শেষকৃত্য
পুলককান্তি কর
হঠাৎ একজন অপরিচিত ভদ্রলোককে এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নীহার বলল, 'বাপি, ওই ভদ্রলোক কে? তোমার কোনও কলিগ না কি?'
নীলাঞ্জন খানিকক্ষণ চোরা চাউনি দিয়েও ঠিক ঠাহর করতে পারলেন না ভদ্রলোকের পরিচয়। মঞ্জুলার জীবন ছিল একেবারে খোলা পাতা। তার কোনও নিজস্ব পরিচিত বন্ধুবান্ধব ছিল বলে তো মনে হয় না। যেটুকু ছিল সবই তাঁর চেনা। কোনও কিছু ভাবতে না পেরে বললেন, 'তুই কাজকর্মে মন দে। পুরোহিত মশাই গেলেন কোথায়?'
পুরোহিত সম্ভবত আগের বডিটার থেকে পাওয়া বকশিশের স্বল্পতা নিয়ে ডোমের কাছে উষ্মা প্রকাশে ব্যস্ত ছিলেন, নীহারের হাঁক ডাকে এক গোছা পাটকাঠি নিয়ে হাজির হলেন। এসেই হাঁক পাড়লেন, 'আপনার গোত্র?'
- কাশ্যপ।
- আপনি কে হন? ছেলে?
- হ্যাঁ।
- অন্য কোনও ভাই-বোন কেউ আছে মুখাগ্নি করার?
- না।
অপরিচিত ভদ্রলোক একটু উসখুশ করে বললেন, 'নীলাঞ্জন বাবু, আপনিও তো মুখাগ্নি করতে পারেন!'
ভদ্রলোকের জলদগম্ভীর স্বরে সবাই চমকে উঠল। পুরোহিত বললেন, 'নীলাঞ্জন বাবু কে?'
নীহার ওর বাবার দিকে ইঙ্গিত করল।
- সম্পর্ক?
- স্বামী।
পুরোহিত তাঁর বিদ্যাবুদ্ধি মত নিদান দিলেন, পুত্র বর্তমান থাকলে স্বামীর হক নেই।
নীলাঞ্জন একটু কৌতূহলী হয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকাতেই উনি শুকনো হেসে হাতজোড় করে নমস্কার করলেন।
- আপনাকে তো ঠিক...
ভদ্রলোক বললেন, 'সরি! আমার বোধহয় এ বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক হয়নি!'
নীরবতা দিয়ে নীলাঞ্জন বক্তব্যটিকে মান্যতা দিয়ে বললেন, 'আপনি কে?'
ভদ্রলোক নীলাঞ্জন এর কাছে সরে এসে একটু খাটো গলায় বললেন, 'বলছি। আগুন যখন তার কাঙ্খিত বিষয়টি পেয়ে যাবে, তখন না হয় ওই ঘাটে বসে আপনার সাথে কথা বলব। ততক্ষণ শেষবারের মতো আপনার জীবনের এত বছরের সঙ্গীকে বিদায় দিন। আমরাও তাকে স্মরণ করি।’
আজকাল দাহকার্যের সরকারীকরণ হওয়ার পর এইসব ধর্মীয় বিষয়গুলির বাগাড়াম্বর কম হয়ে গেছে। সাকুল্যে দশ থেকে পনেরো মিনিটের মধ্যেই সব শেষ।এবার নীলাঞ্জন বললেন, 'চলুন, কোথায় বসবেন বলছিলেন?'
- চলুন। ওই যে অশ্বত্থ গাছটার নীচে বেদী আছে, ওখানে গিয়ে বসি।
একটু বাদে দুজন একটু দূরত্ব রেখে বসলেন। এখন গঙ্গায় ভাটা চলছে। তবুও নদীটার অদ্ভুত এক ছলাৎছল আছে। এত আওয়াজ - এর মধ্যেও এই শব্দটা ভারী এক ধরনের নিস্তব্ধতা তৈরি করে। নীলাঞ্জন বললেন, 'আপনার নামটা?'
- আমার নাম নবকুমার। নবকুমার মণ্ডল।
নামটা শুনে অজান্তেই নীলাঞ্জনের মুখে একটা শ্লেষের হাসি এল। আজকালকার দিনে এমন নাম তো শোনা যায় না, বিশেষ করে শহর-বাজারে। ভদ্রলোক নিশ্চয়ই গ্রামের প্রোডাক্ট। অবশ্য চেহারায় তেমন একটা গ্রাম্যতার ছাপ নেই। একটু থেমে বললেন, 'আপনাকে আমি ঠিক চিনতে পারলাম না।'
- মঞ্জুলা কখনও আপনাকে আমার কথা বলেনি? আশ্চর্য!
🍂
- আপনি ওর বন্ধু ছিলেন?
ভদ্রলোক একটু হেসে বললেন, 'একপ্রকার! ও কি কোনও দিন আপনাকে পাড়াতুতো বুবুদা'র কথা বলেছিল? আমি সেই বুবু'দা।'
বিদ্যুৎ ঝলকের মতো নামটা হঠাৎ করে চিড়িক দিয়ে উঠলো নীলাঞ্জনের মনে। সাঁইত্রিশ বছর আগে হলেই বা! হৃদয় বিনিময়ের প্রথম কয়েকটা দিনে স্ত্রীর প্রাক্তন প্রণয়ীর নাম কেইবা ভুলতে পারে! ভেতরে একটু জ্বালা থেকেই নীলাঞ্জন বললেন, 'তা আপনি হঠাৎ এতদিন বাদে উদয় হলেন কী করে?'
- বাঃরে! আজ ওর মৃত্যুদিন। ছোটবেলা থেকে যাকে চিনতাম, জানতাম - তার বিদায় বেলায় আসবো না? বাই দা বাই, আমি কোনও ভাবে আপনাকে বিড়ম্বিত করার জন্য আসিনি কিন্তু। দাহকাজ মিটলেই আমি চলে যাব।
- কিন্তু আপনাকে মৃত্যু সংবাদটা কে দিল?
- আজকাল ওটা কোনও সমস্যা নীলাঞ্জনবাবু? ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপে কোনও না কোনও মারফৎ খবর তো ঠিক এসেই যায়!
- আপনি তখন আমার নাম নিচ্ছিলেন, সব খবরও রাখেন। আপনার সাথে কি মঞ্জুলার যোগাযোগ ছিল?
