ছিন্নপাশ
পুলককান্তি কর
– আপনার একটা ক্যুরিয়ার কাল বিকেলে এসেছিল অরুণদা। এই নিন।
– এসো মিতালী। বসো। কাল কখন এসেছিল?
– এই সাড়ে চারটা নাগাদ। আপনি চেয়ারে ছিলেন না।
– না। আমি কাল একটু বেরিয়েছিলাম। পার্সোন্যাল কাজ ছিল একটা। আরে দাঁড়িয়ে কেন? বসো না! তোমার সাথে তো তেমন আলাপই হয়নি। কিছু মনে ক'রো না – তুমি বলে বলছি বলে। একটু হাসলো অরুণ। এবার পুর্ন চোখে ভালো করে দেখল মিতালিকে। বছর দেড়েক হ'ল ওদের অফিসে জয়েন করেছে মেয়েটি। প্রথম দিন আলাপ করে গিয়েছিল বটে, তবে অন্য ঘরে বসে বলে তেমন ঘনিষ্ঠতা হয় নি। মাঝে মাঝে বায়োমেট্রিতে ছাপ দিতে গিয়ে দেখা হয়, আলতো হাসি বিনিময় ছাড়া বিশেষ আলাপচারিতা কিছু হয়নি। বেশ ফর্সা গায়ের রঙ মেয়েটির। লম্বা, সুন্দর মুখশ্রী। এক ঢাল বাদামী চুল, বোধহয় রঙ করে। নিজের যত্ন নেয় খুব, দেখলেই বোঝা যায়। হালকা কাজল, ছোট একটা টিপ– গাঢ় নীল রঙের পালাজোঁর ওপর অল্প চিকনের কাজ করা সাদা কুর্ত্তি– দেখলে একেবারেই সবার ভালো লেগে যাবে। অনেকটা বাদামী চুল 'বনলতা সেন' টাইপ। চেয়ার ছেড়ে উঠে উল্টো দিকের একটা চেয়ার অল্প করে টেনে বললো 'আরে বসোই না। চা খাবে?'
– তা খেতে পারি।
– এখানে কানাইদা’র চা খাবে নাকি নীচের ক্যান্টিনে যাবে?
– ডাকুন না কানাইদা কে। এখানেই খাই। আমার টেবিলে অনেকগুলো ফাইল পড়ে আছে। উঠতে হবে।
– চা খাবে না কফি? কানাইদা'র কফিটা তুলনায় ভদ্র গোছের।
– কফি বলুন।
কানাই দা কে মিসড কল মারলেই ও বুঝে যায় কফি বা চায়ের অর্ডার। ওদের অফিসে এটাই দস্ত্তর। ওকে মিসড কল মেরে নিছক আলাপ চারিতার জন্য অরুণ বললো 'কলকাতায় থাকো কোথায়’?
– এইতো, শ্যামবাজারে একটা পি.জি তে।
– পি.জি মানে?
– পেয়িং গেস্ট।
– ওঃ আচ্ছা। আমি তো পি.জি বলতে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট নইলে হাসপাতাল বুঝি। আজকাল সবই শর্ট ফর্ম। সবকিছুতে আপ-টু-ডেট না থাকলে বড় মুশকিল । ভাগ্যিস তুমি পি.জি তে থাকো। নইলে কী জানি কার কাছে এই অজ্ঞতার জন্য অপদস্থ হতে হতো! মজা করলো অরুণ।
মিষ্টি হেসে মিতালি বলল 'এই অজ্ঞতায় দোষ নেই। এটা কি 'নাসা' র অ্যাব্রিভিয়েশন?
বলতে বলতে দুটো ফ্লাষ্কে চা ও কফি নিয়ে হাজির হল কানাই দা। ওর কাছে শুধু ব্ল্যাক কফিই থাকে। মিতালি নাকি ব্ল্যাক কফি পছন্দ করে না একেবারেই। তাই ও চা নিল।
– আমাকেও চা দাও। এক যাত্রায় পৃথক ফল করি কেন?
– না, না। কিছু হবে না– আপনি কফি খান। যাত্রা আমাদের ভিন্নই। সুতরাং ফল ভিন্ন হলে কিছু হবে না।
বাঃ। মেয়েটা বেশ উইটি তো। অরুণও মজা করলো 'অফিস যখন এক, যাত্রাপথও তো এক। পথ ভিন্ন ভাবছ কেন’?
– কানাইদা তুমি কফিই দাও দাদাকে। জোর করল মিতালি।
অরুণ বললো- তোমার বাড়ী কোথায়?
– আসানসোল।
– প্রতি সপ্তাহে বাড়ী যাও নাকি?
– না, না। দুই বা তিন সপ্তাহে একবার যাই।
– এই শনিবার কি কলকাতার ভাগ্যে শিকে খুলবে না কি আসানসোল?
– এই শনিবার আমি কলকাতায়।
– বিকেলে কী করবে? ফিল্ম দেখবে আমার সাথে?
– কী ফিল্ম?
– 'জাঙ্গল বুক'।
– দেখলেই হয়! কোথায় দেখবেন?
– এই তো স্টার এ চলছে। তোমার পি.জি থেকে কাছেই হবে।
🍂
লোকটা বেশ স্মার্ট তো। প্রথম আলাপেই সিনেমার প্রস্তাব। কিছুটা অবাক হল মিতালি। হঠাৎ নিজের প্রতি একটা ধিক্কার জান্মালো তার। কী হ'ল তার নিজের? সে রাজী হয়ে গেল কেন সিনেমা যেতে, এই অল্প আলাপে? কোনও বাহানা দিয়ে এড়িয়ে গেলেই তো পারতো। লোকটার কথায় কি জাদু আছে? এমনি দেখতে তো স্মার্টই। পাতলা দোহারা চেহারা, চোখে পাতলা ফ্রেমলেস চশমা। মুখের মধ্যে দাঁতগুলো খুব উজ্জ্বল, আর চোখে পড়ে প্রথমেই। কথাবার্তা খুব মার্জিত এবং বুদ্ধিদীপ্ত ঠিকই, তবে তার সাথে সিনেমা দেখতে যাওয়াটা কি বাড়াবাড়ি নয়? ওদের মহিলা সহকর্মীরা তো বলাবলি করছিল, এর বউ নাকি সাথে থাকে না। মনটা একটু ভারী হয়ে গেল তার– কী বলে এখন কাটাবে সে, এই ভেবে। হঠাৎ চমক ভাবল অরুণের কথায়–
– কী ভাবছ? আমার সাথে সিনেমায় যাওয়া ঠিক হচ্ছে কিনা?
