পথ ফুরোবে
পুলককান্তি কর
ইউমিয়াম লেকটি ভারী সুন্দর। পাহাড়ি উপত্যকায় এমন দীর্ঘ লেক আর কোথাও আছে কিনা জানা নেই। শিলং ঢোকার ঠিক আগে প্রায় আট দশ কিলোমিটার দীর্ঘ এই হ্রদের মাঝে মাঝে ছোট ছোট দ্বীপের মতো জেগে ওঠা স্হলভূমিগুলোই রবি ঠাকুরের মনে আমার মতো আন্দোলন তুলেছিল কি না কে জানে? শেষের কবিতার লাবণ্য যেমন করে অমিতের সাথে কল্পনায় দাম্পত্যের বাড়ী বুনেছিল সাঁকোর দুপ্রান্তে – আমিও তেমনি কিছু একটা ভাববো ভাববো করছি, এমন সময় এক তিরিশ বত্রিশের যুবতী আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপ ক্যায়া গুয়াহাটি যাও গে?’
হাঁ।
– অগর বুরা না মানে তো এক রিকুয়েস্ট হ্যায়।
– ক্যায়া?
– আপ মুঝে থোড়া লিফ্ট দোগে? আই মিন লিফ্ট নেহি, ম্যায় আপকা কিরায়া শেয়ার করুঙ্গি।
– বাত ক্যায়া হ্যায়?
– একচুয়ালি মুঝে আজ গুয়াহাটি জানা হ্যায়। অচানক প্ল্যান হো গিয়া। মুঝে মালুম নেহি থা কী আজ ইঁহা ইলেকশন কা রেজাল্ট হ্যায়। কোই পাবলিক ভেহিক্যালস নেহি হ্যায়। ইঁহা সে কোই কার ভি হায়ার নেহি হো পা রহা হ্যায়।
– ঠিক হ্যায়, কোই বাত নেহি। আপ আ সকতি হো।
– থ্যাঙ্ক য়্যু সো মাচ। লেকিন আপকো ফেয়ার কা আধা হিসসা জরুর লেনা হ্যায়।
– আভি চলো তো সহি। আপকা সামান কাঁহা হ্যায়?
– ইতনি সি হ্যায়, মেরে হ্যান্ড ব্যাগ মে।
– ঠিক হ্যায়, আপ খাড়া রহিয়ে, ম্যায় থোড়া ফটো খিঁচকে আতা হুঁ।
– কোই বাত নেহি। চাহো তো ইয়ে লেককে সাথ ম্যায় আপকা ফটো খিঁচকে দে সকতি হুঁ। ক্যামেরা একবার দেকে তো দেখো, মেরি ফটোগ্রাফিক সেন্স আচ্ছি হ্যায়।
– ম্যায় খুদকা ফটো নেহি খিঁচতা। ম্যায় দো চার লেককা ফটো লেকে আতা হুঁ।
– ওককে।
এই এক আপদ হল। ভদ্রমহিলা সমস্যায় পড়েছেন, নাও বলা যায় না। মনে মনে ভাবছিলাম যাবার পথে একটা গল্প নামাব। সে গুড়ে বালি। পাশে কেউ একজন বসে থাকলে দু চারটা খেজুরে আলাপ তো করতেই হবে। সর্বোপরি ভদ্রমহিলা উপকারটার বোঝা সহজ করার জন্য নিশ্চই প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথা বলবেন। তাও ভগবানকে ধন্যবাদ। কোনও হুমদো পুরুষ মানুষকে এমন আর্জি নিয়ে পাঠাননি। ভদ্রমহিলা বেশ তন্বী এবং পোষাক আশাকে মার্জিত রুচির। সুন্দর একটা সুগন্ধ মেখেছেন। লেখাটার চৌষটি পুজো হয়ে গেল ঠিকই, তবে নাকের এবং চোখের তৃপ্তি হবে আগামী দু আড়াই ঘণ্টা – সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। চারপাশে এত সুন্দর পাহাড়, তার মাঝে সুন্দরী সহযাত্রীনী – খুব খারাপ যে লাগছে না এটা স্বীকার করার জন্য বুকে হাত দেওয়ার দরকার নেই। আর জোর করে উল্টোটা বললে লোকে আমার কবি-সত্তার সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করবে। মিনিট দশকের মধ্যেই ক্যামেরা ট্যামেরা গুছিয়ে সিগারেটে একটু সুখটান দিয়ে ফিরে এসে দেখলাম ভদ্রমহিলা এখনও ওখানেই দাঁড়িয়ে আছেন। ছিঃ ছিঃ, ড্রাইভারকে বলে ওনাকে বসিয়ে দিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল। আমার বিনা অনুমতিতে ড্রাইভারই বা ওনাকে ভেতরে বসতে দেবে কেন? সত্যি, অনি ঠিকই বলে। আমার কোনও আক্কেল জ্ঞান নেই। একটু ফ্যাকাসে হাসি দিয়ে বললাম, ‘স্যরি থোড়া লেট হো গেয়া।'
🍂
– ওকে। কোই বাত নেহি। আপকা অর কুছ কাম হ্যায়?
– নেহি, চলিয়ে। বলেই আমি পেছনের দরজাটা খুলে ইঙ্গিত করে দেখালাম ভেতরে ঢুকতে। কী করলে উচিত হবে? আমিও কি পেছনের সিটে ওনার সাথেই বসে যাব, নাকি সামনের ড্রাইভারের পাশের সিটে? সামনে বসলে নতুন গল্পটা নিয়ে ভাবা যাবে এটা ঠিক কথা, কিন্তু গাড়ীটা আমিই বুক করেছি যখন, পিছনে বসাটা অনেকটা অধিকারের মধ্যেই পড়ে। সর্বোপরি, সামনে বসতে গেলে উনি ভাবতে পারেন তার জন্যই আমাকে সামনে বসতে হচ্ছে। আচ্ছা কেঁচিকলে পড়া গেল। এইসব আচম্বিত সমস্যায় না পড়লে ঠিক বোঝা যায় না ঠিক কী করা উচিৎ। আমার দ্বিধার অবসান ঘটিয়ে ভদ্রমহিলা একটু কাঁচুমাচু হয়ে আরও ডানদিকে যতটা চেপে বসা যায় ততটাই সরে গিয়ে বসলেন, 'আইয়ে না'। যাক বাবা ঝামেলা মিটল। ভেতরে বসে নিছক ভদ্রতা বশে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপ গুয়াহাটি মে হী রহতে হো ইয়া দুসরে কোই জগহ জানা হ্যায়?
উত্তর দেওয়ার আগেই ভদ্রমহিলা আমার বাঁদিকের পকেট ইঙ্গিত করে বললেন ‘শায়দ আপকা মোবাইল বজ রহী হ্যায়।’
সত্যি তো! প্রায় সাতখানা মিসডকল। কিছু চেনা, কিছু অচেনা নম্বর। এখন যিনি ফোন করছেন তিনি একটি পত্রিকার সম্পাদক। আমি ফোন ধরে বললাম, ‘বলুন দাদা, কী খবর?’
– একটা গল্প পাঠাবে বলেছিলে, পাঠালে না তো?
– পাঠাবো। লেখা হয়নি।
– কবে লিখবে, কবে পাঠাবে?