ভদ্রলোক পূর্ণদৃষ্টিতে একবার নীলাঞ্জনকে মাপতে চাইলেন! এই বাক্যে কি কোথাও কোনও ঈর্ষার জ্বালা ছিল? কে জানে! উনি একটু চুপ করে থেকে বললেন, 'আপনার কী মনে হয় নীলবাবু?'
- মঞ্জুলার জীবনে কিছু প্যাঁচঘোঁচ ছিল বলে তো জানিনা। আমি শুনতে চাই বা না চাই, ও সারাদিনের দিনলিপি আমাকে শোনাতো। ওর পরিসরও খুব ছোট ছিল। ফোন টোন তেমন ঘাঁটাঘাঁটি করত না – মানে অতশত কিছু জানতো না। সুতরাং...
- ঠিক কথা নীলবাবু। গত সাঁইত্রিশ বছর আমার সাথে ওর কোনও যোগাযোগই ছিল না। আপনি এই নিয়ে মৃত মানুষটার প্রতি দয়া করে কোনও বিরাগ পুষবেন না।
- আমার ওর প্রতি বিরাগ হবে – এরকম নীচ ধারণা আপনিই বা করছেন কেন? আপনি আমাকে কতটুকু চেনেন?
- সরি নীলবাবু! আমি আপনাকে কোনও ভাবেই বিচার করতে চাই না। আসলে অধিকাংশ পুরুষ মানুষই হঠাৎ এতদিন বাদে এরকম উপদ্রবকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেন না বলেই কথাটা বলেছিলাম।
- সেই বোধ থাকলে আপনার আসাটাই উচিৎ ছিল না।
- সেটা ঠিক কথা; কিন্তু ওটাও একটা বাধ্যতা। আজ আমাকে আসতেই হত।
- কেন?
- সামান্য কিছু সম্পর্ক আমার সাথেও ছিল যখন, কিছু রিচুয়ালস তো আমাকেও করতে হয়!
- মানে? আপনি আবার ওখানে গিয়ে কিছু ঢং করবেন নাকি? প্লীজ...
- দূর মশাই! আপনারা বড় মানুষেরা বড় বেশি ভাবমূর্তির ভয় করেন। ওসব কিছু না। সব রিচুয়ালসই সবার সামনে পুরোহিত ডেকে ধুমধাম করে করতে হয় কি? এটা আমার নিজস্ব তর্পণ। চাইলে আপনিও আমার সাথে করতে পারেন।
- কী সেটা?
- অপেক্ষা করুন। দাহ শেষ হলে যখন অস্থি গঙ্গায় বিসর্জন দেবে, তখন।
বিকেল নেমে এসেছে। দূরে একটা লঞ্চ ভর্তি মানুষ যে যার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় হয়তো তাকিয়েও দেখছে না – এই সময় গঙ্গার জলে সূর্য কেমন মায়ার চাদর বিছিয়েছে। দু-একটা ডিঙি নৌকা স্থির হয়ে কেবলমাত্র জলের আন্দোলনে সাড়া দিচ্ছে – তাদের কোথাও কোনও তাড়া নেই, কোনও অপেক্ষা নেই। নবকুমার কিছুক্ষণ বাদে খানিকটা সহানুভূতির সুরেই বললেন, 'এবার একটু নিজের দিকে খেয়াল রাখবেন নীলবাবু। মঞ্জুলা তো খুব গোছানো সংসারী মেয়ে ছিল; নিশ্চয়ই আপনার সবকিছু আগলে রাখত – এবার সবকিছু আপনাকে নিজেই দেখতে হবে।'
নীলাঞ্জন একটু থেমে বললেন, 'আচ্ছা আপনি তখন আমাকে মুখাগ্নি করতে বললেন কেন?'
- এটা বুড়ির একটা সাধ ছিল। আপনাকে এত বছরের জীবনে নিজের মৃত্যু নিয়ে কোনও রূপকথা সে শোনায় নি?
- না । তা সেসব আপনাকে শোনাতো বুঝি?
শ্লেষটুকু গায়ে মাখলেন না নবকুমার। বললেন, 'ব্যাপারটা ঠিক শোনানোর জন্য আমাকে বলেছিল, তা নয়। আসলে কথার পিঠেই কথাটা উঠেছিল।
- মৃত্যু নিয়ে আপনারা গল্প করতেন নাকি?
প্রশ্নের উত্তর সরাসরি না দিয়ে নবকুমার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বুড়িকে নিয়ে আপনি গঙ্গার এইসব ঘাটে কখনও আসেন নি?’
মঞ্জুলাকে নিয়ে নীলাঞ্জন মিসিসিপি নদীর পাড়ে গেছেন, রাইন নদীর বুকে ক্রুজে চড়েছেন, স্বপ্নের নীলনদীও ঘুরে দেখেছেন, কিন্তু কলকাতার এইসব ঘাটে সত্যিই কোনদিনও বসা হয়নি। একটু তাচ্ছিল্য নিয়ে বললেন, 'এইসব শ্মশান ঘাটে কী করতে আসবো?'
- তা ঠিক। আসলে আমাদের সময় তো গল্প-সল্প করার তেমন জায়গা ছিল না। ভদ্রলোকের ছেলে-মেয়েরা তো আর এখনকার মতো সিনেমায় গিয়ে হাত ধরাধরি করে বসে থাকতো না বা ভিক্টোরিয়া গিয়ে গাছের আড়াল খুঁজতো না। এইসব ঘাটগুলোয় নদীকে সামনে রেখেই যা একটু-আধটু নিজের মনের কথা হতো।
- তার সাথে আমার প্রশ্নের কী সম্পর্ক?
- আসলে এইসব ঘাটের অনেক কটায় তো শ্মশান আছে। লোকে পোড়াতে আসত, কান্নাকাটি করত, ফলে আমাদের কথাবার্তায় কোন ফাঁকে মৃত্যুও ঢুকে পড়তো।
- তাতে মুখাগ্নি নিয়ে মঞ্জুলার কী ইচ্ছের কথা বলতো?