বাব্বা। এই লোকটা মনও পড়তে পারে নাকি? হঠাৎ অপ্রতিভতাকে ম্যানেজ করতে গিয়ে মিতালি বলে উঠল– 'না না, সেরকম কোনও ব্যাপার নয়। আমার ও ধরনের বায়াসনেস নেই।'
– 'তাহলে তোমার মোবাইল নম্বরটা রেখে যাও। কোনও কারণে দরকার হলে, কাজে লাগবে।' এই বলে অরুণ তার নিজের একটা ভিজিটিং কার্ড দিয়ে দিল। বলল 'তোমারটা বল, সেভ করে নিই'।
মিতালি নম্বরটা দিয়েই উঠে পড়ল চেয়ার থেকে। বলল 'ঠিক আছে অরুণদা, আজ অনেক কাজ জমে আছে।'
– আচ্ছা। শনিবার সাড়ে চারটে কিন্তু। অবশ্য কোনও কারণে টিকিট না পেলে জানিয়ে দেব।
মনটা খচখচ করতেই লাগলো মিতালির। জানা নেই শোনা নেই, একেবারে সিনেমা। লোকটারও আক্কেল নেই। সদ্য পরিচিতা যুবতীকে এমন প্রস্তাব দেওয়া যায় না, এই জ্ঞানটুকু নেই? প্লে বয় নাকি? এই ফোন নম্বর নিল, যখন তখন ঘ্যানর ঘ্যানর করবে নির্ঘাত। নিজের প্রতি বিরক্তিতে কোনও কাজে মন লাগল না তার। পি.জি তে ফিরেও স্বস্তি পেল না সে। একবার ভাবল যদি ফোন করে, কোনও একটা বাহানা বানিয়ে যাবে না সে। আচ্ছা, শনিবার না গেলেও তো হয়। না, না। ও ভারি বাজে ব্যাপার হবে। অ্যাটলিস্ট না যেতে পারলে ফোন করাটা তো উচিৎ। এই মোবাইল হয়েই যত জ্বালা। আগেকার দিন হলে এই ক্ষণে ক্ষণে জানাবার বা ভদ্রতা করবার নাটকটুকু করতে হ'ত না। যাই হোক, তার মন বলছে খেজুরে আলাপের জন্য ফোন এই এলো বলে। অথচ তার চিন্তাকে ব্যঙ্গ করে সেদিন ফোন এল না, পরের দিনও এলো না – এমনকি শনিবারও – 'কী গো যাচ্ছ তো?' মার্কা ফোনও এলো না। অগত্যা সেজেগুজে চারটে নাগাদ সে পৌঁছে গেল স্টার এর সামনে। গিয়ে দেখল উল্টোদিকে অরুণ সিগারেট খাচ্ছে। ওকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে এসে বলল, 'বা, বা, বিফোর টাইম। চল চা খাই।' চা খাওয়ার একটা বাসনা তারও হচ্ছিল, বলল 'চলুন'।
যথাসময়ে 'শো' শুরু হল। সে যেমনটা ভেবেছিল তেমনটা হল না কিছুই। যথেষ্ট সংযত হয়ে বসেছিল অরুণ। চেয়ারের কমন হাতলটায় একবারও হাত রাখেনি পাছে অসতর্কতায়ও ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে যায়। অকারণ গায়ে পড়া কথা নেই। ফিল্মটাও অসাধারণ। শো শেষ হতে অরুণ বলল, 'ডিনারটা একসাথে করলে হয় না? তোমার পি.জি তে ফোন করে দ্যাখো না। এর উপরেই ভালো ভালো রেস্টুরেন্ট আছে।’
– তা আছে জানি। খেয়েছিও আগে এখানে। কিন্তু আজ থাক অরুনদা।
– কেন? প্রথম আলাপেই সিনেমা দেখা আর সেদিনেই ডিনার – বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে বলছ?
কী বলবে মিতালি এ কথার জবাবে? মিষ্টি হেসে বলল, 'সব একদিনে করলে হবে? আগামী দিনের জন্যও তো কিছু রাখতে হবে।?
– বাঃ। এটা আমার সাফল্য বলো! এর পরেও আগামী দিনের জন্য গল্প তুলে রাখছো তুমি – এটা আমাকে বেশ আশার আলো দেখালো।
– কীসের আশা? কপট গাম্ভীর্য ঝরে পড়লো মিতালির গলায়।
– না না। বেশী আশা কিছু নয়। 'দিল হ্যায় ছোটা সা, ছোটি সি আশা'।
– সেই ছোট আশাটা কি জানতে পারি?
– পারো, তবে ক্রমশ প্রকাশ্য। নাও তোমার পি.জি মালকিনকে ফোন করো।
– মালকিন নয়, আমাদের পি.জি দাদা দেখে।
– বেশ তাকেই জানিয়ে দাও।
– জানাবার দরকার নেই। গত সাতদিন ওখানে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ আছে। দাদার ঠাকুমা মারা গেছে– ওরা সব এখন ওদের গ্রামের বাড়ী গেছে।
– ও তাহলে তো ভালোই হল। কী খাবে? বাঙালি খানা নাকি অন্য কিছু?
– আপনার যেখানে পছন্দ, সেখানে চলুন।
ওরা একটা বাঙালি রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসল। মিতালিকে মেনু কার্ড দিয়ে অরুণ বলল– 'তোমার যা খুশি অর্ডার দাও। আমি এ বিষয়ে খুব লেথার্জিক।’
– কেন? আপনি কম্বিনেশন করতে পারেন না?
– তা পারি। কিন্তু ভালো লাগে না। যখন বউ সাথে ছিল, ও-ই অর্ডার দিত। বন্ধুদের সাথে গেলে ওরাই দেয়।
বউ এর কথা গোপন করল না অরুণ– ব্যাপারটা খেয়াল করল মিতালি। তবু সে এ বিষয়ে উৎসাহ দেখাল না। আগের কথার রেশ ধরে বলল, 'একা খেতে যান না বুঝি?
– কখনোই না। আমার একা খেতে বোর লাগে। বাড়ীতে রান্নার লোক আছে, ও যেদিন আসে না নিজেই রান্না করে নিই।
– রান্না ভালো পারেন?
– না না। ওই সেদ্ধ টেদ্ধ। তবে চাইলে পারবো না, এমনটা মনে করি না কখনও। এত এত লোক রাঁধতে পারে, আমিই বা পারবো না কেন? তবে পারতে ইচ্ছে করে না। মিতু তুমি পারো?
– পারি একটু আধটু।
– তোমায় 'মিতু' বলে ডাকলে আপত্তি নেই তো? আসলে মিতালি টা বড্ড বড়।
– আপনি কি আপত্তির অপেক্ষা করেন? দিব্যি তো মিতু বলেই ডাকতে শুরু করলেন। মিষ্টি করে হাসল সে।
– আসলে আমি খুব সরল ভাবে চিন্তা করি। বেশী জটিল করে ভাবলে সমস্যা অনেক। আমি মোটামুটি যেমনটা ভাবি, তেমনটাই করি। এই যেমন তোমাকে দেখে ভালো লেগে গেল, মনে হল তোমার সাথে আলাপটা গভীর করতে হবে। সেজন্যই সিনেমা দেখার প্রস্তাব দিয়ে দিলাম। অন্য কেউ হলে ভাবতো– ছি ছি, ও কী ভাববে, বউ এর সাথে ডিভোর্সের মামলা চলছে, নিশ্চই এর চরিত্র খারাপ ইত্যাদি। আমি এত শত ভাবি না। দেখলাম তুমিও আমার মতো। অল্প স্বল্প ভেবেছ যদিও, তবু আসতে রাজী হয়েছ। অবশ্য তুমি মেয়ে বলেই এসব ভেবেছ, নইলে কেন জানি মনে হচ্ছে 'তুমি আমার মতো'। বাড়ীতে তোমায় কী নামে ডাকে?
