বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৮১
অগুরু
ভাস্করব্রত পতি
খ্রীষ্টপূর্ব ১৯০০ নাগাদ ত্রিপুরার রাজা ছিলেন পাত্রদান। মানিক্য রাজবংশের অনেক আগে তাঁর রাজত্বকাল। লোককাহিনি অনুসারে আগরতলায় চিত্রারথ, দ্রীকপতি, ধর্মপা, লোকনাথ সেসময়ের গুরুত্বপূর্ণ রাজা ছিলেন। সেই আগরতলাই আজ ত্রিপুরার রাজধানী। ৭৬.৫০৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের উত্তর পূর্ব ভারতের রাজ্যের রাজধানী শহরটির নামকরনে উদ্ভিদবাচক গ্রামনামের সন্ধান মেলে। 'আগর' বা অগুরু গাছের নামেই হয়েছে আগরতলা।
আগর (অগুরু) + তলা = আগরতলা
'তলা' অর্থে বৃক্ষের বা আচ্ছাদনের নিম্নস্থিত স্থান বোঝায়। অথবা নিকটবর্তী বা পার্শ্বস্থ স্থান। আগর গাছ সম্বলিত এলাকাই 'আগরতলা'!
আগর গাছের স্থানীয় নাম হল অগরু বা অগুরু। এটি দীর্ঘ চিরশ্যামল বৃক্ষ। এদের শাখাপ্রশাখা রয়েছে। লম্বাটে মাঝারি ধরনের গাছ। অগুরুচন্দন, গুগ্গুল নামেও পরিচিত। ইংরেজিতে বলে Aloe Wood, Eagle Wood। হিন্দি ও গুজরাটীতে বলে অগর্, তামিলে অগগলিবন্দ, অগর্, তেলুগুতে হরুগুহ চেট্ট বলে। এছাড়াও পরিচিত বংশক, বংশিক, রাতক, জোঙ্গক, কাষ্ঠক, অগ্নিকাষ্ঠ, ক্রমিজ, ক্রিমিজ, ক্রিমিজগ্ধ, অনার্যজ, অনার্যক, বাজার্হ, লোহ, লঘু, পিচ্ছিল, ভৃঙ্গ, কৃষ্ণ, লোহাখ্য, বর্ণপ্রসাদন, অসার নামেও। এই গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Aquilaria melaccensis। এটি Thymelaeaceae পরিবারভুক্ত। অগুরু গাছের অন্যান্য যেসব প্রজাতির সন্ধান মেলে, সেগুলি হল Aquilaria agallocha Roxb, Aquilaria ovata, Amyris agallocha, Aquilaria secundaria, Aquilaria malaccense, Agalochum malaccensis ইত্যাদি। সারা পৃথিবীতে মোট ৮ টি প্রজাতির সন্ধান মিললেও ভারতের বুকে পাওয়া যায় ২ টি প্রজাতি।
মূলতঃ পূর্ব হিমালয়, ত্রিপুরা, আসাম, খাসিয়াপাহাড়, শ্রীহট্ট, ভুটান, মায়ানমার, ইরান, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স, মালয় উপদ্বীপ, লাওস, সিলেটে জন্মায়। উচ্চতায় ৬০ থেকে ৮০ ফুট হয় এই মাঝারি ধরনের চিরসবুজ বৃক্ষটি। গুঁড়ির ব্যাস ০.৬ -২.৫ মিটার। এই গাছের কাঠ নরম ও সাদা। বাইরের ছাল পাতলা এবং খসখসে। কিন্তু। কিন্তু ভিতরের ছাল বেশ মসৃণ। পাতাগুলো উজ্জ্বল সবুজ এবং পাতলা। প্রায় চার ইঞ্চি লম্বা, পাতলা এবং সামনের অংশ ক্রমশঃ সরু। ফুলের রং সাদা। তিন বছরের মধ্যেই গাছে ছোট ছোট ফুল চলে আসে। ফুলগুলি কাক্ষিক ছত্রাকার মঞ্জরি ধরনের। একই পুষ্পদন্ডে সাদা রঙের ফুল ফোটে অনেক। সাধারণত জুন মাসে ফুল ফোটে আর আগস্টে ফল হয়। ফলগুলো ডিম্বাকার এবং তা ৪ - ৫ সেমি হয়। ফলগুলি নরম বেশ।
আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালী ভট্টাচার্য লিখেছেন, "গাছটির অগুরু নাম হলেও, সমগ্র গাছটিতে অগুরু, জন্মে না। গাছের কোথায় কোন অংশে জন্মাবে তা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। এটি একটি ছত্রাকজাতীয় পদার্থ। অগুরু গাছ সংগ্রহকারেরা নীলামে খরিদ করে। ছোট ছোট টুকরো করে কুচিয়ে ফেলে। হয়ত একটি গাছে অগুরু পাওয়া যেতে পারে আবার নাও পাওয়া যেতে পারে। গাছ মোটা হলে যে অগার পাওয়া যাবেই তার কোন নিশ্চয়তা নেই। আর যেটি অগুরু বলে সংগ্রহ করা হয় তা একটি গাছের গাঁটের মতো এবং অসমান। এই তথ্যটি আসাম অঞ্চলের সংগ্রহকারীদের নিকট থেকে শোনা। দ্বিতীয় কথা, এই অগুরু নামকরণটি কেন করা হয়েছে-সেটি বেশি ভারি বলে, না কম ভারি বলে? আমরা তো সর্বদাই দেখি কাঠ জলে ভাসে। অগুরু কিন্তু জলে ভাসে না। জলে ডুবেই যায়। বেশি ভারী বলেই নাম অগুরু। যেটি সর্বোত্তম অগর, সেটি ঘোরকি বলে পরিচিত। এটি গ্রন্থির মত গাছের মধ্যে জন্মায়। মনে হয় যেন ছোট ঘটের মধ্যে পিণ্ডাকারে সৃষ্ট হয়েছে। তাই এর বিশিষ্ট পরিচিতি ঘোরকি। এগুলি প্রকৃতপক্ষে কোনটি কি তা অজানা।"
অগুরু গাছ পাঁচ প্রকারের হয়। যথা - ১.কৃষ্ণাগুরু, ২. দাহাগুরু, ৩.স্বাদ্বগুরু, ৪. মঙ্গল্যাগুরু এবং ৫. কাষ্ঠাগুরু। এগুলির মধ্যে দাহাগুরু গজ্জারে এবং মঙ্গল্যাগুরু কেদারে বিখ্যাত বলে বলা হয়। তবে নিঘণ্টকারদের মতে মঙ্গল্যাগুরুই শ্রেষ্ঠ। কালোবর্ণের অগুরু পাওয়া যায় কামরূপে। চরক সূত্রস্থানের তৃতীয় অধ্যায়ের ২১ তম শ্লোকে কুষ্ঠ রোগ, চতুর্থ অধ্যায়ে শ্বাসহর ও শীতপ্রশমক, পঞ্চম অধ্যায়ে অঞ্জনোপাদান এবং সুশ্রুত সূত্রস্থানের ৩৯ অধ্যায়ের ৮ শ্লোকে এই অগুরু শ্লেষ্মাহারক, ৩৮ তম অধ্যায়ের ৬ শ্লোকে পাণ্ডুরোগ, কুষ্ঠ মেহ রোগের নিরাময়ে খুব কার্যকরী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়াও হাঁপানি, চুলকানি, মেহ রোগ উপশমেও ব্যবহৃত হয়।
এটি মস্তিষ্কের বলকারক। চিনে অগুরুকাঠ বলকারক, উত্তেজক, বায়ুনাশক ও কামোত্তেজক হিসাবে প্রচলিত। ইউনানি চিকিৎসকদের কাছে অগুরু কাঠ মৃদু বিরেচক, বলকারক, পাচক, বায়ুনাশক, মুত্রকারক এবং কামোত্তেজক। কম্বোডিয়ায় একে 'জ্বরঘ্ন' হিসাবে প্রয়োগ করা হয়। এর সুগন্ধী আঠা উত্তেজক দ্রব্য। যা রসবাত সহ নানা ধরনের বাত ছাড়াও মাথাঘোরা ও পক্ষাঘাতে ব্যবহৃত হয়। বমি বন্ধ করতে ব্যবহৃত হয় এর গুঁড়ো। এর ক্বাথ জ্বরের উপশম করে।
আগর গাছ থেকেই সুগন্ধি, প্রসাধনী সামগ্রী, শ্যাম্পু, ধূপ তৈরি হয়। তাই ধূপকে বলা হয় "আগরবাতি"। আর এক ধরনের সেন্টকে বলা হয় 'অগুরু'। পূজোয় লাগে। চিনের প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতিতে রোগনির্ণয়ের মূল উপাদান হিসেবে আগর কাঠ ব্যবহৃত হয়। কিন্তু দিন বদলের সাথে সাথে দিন দিন এখানে কমছে আগর গাছের সংখ্যা। আর বাড়তে থাকছে বাড়িঘর। তবে আজও শহরের পুরোনো কোনো বাড়ির দালানে বিশাল আগর গাছ দেখতে পাওয়া যায়। উত্তর ত্রিপুরা সহ সারা রাজ্যেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রচুর আগর গাছ। এক একটি গাছের দাম লক্ষাধিক টাকা।
🍂
0 Comments