- 'বলতো মানে!' এটা ঘটমান অতীত নয়। একবারই বলেছিল।
- সেটাই শুনতে চাইছি। কিছুটা অধৈর্য লাগলো নীলাঞ্জনের গলা।
- ও বলেছিল, আমার মৃত্যুর পর যদি আমার স্বামী বেঁচে থাকে, তবে আমি চাইবো, ও যেন আমার মুখাগ্নি করে।
- কেন? নীলাঞ্জন কিছুটা বিষ্ময়ের সুরে বললেন।
- আমিও তাই জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তাতে ও বলেছিল, যাকে সারা জীবন ধরে আমি আমার দেহ ও মন দেব, আমি চাই আমার সেই দেহ-মনকে প্রকৃতির সাথে মিলিয়ে দেওয়ার শুরুটা সে নিজের হাতে করে দিক।
- তাতে আপনি কী বললেন?
- আমি বলেছিলাম, তোমার স্বামী যদি তোমার প্রিয় না হন, তাহলেও?
- প্রিয় কেন হবেন না বুবুদা! মানুষকে সত্যিকারের ভালবাসলে সেও ভালবাসতে বাধ্য।
- মঞ্জুলার এতখানি আত্মবিশ্বাস ছিল, বুঝিনি কখনও। নীলাঞ্জন খানিকটা খেদোক্তি করলেন।
- হ্যাঁ, বুড়ি খুব সরল ছিল, কিন্তু ওর ধারণা নিয়ে খুব দৃঢ়ও ছিল।
- কিন্তু নববাবু, শাস্ত্রমতে এটা তো ছেলেদেরই অধিকার!
- আমরা কটা শাস্ত্র কথা মেনে চলি নীলবাবু! ছাড়ুন, আমি ভেবেছিলাম – আপনি জানেন, তাই বিষয়টা তুলেছিলাম যাতে আপনি নিজমুখে বলতে এমবারাসড্ ফিল না করেন। যা হয়ে গেছে, তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী লাভ?
- আমি বিষয়টা নিয়ে তেমন করে মাথা ঘামাচ্ছি না নববাবু! আমাকে যখন তার এই ব্যক্তিগত ইচ্ছেপূরণের অভিলাষ জানায়নি, সেই নিয়ে আমার কোনও দায়ও থাকা উচিৎ নয়।
- ছাড়ুন ওসব কথা। আপনার পরিবারের লোকজন বোধহয় এদিকেই আসছে। দেখুন, দাহ বোধহয় শেষ হল। আপনাকে খোঁজ করছে মনে হয়। আপনি যান।
- আপনি?
- আমি এখানেই আছি। ওখানে আমি গিয়ে কী করব? আপনি আসুন, এই ঘাটেই গঙ্গাস্থি করতে নামবে আপনার ছেলে।
নীলাঞ্জন আর কোনও কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়লেন। মনটা কেমন যেন বিষন্ন হয়ে পড়ল। দীর্ঘ সাঁইত্রিশ বছর মঞ্জুলা নীলাঞ্জনের ঘরবাড়ি, সন্তান পালন সবকিছুই আগলে রেখেছিলেন। কাজের ফাঁকে বাড়ির কোনও কিছু নিয়েই তাঁকে মাথা ঘামাতে হয়নি কোনওদিন। অবশ্য বাড়িতে টাকা-পয়সা, চাকর-বাকরের অভাব ছিল না কোনও। মঞ্জুলা সবকিছুকে দক্ষ হাতেই সামলেছেন। আজ সকালে মঞ্জুলাকে মৃত আবিষ্কার করার পরও এতখানি শূন্য লাগেনি। বহুজনের ফোন, অতিথি অভ্যাগতকে সামলাতে সামলাতেই এতখানি বেলা গেল। এখন যেন হঠাৎ করে মনে হল, মঞ্জুলা সত্যিই আর নেই। কিন্তু এতদিন বাদে মঞ্জুলার কোন্ কিশোরী তরুণীবেলার বুবুদাকে দেখতে তাঁর মোটেও ভালো লাগছিল না। দীর্ঘ এতগুলো বছর এই নিয়ে না তো তাঁদের কোন দাম্পত্য কলহ হয়েছে, না তো তিনি কোনওভাবে ওর নাম মনে রেখেছেন। আজ হঠাৎ এসে পড়াতেই স্মৃতির ঢাকনাটা খুলে গিয়েছিল শুধু!
কিছুক্ষণ পরে সবাই মিলে নীহারকে নিয়ে গঙ্গাস্থি করতে এই ঘাটে এসে পড়লেন। নীলাঞ্জন দেখলেন, নবকুমার একটুখানি দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। নীলাঞ্জন এদিকটা সামলে ওঁর দিকে এগিয়ে গেলেন। 'এই যে নীলবাবু, গঙ্গাস্থি তো হ'ল, আপনি কী রিচুয়ালসের কথা বলছিলেন?'
- হ্যাঁ। আপনার কাছে এক টাকার কয়েন আছে?
- হ্যাঁ।
- নিন, চোখ বন্ধ করে মা গঙ্গাকে স্মরণ করে কয়েনটা নদীতে ছুঁড়ে দিন।' বলেই নববাবু একটা কয়েন নদীর জলে ছুঁড়ে মনে মনে কিছু বিড়বিড় করতে লাগলেন।
নীলাঞ্জন একটু চুপ করে থেকে বললেন, 'হোয়াট ননসেন্স! আপনি একজন শিক্ষিত মানুষ? রাষ্ট্রের সম্পত্তি এভাবে কেউ নষ্ট করে?'
নবকুমার হাসলেন। 'আপনার ইচ্ছে না হলে নাই করতে পারেন নীলবাবু। আপনাকে কে জোর করতে যাচ্ছে? এটা আমার কর্তব্য ছিল বলে আমি করতে এলাম।'
- আবার কর্তব্য বলে নিজেকে গৌরবান্বিত করবেন নববাবু! আপনি জানেন না - এটা অপরাধ?
- জানি। মানিও।
- তাহলে পয়সা ছুঁড়লেন কেন?
- অকারনে ইলেকট্রিসিটি, জল খরচ করাও তো রাষ্ট্রের সম্পদ নষ্ট করা। আপনার বাংলোর সামনে এত ওয়াটের এত রকম আলো রোজ জ্বালানোর কি খুব দরকার পড়ে নীলবাবু? আপনার এত সব রাঘববোয়াল ক্লায়েন্টদের ইনকাম ট্যাক্স বাঁচানোর জন্য যেসব ফন্দিফিকির বের করে আপনার ফার্ম এত টাকা কামাচ্ছে, তাতে রাষ্ট্রের আর্থিক লোকসান হচ্ছে না?