– আমার অষ্টোত্তর শত নাম। তবে বেশীরভাগ কাছের মানুষজন মিতু বলেই ডাকে।
– তাহলে ওই নামটা থাক। আমি তোমায় ‘ঝিন্টি’ বলে ডাকি?
– আপনি কি আমার অনুমতি চাইছেন?
– না। এই নামে তোমায় ডাকবো, সেটা জানিয়ে রাখলাম। তুমি নিজেই যদি নিজের নাম না জানো, সাড়া দেবে কী করে? অবশ্য সবার সামনে ডাকবো না, প্রমিস।
– আমার নামকরণ করার মতো ঘনিষ্ঠতা কি আপনার সাথে হয়েছে? কিছুটা রূঢ় শোনালো মিতালির গলা।
– তোমার তরফ থেকে হয়নি জানি; কিন্তু আমার তরফ থেকে পুরোপুরি হয়ে গেছে। 'ঝিন্টি' মানে জানো?
– না।
– ঝিন্টি একটা গাছের নাম।আসল নাম হল 'সহচরী'। তোমাকে আমার সহচরী বানিয়ে নিলাম।
– এর মধ্যে কত জনের নামকরণ করেছেন আপনি?
– মেয়ে পটানোর কথা বলছ? না, না তেমন ব্যুৎপত্তি আমার নেই। তবে 'আঁখি মেলি যারে ভালো লাগে তাহারেই ভালো বলে জানি। সব প্রেম প্রেম নয়, ছিল না তো সে সংশয়, যে আমারে কাছে টানে তারে কাছে টানি' – আমি এই তত্ত্বে বিশ্বাস করি।
মিতালি মনে মনে ভাবলো– 'এই জন্যেই কি বিয়ে টিকলো না।' কিন্তু মুখে বলা টা ভালো দেখায় না, তাই চুপ করে রইল।
– কী গো। চুপ করে রইলে? ভাবছো নাকি লোকটার চরিত্র ঠিক নয়?
– না, না।
– দেখো, চরিত্র ব্যাপারটা বড় আপেক্ষিক। যে যেভাবে নেয়। তবে আমার জীবনে নারী খুব বেশী নেই। ছোটবেলায় খান দুই, যৌবনে আমার বউ – ব্যাস।
বারবার অরুণ বউ এর প্রসঙ্গ তুলেছে, খেয়াল করেছে মিতালি। বোধ হয় সে চাইছে ও ওকে সরাসরি এই নিয়ে জিজ্ঞাসা করুক। বোধ হয় এই মুহূর্তের ওর সিঙ্গেল স্ট্যাটাস এক্সপ্লেইন করতে চায়। তাই জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি আগেও শুনেছি, আজ আপনিও বললেন, বউদি আপনার সাথে থাকে না– ব্যাপারটা কি মনোমালিন্য না কি বড় কিছু?'
– বাঃ শব্দটা দারুন বললে তো! 'মনোমালিন্য'। না না, মনে আমাদের কারো মলিনতা নেই। আপাতত মিউচুয়াল সেপারেশন। ডিভোর্সের মামলা দায়ের করা হবে। তুমি সেদিন যে কুরিয়ারটা এনেছিলে, তুতু, মানে আমার বউ ঐ সংক্রান্ত কিছু কাগজপত্র পাঠিয়েছিল ওতে।
– বউদির সাথে কি আপনার প্রেমের বিয়ে?
– প্রেম? সে আর বলতে! একেবারে উথাল-পাথাল। বিয়ের আগে প্রায় চার পাঁচ বছর চুটিয়ে প্রেম করেছি।
– তাহলে?
– প্রেম ফুরিয়ে গেল। একদিন তুতু এসে বলল আর নাকি আমার সাথে মানতে পারছে না, ডিভোর্স চায়। আমিও বললাম 'তথাস্তু'।
– বাঃ বললেই হল। ডিভোর্স চাই আর অমনি আপনিও দিয়ে দিলেন?
– দেখো ঝিন্টি, জীবন একটাই। এই জীবনে তো আর দ্বিতীয় জীবন দেখা যাবে না। অতএব যা প্রাণে চায় এবং সেই চাওয়ায় যদি মেরিট থাকে তাকে সম্মান জানানো উচিৎ।
– এই ব্যাপারটায় কি মেরিট ছিল? মিতালি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
– হ্যাঁ। বিয়ের পর চার বছর পর্যন্ত আমাদের কোনও সন্তান হয়নি। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা গেল আমারই ফল্ট। অ্যাজুস্পার্মিয়া ।
– সেটা আবার কি?
– আমার সিমেনে একটাও শুক্রাণু নেই।
– তো চিকিৎসা করালেন না কেন?
– কারখানাতেই তো গোলমাল। লেবারদের প্রবলেম হলে সারানো যায়। কারখানাতেই এমন সমস্যা ও আর সারবে না। মজা করল অরুণ।
– বললেই হল? আজকাল কত ভালো ভালো চিকিৎসা বেরিয়েছে। আপনি কুঁড়েমি করে দেখান নি নির্ঘাৎ।
– না গো। সিরিয়াসলি। আমি চেন্নাই ভেলোর ফেলোরেও গেছিলাম। ছোটবেলায় একবার আমার মাম্পস হয়েছিল। ডাক্তারদের ধারণা ওই থেকে মাম্পস আর্কাইটিস হয়ে আমার এরকম পার্মানেন্ট ড্যামেজ হয়ে গেছে।
– সে না হয় হল। কিন্তু অনেকেই তো নিঃসন্তান। তাতে কি দাম্পত্য ভেঙে যায়? বিশেষ করে আট-দশ বছরের সম্পর্ক?
– তা হয়তো ঠিক। তুতু খুব বাচ্চা ভালোবাসতো। হয়তো সেই কারণে কোথাও তার কেটে গিয়েছিল আমাদের সম্পর্কে।
– আপনি বোঝাতে পারতেন?
– কী বোঝাবো? নিঃসন্তানদের সুখ বেশী? এই দ্যাখো অমুকের ছেলে দ্যাখে না, তমুকের মেয়ে নিয়ে সমস্যা– আমরা তো বেশ ভালো আছি?
– না তা নয়। আমতা আমতা করল মিতালি।
– আর তাছাড়া কানাঘুষোয় শুনছিলাম তুতুর কোনও এক অফিস কলিগও নাকি ওর প্রতি খুব ইন্টারেস্ট দেখাচ্ছে।
– বউদি নিজে আপনাকে বলেছে এই নিয়ে?
