জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প— ২৪১নাইজেরিয়া (আফ্রিকা)কাঠবেড়ালির ধূর্তামি /চিন্ময় দাশ

চিত্র- অর্ণব মিত্র 
দূর দেশের লোকগল্প— ২৪১
নাইজেরিয়া (আফ্রিকা)

কাঠবেড়ালির ধূর্তামি
চিন্ময় দাশ

অনেক অনেক কাল আগের কথা। সারা দেশ জুড়ে খরা সে বছর। খরা বলে খরা। চার দিক জ্বলে পুড়ে খাক। ফসল নাই কোত্থাও। এমনকি, কলাগাছেও মোচা আসেনি। বাদাম ক্ষেতে একটা গাছও নাই, যেটা কুঁকড়ে যায়নি। থোড় আসেনি পামগাছগুলোতে। মরিচ গাছগুলোও জ্বলে গিয়েছে।
সবচেয়ে বেশি দুর্দশা বনের ছোট ছোট জীবগুলোর। বলতে গেলে, অনাহারেই কাটাতে হচ্ছে তাদের। পেটে দেওয়ার কিচ্ছুটি নাই কোথাও। তবে, চিতাবাঘের কোনও ঝামেলা হয়নি এমন খরাতেও। তার পেট তো ভরে মাংসে। খরা-টরাকে গ্রাহ্যই করে না সে। অন্য সবাই তখন পেটের জ্বালায় কাতর। দিন দিন কঙ্কাল হয়ে উঠছে। হা-হুতাশ করছে খরা নিয়ে। 
চিতার মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। শিকার ধরবার জন্য ছোটাছুটি করতে মন চাইছে না তার। মনে মনে ফন্দী এঁটেছে একটা। ঘরে আয়েস করে বসে বসে পেট ভরাতে হবে।
একটা সভা ডাকল চিতা। বনের সবাই হাজির হয়েছে। চিতা বলল—আমার গায়ে কত শক্তি জানতে বাকি নাই তোদের কারও। যাকে তাক করব, মরতে তাকে হবেই। মাঝখান থেকে, মাঝখান থেকে শুধু ছোটাছুটি করা।
এ কথা তো সবাই জানে। এর জন্য সভা ডাকার দরকারটা কী? ভয়ে চুপ করে আছে সবাই। এদের মধ্যে কাঠবেড়ালিই একটু সাহসী। সে বলল—সে তো জানি, হুজুর। কিন্তু এছাড়া করবটাই বা কী?
চিতা বলল— সেজন্যই তো ডেকেছি সবাইকে। জোয়ান যারা আছিস, মন দিয়ে শোন সবাই। তোরা যদি মরতে না চাস, তাহলে সবাই নিজের নিজের ঠাকুমাদের আমার কাছে পৌঁছে দিবি। তারা আর বাঁচবেই বা আর ক’দিন।
কাঠবেড়ালি বলল—সব ঠাকুমারা তোমার পেটে চলে যাবার পর কী হবে?
--তখন তোদের মায়েদের পাঠাবি এক একে করে।
--যখন মায়েরাও ফুরিয়ে যাবে?