নীলাঞ্জন খানিকটা গুম মেরে গেলেন। নবকুমার বললেন, 'আপনার আজ মন ভালো নেই, এইভাবে রূঢ় কথা বলা আমার উচিৎ হয়নি!'
- কিন্তু আপনি টাকাটা নদীতে ছুঁড়লেন কেন?
- জানেন নীলবাবু, আমার জীবনে এই প্রথমবার নদীতে টাকার কয়েন ছুঁড়লাম।
- কারণটাই তো জানতে চাইছি!
- আসলে আমি আর বুড়ি যখন এইসব ঘাটে এসে বসতাম, তার ফাঁকে কেউ গঙ্গাস্থি করলে বুড়ি একটা পয়সা নিয়ে নদীতে ছুঁড়ে প্রণাম করতো। আমি অনেকবার ওকে বারন করেছি, রাষ্ট্রের সম্পদ নষ্ট করার জন্য লজ্জিত করার চেষ্টাও করেছি, ও তাতে দমতো না। উল্টে হেসে বলত, ‘এটা প্রণামী, দিতে হয়!’
- কিসের প্রণামী? নীলাঞ্জন কৌতুহলী চোখে চেয়ে রইলেন।
- বুড়ি বলতো, 'গঙ্গায় অস্থি বিসর্জনের মানে কি জানো? আমি জানিনা বললে বলতো, ‘দাহকাজের পর দেহ পুড়ে ছাই হয়ে যায়... সেই ছাইতেও তো মনে হতে পারে – আমাদের প্রিয়জন কোথাও থেকে গেছে। সেইজন্য সেই শেষ মোহটুকুও গঙ্গার পবিত্র জলে ভাসিয়ে আত্মাকে একেবারে মুক্ত করে দেওয়ার পদ্ধতি হল গঙ্গাস্থি।' আমি বলতাম, 'যে মারা গেল - তার আর মোহ কি? সে তো পঞ্চভুতে লীন হয়ে গেল!’
- অন্যের মোহের বাঁধনও তো বড় বাঁধন বুবুদা, ওটা থাকলে মরেও আত্মার শান্তি নেই!' তাতে গঙ্গাকে প্রণামী দেওয়ার কী আছে?
- আমরা ঈশ্বরকে পুজো দিয়ে ভোগ নৈবেদ্য দিই না? কিছু উৎসর্গ করি না? গঙ্গায় অস্থি দিলে সমস্ত পাপের অবসান হয়, আত্মা মুক্তি ঘটে – সেই জন্যই মা গঙ্গাকে মনে মনে পুজো করে কিছু উৎসর্গ করা উচিৎ।
- পুজো করলে ফলমূল দাও, ভোগ দাও, তা না করে পয়সা দিয়ে ঘুষ?' মজা করতাম আমি। বুড়ি বলতো 'নদীর জলে ফুল ফল ছড়ালে দূষণ হবে না? আর পয়সা ছোঁড়া তো প্রতীকী। কোনও মূল্যবান ধাতু দেওয়ার যদি ক্ষমতা থাকতো – তাই ছুঁড়তাম!'
নীলাঞ্জন বললেন, 'আপনি সেই বিশ্বাসে পয়সা ছুঁড়তে চলে এলেন?'
- দেখুন নীলবাবু, আমি এত বিচার বিবেচনা করে চলি না। হৃদয়ের কথা শুনি। আমার মনে হল, বুড়ি এই বিষয়টা অন্তর থেকে বিশ্বাস করতো; সুতরাং তার মৃত্যুর পর এটা করা আমার নৈতিক কর্তব্য!
এক ভদ্রমহিলা এসে বললেন, 'কাকু, নীহারদা একবার আপনাকে ডাকছে।'
নীলাঞ্জন হাতজোড় করে নমস্কার করে বললেন, 'নববাবু এবার আমাকে যেতে হবে। আপনার যদি আরও কিছু রিচুয়াল্স থাকে করুন; আমি আসি।'
নবকুমার মৃদু হাসলেন। বললেন, 'আসুন'।
(২)
বাড়ি ফিরে এসে অব্দি একটুকুও স্থির হতে পারছেন না নীলাঞ্জন। সারাক্ষণ নবকুমারের অবয়ব যেন তাঁকে তাড়িয়ে বেড়াতে লাগলো। তিনি তন্ন তন্ন করে মঞ্জুলার মোবাইল হাতড়ে দেখলেন – ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, কন্টাক্ট লিস্ট। কোথাও নবকুমার, নব, বুবু – এই রকম নামে কোনও সেভ নেই। সন্দেহজনক বা অচেনা কোন নামই তাঁর চোখে পড়লো না। অথচ নবকুমারকে দেখে মনে হয় লোকটি তাঁদের বা মঞ্জুলার সব খবরই রাখে। এত প্রেম তো একে বিয়ে করোনি কেন? আশ্চর্য!
ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে খানকতক নবকুমার মন্ডল পাওয়া গেল বটে, যাদের ফটোর সাথে এই নবকুমারের কোনও মিল নেই। এক নবকুমারের অ্যাকাউন্টে একটা পেইন্টিং আঁকা, সে এই নবকুমার কিনা কে জানে? লোকটার ফোন নাম্বারটা নিয়ে এলে ভালো হত। আজ নীলাঞ্জনের ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে মঞ্জুলার সাথে লোকটার সম্পর্কটা ঠিক কেমন ছিল। মঞ্জুলা বেঁচে নেই। এখন এই সংক্রান্ত সঠিক তথ্য একমাত্র ওই লোকটিই বলতে পারে। অবশ্য যদি সত্য কথা বলে।
সারারাত ঘুম এলো না নীলাঞ্জনের। ডাক্তারের দেওয়া ঘুমের ওষুধ একটার বদলে দুটো খেয়েও কাজ হলো না কোনও। ভোর ভোর উঠে বাইরের লনে চেয়ারটা নিয়ে বসলেন তিনি। সামনের শিউলি গাছটার নিচে সাদা-কমলা ফুলে একেবারে ছেয়ে গেছে। গাছটা মঞ্জুলার লাগানো। উনি সকাল সকাল উঠে শিশির মাখা ফুলগুলো কুড়িয়ে একটা চিনেমাটির বড় পাত্রে রাখতেন। একটা পাত্র থাকতো নীলাঞ্জনের বসার ঘরে, আরেকটা ডাইনিং টেবিলে। নীলাঞ্জনের মনে হল, উঠে ফুলগুলো কুড়োন; কিন্তু কোথাও একটা বাধা এসে ওঁকে নিরস্ত করল। হঠাৎ দেখলেন ওঁর শালা হন্তদন্ত হয়ে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন, 'কী হলো নীলদা, এই হিমে তুমি এখানে একা একা বসে কী করছ?'
