জ্বলদর্চি

'বানপ্রস্থের বাঁশি'-র জন্ম ইতিহাস /মুতাহিরা চৌধুরী

'বানপ্রস্থের বাঁশি'-র জন্ম ইতিহাস

মুতাহিরা চৌধুরী

কবি প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক সালেহা খাতুনের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ 'বানপ্রস্থের বাঁশি'। এটা ঠিকই তিনি সহজ সরল ভাষাতেই ব্যঞ্জনা নির্মাণ করেন। সাধারণ একটি ঘটনাকে তিনি বিশেষ থেকে নির্বিশেষ করে তোলেন। তাঁর কবিতাগুলি পাঠ করে আমি অনুসন্ধিৎসু হয়েছি কবিতাগুলোর জন্ম ইতিহাস সন্ধানে। অনলাইন এবং অফলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ, তপোবনে সারাদিন একদিন তাঁর পাশে পাশে ঘোরা, আমাকে সাহস জুগিয়েছে তাঁর কাছে অফুরন্ত আবদার করার। কবিতাগুলো যখনই প্রকাশ পেয়েছে তখনই পাঠ করেছি। ফলে কিছুটা হলেও জন্ম ইতিহাস সংক্রান্ত তথ্য আমার অজানা নয়। 'ভাতের স্বপ্ন' কবিতাটি কবি লেখেন ২০২৩ সালের আট নভেম্বর। এ কবিতাটি মনে করিয়ে দেয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'গরম ভাত অথবা নিছক ভূতের গল্প'কে। এই কবিতায় ক্যান্টিনের উল্লেখে আমরা জেনেছি কবি তাঁর অসহায় ছাত্রছাত্রীদের কথা বুঝিয়েছেন, যারা পড়াশোনার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়ে মেসে- হোস্টেলে দিনযাপন করছে আর অর্ধাহার এবং প্রায় অনাহারে দিন কাটাচ্ছে।

 'অথচ দেখ ভাণ্ডার উপচে পড়ছে/সময়ের দোহাই দিয়ে/ক্যান্টিন হাত উল্টেই বসে আছে।'  দুপুরে ভাত খাওয়ার উদ্দেশ্যে ক্যান্টিনে এলে ভাত বাদে অন্য  খাবারের তালিকা পাওয়া যায়। বলেন - 'অগত্যা ভাত নেই মোমো খাও/বিরিয়ানি খাও আরও কত কী আছে'!

 'অঙ্ক' কবিতাটির রচনাকাল ২০২৩ সালের সাত নভেম্বর। এই কবিতায় আছে কবির নিজের পিতার মৃত্যুতে পারলৌকিক ক্রিয়ায় অংশগ্রহণের নিমিত্তে পিতৃগৃহে আগত তাঁর মাতুলের কথা। যিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন আর কবি নিজের আঁচল ভিজিয়ে তাঁর পা মুছিয়ে দিয়েছিলেন। এ ঘটনার প্রায় দুবছর পর অজানা এক গভীর ব্যথায় কবি উচ্চারণ করেন -  'আঁচলে পা মুছিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছিল/ভালোবাসি তোমায়?'

প্রায় সম সময়ে ২০২৩ এর আট নভেম্বরে লেখা 'চতুরাশ্রম'  কবিতাটি বেশ সাহসী লেখা। এখানে কবি চাইছেন সন্তান তার নিজ কক্ষপথে ঘুরুক।আর তিনি ফিরে যেতে চান ব্রহ্মচর্য পর্বে অর্থাৎ ছোটোবেলায়  - 
 'আগামী নক্ষত্র দেশ বিদেশের কক্ষপথ চিনে/একদিন আমাদের বিজয়রথ দেবে গড়ে/ততদিন চলো যাই ব্রহ্মচর্যে ফিরে'। আসলে পেশি শক্তির জোরে যাঁরা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখেন কবি তাঁদের দলের নন।

