জ্বলদর্চি

সমাধান /ঝুম্পা মান্না



সমাধান

 ঝুম্পা মান্না


পুজোর ছুটির পর আজ স্কুলের প্রথম দিন। পত্রালি দেবী আজ খুব খুশি কারণ স্কুলের বাচ্চাদের সঙ্গে আজ অনেক দিন পর দেখা হলো। বাচ্চাদের মধ্যে এখনও পুজোর রেশ রয়ে গেছে।

এরা প্রত্যেকেই যেন এক একটি রত্ন। এ ওর চুল টানে তো আর একজন অন্যজনের দিকে ভেঙচি কাটে। এদের নিত্যদিন নিত্য নতুন সমস্যার শেষ থাকে না। খুব অদ্ভুত ভাবে অদ্ভুত সব সমস্যার সমাধান নিজেরাই খুব সহজেই করে ফেলে।

টিফিনের আগের ক্লাসে বাচ্চাদের উৎসাহ যেন দ্বিগুণ হয়ে যায়। এরা এক একজন গোয়েন্দা চরিত্রের নায়কের মতো খাবারের গন্ধ শুঁকে আন্দাজ লাগানোর চেষ্টা করে আজ মধ্যাহ্ণভোজনে কি কি রান্না হয়েছে।

পত্রালি দেবীর টিফিনের আগের ক্লাসটি ছিল আজ চতুর্থ শ্রেণিতে। পত্রালি দেবী বললেন, তোমরা সবাই ভালো আছো? বাচ্চারা চিৎকার করে সবাই একসঙ্গে বলে উঠল - হ্যাঁ ম্যাডাম। পত্রালি দেবী বলেন, পুজোর ছুটিতে যে হোমওয়ার্ক গুলো দেওয়া ছিল সেগুলো সবাই করে এসেছে তো, সবাই এক এক করে জমা দাও। এরপর পত্রালি দেবী ক্লাসে পড়ানো শুরু করলেন। অনিশ বলল, ম্যাডাম, ঋতু হোমওয়ার্কের খাতা জমা দেয়নি। ঋতু তুমি হোমওয়ার্ক করে নিয়ে আসনি কেন? ঋতু নিরুত্তরভাবে জানালার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো। পত্রালি দেবী আবার ক্লাসে পড়ানোতে মনযোগ দিলেন। পড়াতে পড়াতে দেখলেন ঋতু আজ শুরু থেকেই অন্যমনস্ক। অন্যদিন তার মুখ থেকে কথার ফুলঝুরি তো শেষ হতেই চায় না। পড়ানো শেষ করে বললেন, আজকের সমস্ত পড়া কাল সবাই করে নিয়ে আসবে আমি কিন্তু কাল কোনো বাহানা শুনব না। মনে থাকে যেন। ঠিক আছে ম্যা-ডা-ম।

ঢং ঢং ঢং ঢং - টিফিনের ঘন্টা বাজতেই সবাই খাওয়ার জন্য রুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেল। পত্রালি লক্ষ্য করলেন সবাই বেরিয়ে গেলেও ঋতু এখনো চুপচাপ বসে আছে। ঋতুর কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, ঋতু তোমার কি আজকে শরীর খারাপ লাগছে? সবাই চলে গেল তুমি এখনও খেতে যাওনি, তুমি কি আজ খাবে না? ঋতু চুপ করে বসে থাকলো। ঋতুর চোখে মুখে একটা ভয়ের ছাপ লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। পত্রালি আরও শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন কী হয়েছে ঋতু বলো আমায়।

ঋতু ম্যাডামকে জড়িয়ে ধরলো, ভয়ে ভয়ে কান্না ভেজা গলায় যা বললো তা শুনে পত্রালি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।

গতকাল বিকেলে যখন ও খেলছিল তখন ওদের পাড়ার এক দূর সম্পর্কের কাকা, যার নাম রমেন আইসক্রিম খাওয়ানোর লোভ দেখিয়ে ওদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে যায়। বাড়িতে সেই সময় কেউ ছিল না, সেই সুযোগের ব্যবহার করে ওই বদমাইস লোকটি নোংরা ব্যবহার করেছে তার উপর। তার সাথে এই বলে ভয় দেখায় যদি ও কাউকে কিছু বলে তাহলে ও গ্রামের সবাইকে বলে দেবে যে ওদের ফাঁকা বাড়িতে ও চুরি করার মতলব নিয়ে এসেছিল।

