জ্বলদর্চি

ফিরে আসার পথ /বাপন দেব লাড়ু

ফিরে আসার পথ
বাপন দেব লাড়ু 

নামটা ছিল তার—অরুণ। একটি ছোট শহরের গলির ভেতর, ধূসর রঙের একচালা ঘরের এক কোণে বসে যে ছেলেটা কবিতা লিখত, সে-ই অরুণ। বয়স ত্রিশ পেরোয়নি, কিন্তু চোখে ছিল এক অবর্ণনীয় বিষণ্ণতা—যেটা কেবল বুঝতে পারত তার কলম, আর কেউ নয়।

অরুণ কখনো চাকরি করেনি। করতেও চায়নি। তার বিশ্বাস ছিল, মানুষ যদি নিজের ভালোবাসার জায়গা থেকে কিছু তৈরি করে, তবে তা একদিন তাকে জায়গা করে দেবে দুনিয়ার মঞ্চে। তাই সে লিখে গেছে—দিন-রাত, আলো-অন্ধকারের মাঝে।

প্রথম দিকে ছোট ছোট সাহিত্য পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হতে লাগল। মাঝে মাঝে সম্মানীও আসত। সে টাকা দিয়ে সে বই কিনত, নীলার জন্য উপহার আনত, আর কিছু দিয়ে টুকটাক সংসার চালাত।
🍂
ad

নীলা—তার জীবনের আলো। অরুণ যখন কিছুই ছিল না, নীলা তখনো ছিল। তার চোখে অরুণ ছিল বিশাল একজন শিল্পী, যাকে শুধু একটু সময় আর সাহস দিলে পুরো আকাশ ছুঁয়ে ফেলবে। ওদের দুজনের গল্পটা ছিল যেন কবিতার মতো—নির্মল, অনাবিল আর কোমল।

কিন্তু কবিতার পাতার বাইরেও একটা বাস্তবতা থাকে। এবং বাস্তবতা চিরকালই কঠিন।

এক সময় সেই ছোট পত্রিকাগুলোর ফান্ড বন্ধ হয়ে গেল। কবিতার কদর কমে গেল বাজারে। লেখালেখির চাহিদা পড়তে লাগল, এবং সাথে সাথে কমতে লাগল অরুণের সম্মানী। ভাড়া, বিদ্যুৎ, খাবার—সব মিলিয়ে তার জীবন একটা অচল ট্রেনের মতো দাঁড়িয়ে রইল।

অরুণ চাইলেও অন্য কিছু করতে পারত না। লেখার বাইরে তার কোনো স্কিল ছিল না। নীলা তাকে অনেক বোঝাতে চেয়েছিল—“আপাতত একটা কিছু করো, আয়ের পথ তো খুলতে হবে,” কিন্তু অরুণের ভেতরে তখন একধরনের হতাশা বাসা বেঁধেছে। সে নিজেকে অযোগ্য মনে করতে লাগল। কবিতার প্রতি বিশ্বাস হারাতে লাগল।

তারপর একদিন, নীলা চলে গেল।

না, কোনো চিৎকার, অভিযোগ বা বিদায় বার্তা ছিল না। কেবল দরজার সামনে রাখা একটা চিঠি—

"তুমি শুধু তোমার কবিতাকে ভালোবেসেছ, আমাকে নয়। আমি আর পারছি না, অরুণ। ক্ষমা কোরো। প্লিজ..."

অরুণ সেই রাতে কিছু খায়নি, ঘুমায়নি। সে কেবল বসে থেকেছিল জানালার পাশে। সারারাত বৃষ্টি হয়েছিল, ঠিক যেমনটা তারা একসাথে বসে দেখত। কিন্তু সেদিন শব্দগুলো আর মধুর লাগেনি। মনে হয়েছিল, যেন বৃষ্টি নয়—শূন্যতা ঝরছে আকাশ থেকে।

এরপর অরুণের জীবন যেন থেমে গেল। দিনগুলো চলতে লাগল এক ঘোরের মধ্যে। কলম হাতে নিলে কেবলই ফাঁকা কাগজে তাকিয়ে থাকত সে। শব্দেরা যেন অভিমান করে কোথাও পালিয়ে গেছে। সে চেয়েছিল লিখতে, কিন্তু লিখতে পারত না। যেন তার ভিতর থেকে কিছু ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে।