– দেখি। লেখা আসছে না আজকাল। আর যে লেখা আমার বেশী আসে, সেসব তো আপনার চলবে না।
– না না সম্পর্কের টানাপোড়েন নিয়ে নয়। ওসব অন্য পত্রিকায় দাও গিয়ে।
– কিন্তু দাদা, পৃথিবীতে সম্পর্কের টানা পোড়েন ছাড়া কি গল্প লেখা যায়? সবখানেই তো সম্পর্ক। শুধু মাত্র ডাইমেনশনটা আলাদা।
– সে হোক গে নিকেত। কিন্তু একটা কথা বলো দেখি, তুমি নিজে বিয়ে থা করোনি, সম্পর্কের এত জটিলতা লেখো কী করে?
– সে তো দাদা আপনি নিজেও লেখক। আপনি যেমন করে আপনার অভিজ্ঞতার বাইরের অনুভবগুলোকে লেখেন, আমিও তেমনি।
– আমি বাবা তোমার মত পারি না। আমার এই নিবন্ধগুলোই ঠিক আছে। বাই দা বাই, তুমি এখন কোথায়?
– আমি শিলংএ। এখন ফিরছি। সন্ধ্যায় ফ্লাইট।
– ক’টায়?
– ছটা পঁয়তাল্লিশ শিডিউলড। এখন মেসেজ পাঠিয়েছে এক ঘন্টা লেট। দেখা যাক আল্টিমেট কখন ছাড়ে।
– ঠিক আছে, হ্যাপি জার্নি। তাড়াতাড়ি লেখাটা পাঠাও।
– আচ্ছা দাদা।
ফোনটা রেখে আমি ভদ্রমহিলার দিকে তাকাতে উনি পরিষ্কার বাংলায় বললেন ‘আপনি লেখক নাকি?’
একটু দেঁতো হাসি দিয়ে বললাম ‘এই আর কি?’
– মানে, আপনি কি পেশাদার লেখক?
– না।
– শখের?
– হ্যাঁ।
– কী নাম আপনার?
– নিকেত বন্দ্যোপাধ্যায়।
– আপনি কি দেশ টেশ এ লেখেন?
– টুকটাক সব ম্যাগাজিনেই লেখা বের হয়।
– তবে আপনার নামটা অচেনা কেন? আমি তো মোটামুটি নিয়মিত পশ্চিমবঙ্গ থেকে বড় সব ম্যাগাজিনগুলোই আনিয়ে পড়ি।
– লেখক অকিঞ্চিতকর বলেই আপনি চেনেন না।
– স্যরি, আমি ওটা মিন করতে চাইনি।
ভদ্রমহিলা চুপ করে গেলেন। খানিকক্ষণ মোবাইলে খুট খুট করে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ‘আপনার নামের পাশে অন্যান্য বিষয়ের বই দেখাচ্ছে গুগুলে, গল্প কবিতার কিছু দেখাচ্ছে না তো!’
মনটা একটু ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। আমি কি আগবাড়িয়ে ওনাকে বলতে গেছি যে আমি লেখক? ব্যাপারটা এমন হয়ে উঠছে যেন আমাকেই এ ব্যাপারে প্রমাণ দাখিল করতে হবে। আর কিছু বললে ঝাঁঝিয়ে উঠবো কিনা ভাবছি। এমন সময় মিষ্টি হেসে ভদ্রমহিলা বললেন ‘জানেন তো মিঃ ব্যানার্জি, আমি একটু বেশী এক্সাইটেড হয়ে পড়েছি। আমার পাশে একজন প্রখ্যাত লেখক বসে আছেন, এটা যেন আমার বিশ্বাসই হতে চাইছে না। সেজন্যই একটু আধটু সঙ্গত কথা বলে ফেলছি।’
– এত এক্সাইটমেন্টের প্রয়োজন নেই ম্যাডাম। লেখক মোটেই প্রখ্যাত নন। দেখছেন না আপনি নামই শোনেন নি, গুগুলও চেনে না।
– ছি ছি! এভাবে বলবেন না। আমি চিনি না – এটা আমারই অজ্ঞতা। আসলে গৌহাটিতে বসে পশ্চিমবঙ্গের মতো বাংলা চর্চা তো নিশ্চই হয় না। ওখানে আপনার কেমন খ্যাতি তা তো আমার জানা নেই।
– ওখানেও আমার খ্যাতি নেই।
– নাই বা রইল খ্যাতি। গুগুলে তো দেখলাম আপনার অন্যান্য অনেক ফিল্ডে কাজ করবার। নিশ্চই লেখা ছাপানো বা খ্যাতি বিষয়ক ব্যাপারে আপনি ভাবনা চিন্তা করেন না।
এই এক হয়েছে গুগুল। মানুষের নাড়ী নক্ষত্র সব এতে তুলে দিচ্ছে সার্চইঞ্জিন। শুধু কিছু তথ্য দিয়ে কি মানুষ যাচাই করা যায়? কে সত্যিকারের লেখক, কে কাগুজে – এসব বিচার কি মোবাইল টিপে করা যায়? একটা কথা আমার আজও মাথায় ঢোকে না, এসব আপলোড করে কে? লেখক নিজে? না কি পাবলিশার্স? আর ছোটখাটো ম্যাগাজিনে যেসব ছাপা হয়, সেগুলোর খবর কি এখানে ওঠে? কে জানে।
– আচ্ছা মিঃ ব্যানার্জি, আপনি কবিতা লেখেন, নাকি গল্প?
– দুটোই।
– আপনার কোন ফিল্ডে ভক্ত বেশী?
– আপনি মিছিমিছি আমাকে প্রখ্যাত বানাতে উঠে পড়ে লেগেছেন কেন বলুন দেখি?
– আমি কোথায় উঠে পড়ে লাগলাম?
– ভক্ত কার হয়? তার জন্য নামী হতে হয়। আমার এত নামটাম নেই।
– আচ্ছা ছাড়ুন ওসব কথা। আপনি কি সাথে আপনার কোন বই ক্যারি করছেন?
– না।
– মোবাইলে কোনও লেখাটেখা আছে?
– না। কেন?
– তাহলে পড়তাম।
– ঠিক আছে। ঠিকানা দিয়ে দিন, পাঠিয়ে দেব।
– এই মুহূর্তে কিছু নেই?
– কাল একটা কবিতা লিখছিলাম। খসড়াটা আছে।
– দিন না প্লিজ?
ব্যাগ হাতড়ে একটা কাগজ বের করে দিলাম। ভদ্রমহিলা অধীর আগ্রহে ওটা নিয়ে বললেন, ‘ওমা এটা তো হোটেলের বিল।’ আমি বললাম ‘উল্টো পিঠে দেখুন না!’
– আপনি বুঝি কোনও খাতা বা ডাইরিতে কবিতা লেখেন না?
– না। হাতের সামনে যা থাকে তাতেই লিখি।
– এইজন্যই লোকে বলে 'কবি'। ছন্নছাড়া বাউন্ডুলে না হলে লোকে কবিতা লিখবে কী করে?
এরপর সত্যি সত্যি নিজেকে চিড়িয়াখানার জীব মনে হতে লাগলো। কবি যে আলাদা সম্প্রদায়ের কেউ, সাধারণ মানুষ যে তাদের এভাবে বিষ্ময়ের চোখে দেখে – বাংলায় কখনও মনে হয় নি আমার। আড়চোখে দেখলাম ভদ্রমহিলা নিবিড় ভাবে কবিতাটা গিলছেন। কেন কি জানি আমার বুকটাও একটু ধড়ফড় করে উঠলো। উনি মনে মনে আমাকে যে উচ্চতায় বসিয়ে ফেলেছেন, সব সম্ভ্রম এখন দাঁড়িয়ে আছে হলুদ রঙের আধাছেঁড়া ওই হোটেলের বিলটার ওপর। সত্যি যদি কবিতাটা ওঁর মনে না ধরে? অবশ্য পাঠিকা হিসাবে ওর স্ট্যান্ডার্ডটা কেমন সেটাও তো জানা নেই। যদি কাঁচা পাঠিকা হয় সে কি এই কবিতার শব্দমুগ্ধতা নিতে পারবে?