– প্রথম দিকে কিছু বলেনি। যখন সেপারেশন চাইছিল তখন ইঙ্গিত দিয়েছে কিছুটা।
– আপনি জিজ্ঞাসা করতে পারতেন। আফটার অল স্বামী হিসেবে আপনার রাইট আছে।
– তা আছে। তবে রাইট দিয়ে কি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় ঝিন্টি? যখন দেখলাম বউদির মনে অন্য কিছু বা অন্য কেউ, তখন ভাবলাম লেট হার ট্রাই'। ওর ওতো একটাই জীবন। ওরও তো অ্যাম্বিশন থাকতে পারে।
– এই নিয়ে কোনও অশান্তি হয়নি?
– না। একেবারেই মিউচুয়াল। যেদিনই ও আমাকে এই কথা বলল, সেদিনই আমি ওকে বললাম, তুমি কি এখানে থাকবে, না বাপের বাড়ী চলে যাবে? ও বাপের বাড়ী যেতে চাইল। আমি ওর সব জিনিসপত্র গোছগাছে সাহায্য করলাম যতটা পারি। পরের দিন ট্যাক্সি ডেকে দিয়েও এলাম বেলঘরিয়ায়।
– শ্বশুরবাড়ীতে ঢুকেছিলেন?
– না। ওইটা বোধহয় বিড়ম্বনার কারণ হ'ত।
– এই ব্যাপারটা নিয়ে একটা গল্প লেখা যাবে। মিতালি বলল।
– তুমি লেখো নাকি? লেখো তবে।
– আজ উঠতে হবে অরুণদা। রাত নটা বাজতে চলল।
– হ্যাঁ হ্যাঁ চলো। ধন্যবাদ ঝিন্টি, আজ অনেকদিন বাদে একটা ভালো সন্ধ্যে কাটল, তুমি সঙ্গ দিলে বলে।
– আপনাকেও ধন্যবাদ। একটা ভালো ফিল্ম আর এমন সুন্দর একটা ট্রিট দেওয়ার জন্য।
– ভালো যদি তোমার লেগে থাকে, তবে আগামী অনেক শনিবার বা ছুটির দিন ভালো করার দায়িত্ব তুমি নেবে আশা করি। তাতে আমি কৃতার্থ বোধ করব।
– সত্যি। কথায় আপনি একেবারে বৃহস্পতি। ঠিক আছে। পরের কথা পরে। আপাতত চলুন।
সেদিন রাতে শুতে শুতে অরুণের কথাই ভাবছিল মিতালি। মানুষটা খারাপ বলে মনে হয় না। বেশ নরম প্রকৃতির, কবিসুলভ। অকপটও বটে। প্রথমবার কোনও মহিলাকে এত গোপন সংবাদ দেওয়ার জন্যও একপ্রকার সততা লাগে। মোটের উপর অরুণকে ভালোই লাগল তার। অথচ এমন মানুষের বিয়ে টিকল না– ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে হতাশার। একটা ভালোলাগা খারাপ লাগার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল সে।
দিন দিনের মত কাটতে লাগল। এখন প্রায় শনিবারই ওরা এদিক ওদিকে বেরোয়, ফিল্ম দেখে, মলে শপিং করে, নন্দন-রবীন্দ্র সদনে নাটক দেখে। অফিসে যদিও বাকী পাঁচ দিন খুব সংযত ব্যবহার করে। কার মনে কী, বোঝা তো যায় না। তবে কিনা ভালো সম্পর্কেরও সুবাস থাকে। দুজনের মধ্যে যে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে সে নিয়ে অফিস মোটামুটি ওয়াকিবহাল। একদিন বিকেলবেলা অফিস থেকে বেরোবার মুখে মিতালি এসে বলল, 'অরুণদা কাল কি আপনি ব্যস্ত থাকবেন?'
– না, কেন বলো তো?
– কাল একটু অফিস ছুটি নিতে পারবেন?
– তা পারব। কিন্তু কোথায় সোনার তরীতে তুমি নিয়ে যাবে হে সুন্দরী?
– না জেনে যেতে রাজী হবেন না বুঝি?
– না না। যাব। ‘যাব মাতঃ চলো যাবো কিছু শুধোব না, না করি সংশয় কিছু না করি ভাবনা, কোথাও লবে মোরে?’ রবি ঠাকুরের কথা সুর করে আওড়ালো অরুণ।
– আপনি না! দু জায়গা থেকে লাইন পাঞ্চ করে চালিয়ে দিলেন। এই বললেন 'কিছু শুধোব না,' ফের বলেছেন 'কোথা লবে মোরে?'
অরুণ হাসতে লাগল জোরে জোরে। বলল ‘ঠিক আছে বাবা, কিচ্ছুটি শুধোব না। কোথায় দাঁড়াতে হবে বলো।’
– সকাল আটটায় ডানলপের মুখে দাঁড়াবেন।
– বেশ।
পরের দিন সকাল আটটায় সুন্দর একটা পাতলুন পাঞ্জাবী পরে অরুণ দাঁড়াল ডানলপের মুখটায়। কিছু পরে একটা ট্যাক্সি নিয়ে মিতালি এল ওখানে। পেছনের দরজাটা খুলে ওকে ডাকল– 'উঠে আসুন'।
আজ সুন্দর একটা তাঁতের শাড়ি পড়েছে মিতালি। সাধারণত ও অফিসে চুড়িদার বা জিন্স টপ পরেই আসে। এই প্রথম ওকে শাড়িতে দেখে একটু মুগ্ধতা খেলল অরুণের চোখে। বলল, 'বাঃ খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে'।
মিতালি মিষ্টি করে হাসলো। একটু বাদেই ট্যাক্সি এসে দাঁড়ালো দক্ষিণেশ্বরের সামনে। অরুণ কোনও প্রশ্ন করল না। ওরা পূজো দিল। তারপর গঙ্গার ঘাটের পাশে গিয়ে অরুণের পা ছুঁয়ে প্রনাম করল মিতালি।
– কী হল এটা? বিস্মিত অরুণ।
– আজ আমার জন্মদিন।
অরুন আলতো করে জড়িয়ে ধরল ওকে। বলল, 'অনেক অনেক ভালো থেকো ঝিন্টি। শতায়ু হও'।
– শতায়ুর আশীর্বাদ করবেন না অরুণদা। ওটা এ যুগে কাম্য নয়।
– তা ঠিক। তবে রিয়ালি আমাকে আজকে দারুন সারপ্রাইজ দিয়েছ। চল আজ দুপুরে কোথাও খাই। ট্রিট আমি দেব।
– না, না। আজ আমার জন্মদিন। আমি খাওয়াবো।
– ভাগ্যিস তুমি জন্মেছিলে ঝিন্টি। ‘তাই তোমার আনন্দ আমার পর।’ সেই খুশীতে ট্রিটটা আমি দেব।
– কক্ষনো না। যার জন্মদিন, সেই কিন্তু ট্রিট দেয়।
– আচ্ছা এই নিয়ে লড়াই করতে হবে না। চলো কোথায় যাবে।
– কোথায় যাবেন? চলুন বরং সাউথ সিটিতে যাই।
– চলো। উবের কুবের বুক করে নাও একটা। একটু চুপ থেকে অরুণ আবার বলল, 'আচ্ছা ঝিন্টি আমাকে আপনি-আজ্ঞে না করে এবার তো তুমি বলতে পারো!’
