কমলিকা ভট্টাচার্য
কাঁচের পালক
বড় গোপন তার চলাফেরা
নৈশব্দ্যের ঘোড়ায় চড়ে সে আসে।
নেই বাঁশির সুর, নেই ঢাকের ডাক,
তবু অনামন্ত্রিত অতিথির মতো বসে পড়ে পাশে।
ঘুমপাড়ানি গানও চেনে না ওকে,
দরজায় কড়া নাড়ে না কখনো
চোখের পাতায় হঠাৎ নেমে আসে যেন
অজানা এক ধুলো ঝড়ের মত।
‘নিরাপদ’ শব্দটা এখন একটা বুড়ো ছাতা,
যার ছিদ্র দিয়ে চুঁইয়ে পড়ে আতঙ্ক।
আপদে কুয়ো, বিপদে জলাশয়,
চারপাশ যেন শব্দহীন ষড়যন্ত্র।
তাই শিখে নিই আজ প্রতিটি মুহূর্তে বাঁচতে,
প্রাণটা যে কাঁচের পাখির পালক
ভেঙে যাওয়ার আগে উড়ে যাক বারবার!
মৃত্যুকে বলে দেব আসিস খনে একবার!
ডাকটিকিট
আজ আকাশ খুলল ঠিক আমার চোখের মতো
সহ্যরেখা পেরিয়ে ছুটে এলো এক তরল আর্তি।
বৃষ্টির নয়, এ যেন আত্মসমর্পণের শব্দ
হৃদয় থেকে খসে পড়া নীল বিন্দু।
আমার জানালায় ভিজল একরাশ অপেক্ষা,
আর বারান্দার কার্নিশে জমে উঠল
তোমার বলা না-বলা কথার জলচিহ্ন।
দরজার ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছিল যে প্রেম,
সে আজ পায়ে পায়ে এল বুকের ঘরে।
এই প্রথম বর্ষা,
তোমাকে চাই ছিলাম খুব
বৃষ্টির ঝাঁটে ভেজা চুলের ডগা থেকে
ঝরে পড়ছিল আমার আবেগ
টিপটিপ টিপ টিপ
তৈরী হচ্ছিল
একটা জলের নোটেশন
বৃষ্টির গান হাওয়ার সুরে।
আজকের এই বৃষ্টি
একটা অদৃশ্য ডাকটিকিট,
যার ঠিকানায় শুধু তুমি —
আর প্রেরকের নাম?
একটা নীরবতা,
যার প্রতিটা অক্ষর আমার।
🍂
আকাঙ্খা
কেউ আসবার নয় — জানি খুব ভালো,
তবু প্রতীক্ষায়,যদি কেউ আসে,
যেমন করে ফুটো গলে আসে আলো।
কেউ কিছু বলেনি — তবুও শুনি,
চেনা নামের ডাক,যেমন করে শব্দ বাজে ,গলে পাতার ফাঁক।
কেউ নেই — তবু দেখি ছায়া ছবি,
প্রতিটি ঘরে জমে ওঠে না-ফেরা চিহ্ন,তবু কেউ যদি আঁকে মনের জলে প্রতিচ্ছবি অভিন্ন।
অনুভূতির চোরাগলি
তোমার সকালের চুম্বন
আমার দিনলিপির প্রথম শব্দ,
যেখান থেকে সূর্য ওঠে,
অথবা নেমে যায় নিঃশব্দ অতীতের পাঁকে।
আমার বর্তমান
একটা চৌকাঠের রেখা,
যেখানে সময় দাঁড়িয়ে ছবি আঁকে,
কখনও সোজা রেখা
যেমন এক নিশ্বাসে লেখা নাম,
আবার কখনও টালমাটাল,
যেন প্রেমের অসুস্থ ই.সিজি রিপোর্ট।
অনুভূতিগুলো কি পুরোনো হয়?
জিজ্ঞাসা করি রাধার চোখে জমে থাকা নীল জলকে
সে বলে,
বিরহ কখনও মরেনা,
শুধু নতুন শরীর খোঁজে কাঁদবার জন্য?
শত বছর পরে
কখনও যদি কোনো যান্ত্রিক মন
কোড করে অনুভবের অণু,
তবে কি সেই সফটওয়্যার কাঁদবে
একটি ভোরের চুম্বনের জন্য?
কবিতা তখন থাকবে তো?