 ২০২৩ সালের সাতাশ নভেম্বরে রচিত 'প্রতিবেশ' কবিতার ভরকেন্দ্রে আছে সেই সমস্ত সন্তানরা, যারা পড়াশোনার নিমিত্তে পাড়ি দিয়েছে দূরে। সন্তানকে দূরে পাঠিয়ে একাকী দিনযাপন করছেন যে সমস্ত মায়েরা তাঁদের যন্ত্রণাকাতর মাতৃত্বের অপরূপ রূপ উঠেছে এই কবিতায়।
'বাণী'-র শুরুই হয়েছে ইসলামীয় সংস্কৃতির ভোরের আজানের একটি পংক্তি তুলে  -  'আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম'। যা অন্য চার ওয়াক্তের আজানে ঘোষিত হয় না। এ ধ্বনির সাথে নিজের জীবনকে মিলিয়ে দিয়েছেন তিনি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রচিত এই কবিতা।'নিষিদ্ধ' কবিতাটি রচনা করেন ২০২৩ সালের দুই ডিসেম্বর। এই কবিতায় কবি নিজের জীবনযুদ্ধ বা স্ট্রাগলের কথা অপরূপ ছন্দে ভরিয়ে তুলেছেন। শিক্ষার্থীদের একটি অনুষ্ঠানে কবির নিজের পাঠ কবিতাটিকে তুমুল জনপ্রিয় করে তোলে।

 'মানবাধিকার' কবিতাটি ২০২৩ সালের এগারো ডিসেম্বর  যাদবপুরে বসে লেখেন। এর প্রেক্ষাপটে আছে মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্রের একটি বক্তৃতা। এই কবিতায় কবি জানিয়েছেন -'হাসবো খেলবো ছুটবো/আর সবারে ভালবাসবো'। আর আমরা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেও জানি, কবির জীবনে ভালোবাসা শ্রেষ্ঠ সম্পদ; কবি ভালোবাসেন সবাইকে। 'করুণা' কবিতাটি কবি ২০২৩ সালের বারো ডিসেম্বর রচনা করেন। এই কবিতাটিরও জন্ম যাদবপুরে। এই কবিতায় অন্যের প্রতি করুণা প্রকাশ প্রসঙ্গে কবি নিজেকেই ব্যঙ্গ করে বলেছেন -'রাতের লোকাল ট্রেনে মহিলা কামরায়/পুলিশ দেখে শান্ত থাকি/কেন কেন এতো ভয় পাই?তুমি করবে করুণা?হা হা হা তোমারই করুণা চাই'।

'আকুপাংচার' কবিতাটির জন্ম গড়িয়াহাটের এক রেঁস্তোরায়। বুদ্ধমূর্তি এই কবিতার প্রধান প্রেরণা। এই কবিতাটি রচনা করেন ২০২৪ সালের সতেরো ফেব্রুয়ারি।  
'উলঙ্গ' কবিতাটি একাকী রাত্রিকালীন ট্রেন সফরকালে রচিত। সময়কাল সাতাশ এপ্রিল, ২০২৪। বন্ধু মহলে উচ্চ প্রশংসিত এ কবিতার প্রতিটি শব্দ বারুদের মতো -
'উলঙ্গ কি শুধু বস্ত্রহরণেই হয়? তাতে দেহের চামড়াটা শুধু যায় দেখা।/মন যে কত কতবার কতজনের কাছে উলঙ্গ হয়েছে/সামান্য সুতোটুকুও পায়নি আবরণ রূপে/নিনাদিত বজ্রধ্বনি তাল কেটেছে বারবার'। রবীন্দ্রনাথ 'মালঞ্চ' উপন্যাসে যথার্থই বলেছিলেন - " এখনকার সভ্যতাটা দুঃশাসনের মতো হৃদয়ের বস্ত্রহরণ করতে চায়।"