- এই তো বসে আছি একটু। তা তুমি এত সকালে উঠে পড়লে কেন? কাল সারাদিন জার্নিতে এত ধকল গেল, একটু শুয়ে থাকলে পারতে!
- বাথরুমে গেছিলাম। হঠাৎ চোখ গেল তোমার ঘরে। দরজা খোলা দেখে ভাবলাম, তোমার শরীর টরীর খারাপ হলো নাকি দেখি!
- যাও শুয়ে পড়ো গে!
- থাক। বহুদিন বাদে ভোর দেখে মনটা ভারী ভালো হয়ে গেল। পরীক্ষার সময় দিদি ভোর ভোর উঠে আগে ঘরের চারিদিকে গোবর জল দিয়ে আমাদের তুলে দিত। পল্টু তো ঘুমকাতুরে ছিল, অবশ্য এখনো আছে... তা সে উঠেই শুয়ে পড়তো। আমি দুলে দুলে পড়া মুখস্ত করতাম। সত্যি, দিদির মত মানুষ ছিল না। আমাদের সবার জীবনে দিদির ভূমিকা অনেকখানি। কীইবা এমন বয়স হয়েছিল!
- আচ্ছা হিমাংশু, তোমাদের গ্রামের নবকুমার মন্ডল লোকটা কেমন?
- নবকুমার মন্ডল? এই নামের কাউকে তো মনে পড়ছে না!
- তোমাদের ‘বুবুদা’ বলে কেউ ছিল?
- ওঃহো বুবুদা! হ্যাঁ হ্যাঁ, ওর নাম নবকুমার মন্ডলই বটে। বুবুদা নামটাই এত পরিচিত যে ওই নামটা মনে আসে না।
- ওই বুবুদার সাথে মঞ্জুলার একটু ইয়ে ছিল, সে বিষয়ে তোমার কিছু জানা আছে?
- তুমি হঠাৎ দিদি মারা যেতে তার জীবনে কাদা ছেটাতে শুরু করলে নাকি? এরকম স্বভাব তো তোমার ছিল না নীলদা!
- কাদা ছেটাতে যাব কেন? নীলাঞ্জন একটু মলিন হেসে বললেন, আর তাছাড়া কাদা ছেটাতে হলে সে কাদা কি আমার গায়েও পড়বে না?
- তাহলে হঠাৎ এসব কথা বলছ কেন?
- আরে তোমার দিদিই বিয়ের পরে আমাকে একটু আধটু ইঙ্গিত দিয়েছিল; আমি তখন অত পাত্তা দিইনি।
- তাহলে আজ দিচ্ছ কেন? বেঁচে থাকতে থাকতেই ফয়সালা করতে পারতে!
- আরে রেগে যেও না। বিষয়টা নিছকই কৌতুহল। কাল আসলে পেনিটির ঘাটে তোমার ওই নবকুমার এসে হাজির। তোমার দিদির সাথে গঙ্গার ঘাটে ঘুরে বেড়ানোর গল্প বলছিল।
- তাই নাকি? এরকম কোনও গল্প বা ঘটনা আমার জানা নেই।
- লোকটা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য হিমাংশু? মানে যা বলছে সেগুলো তো মনগড়াও হতে পারে!
- বুবুদা বলেছে, ওর সাথে দিদির ভাব ভালোবাসা ছিল? উষ্মা এবং বিস্ময় দুই প্রকাশ করল হিমাংশু।
- না, ঠিক সেরকমও বলেনি।
- তবে? এক্সজ্যাক্টলি কী বলেছে, তাই বল।
- ওরা গঙ্গার বিভিন্ন ঘাটে ঘুরে বেড়াতো সেই কথা বলেছে – অবশ্য কিছু কথার পরিপ্রেক্ষিতে।
- তাই বলো! বুবুদা খুব ভালো লোক। আপনভোলা, একটু পাগলাটে!
- কী করেন ভদ্রলোক?
- এক্সাক্টলি জানিনা। বহুদিন যোগাযোগ নেই। তবে চাকরী বাকরী কিছু বোধহয় করে না। আর্ট কলেজে পড়াশোনা করত, তারপর বাবার টাকা ভেঙেই বোধহয় চলে – ঠিক জানিনা ওর বর্তমান খবর।
- আচ্ছা হিমাংশু, মঞ্জুলার সাথে নবকুমারবাবুর বিয়ে নিয়ে কোনও কথা ওঠেনি কোনওদিন তোমাদের বাড়িতে?
- কী যে বলো নীলদা? তোমার মাথায় কী এখন এইসব ভূত বসে আছে?
- কেন? এটার মধ্যে অসম্ভব কি আছে?
- মানুষের মধ্যে ভাব ভালোবাসা থাকলে তবে না বিয়ের কথা উঠবে! দিদি তো এই নিয়ে বাড়িতে কিছু বলেনি। বুবুদার তরফ থেকেও নিশ্চই কোন প্রস্তাব আসেনি।
- প্রস্তাব এলে কি বিয়েটা হতে পারতো?
- না।
- কেন?
- দেখো নীলদা, আমাদের বাড়ি মেদিনীপুরের ধ্যাদ্ধেড়ে পাড়া গাঁয়ে। আমরা ব্রাহ্মণ, ওরা মণ্ডল। কে মেনে নিত এই বিয়ে? আর তাছাড়া, মা মারা যাবার পর থেকে দিদিই ছিল আমাদের মা। সারাদিন সংসার টেনে সে পড়াশোনা চালিয়েছে। বাবার অমতে সেও নিশ্চই কিছু করতে পারত না।
এবার যেন একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেন নীলাঞ্জন। তাঁর অঙ্কটা মিলে যাচ্ছে। তিনি বললেন, ‘দিদি যখন বি.এস.সি. পড়তে এলো, নবকুমার তখন আর্ট কলেজের ছাত্র?’