পত্রালি ঋতুর মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে নিয়ে বললো - ঋতু চলো খেয়ে নেবে, আমিও আজ তোমার সাথে বসে খাবো। ঋতুকে খাবার খেতে দেখে ভাবলো যাক মেয়েটা একটু স্বাভাবিক হয়েছে। পত্রালি মনে মনে ভাবলেন আমাকে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিছু একটা করতে হবে।

আজ স্কুল ছুটির পর পত্রালি ঋতুর সঙ্গে ওদের বাড়িতে যান। সেখানে যাওয়ার পর যা দেখলেন তার কিছুটা আন্দাজ আগেই করেছিলেন।

ম্যাডাম কিছু বলবেন আপনি? আমি বুঝতে পেরেছি ওকে বারণ করা সত্বেও ও সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে, আপনাকে বলেছে ঠিক আছে আর কাউকে কিছু বলেনি তো? যদি সবাই জানতে পারে তাহলে আমরা আর মুখ দেখাতে পারবো না। তোকে আজ আমি মেরেই ফেলবো। এই বলে ঋতুর মা ঋতুর দিকে তেড়ে গেল। ওর শরীরে সমানে কিল, চড় বসাতে লাগল।

পত্রালি ছুটে গিয়ে ঋতুকে জড়িয়ে ধরেন। কান্না ভেজা গলায় বলতে থাকেন কী এই সমাজ, যে অন্যায় করলো তার শাস্তির কথা কেউ ভাবছে না, কিন্তু যার সাথে অন্যায় হলো তাকেই নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে।

ঋতুর মায়ের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। বলল, ম্যাডাম, কাল থেকে মেয়েটা আমার কিছু খায়নি, কাল ও বাড়িতে আসার পর ওর বাবা ওকে খুব পিটিয়েছে, বলেছে যদি ও স্কুল ছাড়া কোথাও যায় তাহলে ওর হাত পা ভেঙে দিবে। মেয়েটা সেই থেকে একটা কথাও বলেনি একেবারে চুপচাপ হয়ে গেছে। আপনি বললেন না শাস্তির কথা - আমরা কাকে শাস্তি দেব? ওরা বড় লোক ওদেরকে শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই, আমাদের পক্ষে চুপচাপ থাকাটাই সব থেকে ভালো।

কী ভালো, - ঋতুর বাবা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো, আমি সব শুনেছি বাইরে থেকে। আপনার কাছে আমার একটাই অনুরোধ আপনি যা শুনেছেন সব ভুলে যান। তাতে আপনিও ভালো থাকবেন, আমাদেরও ভালো থাকতে দিন।

- মেয়েটার সঙ্গে এত বড় একটা অন্যায় হওয়ার পরেও আপনারা চুপচাপ থেকে ভালো থাকতে চাইছেন? সেটা আপনাদের জন্য সম্ভবপর হলেও আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। ওর শিশু মনে যে খারাপ প্রভাব পড়েছে তা থেকে আমি ওকে মুক্ত করে ওর স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো। এরজন্য আমাকে যা করতে হবে আমি তাই করবো।

ভয় পেয়ো না ঋতু - তোমার ম্যাডাম তোমার সঙ্গে আছেন। ঋতুর মুখ দেখে মনে হল ও চাইছে লোকটার যেন শাস্তি হয়।

আসছি আমি বলে পত্রালি ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে পত্রালির মাথায় একটাই চিন্তা ঘুরপাক করতে থাকল - ও কী করবে, কী করলে সমস্যার সমাধান ঘটবে? ঋতুর পরিবার তো এই অন্যায়কে এক প্রকার বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছে। না মেনে উপায় নেই। গ্রামে জানাজানি হলে ওদের ওখানে সুস্থভাবে জীবন কাটানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। ঋতুর উপর নির্যাতন আরও বাড়তে পারে। তাই ওকে খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে - যা করার সেটা খুব ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে চিন্তে করতে হবে।