--আচ্ছা, হাঁদা তো তুই। ততদিনে খরাও কেটে যাবে। সমস্যা থাকবে না কারও। আবার সব আগের মতো হয়ে যাবে।
এবার কাঠবেড়ালিও চুপ। কেউ কিছু বলছে না। চিতাই বলল—তবে, আর একটা কথাও শুনে রাখ। আমার কিন্তু রোজ পেট ভরবার মতো খাবার চাই। ব্যবস্থা করে দিলাম। খেলাপ করলে, তখন কিন্তু জোয়ানগুলোকেই খেতে আরম্ভ করব।
কারও সায় নাই। মনঃপুত হয়নি কারওই। কিন্তু না মেনেও তো রেহাই নাই। বিশেষ করে যুবক বয়সীরা বুঝে গিয়েছে, নিজেদের বাঁচাতে হলে, ব্যবস্থাটা মানতেই হবে। সবাই মাথা নেড়ে সায় দিতে বাধ্য হোল।
কাঠবেড়ালিই হোল সবার চেয়ে ধূর্ত আর চালাক। চিতার কাছে ভালো সাজতে হবে। পরদিন বুড়ি ঠাকুমাকে নিয়ে, সে-ই প্রথম এসে হাজির গেল। হাড় জিরজিরে বুড়ি। লেজখানাও শুকিয়ে পাক দেওয়া দড়ির মতো। 
চিবাতে হোল না। বুড়িটাকে গিলেই ফেলল চিতা। বলল—দূর, পেটের একটা কোণাও তো ভরল না এতে। 
তখন একটা বনবিড়াল ঠেলে দিল তার ঠাকুমাকে। মুখ চোখে কুঁচকে সেটাকে কোন মতে খেল চিতা। বলল—এতেও তো কিছু হোল না রে। 
🍂
ad

তার পরে এলো একটা বক বুড়ি। দোনা মনা করে বকটাকে পেটে চালান করে দিল। বলল—আজ এই পর্যন্ত থাক। কাল কিন্তু একটু সুস্বাদু কাউকে পাঠাবি।
পরের দিন, এ ভাবেই কয়েক জন এলো চিতার ভোজে। দিন কয়েক গেল এই ভাবে। পরের দিন প্রথমেই কচ্ছপের পালা। কিন্তু ঠাকুমাকে সে খুব ভালোবাসে। মাঝ রাতের দিকে, বুড়িকে নদীর দিকে পাঠিয়ে দিয়েছে সে। সকাল হতে, খালি হাতে এসে হাজির হয়েছে চিতার সামনে। চিতা কটমট করে তাকাতেই, ককিয়ে উঠেছে কচ্ছপ—অপরাধ নেবেন না হুজুর। এই গেল বছরই তো মারা গিয়েছে আমার ঠাকুমা। আমার এই পড়শিদের জিজ্ঞেস করুন। সত্যি কি না।  
কয়েকজন সাক্ষী সাথে নিয়ে এসেছিল কচ্ছপ। তারাও মাথা নেড়ে দিয়েছে। তাতে কচ্ছপ ছাড় পেয়ে গেল। অন্যদের ঠাকুমারা যেতে লাগল চিতার পেটে।
দিন কয়েক বাদে, ঠাকুমারা সব সাবাড় হয়ে গেল দেখতে দেখতে। এবার মায়েদের পালা। ঠাকুমাদের জন্য কষ্ট হলেও, নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে মেনে নিতে হয়েছে সবাইকে। কিন্তু মায়েদের বেলায় কারও মন চাইছে না, চিতার ফরমান মেনে নিতে। নিজের মাকে কে না ভালবাসে! সবারই তীব্র আপত্তি। বেশি প্রতিবাদ কাঠবেড়ালি আর কচ্ছপের। 
মুখে আপত্তি জানাচ্ছে। কিন্তু ভয় আর দুশ্চিন্তায় মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় কচ্ছপের। ঠাকুমার বেলায় সে যে মিথ্যা কথা বলেছে, এটা সবাই জানে। এবার ঐ একই চালাকি আর খাটবে না, সে ভালোই বুঝে নিয়েছে। সেজন্য ভেবে ভেবে একটা ফন্দি এঁটে নিয়েছে সে। সারা রাত বসে বসে একটা ঝুড়ি বানিয়েছে কচ্ছপ। মাকে বলল—তোমাকে চিতার পেটে যেতে দেব না আমি।
মা বলেছে—কিন্তু এ ছাড়া আর উপায়ই বা কী আছে, বাছা?