মিতালী কিছু না বলে মুচকি হাসলো। একটু পরেই তারা একটা ক্যাব নিয়ে রওনা দিল। মন্দিরের পান্ডা মিতালির কপালে একটা লাল সিঁদুরের টিপ এঁকে দিয়েছে– সেটা একটু এলোমেলো হয়ে গেছে দেখে অরুণ বলল 'একটা টিস্যু নিয়ে কপালটা ঠিক করে নাও'।
– কি করে করব? আমার কাছে আয়না নেই।
– তুমি কেমন মেয়ে গো? পার্সে আয়না থাকে না? লিপস্টিক লাগাও না পথে-ঘাটে?
– না, না। আমি কখনও কখনও একটু লিপবাম লাগাই, ওতে আয়না লাগে না।
– আমি ঠিক করে দেব?
– দিন না। আপনি কবে আমার অনুমতি নেন?
পরম যত্নে সিঁদুরটা ঠিক করে দিল অরুন। এখনকার দিনের মেয়ে মিতালি, এরা কি স্পর্শ সুখ বোঝে? অবশ্য এটা ঠিক, স্পর্শ সুখ বোঝার জন্যও ঐ মানুষটার প্রতি একটা ফিলিংস থাকা দরকার। মিতালির কি ওর প্রতি সেরকম ফিলিংস থাকবে? ও বিবাহিত, বয়সে ওর থেকে অন্তত চোদ্দ পনেরো বছরের বড়। না থাকাটাই স্বাভাবিক। আজ কিছুটা অন্যমনস্ক কেন মিতালি?
ওরা একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে প্রথমেই একটা স্টার্টার নিল। অরুণ বলল, ‘আজ হাতে অনেক সময় আছে, নাটক দেখতে যাবে নাকি?'
মিতালি বলল, ‘না অরুণদা। আমি সাড়ে চারটের মধ্যে শ্যামবাজার ফিরব। আমার একটু কাজ আছে।’
– ওঃ আচ্ছা। ঠিক আছে, খাবারের অর্ডার দিয়ে দাও। প্লিজ, একটা কথা রাখবে আমার আজ? অনুনয় করল অরুণ।
– কী?
– আজ তুমি সেগুলোই অর্ডার দাও, যা তোমার প্রিয়। এখানে তো পায়েস পাওয়া যায় না। শেষ পাতে বরং একটু ফিরনি অর্ডার ক'রো। পায়েসের এফেক্ট আসবে।
– ফিরনি আমি ভালোবাসি না অরুণদা।
– তবে পায়েস লাইক কি আছে যা তোমার পছন্দ?
– পায়েসই আমার পছন্দ না। মা হয়তো বাড়িতে করবে আজ।
– মা কে প্রণাম জানিয়েছ সকালে?
– হ্যাঁ। মা কাল থেকে বলছিল আজ সকাল সকাল কোনও মন্দিরে গিয়ে পুজো দিয়ে আসতে। সেজন্যই গিয়েছিলাম দক্ষিণেশ্বরে।
– ওঃ। ভালো করেছ। আজ বাড়ি চলে গেলে পারতে তো।
– সপ্তাহের মাঝে বাড়ি গেলে সমস্যা। দুদিন মিনিমাম সি-এল যায়।
– দ্যাখো ঝিন্টি, কেমন স্কুল পড়ুয়ারা স্কুল থেকে পালিয়ে রেস্টুরেন্টে বসে খাচ্ছে, তোমার ঠিক পেছনের ওই কোণার টেবিলটায়। আজকালকার জমানাটাই খারাপ।
– কেন, আপনারা স্কুল পালাতেন না বুঝি?
– সে কাটতাম, তবে ইলেভেন ক্লাসে। এত ছোট বয়সে থোড়ি!
এইবার হাল্কা পেছন ফিরে ওদিকের ছেলে মেয়েদের দেখল মিতালি। বলল ‘জানেন অরুনদা, এই মেয়েগুলো যে ড্রেস পরেছে, আমাদের ইস্কুলের ড্রেস এরকমটাই ছিল।’
– সাদা টপ, নীল চেক স্কার্ট? তুমি যা ফর্সা, তোমাকে নিশ্চই দারুণ দেখাতো? স্কুল বয়সের ফটো নেই তোমার?
– আছে হয়ত। তবে থাকলেও বাড়ীতে থাকবে।
– আচ্ছা ঝিন্টি, তোমার স্কুল জীবনে নিশ্চই অনেক গুণমুগ্ধ ছিল।
– তা ছিল।
– কত হবে?
– গুনিনি কখনও।
– মানে? অগুনতি? মাস্টার, ক্লাসমেট, দাদা ফাদা সব?
– ছোটদের বাদ দিচ্ছেন কেন?
– ও তারাও ছিল? কত উইকেট ফেলেছো শুনি?
মিটমিট করে হাসতে লাগল মিতালি। এখন তার চোখে যেন ছোটবেলার দুষ্টুমি।
– তুমি নিজে পিছলাওনি কখনও?
– একবার এমন স্থিতি এসেছিল বটে, তবে আমি সামলে নিয়েছি।
– কীরকম?
– আমাদের দু ক্লাস উপরে এক দাদা ছিল। গায়ের রঙটা একটু ময়লা, তবে মুখটা যেন কার্তিক ঠাকুর। আমাদের ওখানকার বিশাল এক ধনী ব্যবসায়ীর একমাত্র ছেলে। বড় ছোট সব মেয়েরা তখন ওর জন্য পাগল। আমি নিজেও মনে মনে ওকে পছন্দ করতাম। ও যদিও কাউকে পাত্তা দিত না। আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, তখন আমার বন্ধু শ্রেয়া একদিন একটা চিঠি এনে গুঁজে দিল আমার খাতার মধ্যে। খুলে দেখি ওই দাদাটির প্রেম পত্র। আসলে শ্রেয়ার বয়ফ্রেন্ড হল ওই ছেলেটির বুজুম ফ্রেন্ড।
– এতদিনে পাথর গলল তো গললোই, তাও তোমায় দেখে?
– হ্যাঁ। আমার তো তখন 'আজকাল জমি পে পাঁও নেহি পড়তে মেরে' অবস্থা। সারারাত প্রবল আনন্দে কেটে গেল ও আমাকে পছন্দ করে – এই খুশীতে।
– তারপর?
– তার আর পর নেই। পরের দিন শ্রেয়া বলল, 'কীরে কী বলব বল। রাজি তো?’
– না।
– না মানে? এত ভালো ছেলে, সবাই দিওয়ানা তার, তুই 'না' বলে দিবি?
– হ্যাঁ।
– হ্যাঁ মানে?