কিছুক্ষণ পরে ভদ্রমহিলা ওঁর দুহাত দিয়ে আমার ডান হাতটা শক্ত করে ধরে অনেকখানি মুগ্ধতা নিয়ে বললেন, ‘এই কবিতা আপনি লিখেছেন?’
আমি লাজুক হেসে বললাম, ‘আপনার ভালো লেগেছে?’
– আমার নাম দিতিপ্রিয়া। আপনি আমায় ‘দিতি’ বলে ডাকুন।
– বেশ, তাই না হয় ডাকবো। কিন্তু বললেন না তো কবিতাটা ভালো লেগেছে কিনা?
– এর পরও কি আর বলে দিতে হবে? ‘কথা কিছু কিছু বুঝে নিতে হয়।’
– প্রশংসা মুখে শুনতে ভালো লাগে বেশী। বিশেষ করে সদ্য পরিচিতা সুন্দরী মহিলার মুখে।
– ওঃ। আপনার এ ধরনের অনেক অভিজ্ঞতা আছে বলুন? যদিও বলার কথা নয়, তবু আমার কেন যেন একটা জেলাসি ফিলিংস হচ্ছে।
– জেলাস হওয়ার দরকার নেই। সত্যি সত্যি তেমন সৌভাগ্য আমার এখনও হয়নি।
– মানে? কপট রাগ করে দিতি বললেন ‘আপনি কিন্তু আমাকে অসম্মান করছেন?’
– কী রকম?
– সুন্দরী হই বা না হই, মুখের ওপর অসুন্দর বলা কি ঠিক?
– আমি অসুন্দর কখন বললাম।
– এই যে বললেন, আপনার সেরকম সৌভাগ্য হয়নি।
– ওঃ। ওটা তো ঠিকই বলেছি। আপনি তো মুখে প্রশংসা করেননি, বুঝে নিতে বলেছেন।
– মুখে বলবো। কিন্তু একটা শর্ত আছে।
– কী শর্ত?
– আমাকে ‘তুমি’ বলতে হবে। আমি আপনাকে চেয়ে অনেকখানি ছোট ।
– আমার বয়স না জেনে তুমি আমার বৃদ্ধ বানিয়ে দিলে?
– বৃদ্ধ কোথায় বললাম? আমার চেয়ে অনেকখানি বড় বললাম। আপনার বার্থ ডে এবং ইয়ার গুগলে আছে; দেখে নিয়েছি আপনার এখন থার্টি টু।
– তুমি কি বাঙালি নাকি অসমীয়া?
– আমার জন্ম ইত্যাদি সব আসামেই। এখানে আমাদের বহু পুরুষের বাস। তবে অরিজিন যদি জানতে চান তবে আমারা বাঙালি।
– তুমি কি লেখো টেখো?
– না, আমি বিশুদ্ধ পাঠিকা। এখানে থেকে যতটা বাঙলা বই পাওয়া সম্ভব, আমি পড়ার চেষ্টা করি।
– তুমি কী কর ?
– আমি এল.আই.সি তে চাকরী করি। ডেভেলপমেন্ট অফিসার।
– তোমার বাবা-মা?
– দুজনেই গত। আমি এক সন্তান। বাবা মার বাড়ী পাহারা দিই। চলুন না আমার বাড়ীতে আজ। এই তো শুনলাম ফ্লাইট লেট আছে। ফাঁকা রাস্তা। যেভাবে গাড়ী চলছে, মনে হয় দুটোতেই এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাবেন। এতক্ষণ ওখানে বসে কী করবেন?
– আর বলো না। আজ ভোটের ফলাফল বলে সবাই জোর করে সকাল সকাল বেরিয়ে যেতে বলল। ড্রাইভারও বলল, হোটেলের ম্যানেজারও বলল। পুরো রাস্তা নাকি জ্যাম থাকবে। এ তো দেখি উল্টোটা।
– তা আপনি শিলং এ কেন এসেছিলেন? এ সময়টাতো বেড়ানোর নয়।
– যে কারণে এসেছি, তা বলা যাবে না। বললে বিশ্বাস করবে না।
– কবি লেখকের কিছু মনে হওয়াটাই যথেষ্ট কারণ। বলে দেখুন, অবিশ্বাস করার প্রশ্নই উঠবে না।
– আসলে পাঁচ দিন আগে মানে গত শনিবার আমি আলমারি গোছাতে গিয়ে শেষের কবিতা বইটা হঠাৎ পেলাম। বহুবার পড়া, তবু হাতে পড়তে লোভ সামলানো গেল না। সারা সন্ধে আর কিছুটা রাত জুড়ে পড়া তো শেষ হল, কিন্তু মনের উচাটন শেষ হল না। মনে হল একবার শিলং-এ গিয়ে চাক্ষুস করে আসি ঠিক কোন জায়গায় বসে রবীন্দ্রনাথ উপন্যাসটা ভেবেছিলেন, কোথায় এমন করে রডোডেনড্রন গুচ্ছ ফুটতো ইত্যাদি। তো উঠলো বাই তো কটক যাই। পরের দিনই সোজা ফ্লাইট এ গুয়াহাটি, সেখান থেকে ট্যাক্সি করে শিলং।
– এটাই তো কবি স্পিরিট। খুব ভালো করেছেন। দিতিকে রীতিমতো উত্তেজিত দেখালো। ওকে অপ্রতিভ করার ইচ্ছে ছিল না, তবু না বলে পারলাম না 'না হে দিতি, সবসময় আবেগের বশে কাজ করলে লাভ হয় না।'
– এমন বলেছেন কেন?
– এখানে আসার আগে একটু গবেষণা করা উচিৎ ছিল, রবীন্দ্রনাথ কোথায় উঠতেন, সেই জায়গাটা এখনো আস্ত আছে কিনা!
– এ তো হিসেবীরা ভাববে। আপনি ভাববেন কেন?
– আসলে যে উদ্দীপনায় আসা, সেটা পূর্ণ হল না যে!
– না হয়েছে, না হয়েছে। আপনি এসে আদৌ একদিনও সেটা খোঁজার চেষ্টা করেছেন কি? দেখে তো মনে হয় আপনি মিনিমাম ইনিসিয়েটিভই নেননি।
মেয়েটি মানুষের ফেস স্টাডি ভালো মতো করতে পারে মানতেই হবে। এ নিশ্চিত সফল বীমা অফিসার। মানুষ চরিয়ে বীমা করায় যখন – বাক্যের মুন্সিয়ানাটাও ভালো থাকতে হবে। হঠাৎ করে দিতির কথায় ঘোর ভাঙলো – ‘কী, ঠিক বলেছি কিনা?’
– কোনটা?
– এই যে, আপনি গত চারদিনে একেবারের জন্যও রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতার পটভূমি নিয়ে কোনও ঔৎসুক্যই দেখান নি?