- তুমি এসব দিয়ে কী করে মেলাতে চাইছো নীলদা? একই গ্রামের ছেলে মেয়ে কলকাতায় থাকলে তারা তো মাঝেমধ্যে নিজেদের মধ্যে দেখা সাক্ষাৎ করতেই পারে, না কী?
- তুমি চাপ নিও না হিমাংশু। আমি কিছুই মেলাতে চাইছি না। তুমি চিন্তা করো না। তুমি ভাই আমার একটা উপকার করবে?
- কী?
- নবকুমারবাবুর ফোন নম্বরটা একবার জোগাড় করে দেবে?
- আবার তুমি এই নিয়ে পড়েছো? কেন নিজের স্থিতাবস্থা বিঘ্নিত করতে চাইছো তুমি নীলদা? এতদিন পরে, এই বিষয়ে খোঁজ খবর করে কী লাভ? জীবনে তোমার প্রাপ্তির ঘরে তো কিছু কম পড়ে নি! দিদি জীবনে কাউকে ফাঁকি দেয়নি!
নীলাঞ্জন মনে মনে ভাবলেন, সেই ফাঁকি না দেওয়ার মধ্যে কোথায় ফাঁক থেকে গেল সেটাই তো জানা বড় দরকারই হিমাংশু। মুখে বললেন, 'সেসব ভয় নেই তোমার। শ্মশানে যে যায় সেই শ্মশানবন্ধু! শ্রাদ্ধের দিন নেমন্তন্ন করাটা আমার ভদ্রতা! ফোন নম্বরটা জোগাড় করে দিও প্লীজ!’
(৩)
ফোনটা পেয়ে একটু গলা খাঁকরে নিয়ে নবকুমার বললেন, 'হঠাৎ পেনেটির ঘাটে আমায় তলব করলেন নীলবাবু, ব্যাপারটা কী? অনুসন্ধিৎসা?
- ওভাবে বলছেন কেন? আসলে আমার আপনাকে শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ পত্রটা দেওয়ার ছিল। আপনার বাড়ি গিয়েই ওটা দেওয়া উচিৎ। ভাবলাম আপনার সংসারে মঞ্জুলার বিষয়টা ঠিক কী, না জেনে যাওয়াটা সমীচীন হবে না। তাই পেনিটির ঘাটে ডাকলাম। আর তাছাড়া জায়গাটাও আপনাদের স্মৃতি বিজড়িত।
- ঠিক আছে, আমার কোনও অসুবিধা নেই। কবে যেতে হবে বলুন!
- যবে আপনি সময় দেবেন। আজ বললে, আজই।
- বেশ তো; বিকেল চারটে নাগাদ আসুন। আমি ওই ঘাটে থাকবো।
বিকেলবেলা নীলাঞ্জন যখন পানিহাটির ঘাটে গিয়ে পৌঁছলেন, দেখলেন নবকুমার একমনে গঙ্গার দিকে চেয়ে একটা গান গুনগুন করছেন। পাশে নীলাঞ্জনের উপস্থিতি টের পেয়ে বললেন, 'আসুন নীলবাবু, বসুন এখানে।'
- আপনি গান-বাজনাও করেন না কি?
- না, না। শখের গান। অনেকদিন বাদে মনে পড়ল।
- কী গান গাইছিলেন?
- 'শুধু তোমার বাণী নয় গো!'... রবীন্দ্রসঙ্গীত।
- ওঃ। ও রসে আমি বঞ্চিত। বিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীত! তা গাইছিলেন যখন একটু জোরে গান না, আমিও শুনি।
- এসব গন্ধর্ব নীলবাবু! ওরাও বোঝে কোথায় ওদের আদর! জোর করলে ওরা পালায়!
- এই গান এখানে বসে গাওয়ার মধ্যে কি বিশেষ কোনও তাৎপর্য আছে?
- আপনি কি এর সাথে বুড়ির কোন সম্পর্ক আছে কিনা বুঝতে চাইছেন?
নীলাঞ্জনকে চুপ করে থাকতে দেখে নবকুমার বললেন, 'বুড়ি খুব ভালো গাইতো এই গানটা – একেবারে সমাহিত হয়ে।’
- আপনাকে ও গান শোনাতো বুঝি?
- আমাকে শোনাবে কেন? যাঁর উদ্দেশ্যে গাইতো তাঁকেই শোনাতো। আমি আশে পাশে থাকলে শুনে ফেলতাম।
- আপনি নিজে থেকে শুনতে চাইতেন না?
- না। আপনি শোনেননি কখনও!
- আমি জানতামই না মঞ্জুলা গান করে। আমাকে বলেনি কখনও।
- ওর খুব গান শেখার ইচ্ছে ছিল, জানেন নীলবাবু। কিন্তু ওর বাবার রোজগার খুব বেশি ছিল না। আমি বলেছিলাম কলকাতায় কোনও ভালো টিচারের কাছে ভর্তি হতে, কিন্তু ও রাজি হয়নি। ভর্তি হলে টাকা পয়সা ম্যানেজ হয়ে যেত ঠিক।
- কী আশ্চর্য! বিয়ের পর তখনও বাবু, মানে আমার ছেলের জন্ম হয়নি; আমি বলেছিলাম তোমার যদি কোনও শখ আহ্লাদ থাকে, আমায় বলো; কই কোনওদিন এসব কথা আমাকে বলেনি তো!
- আচ্ছা নীলবাবু, আপনি কখনও ওকে গুনগুন করে গান করতেও শোনেন নি?
- না। আসলে সকালে জলখাবার খেয়েই তো বেরিয়ে যেতাম, বাড়ি ফিরতে রাত এগারোটা! এর আগে পরের কোনও সময়টাই বোধহয় গুনগুনানির জন্য উপযুক্ত নয়।
নবকুমার হাসলেন। বললেন, 'শ্রাদ্ধের কাজকর্ম কদ্দূর?'