--একটা উপায় আমে বের করেছি। তুমি এসো আমার সাথে।
ভোর হতে বাকি আছে তখন। মাকে নিয়ে চুপিসারে একটা পামগাছের তলায় পৌঁছাল কচ্ছপ। এবার মাকে বলল—তুমি চটপট গাছের মাথায় উঠে, বসে থাকো। প্রতিদিন তোমার খাবার পৌঁছে দিয়ে যাব আমি। চিন্তা কোর না।
ঝুড়িটায় একটা দড়ি বেঁধে মায়ের হাতে ধরিয়ে বলল—প্রতিদিন ভোরবেলায় ঝুড়িটা ঝুলিয়ে দিও। আমি তোমাকে খাবার দিয়ে যাবো। দড়ি বেশ শক্তপোক্তই আছে। যেদিন তোমার আমাকে দেখতে মন চাইবে, ঝুলিয়ে দিও। ঝুড়িতে চেপে বসবো। তুমি তুলে নিও। দেখা হয়ে যাবে মায়ে-পোয়ে।  
দিন কয়েক এভাবে বেশ ভালোই চলল। দিনে দিনে পামগাছের নীচে পৌঁছে যায় কচ্ছপ। মা ঝুড়ি নামিয়ে দেয়। ছেলে খাবার ভরে দিলে, সুড়সুড় করে মা উপরে তুলে নেয়। খাবার পৌঁছানো হয়ে গেলে, কচ্ছপের কাজ শেষ। নিশ্চিন্তে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়।
এদিকে চিতা আছে মহানন্দে। নিয়মিত খাবার পৌঁছে যাচ্ছে মুখের সামনে। এক্টুও এদিক ওদিক হচ্ছে না। একদিন কাঠবেড়ালির পালা এসে গেল। মাকে খুবই ভালবাসতো সে। কিন্তু বনের ভিতর সবচেয়ে দুর্বল জীব কাঠবেড়ালি। শক্তি কতটুকু তার। সাহসও বা কোথায়? চোখের জল ফেলতে ফেলতে, সেই মাকেও চিতার মুখে ঠেলে দিতে হোল তাকে। নইলে যে দুজনকেই গিলে ফেলবে শয়তানটা। 
এবার কচ্ছপের কথা মনে পড়ল মনে পড়ল কাঠবেড়ালির। ঠাকুমাকে যে চাতুরি করে সরিয়ে দিয়েছিল, ভালোই জানা আছে। এবার মায়ের ব্যাপারেও নিশ্চয় কিছু ফন্দি এঁটেছে। ভারি কৌতুহল হোল কাঠবেড়ালির। কচ্ছপের চলাফেরায় নজর রাখতে শুরু করল সে। 
পরের দিন। সকাল হয়েছে। সবে একটা বাদাম গাছে চড়েছে। হঠাৎ দেখে, থুপথুপ করে ঝপঝাড়ের ভেতর দিয়ে কচ্ছপ হেঁটে যাচ্ছে। পিঠে একটা পুঁটলি চাপানো। অবাক হয়ে গেল কাঠবেড়ালি। ব্যাপারখানা কী? সে তো আছে গাছের মাথায়। এ গাছ ও গাছ লাফিয়ে কচ্ছপকে অনুসরণ করতে কষ্ট হোল না এক্টুও। 
কচ্ছপ কিছুই টের পায়নি। সে নিশ্চিন্ত মনে পামগাছের তলায় এসে হাজির। মা তো ঝুড়ি নামিয়েই রেখেছে। খাবার ভরে সামান্য একটু টান দিয়েছে, উপর থেকে সর-সর করে ঝুড়ি তুলে নিয়েছে তার মা।
ওহ, এই ফন্দী! কাঠবেড়ালি বুঝে গেল ব্যাপারটা। এভাবেই মাকে লুকিয়ে রেখেছিস হতভাগা! দাঁড়াও, মজা দেখাচ্ছি তোমাকে। সকলের মা চিতার পেটে যাবে। আর তোমার মা লুকিয়ে থাকবে পামগাছে্র মাথায়! 
