২০ মে পালিত হোক আরও একটি ভাষা দিবস
দুর্গাপদ মাসান্ত
প্রতি বছরই সর্বত্র পালিত হয় ২১ ফ্রেব্রুয়ারি "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস"। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সারা পৃথিবীতে আরও ৬টি ভাষার জন্য আলাদা আলাদা ভাষা দিবস আছে। যেমন-
১) ২০ মার্চ "আন্তর্জাতিক ফরাসি ভাষা দিবস"
২) ২০ এপ্রিল "আন্তর্জাতিক চিনা ভাষা দিবস" ( চিনা বর্ণমালার প্রতিষ্ঠাতা সঙ্ জি হৈ-কে স্মরণ করে)
৩) ২৩ এপ্রিল "আন্তর্জাতিক ইংরেজি ভাষা দিবস" (শেক্সপিয়রের মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণে)
৪) ৬ জুন "আন্তর্জাতিক রুশ ভাষা দিবস" ( আলেকজান্ডার পুশকিনের জন্মবার্ষিকী স্মরণে)
৫) ২১ অক্টোবর "আন্তর্জাতিক স্পানিশ ভাষা দিবস"
৬) ১৮ ডিসেম্বর "আন্তর্জাতিক আরবি ভাষা দিবস"।
শুধু তাই নয় বাংলা ভাষাকে নিয়ে আন্দোলন হয়েছে একটি নয়, দু'টি নয়, কমপক্ষে তিন তিনটি। এর মধ্যে ২১ ফ্রেব্রুয়ারির কথা আমরা সকলেই জানি; উর্দু নয়, বাংলা চাই- এই দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানে অধুনা বাংলাদেশে।
আর ১৯৬১ সালের ১৯ মে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে অসমের শিলচর স্টেশনে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছিল কমলা ভট্টাচার্য সহ ১১জন ভাষাসৈনিক। তাই অসমের বরাক উপত্যকায় প্রতি বছর ১৯ মে ভাষা শহিদ দিবস হিসেবে পালিত হয়।
🍂
অসমের মতো এপার বাংলাতেও ১৯১২ সালে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল মানভূম জেলায়, যা তৎকালীন বিহার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে আন্দোলনের জেরে বিহার ভেঙে তৈরি হয় একটি জেলা-পুরুলিয়া। টুসু গানে এর প্রচার করা হত বলে এই আন্দোলনের আর এক নাম ছিল 'টুসু সতাগ্রহ'।
১৯৩১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, সেই সময় মানভূম জেলার সদর মহকুমা পুরুলিয়ায় শতকরা ৮৭ ভাগ বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বাস ছিল। স্বধীনতার পর তৎকালীন বিহার নিয়ন্ত্রিত মানভূম-পুরুলিয়ায় বাংলা ভাষাভাষীদের আকস্মিক ভাবে তীব্র সমস্যার মুখে পড়তে হয়। কারণ ১৯৪৮ সালে এক সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, মানভূম জেলার কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাংলা হরফে সাইনবোর্ড দেওয়া যাবে না। এমনকী বাংলা ভাষাভাষীদের স্কুলে বাংলা ভাষায় প্রার্থনাসঙ্গীতও চলবে না। তার পরিবর্তে 'রামধুন' আবশ্যিক। সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত বিদ্যালয়ে পঠনপাঠনে বাংলা ভাষাও চলবে না।
১৯৪৭-এ স্বাধীনতার পর থেকেই মানভূমে শুরু হল হিন্দি-সাম্রাজ্যবাদ। বাংলা স্কুলগুলি পরিণত হল হিন্দি স্কুলে। পোস্ট অফিস সহ সমস্ত সরকারি দপ্তরে হিন্দি বাধ্যতামূলক হল। ফরমান এল, আদালতের সওয়াল-জবাব, জমির দলিল সব হবে হিন্দিতে। ঠিক যে কৌশলে পূর্ব-পাকিস্তানে বাঙালিদের উপরে উর্দু চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল; হিন্দির আগ্রাসন মানভূমে ততটাই প্রবল হয়ে ওঠে ১৯৪৮ থেকে। এর বিরুদ্ধেই মানভূমের ভাষা আন্দোলন। কিন্তু সে ইতিহাস বেশি আলো পায়নি, যেমন ২১ ফেব্রুয়ারির কোলাহলে চাপা পড়ে গিয়েছিল বরাক উপত্যাকার ১১ জন ভাষা শহিদের কথা।
শুরু হল মুক্তির লড়াই। মানভূমবাসীর দাবি ছিল, বাংলা যেহেতু তাদের মাতৃভাষা, সে কারণে মানভূম জেলাকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্বাধীনতা লাভের পর প্রায় ৯ বছর ধরে আন্দোলন চলে। একেবারে শেষ ধাপে ১৯৫৬ সালের ২০ এপ্রিল অতুলচন্দ্র ঘোষ, নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত, লাবণ্যপ্রভা ঘোষ প্রমুখের নেতৃত্বে পুরুলিয়ার পুঞ্চা থানার পাকবিড়রা গ্রাম থেকে প্রায় ১০ জন মহিলা সহ ১০০৫ জন পদযাত্রী মানভূমকে পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে কলকাতা পর্যন্ত পায়ে হেঁটে এসে আইন অমান্য করেন এবং ৭ মে কারাবরণ করেন। এদের মধ্যে ৯৫৬ জন গ্রেফতার হন এবং ৩৪ জন অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১৩ দিন পরে, ২০ মে তাঁরা মুক্তি পান। টানা ২১ দিন বৈশাখের তীব্র দাবদাহ মাথায় নিয়ে প্রায় ৩০০ কিমি পথ হেঁটেছিলেন সত্যাগ্রহীরা। সত্যাগ্রহই ছিল তাঁদের মূল আদর্শ। বাংলাভাষীদের আন্দোলনের ফলে পশ্চিমবঙ্গে সেদিন জন্ম নেয় আজকের পুরুলিয়া জেলা।
মানভূমের এ ভাষা আন্দোলন কোনও স্বাধীন দেশ গড়ার আন্দোলন ছিল না; ছিল কেবল বাংলা ভাষাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়ার লড়াই। আজকের প্রশাসনিক পুরুলিয়া সেই লড়াইয়েরই ফসল। এবং পুরুলিয়া জেলা যে এরকম একটি গৌরবজনক ইতিহাসের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছে তা প্রায় অনেকেরই অজানা। তাই ২০ মে পালিত হোক আরও একটি ভাষা দিবস। মিলে যাক ১৯, ২০, ২১।
1 Comments
খুব ভালো লাগলো
ReplyDelete