– হ্যাঁ মানে 'না'। 'না' বলে দিবি।
– কেন জানতে পারি কি?
– এর আবার কেন কী? আমার পছন্দ নয়।
– দ্যাখ মিতু চালাকি করিস না। আমি কিছু বুঝি না, না? কাল তোর মুখ দেখেই বুঝেছি।
– হাতি বুঝেছিস। তুই রন্টাইকে বলে দে, ওকে যেন না করে দেয়।
– আর একবার ভেবে দ্যাখ মিতু। এত বড় বাড়ীর ছেলে। রাজরানী হয়ে থাকবি।
– তোকে এত ভাবতে হবে না শ্রেয়া। আমার ডিসিশান ফাইন্যাল।
– ঝিন্টি, এমন কেন ডিসিশন নিলে জানতে পারি কি? অরুণ জিজ্ঞাসা করে উঠল মাঝপথে।
– দেখুন অরুণদা। আমার তখন ক্লাস নাইন। এই বয়সে এমন কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া আমার পক্ষে হঠকারি হ'ত। বাবা-মা কে কী বলতাম?
– তখন বলতে না। প্রেম চালিয়ে যেতে। বড় হয়ে বলতে।
– আমি তখন নিজেকে প্রশ্ন করলাম– আমার কী করনীয়। আমার ভেতর থেকে উত্তর এল এগোনো উচিৎ হবে না।
– বা বাঃ। তুমি তো হৃদয়ের দাবী মানো না। মস্তিষ্ককেই প্রাধান্য দাও।
– হয়ত ঠিক বলেছেন। আমি বয়সের তুলনায় ম্যাচিওরড।
– এরপর আর কখনও তোমার সাথে ওর দেখা হয়নি ঝিন্টি? এই বড় হয়ে?
– হয়েছে। স্কুলে থাকতে তো মাঝে মাঝেই দেখা হত। আমি যেবার মাধ্যমিক দেব, ওর টুয়েলভ ফাইনাল। রেজাল্ট একেবারেই ভালো হয়নি। অনেকে বলে সে নাকি আমার জন্য। তারপর পড়া ছেড়ে দিয়ে বাবার দোকানে বসত। এই কদিন আগে আমার জেঠতুতো দিদির বিয়েতে আমি ওর সাথে শপিং করতে গিয়ে ওকে দেখি।
– তোমাদের ওর দোকানেই যেতে হল? অরুণ ফুট কাটলো।
– আসলে ওদের দোকান এত বড় যে, বিয়ের বাজার করতে হ'লে ওই দোকানেই সকলকে যেতে হয়। আমি গিয়ে দেখি ও ক্যাশে বসে আছে।
– ও দ্যাখেনি তোমাকে?
– দেখেছে, তবে আমি চেনা দিইনি। সামনে দিয়ে ওপরের তলায় শাড়ীর কাউন্টারে চলে গেয়েছি। বেরোবার সময়ও আড়াল বুঝে চলে এসেছি।
– আহারে! মেয়েরা বড় নির্দয় হয়। একটু গল্প করলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হ'ত?
– ও একটা স্হিতাবস্হায় আছে। সেখানে ঝড় তোলাটা কি খুব আনন্দের হতো অরুণদা? মেয়েরা সব সময় দূরটা দেখে। ওর বিয়ে থা হয়ে গেছে নিশ্চই। সেখানে ওর পুরনো স্মৃতি উস্কে দিয়ে লাভ কী হত?
– বিয়ে হয়ে গেছে জানলে কী করে? লুকিয়ে চুরিয়ে খোঁজ টোঁজ রাখো না কি? মজা করল অরুণ।
– কী যে বলেন! ব্যবসায়ীর ছেলে। এত টাকা উপার্জন। এতদিন না বিয়ে করে থাকবে? এ তো সিম্পল অনুমান।
– তোমার অনুমানের এত নৈপুণ্য, তা তো জানতাম না। আচ্ছা অনুমান শাস্ত্রী, ওর নিশ্চই একটা দুটো বাচ্চাও হয়ে গিয়ে থাকবে?
– অরুণদা, আপনি এই নিয়ে পেছনে পড়েছেন কেন বলুন দেখি? দেখুন না অর্ডারটা কতদূর! আড়াইটা বেজে গেল। আমাকে উঠতে হবে কিন্তু।
– কোথায় যাবে?
– যাব এক জায়গায়।
– বলতে মানা?
– ধরে নিন তাই। একটু ঠোঁট টিপে হাসলো মিতালি। বলল, ‘নিন খাবার এসে গেছে। মন দিয়ে খান।’
অনেক রকম আইটেম অর্ডার করেছে মিতালি। ও নিজে যদিও স্বল্পভূক, তবু আজ কোনও কিছুতে কার্পণ্য করেনি। ইলিশ, চিংড়ি, মাটন, ভাপা আরও কত?
– কী করেছ ঝিন্টি? এত দুজনে খাওয়া যায়?
– যা খাওয়ার খান। না পারলে প্যাক করে নিয়ে চলে যাবেন বাড়ি। রাতে খেয়ে নেবেন।
– আমার বাড়ীর খাবার কী হবে?
– ওটা কাজের লোককে দিয়ে দেবেন। নিন এখন খান।
মিতালির কন্ঠে একটা দাপট আছে। ওর কথা মানতে ইচ্ছে করে। ভেতরের কোন জায়গা থেকে ওর স্বর আসে, অস্বীকার করা যায় না কিছুতেই। খাওয়া শেষ হতেই মিতালি বলল, 'স্যরি অরুণদা। আমার লেট হয়ে গেছে, আমি এখান থেকেই চলে যাবো, আপনি বাড়ি ফিরে যান।’
– কিছুটা রাস্তা কি কমন করা যেত না?
– না। অকারণ দৃঢ় গলায় যেন বলল মিতালি। অরুন একটু গম্ভীর হল মনে মনে। বাইরে কিছু বলল না। মিতালি যেতে যেতে বলল 'এই শনিবার বাড়ী যাব। আগামী সপ্তাহে দেখা হবে'।
সারাটা দিন এত আনন্দের পর হঠাৎ করে যেন রেশটা কেটে গেল কোথাও। অরুন নিজেকেই ধিক্কার দিল মনে মনে। কেন সে এত প্রত্যাশা করছে মিতালির সঙ্গকে? নিজে নিঃসঙ্গ বলে? সে তো নিঃসঙ্গতা পছন্দ করে। একটা সিগারেট ধরিয়ে ট্যাক্সি ডাকল সে। একবার লেবুতলায় অনিন্দ্যের চেম্বারে যাওয়ার দরকার। অনিন্দ্য ওর ছোটবেলার বন্ধু ছিল। ওর ডিভোর্সের কেসটা ওই দেখছে।
২
– হ্যালো, ঝিন্টি?
– হ্যাঁ অরুণদা, বলুন।
– আজ অফিসে আসোনি তুমি?
– না। শরীরটা ভালো ছিল না আজ।
– কেন গো, জ্বরটর নাকি?