- চলছে। আচ্ছা নববাবু, মঞ্জুলা তার শ্রাদ্ধকর্ম নিয়ে কোন ফ্যান্টাসি বলে গেছিল আপনাকে? তাহলে সেরকমটা করার চেষ্টা করব।
- ও একবার বলেছিল ওর শ্রাদ্ধ যদি হরিদ্বারে গঙ্গার তীরে করা যেত! যখন গঙ্গার আরতি শেষ হবে তখন ওর প্রিয় মানুষটি যদি আকাশের দিকে চেয়ে 'সন্ধ্যা হলো গো... ও মা' – গানটা করে, আর সব শেষে গঙ্গার জলে একটা কাগজের নৌকো ভাসিয়ে দেয় – তবে ভারী ভালো হয়।
নীলাঞ্জন খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললেন, 'তা আর কী করে হবে? এখানে এত আত্মীয়-স্বজন, লোকজন সব নিমন্ত্রণ হয়ে গেছে!
- ও নিয়ে আপনি মানসিক চাপ নেবেন না নীলবাবু। মানুষ যেসব স্বপ্ন দেখে – তা কি সব বাস্তবে মিলে, না কি করা যায়? ওই যে একটু আগে একটা শব্দ বললেন না, 'ফ্যান্টাসী’ – এটা ফ্যান্টাসীই! ফ্যান্টাসীকে কে কবে পূরণ করতে পারে!
- মঞ্জুলা এতরকম আনরিয়ালিস্টিক কল্পনায় ভাসতো, বুঝতেই পারিনি কোনওদিন!
- মানুষের প্রিয় চাহিদাগুলোর অধিকাংশই তো আনরিয়ালিস্টিক নীলবাবু! একটা মানুষের মধ্যে অনেক সত্ত্বাই থাকে, যেগুলো সারাজীবন পাশে থেকেও মানুষ জানতে পারে না – আবার দুদিন পাশে থেকেও অনেকে টের পেয়ে যায়।
- এটা কি আপনি আমার মঞ্জুলার প্রতি উদাসীনতা বলে প্রমাণ করতে চান?
নবকুমার জিভ কেটে হাঁ হাঁ করে উঠলেন – ছিঃ ছিঃ নীলবাবু! আমি এমন কোনও কথা বলতে চাইছি না বা এমন কথা বলার আমার এক্তিয়ারও নেই। বিষয়গুলো যে সব সময় ভালোবাসার তীব্রতা বা উদাসীনতার ওপর নির্ভর করে তা নয়; বরং বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মুহূর্ত এবং পারস্পরিক তরঙ্গের উপর নির্ভর করে।
- এমন আরো কত জিনিস মঞ্জুলা ভালোবাসতো, আমি জানি না?
- তা তো জানিনা নীলবাবু। আপনি নিশ্চিত অনেক বেশি জানবেন আমার থেকে। তবে একটা জিনিস আমি জানি – সেটা বুড়ি নিজেও বিশ্বাস করত না – ও অসাধারণ পোট্রেট আঁকতে পারতো!
- আপনার থেকে শেখা নিশ্চই?
- তা কেন? আমি কোনওদিন বুড়িকে কিছু শেখাইনি। তবে ওর আঁকা আমি দেখেছি। মানুষের ছবি খুব একটা ভালো আঁকতো না অবশ্য!
নীলাঞ্জনের মনে পড়লো নীহারের স্কুলের খাতাপত্রে ছবিগুলো মঞ্জুলাই এঁকে দিতেন। ছেলে এসে এক আধবার দেখিয়েছে, ‘দ্যাখো বাপি, মা কী সুন্দর ছবি এঁকেছে!’ সারা জীবন মঞ্জুলার কত কিছু না জানা থেকে গেছে তাঁর।
দুজনে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসলেন। একসময় নবকুমার বললেন, 'যে কারণে আপনি এত দূর ছুটে এলেন, সেই আসল কথাটা বললেন না তো এখনও! সন্ধে হতে চললো, আপনার বাড়িতেও তো খোঁজ পড়বে আপনার!
একটু চুপ থেকে সরাসরি প্রশ্নটা করলেন নীলাঞ্জন। 'আপনার সাথে মঞ্জুলার বিয়েটা হল না কেন?'
- খামোখা বিয়ের প্রশ্ন উঠছে কেন?
- ওটাই তো স্বাভাবিক। দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে পরস্পরকে ভালবাসলে বিয়ের কথাই তো ভাবে!
- বুড়ি কখনও আপনাকে বলেছে, সে আমাকে ভালোবাসতো?
- সেরকমই কিছু একটা বলতে চেয়েছিল বলে মনে পড়ছে। আজ এত বছর পর সব কথা মনে নেই।
- আমাকে তো সেরকম কোনও ইঙ্গিত দেয়নি কখনও।
- আপনিও কি সেরকম কোনও ইচ্ছে ওর কাছে প্রকাশ করেননি বলে বলতে চান?
- দেখুন নীলবাবু, বুড়ি বরাবর থিতু হতে ভালবাসতো। আমার মত বাউণ্ডুলে, হতোদ্যমী, খেয়ালী মানুষকে ওর বর হিসেবে পছন্দ করার কথা নয়। আমাকে বিয়ে করলে সারা জীবন ওকেও ভেসে বেড়াতে হতো!
- এখন যাঁকে আপনি বিয়ে করেছেন, তিনি বুঝি ভেসে বেড়াচ্ছেন নববাবু?
- আমি অকৃতদার।
- কই সেদিন বললেন না তো, যেদিন আপনার বাড়ি যাবার প্রসঙ্গ উঠেছিল?
- প্রসঙ্গ ঠিক ওঠে নি নীলবাবু। আপনি এখানেই আসার ব্যাপারে যুক্তি সাজাচ্ছিলেন; আমি কথা বাড়াই নি। আর তাছাড়া এটা আপনার বাড়ির কাছাকাছি। আমার বাড়ি যেতে হলে আপনাকে দু ঘন্টা ড্রাইভ করে যেতে হত।
নীলাঞ্জন খানিকক্ষণ নবকুমারের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, 'আপনিও মঞ্জুলাকে ভালবাসতেন না– সে কথা বলতে চান?'
- সে কথা তো আমি কখনও বলিনি।
- তাহলে আপনার মনের কথা ওকে বলেন নি কেন? প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়ে?
- না নীলবাবু? প্রত্যাখ্যানের ভয়ে ভালোবাসা প্রকাশ না করাটাও একধরনের নিজের ইগোকে ভালোবাসা। যারা নিজের ইগোর বাইরে যেতে না পারে, তারা আর ভালোবাসার কী বোঝে!