– ঠিক বলেছো। আসলে এখানে এসে একপ্রকার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। আমার কাছে পাহাড় অনেকটা নির্জন, বিশাল-বক্ষ পুরুষের মতো। তার কোলে এত এত বাড়ি দেখে কেমন যেন কংক্রিটের বস্তি মনে হল।
– সবচেয়ে বড় কথা দেখুন, এখানে একটাও আর কাঠের বাড়ী দেখবেন না। এটা শুধু মেঘালয় নয়, আসামেও। মানুষ ব্যবসাটা বুঝে গেছে। কংক্রিটের তিন চার তলা বাড়ি বানিয়ে একটা ফ্লোরে নিজেরা থাকবে, অন্যগুলো ভাড়া দিয়ে রোজগার করবে।
– কোনও জায়গায় একবারে নির্জন পাহাড় পেলাম না দিতি।
– আপনাকে একটু ভেতরে যেতে হতো।
– গেছি। যতটা পেরেছি ইনটিরিয়ারে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। সারা শিলং জুড়ে একই অবস্থা। একেবারে ওরকম পাহাড় পেতে হলে ট্রেকিং এর প্ল্যান নিয়ে আসতে হতো।
– তাহলে গত চারদিন কী করলেন?
– এরই মাঝে এখনকার শিলং আবিষ্কার করার চেষ্টা করলাম। এখন তো আর অমিত লাবণ্যের জমানা নেই, ওদের মতো সম্পর্ক নিয়েও লেখা যাবে না।
– কেন? লেখা যাবে না কেন?
– এখন জীবন জটিল হয়ে গেছে দিতি। ওসব লিখলে লোকে নেবে না। ব্যাকডেটেড ভাববে।
– কেন? তখনকার দিনে অমিত লাবণ্যকে ছেড়ে কেটিকে বিয়ে করল শুধুমাত্র ওই সম্পর্ককে অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখবে বলে, তুচ্ছ পাওয়ার মলিনতা দিয়ে সম্পর্কের অধরা সীমাহীনতাকে ক্লিষ্ট করবে না বলে – এটা কি আধুনিক নয়? এটা কি জটিলতার দিক দিয়ে কম কিছু?
– না না দিতি। শেষের কবিতা ব্যাকডেটেড – একথা বলছি না। ওটা যথেষ্ট আধুনিক। কিন্তু আমি তো আর একটা শেষের কবিতা লিখছি না, আমাকে এখনকার সময়োপযোগী অথচ নতুন ধারার কিছু লিখতে হবে। সবাই শুধু নতুন চায়। নতুন ভাবধারা, নতুন প্লট, নতুন আঙ্গিক। সবাই নতুন নতুন করলে এত নতুন আসবে কোত্থেকে?
– মানুষজনের সম্পর্কের মধ্যে কতখানি আর নতুনত্ব সম্ভব? ঘটনা একই, শুধু পরিপার্শ্বটুকু আলাদা। আগেও দাম্পত্যের টানাপোড়া ছিল, এখনও আছে, হয়ত আগে লোকেরা মেনে নিত – এখন ডিভোর্সটা বেড়ে গেছে। আগেও পরকীয়া ছিল, লোকে আড়ালে করত; কেউ গল্পে লিখলে সেই চরিত্রটা নিন্দিত হত, এখন লোক প্রকাশ্যে পরকীয়া করে বা বলে। পরকীয়াটা বদলে যায়নি।
– এটাই তো সমস্যা দিতি। আজকাল এজন্য আর লোকে এসব সম্পর্কের টানাপোড়েনের গল্প শুনতে চায় না।
– এটা ভুল কথা। কালজয়ী সব লেখাগুলো কিন্তু সম্পর্ক নিয়েই। এখনকার যে যে বইগুলো নাম করেছে, পুরস্কার পেয়েছে – সবই কিন্তু সম্পর্ক নিয়েই। এর বাইরে বিখ্যাত লেখা বা বই কিন্তু হাতে গোনা।
– তুমি সাহিত্য নিয়ে বেশ চর্চা করো, এটা বোঝা গেল দিতি? ভালো লাগলো তোমার সাথে আলাপ হয়ে। চলো কোথাও গিয়ে লাঞ্চ করি। দেড়টা তো বেজে গেল।
– চলুন না নিকেত’দা আমার বাড়ীতে। ওখানে দু-মুঠো কিছু খেয়ে নেবেন। আর তো চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই আমরা গুয়াহাটি ঢুকে যাব।
– না দিতি। চলো এখানে কোথাও খেয়ে নিই।
– চলুন আমার বাড়ীতে। আপনার পায়ের ধূলো তো পড়তো।
– জুতো মোজা পরা আছে দিতি, পায়ে ধূলো নেই। আর তাছাড়া বাড়ী যাওয়াটা ব্যাপার নয়। গিয়ে আবার তোমাকেই রান্নাবাড়ী করতে হবে, সময় যাবে। তার চেয়ে রেডিমেড সেরে নিই।
– বাড়িতে কাজের মাসি আছে। ফোন করলে চলে আসবে।
– লোকের হাতে খাবো যখন, দোকানের লোকেদের হাতেই খাই।
– বেশতো চলুন, মাসির দরকার নেই, সেদ্ধ ভাত করেই খাওয়াবো। চলুন, ওই ধাবাটায় গিয়ে বরং একটু চা টা খাই।
– চলো।
চা খেতে খেতে বেশ ভালো করে দেখলাম দিতিকে। এখন একেবারে মুখোমুখি বসে, ফলে ওকে পুরোপুরি দেখার এবং দেখে ওর প্রতি কিছু অনুভব করার মতো একটা স্হিতি এল। ছিপছিপে চেহারা, বেশ ফর্সা রঙ। একমাথা চুল, এবং চুল গুলো বেশ কালো এবং মোটা শাঁসের। সুন্দর একটা জারুল রঙের সাথে লাল কম্বিনেশনের চুড়িদার, সিল্কেরই মনে হচ্ছে। সবচেয়ে সুন্দর হল ওড়নাটা। মনে হচ্ছে ওটাই যেন ডানা। দিতি চাইলেই ওইটা মেলে উড়ে যেতে পারে এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়ে। তবে মুখে যত উচ্ছলতাই দেখাক ও, ওর চোখের কোনে যেন হালকা কালোর পোঁছ। হয়তো ঘুম হয়নি দু-এক দিন। চা খেতে খেতে দেখলাম ও এক মনে ওর বাঁ হাতের আঙ্গুলগুলো নিরীক্ষন করছে। আগে বইয়ে পড়েছি, এখন দেখে মনে হল ওই আঙুলগুলো সত্যি সত্যি কনক চাঁপার মতো। নখের উপরে লাল হলুদ দিয়ে এখনকার স্টাইলের নেল আর্ট করা। শরীরের প্রতি নজর আছে মেয়েটার, বোঝাই যায়। বললাম, 'হঠাৎ শিলং-এ যে?
– বেবীজ ডে আউট।
– বুঝলাম না।
– এত অল্প সময়ে বুঝবেন না নিকেত দা।
– এই যে বললে আরও মিনিট চল্লিশেক লাগবে পৌঁছতে।
– সব কথা ড্রাইভারের সামনে বলা যায় না যে। আর যদিও আপনার ড্রাইভার খাসী, তবু এরা সব বাংলা বোঝে।
– ওঃ। চল উঠি।
গাড়িটা বেশ ভালই জুটেছে এবার। একেবারে নতুন গাড়ী ‘ইটিয়স’। আর রাস্তাও চমৎকার। সেই আগেকার মতো পাহাড়ী সরু রাস্তার কনসেপ্ট একদম মেলে না। আগে কোনও দুর্ঘটনার কারণে বা গাড়ী খারাপ হলে পুরো রাস্তা বন্ধ থাকত ঘণ্টার পর ঘন্টা। সেই জ্যাম ছাড়ানো রীতিমত সময়সাধ্য ব্যাপার ছিল। চরকী কেটে কেটে পাহাড়ে ওঠার মনোরম আনন্দ আগে যেমন ছিল, নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানোটাও ছিল ভবিতব্যের হাতে। এখন সে বলাই নেই; কিছু পেতে হলে কিছু ছাড়তে হয় এ তো নীতি কথাই। বেশ কিছুক্ষণ কারোর মুখে কোনও কথা ছিল না। কিছুটা যেন নিস্তব্ধতা ভাঙবে বলেই দিতি জিজ্ঞাসা করল ‘নতুন গল্পের প্লট কিছু মাথায় এল?’