– না, না, তেমন কিছু না। একটু রেস্ট নিলাম আজ। কালও তো নিউইয়ারস ডে'র ছুটি। ঠিক হয়ে যাব।
– ওষুধ খেয়েছ?
– না না, ওষুধ কী খাব! বললাম তো, তেমন কিছু নয়।
– এত অবহেলা করো না। চল ডাক্তার দেখিয়ে আনি।
– অরুণদা, ছাড়ুন না। তেমন কিছু হয়নি।
– দুদিন অফিস আসতে পারছো না, তাও তেমন কিছু নয়?
– আপনি না বড্ড কেয়ারিং! আসলে একটু গাইনি রিলেটেড প্রব্লেম তো।
– ওঃ স্যরি। বুঝতে পারিনি। কিছু মনে করো না।
– না, না। মনে করার কিছু নেই। ফোন করেছিলেন কেন?
– ওই কালকে তো নিউইয়ারস ডে। ছুটি আছে। আমার বাড়ী আসবে?
– না অরুণদা।
– কেন?
– এমনিই।
– তাহলে অন্য কোথাও আসবে? বছরের প্রথম দিনটায় দেখা হলে ভালো লাগতো।
– কাল আমার সময় হবে না অরুনদা। আমার একটু বেরোনোর আছে। পরশু দেখা হবে।
হঠাৎ করে রাগ হয়ে গেল অরুণের। পরশু তো আর বছরের প্রথম দিন নয়। ওর একটা আধো আধো সংস্কার আছে। ওর মনে হয় বছরে প্রথম দিনটা ভাল কাটলে সারা বছরই ভালো কাটে। মিতালির সাথে কাটানোর থেকে ভালো আর কিছু এই মুহূর্তে মনে আসে না তার। আগে যখন তুতু ছিল, এই দিনটা খুব আদর করত তুতুকে। চেষ্টা করতো সারাদিন যেন ঝগড়া না হয়। বাইরে খেতে যেত। তুতুও এই দিন নিয়ম করে ওর জন্য, নিজের জন্য আর বাড়ীর চাকর বাকরের জন্য নতুন জামা কাপড় কিনত। সকালে নিজের হাতে টিফিন বানাতো ওই দিন। ঘোর কাটল মিতালির কথায়– 'আর কিছু বলবেন?'
– না। বলেই ফোনটা কেটে দিল অরুণ।
কী হত যদি মিতালি আসতো ওর ঘরে? ও কি ঝাঁপিয়ে পড়ত ওর উপর? নাকি একা পুরুষের ঘরে এলে লোক নিন্দার ভয়? এটা তো ফ্ল্যাট নয় যে দরজা খুললে উল্টো দিকের ফ্ল্যাট থেকে উঁকি দিয়ে দেখবে, কে এল! বাড়ীতে তুতু চলে যাওয়ার পর কি লোকে আসে না, নাকি তাদের মধ্যে মহিলা নেই? আর মিতালি কাল অন্য কাজে বেরুতে পারবে, ওর সাথে কোথাও একটুক্ষণ দেখা করতে পারবে না? ওই জন্য অরুণ নিজে পছন্দ করে একটা শাড়ী কিনেছিল। কী অজুহাতে দেবে ঠিক করতে পারছিল না; নতুন বছর উপলক্ষ্যে দেওয়া যেতে পারতো। কী আর করা যাবে!
রান্নাঘরে গিয়ে এক কাপ চায়ের জল চড়াল অরুণ। আজ বছরের শেষ দিন। তুতুকেও একবার ফোন করা দরকার। চা খেতে খেতে ডিভোর্সের কাগজপত্র গুলো দেখতে দেখতে ফোন লাগালে সে। – 'তুতু'
– বল। কেমন আছো 'রু'। অরুণ কে ছোট করে 'রু' ডাকতো তুতু।
– ভালো আছি। তোমার খবর?
– এই গতানুগতিক। তোমাকে যে কাগজপত্র গুলো পাঠিয়েছি সই করে দিয়েছ?
– হ্যাঁ।
– জানো তো, আমি কিছুতেই সই করতে পারছি না 'রু'। হাত কাঁপছে। পুরনো দিনের কথা মনে পড়ছে সব। সবকিছু তো খারাপ ছিল না।
– আজ আর এসব ভেবে কী লাভ তুতু? আগামী চারই জানুয়ারী তো সব ফাইন্যাল হয়ে যাবে। জজ সাহেব বলে দিয়েছেন।
– হ্যাঁ গো, যদি আবার আগের বারের মতো বলে – ভেবে দেখুন, মিটিয়ে নিন ইত্যাদি, – কী বলবে?
– এবার আর বলবে না। সেই ধাপ গতবারেই পার হয়ে গেছে।
– তোমার খারাপ লাগছে 'রু'?
একটু চুপ করে রইল অরুণ। বলল, ‘আজকে তোমার কী হয়েছে তুতু? ডিসিশান যখন নিয়েছ, দোনা মোনা করো না। এতে তোমার সামনের জীবনও অন্ধকার হয়ে যাবে।’
– তোমার আর তর সইছে না, না রু। শুনছি কম বয়সী একটা মেয়ে নিয়ে ঘুরছো; যত তাড়াতাড়ি ডিভোর্স হয়, ততই মঙ্গল – না?
– এতে মঙ্গল অমঙ্গলের কী আছে?
– কেন তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নিতে পারবে।
– কী যা তা বলছ? ফোঁস করে উঠল অরুণ।
– কেন মিতালি বলে একটা মেয়ের সাথে ঘোরো না?
– হ্যাঁ ঘুরি। কিন্তু তুমি জানলে কী করে?
– কেন, তোমাদের অফিসের দোলন, সে তো আমার বন্ধু আছে এখনও। ওই সব খবর দেয়।
– তা দোলন এ খবর দেয় নি যে মিতালি আমার হাঁটুর বয়সী?
– তাও হাঁটুটা কতটা নীচে শুনি।
– পনেরো বছর তো হবেই।
– সে আর এমন কী? তোমার বাবা, মায়ের বয়সের মধ্যেই তো কুড়ি বছরের তফাৎ ছিল!
– ও আগে হ'ত। এখন হয় না।
– তোমার উদাহরণ চাই রু? প্রেম কি বয়স মানে?
– প্রেম হয়েছে, কে বলল তোমাকে?
– না হয়ে থাকলে কর। সামনে এত বড় জীবন পড়ে আছে। আন্তরিক শোনালো তুতুর গলা।
– সে আর হয় না তুতু। 'যে দিন গ্যাছে, একেবারেই গেছে'।
– আমি মেয়েটিকে তোমার হয়ে প্রপোজ করব?
– পাগল হয়ে গেলে নাকি? সে তোমায় বলবে না, তুমি নিজে যার সাথে ঘর করতে পারোনি, তার ওকালতি করছ কোন মুখে?
– 'রু', তোমার সাথে আমি থাকতে পারিনি, এটা আমারই অক্ষমতা। আমি কোনওদিন তোমাকে কি দোষ দিয়েছি এই নিয়ে?