গাছের মাথায় মাথায় লাফিয়ে, সোজা চিতার ডেরায় হাজির হয়েছে কাঠবেড়ালি। বলল-- আমাদের ঠাকুমা আর মায়েদের তোমার কাছে দিয়ে যাচ্ছি সবাই। কিন্তু কচ্ছপ তোমার সাথে চালাকি করছে মিথ্যে কথা বলে। 
সব শুনে, মাথা গরম হয়ে গেল চিতার। গরগর করে উঠল—চল তো দেখি। কত বড় ধুরন্ধর আজই বুঝিয়ে দিচ্ছি ব্যাটাকে। 
কাঠবেড়ালি বলল—আজ হবে না, হুজুর। এইমাত্র মাকে খাবার দিয়ে গেছে কচ্ছপ। ঝুড়ি তো উপরে তুলে নিয়েছে মা। তুমি উঠবে কী করে গাছে? কাল খুব সকালে হাজির হয়ে যাব আমরা। কচ্ছপ পৌঁছানোর আগেই। মা ঝুড়ি নামিয়েই রাখবে তখন। তাতে চড়েই উপরে পৌঁছে যেতে পারবে তুমি।
সেই কথা ঠিক রইল। পরদিন সবে মোরগ ডাকা শুরু হয়েছে। দুজনে পৌঁছে গেল পামগাছের নীচে। ঝুড়ি তো নামানোই ছিল। চিতাকে ঝুড়িতে চপিয়ে, দড়িটা একটু নাড়িয়ে দিল কাঠবেড়ালি। 
কিন্তু ঐ পর্যন্তই। ঝুড়ি ওপরে উঠছে না। উঠবে কী করে? সামান্য খাবার দিয়ে যায় ছেলে। সেটা ওপরে তুলে নিতে, বুড়ি মায়ের অসুবিধা হয় না। কিন্তু ঝুড়িতে আস্ত একটা চিতা চেপে বসলে, সেই ঝুড়ি কি আর একটা বুড়ি কচ্ছপ টেনে তুলতে পারে? 
চিতা বুঝে গেল ব্যাপারটা। বলল—ঝুড়ির দরকারটা কী? আমি নিজেই গাছে উঠে যাচ্ছি। 
চিতা গাছে চড়তে ওস্তাদ। তর তর করে উঠে গেল গাছের মাথায়। সত্যিই সেখানে কচ্ছপের মা লুকিয়ে বসে আছে। কিন্তু চোখে দেখে তো আর পেট ভরে না। খেতে গিয়েই হোল সমস্যা। কছপের পিঠের খোল এত শক্ত, কিছুতেই সুবিধা করা যাচ্ছে না। 
রাগ চড়ে গেল চিতার মাথায়। কচ্ছপটাকে ধরেই এক আছাড়। নীচে আছড়ে পড়ে গেল কচ্ছপ। চিতা যখন নেমে এখন, কচ্ছপটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে নীচে। চেশ চেটেপুটে খেয়ে, হেলতে দুলতে নিজের নিজের ডেরায় ফিরে গেল দুজনে।
খানিক বাদে মায়ের খাবার নিয়ে কচ্ছপ এসে হাজির হয়েছে। ঝুড়িতে খাবার সাজিয়ে, দড়িতে হালকা টান। কিন্তু অবাক ব্যাপার। ঝুড়ি ওপরে উঠছে না। কারণটা কী? এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। কোনও দিন হয় না। তখনই তার চোখে পড়ল, কচ্ছপের খোলের কতকগুলো টুকরো ছড়িয়ে আছে আশেপাশে। এ যে চিতার কীর্তি, বুঝতে অসুবিধা হোল না তার। 
মনের দুঃখে সেই যে বন থেকে বেরিয়ে গেল, আর কখনও বনে দেখা যায় না কচ্ছপকে। আজও নদীর পাড়ে গর্ত খুঁড়ে, একা একা বাস করে কচ্ছপেরা। বনের অন্য কারও সাথে মেলামেশা করে না তারা।

Post a Comment

0 Comments