– না গো। সেই শেষের কবিতায় লাট খাচ্ছি এখনও।
– ওই একই বিষয় একটু মডিফাই করে লিখুন না।
– না গো। ওটা এমন আত্মস্থ হয়ে গেছে যে ওই ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো না। কপি হয়ে যাবে।
– তা কেন? আপনি আপনার মতো লিখবেন। বেসিক্যালি শেষের কবিতা একপ্রকার পরকীয়ারই গল্প।
– কী রকম?
– দেখুন কেটি অমিতের বাগদত্ত ছিল। ওদিকে শোভনলালও লাবণ্যের প্রতি প্রেম প্রকট করেই রেখেছিল। মাঝে শুধু পথ কখন বন্ধনহীন গাঁট বেঁধে দিল অমিত আর লাবণ্যের মনে, তখনই হল উপন্যাসের শুরু। আইনত বিয়ে হয়ে গেলেই অতিরিক্ত সম্পর্কগুলো পরকীয়া – বিষয়টা তো এমন নয়! নিদেন পক্ষে সাহিত্যের আঙ্গিকে তো নয়ই।
– বাঃ, ভালো বললে তো দিতি। পরকীয়াকে এভাবে কখনো ভাবিনি তো! তুমি তো চাইলে ভালো লেখিকা হতে পারো।
– তা হয়ে কাজ নেই নিকেত’দা। তবে পরকীয়া সংক্রান্ত এমন একটি বক্তব্য শ্রী বুদ্ধদেব গুহ'র কোনও একটা লেখায় পড়েছি।
– কোনটা বল তো?
– ওই যে ‘পরকীয়া হলো প্রেমের অতিরিক্ত টুকু।’ আপনিও পড়েছেন নিশ্চই।
– মনে করতে পারছি না এই মুহূর্তে। যা হোক অমিত লাবণ্য নিয়ে যা বলছিলে বলো।
– আপনি পারেনও নিকেত’দা। আমার মতো এক সামান্য মেয়ের কথা এত মনোযোগ দিয়ে আপনি শুনছেন, আমি ভাবতেও পারছি না।
– তুমি যে কী দারুন একটা গল্পের ঝিলিক দিয়ে গেলে দিতি, তুমি ভাবতেও পারবে না। আমার ভেতরে ভেতরে কেমন একটা প্রস্রবণ খুলে গেল। মনে হচ্ছে কেউ একটা আদল পেতে চাইছে এতদিন পরে।
– বেশ তো। লিখে ফেলুন।
– জানো দিতি, আদতে কিন্তু এটা তোমারই সন্তান, আমি শুধু গর্ভে নেবো। যদি প্রসব হয় তবে এর প্রথম পাঠের অধিকার তোমারই থাকবে ।
– আমি ধন্য হলাম নিকেত’দা, তবে এতখানি দাবি আমার নেই। আপনি কোথাও ছাপিয়ে আমায় পাঠাবেন তাতেই হবে ।
– ঠিক আছে এবার বল।
– কী বলবো?
– অমিত লাবণ্য প্রেম কথা।
– যাঃ। আপনি আমায় লজ্জায় ফেলছেন। তখন জা মনে হচ্ছিল বলছিলাম, এখন তো আর কিছুই পারবো না।
– বেশতো। ওভাবে না হয় নাই বললে।আমি বরং কিছু কিছু জিজ্ঞাসা করি, তুমি তার উত্তর দাও।তবে তোমার ভিউটা আমি বুঝতে পারবো ।
– আচ্ছা জিজ্ঞাসা করুন ।
– এই যেমন ধরো তোমার মতে অমিত লাবণ্য সম্পর্কটা প্রেমের অতিরিক্ত টুকু। তাহলে কি ধরে নিতে হবে অমিত ও কেটির মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল ?
– দেখুন নিকেত’দা, প্রেমের অতিরিক্তটুকু পরকীয়া – এটা আমার মত নয়। বরং আমার মনে হয় প্রেমের অতিরিক্ত বলে কিছু হয় না। প্রেম আকাশের মতো ব্যাপ্ত সীমাহীন।অসীমের আর অতিরিক্ত কী হয়! পরকীয়া অনেকের মতে হলো সমাজ স্বীকৃত সম্পর্কের বাইরের সম্পর্ক। এখন জীবন যাপনের ধারা বদলেছে। এখন মানুষজন বা লেখক সব সময় সমাজকে আগের মতো মেনে চলার দায়টুকুও স্বীকার করেন না। সুতরাং এখন পরকীয়াকে সংজ্ঞায়িত করা সাহিত্যের চোখে বড় মুশকিল।
– বেশ তো! কিন্তু অমিত কেটির মধ্যে কি প্রেম ছিল? তোমার কী মনে হয়?
– প্রেম তো ছিলই! ইউরোপে অমিত যখন কেটিকে আংটি পরিয়ে ছিল, সে কি তখন ওর রূপে গদগদ ছিল না?
– কিন্তু এটা তো রবি ঠাকুরের ওই কবিতার মতো – ‘আখিঁ মেলি যারে ভালো লাগে তাহারেই ভালো বলে জানি/ সব প্রেম প্রেম নয়, ছিল না তো সে সংশয়/ যে আমারে কাছে টানে তারে আছে টানি।’
– নিকেত’দা এটা তো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের গল্প, তাই না? আমরা কি প্রেম করার আগে বুঝি, ওটা সত্যি প্রেম কিনা? তখন তো হৃদয় দিয়ে এগোই, মাথা দিয়ে বিচার করে নয়। বুঝি কখন? যখন জীবনে তথাকথিত অতিরিক্ত কিছু আসে। তখন তুল্য মূল্য বিচার করতে বসি – প্রেমটা আসলে প্রেম ছিল কিনা!
– তাহলে অমিত যখন লাবণ্যকে দেখলো, ওর সাথে কথা বললো, তখন তো বুঝলো এ সেই নারী যাকে সে চায়। ওর মনের গঠন, ভাবনা চিন্তা – নিকেতন চক্রবর্তী মতো। তখন তো ওর বিয়ে হয়নি, ফলে ওকে বিয়ে করে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হত। জীবন তো একটাই। উপন্যাস হিসেবে হয়তো সিদ্ধান্তটা কালজয়ী হল, কিন্তু বাস্তব জীবনে আমরা কি ওই সেরাটুকুই আমার অধিকারে থাকবে – এটা চাই না? আমরা কি চাই না আমার মনের মিতাই আমার জীবন সঙ্গী হোক?
– আমি বুঝি নিকেত’দা, এসব প্রশ্ন আপনার কথা নয়। আপনি শুধুমাত্র আমার মুখ থেকে কথা বের করার জন্য এসব বলছেন।
– কেন মনে হচ্ছে তোমার?
– এসব তো আম মানুষের কথা। তারা সেরাটুকু অধিকার করতে চায় আপাত জেতার আনন্দে। অমিত তো সাধারণ মানুষ নয়, আপনিও নন । ফলে আপনারা অন্যরকম ভাববেন, সেটাই স্বাভাবিক। রবি ঠাকুরের একটা গান আছে না, ‘শেষ জয়ে যেন হয় সে বিজয়ী তোমারই কাছে তে হারিয়া...’