– না।
– তোমার যদি কিছু একটা উপায় হয়, আমি সত্যি খুব খুশী হব রু। আচ্ছা মেয়েটি তোমাকে ভালোবাসে না?
– বুঝি না।
– তুমি বাসো?
চুপ করে রইল অরুণ। অনেকক্ষণ পরে বলল 'ভেবে দেখিনি তুতু। আসলে এই নিয়ে ভাবার মতো স্তরেও আমি নেই। তবে মেয়েটিকে ভালো লাগে।’
– তবে একবার বলেই দ্যাখো না।
– না তুতু। এখন এসব কথা থাক।
– আচ্ছা মেয়েটি কি অন্য কাউকে ভালোবাসে?
– জানি না।
– জিজ্ঞেস করোনি কখনও?
– না। ছাড়ো ওর কথা। তুমি কি কিছু ডিসাইড করেছো?
– কি ব্যাপারে?
– কালকের ব্যাপারে।
– আমি কি কাল আসবো তোমার কাছে?
– না তুতু। মায়া বাড়িও না। তুমি বরং বলো। ওই গীতাদি, বাইন – এদের জামাকাপড়ের কী করব?
এবার কি দেব, নাকি তুমি গিয়েছো তাই পাটটাই তুলে দেব?
– তুমি কিনে দাও না! বছরকার দিনে বাড়ীর কাজের লোক নতুন জামা পরবে না? যাও সন্ধে হয়ে গেছে, এখনই যাও, কিনে আনো গিয়ে।
৩
চার তারিখ ডিভোর্সটা হয়েই গেল অরুণের। ওইদিন কোর্ট থেকে ফিরেই ধূম জ্বর এলো তার। গত দুদিন বেশ অনিয়ম হয়েছে। ঠান্ডাটাও বেশী পড়েছে এবার। তারপর মাফলার না পরে বাইক চালিয়েছে খুব। একটা প্যারাসিটামল খেয়ে শুয়ে পড়েছিল সে। পরের দিন ঘুম ভাঙলো কলিং বেলের আওয়াজে। দরজা খুলেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল সে – 'আরে মিতালি? এখন এখানে?'
– আগে ঘরে তো ঢুকতে দিন।
– স্যরি। এসো এসো। বোসো এই সোফাটায়। চিনে এলে কী করে? তোমায় ঠিকানা দিইনি তো কখনও।
– ‘খুফিয়া জানকারি’ আমারও কি কম আছে অরুণদা? হাসল মিতালি।
– তুমি এখানে এসেছ, অফিস যাবে না?
– না।
– কেন গো?
– চাকরিতে কাল আমি রেজিগনেশন দিয়ে দিয়েছি। কাল আপনি অফিস যাননি তো, তাই বলা হয়নি।
– কাল আমার কোর্টের ডেট ছিল।
– কী হল ওখানে?
– ডিভোর্স হয়ে গেল কাল।
– মন খারাপ? সমবেদনার স্বরে বলল মিতালি।
– না, না। ওতো জানাই ছিল। তুমি বরং বলো, হঠাৎ চাকরি ছাড়লে কেন? তাছাড়া আমি তো কিছুই জানি না।
– আসলে আমার বিয়ে এই মাসের ২৬ তারিখ। বলেই অরুণের নাম লেখা একটা কার্ড বের করল সে।
হঠাৎ বুকটা যেন ফেটে যাওয়ার উপক্রম হল অরুণের। এতটা চমক সে প্রত্যাশা করে উঠতে পারছে না এখনও। বলল, ‘বিয়ে? কার সাথে?’
– কেন, অরিঞ্জয় মানে আমার এক ফ্রেন্ড আছে, তার সাথে!
– ফ্রেন্ড? মানে প্রেমের বিয়ে?
– হ্যাঁ।
– কবে প্রেম করতে? তোমাকে তো কখনও প্রেম করতে যেতে দেখিনি। তুমি তো প্রায় প্রতি শনিবার, ছুটি ছাটা আমার সাথেই কাটাতে?
– তা কাটাতাম, তবে ওর সাথেও মাঝে মাঝে দেখা করতাম। ও আসলে জি.আর.ই পরীক্ষার জন্য তৈরি হ'ত তো! তাই রেগুলার দেখা হ'ত না।
– বলোনি তো কখনও।
– আপনিও তো জানতে চাননি কোনওদিন।
– এতে চাকরি ছাড়ার কী হল?
– আসলে অরিঞ্জয় বিয়ের আটদিনের মধ্যেই নিউইয়র্ক চলে যাচ্ছে। আমিও ওখানে চলে যাবো।
– কবে যাবে?
– ও ওখানে গিয়ে কাগজপত্র করে পাঠাবে। পাঠালেই চলে যাবো।
– ততদিন তো চাকরিটা করতে পারতে।
– কী লাভ বলুন। সেই তো ছাড়তেই হতো। মায়া বাড়িয়ে লাভ কি?
– তোমার শ্বশুর বাড়ী কোথায়?
– বর্দ্ধমান। তবে ওদের কলকাতায় ফ্ল্যাট আছে। বিয়েও কলকাতায় হবে। লেক গার্ডেন্স এ। আসবেন তো?
একটুখানি চুপ করে অরুণ বলল, ‘কী বার?’
– শনিবার। অসুবিধা হবে না, বাহানাও দিতে পারবেন না এমন দিনে পড়েছে।
– দেখি। চা খাবে?
– বসুন, আমাকে জায়গা দেখিয়ে দিন, আমি চা করে দিচ্ছি।
অরুণ কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। চা চাপিয়ে অরুণের ঠিক পাশ ঘেঁষে বসল মিতালি। হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে প্রণাম করল অরুণকে।
– হঠাৎ প্রণাম?
– এমনিই। আশীর্বাদ চাইছি। বলেই কাছ ঘেঁষে চুপ করে দাঁড়ালো মিতালি। যেন কিছু বলবে।
– কিছু বলবে মিতালি?
– কই, আমাকে আপনি হাগ করলেন না তো? প্রণাম করলে তো আপনি হাগ করেন!
উঠে দাঁড়ালো অরুণ। ওর পায়ে যেন জোর নেই। কোনোরকমে এসে আলতো করে জড়িয়ে ধরল তাকে। মিতালি ওর বুকে মুখ রেখে ফিসফিস করে বলল– ‘আর বুঝি আমাকে ঝিন্টি বলবেন না?’
অরুণ চুপ করে রইল। মিতালিও সময় নিল একটু। তারপর একটু স্পষ্ট স্বরে বলল ‘আমার বিয়েতে তোমার এসে কাজ নেই অরুণদা। তুমি এসো না। আমি কিছু মনে করব না।’
আস্তে আস্তে বাহুপাশ থেকে মিতালিকে মুক্ত করে দিল অরুণ। নাভির কাছ থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসে যেন চমকে দিল দুজনকেই।
1 Comments
ভারি সুন্দর লেখাটি!
ReplyDelete