সময় কেটে গেল। মাস গড়াতে গড়াতে বছর। অরুণ এখন আর কাউকে ফোন করত না, বন্ধুদের সঙ্গ এড়িয়ে চলত। দিনের বেশিরভাগ সময় কাটত পুরোনো কবিতার খাতা আর নীলার চিঠিগুলোর পাশে বসে।

তবু কোথাও যেন একটা আগুন নিভে নিভে জ্বলছিল।

একদিন, সেপ্টেম্বরের এক ভেজা দুপুরে, বৃষ্টির ধোঁয়াশায় ঘেরা জানালার পাশে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে চোখে পড়ে গেল একটি পুরোনো কবিতা—যেটা সে শেষ করতে পারেনি। তারিখ লেখা ছিল—তিন বছর আগে, সেই মাসেই যখন নীলা তাকে ছেড়ে যায়।

পঙক্তিগুলো ছিল—

"তুমি চলে গেলে, অথচ জানলে না
এই শহর, এই বৃষ্টি, এই কবিতা—সব তোমায় খুঁজে ফেরে।"

সেই মুহূর্তে অরুণের ভেতর কিছু যেন ভেঙে পড়ল। হয়তো ছিল সেটা নীরব অভিমান, হয়তো ছিল ব্যর্থতার বোঝা। অথবা ছিল সেই সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা—আবার কিছু লেখার।

সে কলম তুলে নিল।

হাত কাঁপছিল। কাগজ ভিজে যাচ্ছিল চোখের জলেতে, কিন্তু অরুণ লিখে ফেলল সেই বাক্য—

"তোমার না-থাকার ভেতরেই আমি খুঁজে পেলাম নিজেকে।"

সেই পঙক্তিই ছিল তার ফিরে আসার শুরু।

এরপর অরুণ আবার লিখতে শুরু করল, প্রতিদিন না হলেও মাঝে মাঝে। শুরুতে শব্দগুলো এল না সহজে, বাক্য জুড়তে সময় লাগল। কিন্তু সে ধৈর্য ধরল।

সে নিজেকে বলেছিল—এইবার লিখবে নিজের জন্য, ভালোবাসার ক্ষতগুলো থেকে জন্ম নেওয়া গল্পগুলোর জন্য, যারা আজও নিঃশব্দে অপেক্ষা করে শব্দ হয়ে ওঠার।

কবিতাগুলো এবার ভিন্ন রকমের হয়ে উঠল—আগে যেখানে শুধু প্রেম ছিল, এবার সেখানে ছিল প্রস্থান, যেখানে কেবল স্বপ্ন ছিল, এবার সেখানে ছিল ভাঙা আয়নার টুকরো।

তার কবিতা একদিন পৌঁছাল সোশ্যাল মিডিয়ায়। কেউ একজন পড়ে সেটা পোস্ট করেছিল। ধীরে ধীরে পাঠক ফিরে এল। কেউ বলল—“আপনার কবিতা আমার রাত কাটিয়ে দিয়েছে,” কেউ বলল—“ভালোবাসা হারানোর ব্যথা এমন করে কেউ আগে বলেনি।”

অরুণ আবার আলোতে ফিরল। এবার সে জানে—হারিয়ে যাওয়া মানেই শেষ নয়, শূন্যতা থেকেই তো জন্ম নেয় নতুন কিছু।

নীলার চিঠিগুলো আজও তার টেবিলের ড্রয়ারে থাকে, কিন্তু এখন সে চিঠিগুলোর দিকে তাকিয়ে কাঁদে না। সে জানে, ভালোবাসা হারায় না—রূপান্তরিত হয়।

শেষ বাক্যটি হয়তো এমন হতে পারে:

"কবিতার মতো জীবনেরও একটা বিরতি থাকে—কিন্তু বিরতির পরে যে শব্দ আসে, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।"

সমাপ্ত

Post a Comment

0 Comments