– বাঃ, খুব সুন্দর কোটেশনটা দিলে। একেবারে মোক্ষম জায়গায়। কিন্তু অমিতের চিন্তাটা আমার চিন্তার সাথে মিলবে – এমনটা কেন মনে হল তোমার?
– না হলে কি কেউ বইটা পড়ে বিনা বিচারে শিলং চলে আসে?
– কিন্তু তোমার কি মনে হয় না দিতি অমিত এক প্রকার নিজের ইচ্ছে মত সম্পর্কটা চালালো? ওর মনে হল ও লাবণ্যকে গ্রহণ করলো, আবার মনে করল ওকে ছাড়া দরকার – ছেড়ে দিল। একজন নারী হিসেবে তোমার মনে হয় না, লাবণ্যের চাওয়াটুকুকে মর্যাদা দেওয়ার দরকার ছিল? অন্তত ওর সাথে কথা বলার দরকার ছিল?
– এতে তো অমর্যাদা কিছু হয়নি নিকেত’দা। আমি বুঝতে পারছি আজ আপনি নিজেকে নিবারণ চক্রবর্তীর জায়গায় বসিয়েছেন। তার প্রতিটি কর্মকলাপ আপনি নিক্তি মেপে জরিপ করছেন – কতকটা যেন রবি ঠাকুরের দায় নিজের কাঁধে নিয়ে খোঁচাখুঁচির জায়গাগুলোতে পাবলিক সেন্টিমেন্টের নিরিখে নিজেকে রিলিফ দেওয়া বা টু সাম এক্সটেন্ট জাস্টিফাই করার চেষ্টা। আপনি নিজে বলুন তো লাবণ্যের সাথে এই নিয়ে আলোচনায় বসলে কী লাভ হতো? একটু সেন্টিমেন্টাল কথাবার্তা, কান্নাকাটি – আলটিমেটলি মায়া বলুন মোহ বলুন – তাই বাড়তো।
– লাবণ্য কি কান্নাকাটি করার মেয়ে?
– না তা নয়! তবে হয়তো অন্য অভিব্যক্তি হত। সে চুপ করে শুনে মেনে নিত। কিন্তু তার মন খারাপ নিশ্চিত হত। তার এই মন খারাপ হয়ত অমিত সইতে পারতো না, দুর্বল হয়ে পড়তো। এইরকম একটা গল্প পড়লাম মাস দুই আগে। আপনাদের পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত কোনও এক ম্যাগাজিনে।
– কী নাম ছিল বলতো গল্পের, বা তার নায়ক নায়িকার?
– গল্পটার নামে বোধহয় 'মেঘ নেই’। মেয়েটির নাম মনে আছে ‘চৈতি’। আসলে আমার ডাক নাম ও ‘চৈতি’ – সেই জন্যই মনে আছে।
– যাইহোক, বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি গল্পটির লেখক কিন্তু এই অধম।
– ও বাবা! কি দারুণ গল্প ছিল ওটা। ওখানে তো ছেলেটি লাষ্ট মুহূর্ত পর্যন্ত বোঝানোর চেষ্টা করল যে বিয়েটা আসলে সম্পর্ককে ফাঁকি দেওয়া। মেয়েটিও লাবণ্যের মতো কিচ্ছুটি মুখে বলল না। অথচ লাস্টে ছেলেটি ওই দিন রাতে চৈতিকে ফোন করে তার মত বদলের কথা জানালো।
– দ্যাখো দিতি, ওই ছেলেটির মানে ঋক কিন্তু অমিতের মতো দৃঢ় মনের হতে পারেনি। ও সাময়িক প্রাপ্তিটুকুর মোহকে জয় করতে পারল না ।
– সবাইকে সবকিছু পারতে হবে – তার কী মানে আছে নিকেত’দা। এই জন্যই তো সম্পর্কগুলো এত সুন্দর। এই জন্যই তো গল্পটা অন্যরকম হলো।
– এ তো তোমার দ্বিচারিতা হল দিতি। এখনই বললে অমিতের সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল, আবার ঋকের সিদ্ধান্তকেও অনাদর করলে না তুমি।
– দেখুন শেষের কবিতায় যদি একটাই সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে তবে সেটা অমিতের কেটিকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত।
– কেন?
– অমিত এক বিশাল মাপের কবি। সে এমনকি নিবারন চক্রবর্তীর কলমে রবিঠাকুরেরও ভুল ধরে। লাবণ্যের চোখের সে অসামান্য বিরাট মাপের এক পুরুষ। লাবণ্য তার প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভক্তিতে বিহ্বল। তুলনায় কেটির কাছে অমিত কেবলমাত্র উচ্চ শিক্ষিত এবং বিলাত ফেরৎ একজন পুরুষ। সে অমিতকে ভক্তি করেনা, ভগবান জ্ঞানে পুজোও করে না। সত্যিকারের দাম্পত্যটা তাদেরই জমবে ভালো। অমিত যখন করায়ত্ত হয়ে যাবে, দাম্পত্য কলহ করতে কোন পক্ষেরই বাধবে না।
– কলহটা বুঝি দাম্পত্যের জরুরি অঙ্গ?
– তা নয়। তবে সম্পর্ক তলানিতে এসে ঠেকলে যদি নিদেন পক্ষে কলহ করার মতো অবসরও না থাকে তবে সে দাম্পত্য টেকে না।
– অমিতের দাম্পত্য কলহ করতে রুচিতে বাধবে না?
– লাবণ্য হলে বাধতো; কেটিতে বাধবে না। কেটি তো তার কাছে নারী মাত্র, দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য ঘড়ায় তোলা জল। বরঞ্চ তেমন তেমন মন খারাপের দিনে লাবণ্যের কথা ভেবে ও কিছুটা বাঁচার রসদ পাবে, লেখার রসদ পাবে। লাবণ্যকে আপাত না পাওয়াটাই ওর জীবনে মস্ত পাওয়া হয়ে যাবে।
– এটা কি স্ত্রী জাতির প্রতি অবমাননা হল না?
– স্ত্রী জাতি বলেছেন কেন? স্বামী বা স্ত্রী উভয়ের জন্যই 'ঘড়ায় তোলা জল' উপমাটি ব্যবহার করা যেতে পারে। দৈনন্দিন সংসারকে কবিতার জগৎ বানিয়ে রাখাটা চাট্টিখানি কথা নয়।
– লাবণ্যের মতো মেয়ে কি পারতো না এমন জগৎ কে আজীবন বাঁচিয়ে রাখতে?
– লাবণ্য হয়তো পারতো। কিন্তু সমস্যাটা অমিতেরই হতো। ও দৈনন্দিন ব্যবহৃত লাবণ্যকে মানতে পারতো না। সেই জন্যই দেখুন সিদ্ধান্তটা ও নিয়েছে, লাবণ্য নয় ।
– আচ্ছা দিতি, শোভনলালের সাথে লাবণ্য কি সুখী হবে?