মোবাইলের এলার্মের আওয়াজে পত্রালির ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম থেকে উঠে তড়িঘড়ি করে রেডি হয়ে আজ একটু জলদি স্কুলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। পত্রালি দেবী আজ স্কুলে এসে সমস্ত ঘটনা প্রধান শিক্ষককে জানালেন। সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে স্যার বললেন - আমিও খেয়াল করেছি, কিন্তু আপনার মতো করে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবিনি কিন্তু যখন ওর বাড়ির লোক চাইছে না আমরা এখানে কী করতে পারি বলুন তো।

পত্রালি বলেন, কিন্তু স্যার ও আমাদের ছাত্রী, আমাদেরও তো কিছু দায়িত্ব আছে। হেড স্যার বলেন, আমরা নিজেরা তো কিছু করতে পারবো না, কিছু করলে উল্টে বিপদ বাড়তে পারে। এ ব্যাপারে আমরা একবার লোকাল থানার সাহায্য নিতে পারি। পত্রালি বলেন, তাহলে আজ স্কুল ছুটির পর একবার লোকাল থানায় যাব। দেখি ওখান থেকে কোনো ব্যবস্থা হয় কি না।

থানায় সব শুনে বড়বাবু বললেন, দেখুন ম্যাডাম সব তো শুনলাম। আমরা শুধুমাত্র আপনাদের মুখের কথা শুনে কারও বিরুদ্ধে স্টেপ নিতে পারব না। ঐ বাচ্চাটির সাথে যদি কোনোভাবে কথা বলতে পারতাম তাহলে আমাদের কাজে সুবিধা হতো।

পত্রালি বলেন, আসলে ওর বাড়ির লোক চায় না ব্যাপারটা জানাজানি হোক। ঐ বাচ্চা মেয়েটিও খুব ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আছে, তাও আমরা চেষ্টা করব কোনোভাবে আপনাদের সাথে কথা বলানো যায় কি না। তবে একটা উপায় মনে এল- কাল যদি আপনারা স্কুল ছুটির আগে একবার সিভিল ড্রেসে স্কুলে যেতে পারেন তাহলে সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

বড় বাবু বললেন, তাহলে তো ভালই হয়। পত্রালি বললেন, স্যার একটা অনুরোধ রাখবেন, তদন্তের সাপেক্ষে আপনাদের অনেক কিছুই করতে হতে পারে। চেষ্টা করবেন যে কোনও অবস্থাতেই বাচ্চা শিশুটি ও তার পরিবারের পরিচয় যেন সবার কাছে প্রকাশ না পায়। বড়বাবু বললেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন ম্যাডাম - এটা আমাদেরও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। অপরাধী তো তার কৃতকর্মের শাস্তি অপরাধ প্রমাণ হওয়ার পর অবশ্যই পাবে - তাছাড়াও আমরা সবরকমভাবে চেষ্টা করব, এই ঘটনা যেন শিশুটির আগামী ভবিষ্যতে কোনো খারাপ প্রভাব না ফেলতে পারে।

-আপনার কথা শুনে আমি আশ্বস্ত হলাম। বাকি কথা কালকে স্কুলে হবে। আসছি স্যার বলে পত্রালিরা বাড়ি ফিরে গেলেন।

পরের দিন স্কুল ছুটির আগে বড়বাবু স্কুলে উপস্থিত হলেন। ঋতুকে অফিস রুমে ডেকে আনা হল। প্রথমে ঋতু কিছুটা ভয় পেলেও সবাই ওকে সাহস দেওয়াতে বড়বাবুর সামনে ও আস্তে আস্তে সবকিছু বলে।

সবকিছু শুনে বড়বাবু রমেনের নামে স্বতঃপ্রণোদিত এফ.আই.আর. করলেন। সেই দিন রাত্রে একজন ইন্সপেক্টরকে সঙ্গে নিয়ে এসে রমেনকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেলেন।

স্কুলে আজ ঋতু পত্রালির কাছে এসে বলল - ম্যাডাম জানেন, কালকে ওই বজ্জাত কাকুটাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে।

-আচ্ছা তাই বুঝি - তাহলে তুমি খুশি তো?

হ্যাঁ ম্যাডাম খু-ব।

পত্রালিও তার প্রাণচঞ্চল হাসিখুশি ছাত্রীটিকে নতুন করে ফিরে পেলেন।

🍂

Post a Comment

0 Comments