারও লাভ তাতে।
--তোমাদের লাভ বুঝলাম। আমার আবার তাতে লাভ কী?
মুরগি বলল—তুমি আমাদের থাকবার একটা পাকাপোক্ত বন্দোবস্ত করে দাও। প্রতিদিন ডিম পাড়ব আমি। সেটা তোমরা খেতে পারবে। আরও ভালো ব্যবস্থা হতে পারে।
--সেটা আবার কী রকম?
--সবগুলো ডিম খেয়ে ফেলবে না। কয়েকটা খাবে, কয়েকটা রেখে দেবে। তা থেকে নতুন করে মোরগ মুরগি জন্মাবে। তারা আবার ডিম পাড়বে। আবার নতুন মোরগ মুরগি। ঘর ভরে যাবে তোমার।
মোড়ল বলল—তোমাদের গুষ্টি শুদ্ধ সবাইকে রাখব, অতো জায়গা নাই আমার।
মুরগি হেসে বলল—সবাইকে রাখতে যাবে কেন? মাঝেমাঝে মাংস খাবে কেটে কেটে। কতো লাভ তাতে বলো?
মোড়লের বউ এস দাঁড়িয়েছিল পেছনটাতে। সে বলল—খুব ভালো কথা। আলাদা ঘর বানিয়ে, আমিই তোমাদের থাকবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। বনে যেতে দিচ্ছি না আর। আজ থেকে গ্রামেই আমাদের বাড়িতেই থাকবে তোমরা।
ওদিকে হয়েছে কী, মোরগের কাছে যে কোনও আগুন নাই, এটা বনের সবাইকে ডেকে নেকড়ে বলে দিয়েছে। শুনে সবারই মনে রাগ। সবাই শাস্তি দিতে চাইল মোরগ-মুরগিকে। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও, দুজনের কোন হদিশই করে ওঠা যায়নি।
0 Comments