– দেখুন নিকেত’দা, মেয়েরা তাদের থেকে উঁচু স্তরের মানুষকে স্বামী হিসেবে পছন্দ করে। কিন্তু লাবণ্য যখন দেখলো অমিত একটা সময় কেটিকে ভালোবাসতো, তখন সে-ই কিন্তু অমিতকে উদ্বুদ্ধ করল কেটির কাছে ফিরে যেতে। সে একফাঁকে শিলং ছেড়ে চলেও গেল যাতে অমিতের সিদ্ধান্তটা নিতে সুবিধা হয়। এটা অনেকটা সেই শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্তের সংলাপটার মতো। ‘বড় প্রেম শুধু কাছে টানে না, দূরেও ঠেলে দেয়।’ আর একটা কথা, শোভনলাল কিন্তু লাবণ্যের গুণমুগ্ধ। এরকম ভক্ত প্রেমিক স্বামী হলে মেয়েদেরই সুবিধা।
– হ্যাঁ দিতি, মুরগী যে হয়েই আছে তাকে আর মুরগী বানিয়ে নিতে হয় না।
– এটা একেবারেই 'অনিকেতীয়' হল। হাসল দিতি।
– শেষে লাবণ্য কিন্তু এরকমই একটা ইঙ্গিত দিয়েছে দিতি। ‘মোর লাগি করিয়ো না শোক/ আমার রয়েছে কর্ম, আমার রয়েছে বিশ্ব লোক। মোর পাত্র রিক্ত হয় নাই/ শূন্যেরে করিব পূর্ণ এই ব্রত বহিব সদাই।/ উৎকণ্ঠ আমার লাগি কেহ যদি প্রতীক্ষিয়া থাকে/ সেই ধন্য করিবে আমাকে।'
– তো?
– সে কিন্তু শোভনলালের প্রতীক্ষাময় উৎকণ্ঠাকে সম্মান দিতেই চায়। পরের লাইনে বলেছে না ‘এবার পুজোয় তারি আপনারে দিতে চাই বলি....?
আমি অন্যমনস্ক ভাবে ‘হুঁ’ বললাম। গাড়ী গুয়াহাটি শহরে ঢুকে গেছে অনেকক্ষণ।
– নিকেত’দা ড্রাইভারকে এবার বলুন সামনের রাস্তা দিয়ে ডান দিকে টার্ন নিতে। ও আমার বাড়ীতে নামিয়ে চলে যাক। বিকেলে সাড়ে চারটা পাঁচটায় আমি আপনাকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে আসবো।
গুয়াহাটির একেবারে অভিজাত জায়গার দিতিদের বাড়ী। বেশ বড়সড় অনেকখানি জায়গা জুড়ে। সামনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে কেয়ারি বাগান। নানান শীতকালীন ফুল। মেয়েটির রুচির সত্যিকারের প্রশংসা না করে উপায় নেই। নেমেই ও আমাকে জোর করে দু হাজার টাকার একটা নোট গুঁজে দিতে চাইলো। অনেক চেষ্টায় তাকে বিরত করতে সক্ষম হলাম। ডাল ভাত ডিম সেদ্ধ খেয়ে উঠলাম যখন তখন প্রায় সওয়া তিনটে। দিতি বলল, 'চলুন একটু রেস্ট নিন। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই বেরোতে হবে।'
– বেকার তোমার কষ্ট দেওয়া হলো শুধু।
– তার আপনি কী বুঝবেন! বরং কথা দিন এমন কষ্ট যেন আমি মাঝে মাঝে পেতে পারি। আপনি তো ঝাড়া হাত পা। যখনই মনে হবে আমার কথা, তখনই চলে আসবেন।
– জিজ্ঞাসা করতে সংকোচ হয়, তবু না করেও উপায় নেই – তুমিও কি ঝাড়া হাত পা?
– একপ্রকার।
– শিলং কেন গিয়েছিলে বলবে বলেছিলে, বললে না তো!
– নাই বা শুনলেন। ঘণ্টাখানেক আগেও একথা শোনা আপনার জন্য সহজ হত। এখন একটুখানি গুরুপাক হয়ে যাবে। বিষন্ন লাগলো দিতির গলা ।
আমি বললাম, 'থাক তাহলে।'
একটুক্ষণ চুপ থেকে দিতি বলল ‘না নিকেত’দা আপনি শুনুন।’
– থাক না দিতি। ব্যক্তিগত বিষয়ে আর আমাকে জড়িও না।
– আমার মনে হয় ঠিক এখনই বিষয়টা আর ব্যক্তিগত নেই। আমি বুঝতে পারছি আপনার সাথে আমার মনের তারটা ঠিক কোথায় যেন একই কম্পাঙ্কে বাজছে। আপনার শোনাটা দরকার। শুনেও যদি মনে করেন যোগাযোগ রাখা যাবে, তবেই রাখবেন। নইলে আমি কেবল আপনার গুণমুগ্ধ পাঠিকা হয়েই থেকে যাব।
– থাক না দিতি এই দেখাটা একট সুখস্মৃতি হয়ে!
– অলীক সুখস্মৃতি রেখে লাভ কি নিকেত’দা ।
– বেশ। বলো। কবে গিয়েছিলে শিলং ?
– গতকাল।
– মাত্র? আজই চলে এলে?
– সেটাই তো শোনাতে চাই নিকেত’দা। একটুক্ষণ চুপ করে রইল দিতি। তারপর বলল, ‘জানেন তো নিকেত’দা – কবি সাহিত্যিকদের উপর আমার বরাবরের দুর্বলতা। আমি যখন নাইন টেনে পড়তাম তখন থেকে একজনকে ভালবাসতাম। নাম রাকেশ বরদলুই। অসমীয়া। খুব ভালো লিখতো। ও তখন বি.এস.সি পড়ে। ওইটুকু বয়সে পত্র পত্রিকায় লেখা বের হতো ওর।
– কীভাবে আলাপ?
– সেও ধরুন সেই চেনা গল্পের ঢঙ! বান্ধবীর দাদা।
– কী আর করবে? চেনা ঢঙে পড়ে যাবে বলে বান্ধবীর দাদাকে রিজেক্ট করে দেবে – তা কী করে হয় ? অল্প হাসলাম আমি। দিতি এই হাসির ধার মাড়ালো না। খুব সিরিয়াস মুডেই বলতে লাগলো ‘আসলে এই ভালো লাগাটা প্রাথমিকভাবে ছিল আমারই। একটা শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালবাসা – সব মিলে সে এক অনির্বচনীয় ব্যাপার। যখন রাকেশদা ব্যাপারটা বোঝে, তখন ও এম.এস.সি পাস করে গেছে; আমিও টুয়েলভ পার করে বি.এস.সিতে ঢুকেছি। টুকটাক গল্প, বেড়াতে যাওয়া – গল্প সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে করতে ও চাকরী পেয়ে গেল জিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ায়। বছর দেড় দুই এর মধ্যে ওর বিয়েও হয়ে গেল এক হিন্দিভাষী মেয়ের সাথে।
– কেন? তোমার কথা ভাবা হল না কেন?
– দেখুন নিকেত’দা, আমি পড়াশোনায় বেশ ভালোই ছিলাম। আমার বাবা-মা বা রাকেশ’দা এর বাবা মা –আমাদের রিলেশনটা অনুমান করতেন। কিন্তু এটাকে কোনও পক্ষই আমল দেওয়ার কথা মনে করেননি। রাকেশ’দাও আদৌ বোঝাবার কোনও চেষ্টা করেছিল বলে মনে হয় না।
– সম্বন্ধ করে যে বিয়ে নয় – সেটা তো হিন্দিভাষী মেয়ের সাথে বিয়ে হওয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
– আমারও তাই মনে হয়েছিল। তবে রাকেশ’দা বা আমার বান্ধবী সে কথা স্বীকার করেনি। মেট্রিমোনিয়াল সাইট দেখে নাকি সম্বন্ধ হয়েছিল।
– স্ট্রেইঞ্জ! যাইহোক, তারপর?