হয়তো থাকবে ধূলিধুসর কোনও চিপে,
বা কোনও গ্রহান্তরের পাঠশালায়
একটা বাচ্চা পড়বে,
"তোমার অভাব আজও বিষণ্ণ করে আমাকে"।
কিন্তু আমার তাতে হাহাকার নেই।
আমি বিশ্বাস করি—
একটা অক্ষরও যদি হৃদয়ে ঢেউ তোলে,
সে থাকবে, কাগজ না থাকলেও,
ডাটাবেস ভেঙে গেলেও
একটা মন যদি তা অনুভব করে,
তবে কবিতা বাঁচে।
আমার কবিতা শুধু কবিতা নয়,
সে একটা নড়াচড়া করা ছায়া
যে অনুভূতিরা মরে না,
শুধু জন্ম নেয় নিত্য
নতুন বর্ণমালায়।
দায়সারা প্রেম
দায়সারা অনুভবের কাঁধে যখন নামিয়ে দিলে আমায়,
আমি খুঁজেছি এক কণায় লুকোনো গোটা ব্রহ্মাণ্ড
সেই কণায়, যেখানে প্রেম গড়ে তোলে মহাশূন্যের মানচিত্র।
আমি চেয়েছিলাম
তারা ছাওয়া এক আকাশ,
তুমি দিলে,
বারো বাই দশের ছাদ,
যেখানে বাতাসও আসে অনুমতিসাপেক্ষে,
অরণ্যের অক্সিজেন চাহিদা সেখানে হাঁফায়
সিলিন্ডারের নলের শেষে।
ঝর্ণার পাশে দাঁড়িয়ে মুখ পেতেছি,
জলের আশায়
তুলোর মতো নিকড়ানো মেকি সান্ত্বনা
ঠোঁট ছুঁয়েছে, তৃষ্ণা মেটেনি।
তবু
আমি কোনোদিন কুনকে ভরে চাল রাঁধিনি,
মুখচাপা হাসিতে চালাকি ছিল না আমার স্বভাব।
যা ছিল, তা ছিল পেঁয়াজ কাটার অজুহাতে
আড়ালে লুকোনো অনেক কান্না।
নিঃশব্দে জলে গলে যাওয়া ক্ষত।
তোমার পাঠানো ইমোজির সারি
একেকটা চিহ্ন যেন
বাতিল হয়ে যাওয়া অনুভবের অক্ষর।
আমার কথা গুলো এলোমেলো নয়,
ওরা নিঃশব্দ প্রতিবাদের ভাষা,
যে ভাষায় প্রেম আর লোক দেখানো থাকেনা পাশাপাশি।
আমি কখনোই পারিনি
প্রেম করতে
মঞ্চস্থ কোনো দৃশ্যের মতো।
কবিতার ভবিষ্যৎ
একদিন
কোডিং শেখানো হবে অনুভূতিকে
অভিমানের অ্যালগরিদম,
বিরহের ফায়ারওয়াল,
মুক্তি চাওয়া ভালোবাসার ব্লু-প্রিন্ট।
তখন কবিতা লেখা হবে
মস্তিষ্কের পেছনের চিপে বসানো
একটি আয়নার ভেতর
যেখানে চোখের জল হবে কৃত্রিম,
তার স্রোত পাবে না চেতনার গভীরতা।
তোমার সকালের আদর তখন
ডিজিটাল ‘মেমোরি’ হিসেবে সংরক্ষিত হবে,
কিন্তু তার গন্ধ?
সে তো কেবল শরীর জানে,
ডিভাইস নয়।
আমার লেখা তখন পড়বে
একটি যান্ত্রিক চোখ,
যার কর্নিয়ায় প্রতিফলিত হবে না
কোনও চাঁদের আলোর স্পর্শ,
শুধু ডেটা-সনাক্ত ধূসর বিশ্লেষণ।
রাধার কান্না তখন
হয়তো ফসিল হয়ে থাকবে কোনও ডিএনএর কোণে,
কিন্তু কে বোঝাবে
সে জল ছিল ঘন সুনীল অনুভূতি
না শুধু H2O?
আজ আমি লিখি,
মাটির কালি, আঙুলের আঁচড়ে,
চন্দনের মত গন্ধ থাকে এই হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিতে—
যা সময় ছিঁড়ে ফেলে দেবে একদিন।
তবু আমি জানি
যতক্ষণ কোনও হৃদয়
ভাঙে নিঃশব্দে,
যতক্ষণ ঘুমভাঙা সকালের জানালায়
কারও নিঃশ্বাস পড়ে
0 Comments