- তবে বলেন নি কেন?
- আসলে বুড়ি যেদিন কলকাতা ছেড়ে বাড়ি ফিরে গেল, সেদিনই বুঝলাম আমি ওকে ভালবাসতাম।
- ওটা কোন কথা হল? চিঠি লিখতে পারতেন, গ্রামে ফিরে গিয়ে দেখা করতে পারতেন!
- সেটা সম্ভব ছিল না নীলবাবু!
- কেন? এতে অসম্ভবের কী ছিল?
- বুড়ি মানা করে গিয়েছিল।
- কী রকম?
- যেদিন আমাদের শেষ দেখা, সেদিন আমরা বাগবাজারের ঘাটে বেড়াতে গিয়েছিলাম। বুড়ি খানিকক্ষণ কথা-টথা বলে বলল, 'বুবুদা, কালকেই বাড়ি ফিরে যাচ্ছি, আজই আমাদের শেষ দেখা!
আমি বললাম, 'ধুর বোকা! শেষ দেখা হতে যাবে কেন? জীবন কি ফুরিয়ে যাচ্ছে? কবে কখন কোথায় দেখা হয়ে যায় কে বলতে পারে?’
- না বুবুদা? যে কোনও পিছুটানই মোহের জন্ম দেয়। আর সেই মোহ বর্তমানকে ঝাপসা করে দেয়। আমি জীবনের চাহিদা মত বাঁচতে চাই। আমার নিজের কোনও চাহিদা নেই।
- এত কঠিন কঠিন কথা কেন বলছ বুড়ি? তোমার কি বিয়ে টিয়ে ঠিক হয়ে গেছে নাকি?
বুড়ি সেদিন কিছু উত্তর দেয়নি। চুপ করে ছিল শুধু। পরে জানতে পারলাম আপনার পাকা দেখা ছিল তার কয়েকদিন পরে।
নীলাঞ্জন বললেন, 'এ তো স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল নববাবু! আমি রসকষহীন কমার্সের লোক বুঝতে পারছি, আপনার মত আঁতেল মানুষ বুঝতে পারলেন না?'
- আজ আপনি দুয়ে দুয়ে মেলাতে বসেছেন বলে আপনার পক্ষে মেলানো সহজ হচ্ছে। কথার পিঠে চলতে থাকা হাজারো কথার ভাঁজে হঠাৎ করে এ ধরনের কথা একটা সন্দেহ তৈরি করে মাত্র, স্পষ্ট কোন ইঙ্গিত দেয় না।
- আপনার ফেসবুক প্রোফাইল, হোয়াটসঅ্যাপ – কোনওটাতেই আপনার ছবি না থাকাটা কি একপ্রকার মঞ্জুলার ইচ্ছাকেই সম্মান দেওয়া?
নবকুমার চুপ করে রইলেন। একদল শবযাত্রী এইমাত্র গঙ্গাস্থি করতে গঙ্গায় নামল। নীলাঞ্জন দেখলেন নবকুমার পকেট থেকে একটা কয়েন বের করে চোখ বন্ধ করে ছুঁড়ে দিলেন দূরের জলে। চারপাশের কোলাহলে সে শব্দটুকুও এসে পৌঁছল না তাঁদের কাছে। জলের স্রোতে কয়েন পড়ার তরঙ্গটুকুও মিলিয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। নীলাঞ্জন হাতের ছোট্ট পোর্টফোলিও থেকে একটা কার্ড বের করে বললেন, 'আগামী বারো তারিখ এই ঘাটেই দশাহের কাজ হবে। তেরো তারিখ শ্রাদ্ধবাসর। কার্ডে ঠিকানা দেওয়া আছে, আপনি এলে মঞ্জুলার আত্মা খুশি হবে। আসবেন।'
নবকুমার একটু হেসে বললেন, 'সরি নীলবাবু, ওদিন থাকলে অবশ্যই যেতাম। কিন্তু আমি এগারো তারিখ থেকেই কলকাতার বাইরে থাকবো। যাওয়া হবে না।'
নীলাঞ্জন একটু থেমে বললেন, 'কোথায় যাবেন? হরিদ্বার?'
নবকুমার কিছু উত্তর করলেন না। এই সাধারণ দর্শন উড়নচণ্ডী লোকটার কাছে হেরে যাবেন নীলাঞ্জনবাবু? তিনি কি মঞ্জুলাকে কিছু কম ভালবাসতেন? তাঁর তীব্র ইচ্ছে হল, তিনিও বলেন, 'চলুন আমিও যাই।' কিন্তু তীব্র আত্মাভিমান আর এতদিন ধরে গড়ে তোলা নিজের সিংহাসন তাকে পিছু টেনে ধরল। তিনি বললেন, 'চলুন নববাবু, আপনাকে বি.টি. রোডের মুখটাতে নামিয়ে দিই।'
নবকুমার বললেন, 'আজ বহুদিন বাদে এই ঘাটে সূর্যাস্ত দেখার বড় ইচ্ছে হলো নীলবাবু। আপনি যান, তাছাড়া আমার এই পথটুকু হেঁটে যেতেই ভালো লাগে।'
- বেশ, আজ চলি।
- একটা কথা বলব নীলবাবু?
- বলুন।
- বুড়ি জুঁই ফুলের মালা খুব ভালবাসতো। পারলে ওর ফটোটা ওইদিন জুঁই ফুলের মালা দিয়ে সাজাবেন।
- বাবু তো ডেকোরেটার্সকে অর্কিড দিয়ে পুরোটা সাজাতে বলেছে। দেখি, কী করা যায়!
- জুঁই তো খুবই ছোট সাইজের। বড়ই সুক্ষ্ম। প্রথম মালাটা অন্তত জুঁই-এর দিয়ে অর্কিড চাপিয়ে দেবেন; সৌন্দর্যের ব্যাঘাত হবে না ওতে!
গঙ্গার বুকে সূর্যাস্তের রঙের খেলা শুরু হয়ে গেছে। আকাশের মেঘে এখন যেন বিদায়ের গ্লানি নেই। সবাই যেন মোহের রং মেখে বুড়ির মতোই বলছে, কোথাও পিছুটান রেখে যেতে নেই। অথচ একরাশ পিছুটান নিয়েই এক লঞ্চ মানুষ এখুনি দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে পানিহাটির ঘাটে।
0 Comments