🍂
ad

 'পৃথিবীতে কে কাহার' কবিতার রচনাকাল চার মে, ২০২৪। রবীন্দ্র প্রভাবিত কবি এখানে দার্শনিক হয়ে উঠেছেন। 'পোস্টমাস্টার' গল্পের শেষ বাক্য এবং রবীন্দ্র ছোটোগল্পের বিভিন্ন চরিত্ররা উঠে এসেছেন এ কবিতায়। 'তফাত যাও' কবিতাটি রবীন্দ্র জন্ম মাসেই রচিত। কবি কি ট্রিবিউট দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথকে? 'ক্ষুধিত পাষাণ' গল্পের মেহের আলিকে একালের ক্ষুধিত মানুষের দুঃখে সামিল করেছেন তিনি।'অস্বাভাবিক' কবিতাটি রচনা করেন দশ মে, ২০২৪। এই কবিতাটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'নীরা, হারিয়ে যেও না' কাব্যগ্রন্থের 'তিনি এবং আমি' কবিতার শেষ অংশ দেখে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রচিত। দিনে রাতে গরিবের দুঃখ বেচে সুখ খুঁজছেন যে সব কবি তাঁদের অস্বাভাবিক মানসিকতায় কবির ব্যথা প্রকাশিত হয়েছে এ কবিতায়। 

'অদ্ভুত আঁধার' কবিতাটি রচনা করেন ১১মে, ২০২৪ সালে। এই কবিতায় কবির জীবনকে মিলিয়ে দেখার একটা পাঠ নিতেই পারি আমরা। কবি কি নিজের চোখের দৃষ্টি কে রূপকের মাধ্যমে প্রকাশ করলেন? 'সম্পর্ক' কবিতাটি  কবি রচনা করেন  তেরো মে , ২০২৪ । এই কবিতায় কবি ইসলামীয় সংস্কৃতিজাত শব্দ পুলসেরাতের ব্যবহার করলেন। ইসলামীয় বিশ্বাস অনুযায়ী পুলসেরাত হলো একটি পারলৌকিক সেতু। যা চুলের চেয়েও সরু এবং তরবারির চেয়েও ধারালো। উত্তম জীবন যাপন যে করেনি সে এই সেতু পার করতে গিয়ে তার হাত পা কেটে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েই থাকবে। 'শূন্য যখন পূর্ণ' কবিতাটির রচনাকাল ২২ মে, ২০২৪। এই কবিতায় বাবার স্থান নিতে দেখেছেন তাঁরই উত্তরসূরিকে।

 'বঁধুয়া' কবিতা কবি রচনা করেন ১৬ জুন, ২০২৪। এই কবিতায় কবি প্রকৃতিকে 'আন বাড়ি' ভেবেছেন। বৈষ্ণব পদাবলির ঐতিহ্য অনুসারী পাঠক অবাক হবেন এ কবিতা পাঠ করে। ড.শুভাশিস মণ্ডল  যথার্থই লিখেছেন - "প্রিয়তম 'প্রকৃতি'মুখী হলে, বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী!ভূ-প্রকৃতিমুখী হলেও যে বিপদ, জানতাম না।"  কবির উচ্চারণ -  'আমার বঁধুয়া আন বাড়ি যায় /আমারি আঙ্গিনা দিয়া.../ প্রকৃতিতে বিভোর হয়ে/ আমারে যায় ভুলিয়া'। 'ঘর'কবিতাটির রচনাকাল  ২৬ জুন, ২০২৪ । এই কবিতার আড়ালে রয়েছে কলেজের নন টিচিং কোয়ার্টার ভেঙে সুউচ্চ  প্রাক্তনীভবন নির্মাণ-এর প্রেক্ষাপট। তাই লিখেছেন -  "প্রিয়াকে কাড়েনি কেউ/তবে ভেঙেছে ঘরবাড়ি"। কলেজ ক্যাম্পাসে বসেই এই কবিতা রচিত। 
'তিলোত্তমাসম্ভবকাব্য' রচনা করেন ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪। এই কবিতাতেও কবি 'হাশরের ময়দান', 'ইসরাফিলের শিঙ্গা' প্রভৃতি ইসলামীয় ধর্ম-সংস্কৃতিজাত শব্দ ব্যবহার করে বাংলা কবিতার সীমাকে প্রসারিত করেছেন। 

'বানপ্রস্থের বাঁশি' কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলির জন্ম ইতিহাসকে সামনে রেখে কবিতাগুলি পাঠ করে একটা কথা আমরা বলতেই পারি যে, অত্যন্ত সফলভাবে কবি তাঁর বিভিন্ন কবিতায় বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি এবং ইসলামি সংস্কৃতি ও পুরাণকে প্রয়োগ করে বাংলা কাব্যসাহিত্যে একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছেন।

Post a Comment

0 Comments