– শিলংএ একটা জিও-ফিজিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট আছে দেখেছেন কি? গতকাল সেখানে এক সেমিনার উপলক্ষে রাকেশ’দা এসেছিল। আমিও এসেছিলাম এই সুযোগে ওর সাথে দেখা করতে।
– মানে? বিয়ের পর ওর সাথে তোমার যোগাযোগ ছিল?
– কি ভাবছেন, পরকীয়া?
– ব্যাপারটা তো সেরকমই। একজন বিবাহিত পুরুষের সাথে তুমি লুকিয়ে দেখা করতে যাচ্ছো যখন, একে পরকীয়া ছাড়া কীই বা বলা যাবে?
– সে যাই সংজ্ঞা দেবেন, দিন। জিজ্ঞাসা করছিলেন না ওর সাথে আমার যোগাযোগ ছিল কিনা? বিয়ের পর পাঁচ-ছ বছর ছিল না। লাস্ট দেড় দু বছর ফোনে আবার যোগাযোগ শুরু হয়েছে।
– কারণ?
– কারণ কিছু না। খাঁচা থেকে পোষা পাখিকে ছেড়ে দিলে দু চারবার ডানা ঝাপটিয়ে ওড়বার চেষ্টা করে। এটাও সেরকম প্রয়াস।
– খাঁচা খুলল কেন?
– ডিটেলস জানি না। শুনি নাকি ওদের সেপারেশনের মামলা চলছে। অতএব পুরনো স্মৃতিকে একবার উসকে দেবার চেষ্টা করা – এই আর কী।
– উস্কালো?
– জানেন তো নিকেত’দা, খুব উত্তেজনা ছিল। এতদিন বাদে আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষের সাথে মিলব! প্ল্যান করে একসাথে শিলং গেলাম। ওদের ইনস্টিটিউটের তরফ থেকে দেওয়া হোটেল ক্যানসেল করে ও নিজের নামে আলাদা ঘর বুক করে নিল।
– তাহলে আজকে চলে এলে যে? তোমার আসা দেখে মনে হচ্ছে একেবারে আনপ্ল্যানড।
– জানেন তো নিকেত’দা – যখন ওর সাথে আমার সত্যিকারের সম্পর্ক ছিল তখন আমি ওকে একদিনের জন্যও ছুঁয়ে দেখিনি। ও কখনো আমার হাত ধরেছে বলে আমার তো মনেই পড়ে না। অথচ কালকে হোটেলের চেক ইন করা মাত্র ও আমাকে জড়িয়ে ধরল। এবং কী আশ্চর্য আমিও কোনও বাধা দিলাম না। যেন এই ব্যাপারটা আমাদের কতদিনের অভ্যাস।
– এভাবে না ভেবে বহুদিন আকাঙ্ক্ষিত বলেও তো ভাবতে পারো?
– না নিকেত’দা। আসলে বিবাহিত মানুষেরা এসব বিষয় দ্রুত পা ফেলে। অভ্যস্ত কিনা!
– তাতে সমস্যাটা কোথায়?
– ঠিক বোঝাতে পারবো না নিকেত’দা। আমার মনে হল আমাদের তারটা কোথাও কেটে গেছে। যা করলাম শুধু দেহের অভ্যেস।
– মানে? তোমার আবার অভ্যেস কিসের?
– আমি বিবাহিতা।
– কোন চিহ্ন নেই তো! নাকি মানো না?
– মানতাম না তা নয়। তবে আমি আমার হাজবেন্ডের সাথে থাকি না। ডিভোর্স টিভোর্স যদিও হয়নি।
– কেন? কী করেন উনি?
– আমার বর পেশায় একজন ডাক্তার। নিকেত’দা কোনওদিনই আমার সাথে তাঁর বনতো না। দুজনে আলাদা মনের মানুষ। উনি ওঁর পেশা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। সাহিত্যের বিষয়ে ওঁর কোনও আগ্রহ ছিল না। শুধু অনাগ্রহে হয়তো সমস্যা হত না। উনি আমার এই ভালোলাগাটাকে উপহাস করতেন। ধীরে ধীরে তিনি হাসপাতালের এক নার্স এর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েন। শুনি নাকি এখন তিনি উনার সাথেই থাকেন।
– কোথায়?
– ওই তেজপুর পার করে ওদিকটায়। প্রায় অরুনাচলের বর্ডারে।
– ডিভোর্সটা করে নিলে না কেন?
– কী হবে নিকেত’দা? বাঁধনটা আইনি বইতো নয়।
– তাই বা থাকবে কেন? কোনওদিন সেই দাবী নিয়ে তো উনি দাঁড়াতে পারেন।
– সেই সাহস নেই। নিজের কৃত কর্মের জন্য এমনি মরমে মরে থাকেন। যাই হোক মানুষটা খুব খারাপ না।
– তোমার ভবিষ্যতের প্ল্যান?
– জানিনা নিকেত’দা। ভেবেছিলাম রাকেশ’দার সাথে হয়তো সামনের পথটা চলা যাবে; কিন্তু কালকে মনে হলো অসম্ভব।
– তুমি কি বলে এসেছো?
– না। ও সেমিনারে বেরিয়ে গেল। তার পিছু পিছু আমি বেরিয়ে এসেছি। একটা চিঠি রেখে এসেছি।
– রাকেশ কি এখনও লেখালেখি করে?
– না। একেবারে বুজে যাওয়া পুকুর।
চুপ করে রইলাম কিছুক্ষণ। দিতি বলল, ‘মেঘে ঢাকা তারা দেখেছেন?’
ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম।
– ওখানে লাস্ট সিনে নীতা চিৎকার করে বলছিল না ‘দাদা আমি বাঁচতে চাই। জানেন ওটা শিলং পাহাড়ে তোলা?’
– জানতাম না।
– আমিও তো বাঁচতেই গিয়েছিলাম নিকেত’দা। কিন্তু নীতার মত আমারও সম্পর্কের মৃত্যু হল শিলং-এ গিয়েই। রাকেশ’দা অমিত হতে পারল না, বা আমিও লাবণ্য হতে পারলাম না। অথচ আমাদেরও তো বিয়ে নামক অনুষ্ঠানটা সম্পর্কের মাঝে দাঁড়ায়নি।
বলতে ইচ্ছে করছিল না, তবুও বললাম ‘চারটে বাজে দিতি। এবার তো আমায় যেতে দিতে হবে!’
– ডাইভার কে বলে দিয়েছি নিকেত’দা। ও এলেই বেরিয়ে যাবো।
একটু পরে কলিংবেল বাজলো। দিতি বলল, ‘নিশ্চই ড্রাইভার এসে গেছে। আপনি ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে নিন।’ বলেই ধীর পদক্ষেপে দরজার দিকে উঠে গেল দিতি। খুবই শান্ত অথচ দৃঢ়। বড় লাবণ্যময় লাগছে এখন ওকে। দিতি। দিতিপ্রিয়া ব্যানার্জি। আচ্ছা দিতিপ্রিয়া মানে কী? দিতি তো কাশ্যপ মুনির স্ত্রী। অন্য কোনও অর্থ তো নেই! দিতিপ্রিয়ার অর্থ তবে কি, যে দিতি প্রিয়া স্বরূপ? এমন সাহিত্যানুরাগী মেয়ের এমন গোঁজামিল দেওয়া নাম কে রেখেছিলেন কে জানে। এমন অর্থহীন এক নাম, অভীষ্টহীন জীবনের সাথে তাকে বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন।
0 Comments