জ্বলদর্চি

ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি (ঔপন্যাসিক নজরুল / সপ্তম পর্ব) / চিত্রা ভট্টাচার্য্য(

ঘুমিয়ে গেছে গানের পাখি             
 চিত্রা ভট্টাচার্য্য
(ঔপন্যাসিক নজরুল / সপ্তম পর্ব)

বাংলা সাহিত্যের আকাশে কথাসাহিত্যিক হিসেবেই সাম্যবাদের কবি নজরুলের প্রথম আবির্ভাব । বাঙালির মনে-প্রাণে বজ্র-বিদ্যুতের ঝড় তুলেছেন উদ্দাম, উচ্চকন্ঠে কোলাহলময় ভাষায় প্রবল প্রসন্ন প্রাণের পরিপূর্ণ  তারুণ্যের প্রতীক হয়ে -চির যৌবনের দূত নজরুল যেন সত্যি প্রাণবন্ত এক ''টর্পেডো ভীম ভাসমান মাইন'।  তাঁর দুর্বার প্রাণশক্তির ভাষায় এনেছে তীক্ষ্ণতা, ছন্দে এনেছে জীবনের স্পন্দন, ভাবে এনেছে বীরবিক্রমের  তেজদীপ্তি । তাঁর  তেইশ বছরের সাহিত্যিক জীবনে অজস্র সৃষ্টিশীল লেখনীর সম্ভারে উপন্যাস মাত্র তিনটি। এবং  তিনটি উপন্যাসেই তিনি  অনন্য  একজন প্রাবন্ধিক , ঔপন্যাসিক ও বটে । মূলত কালের চক্রে এই বরণীয় স্রষ্টা বাংলার মননে স্মরণীয় হয়ে রইলেন ''বিদ্রোহী কবি নজরুল ''পরিচয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলের কথাসাহিত্য সম্পর্কে বলেছিলেন,‘‘ভাবের সংস্কৃতি সমন্বয়ের সাধনায় এই এক নতুন অবদান আনছ তুমি। ’’ 
 ১৯২০ সালের মার্চেমাসে ৪৯ নম্বর বাঙালি পল্টন ভেঙ্গে গেলে উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি হাতে কলকাতায় ফিরলেন উচ্ছ্বসিত এক তরুণ যুবক কাজী নজরুল ইসলাম।  তিনি এলেন, লিখলেন, জয় করলেন সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রতিভার ঔজ্জ্বল্যে ,ব্যক্তিত্ব ও শক্তিতে।  ভবিষ্যতের বাঙালির রক্তে জাগালেন সচেতনতার  উন্মাদনা। দ্রোহের বিপ্লবের সংগ্রামের বাণী অবিরাম বর্ষিত হলো তাঁর দৃঢ় কণ্ঠে উদাত্তস্বরে সুপ্ত বাঙালি জাতিকে স্বমহীমায় জাগ্রত করে তুলতে।  

কলকাতায় ফিরে  তাঁর প্রথম দিকের আস্তানা ছিল বঙ্গীয় মুসলমান সমিতির দফতর (৩২ কলেজ স্ট্রিট)। মুজফ্ফর আহমদ থাকতেন সেখানে। সে-সময় নজরুলের বাঁধনহারা উপন্যাস মোসলেম ভারত পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশ হতে থাকে। ১৯২০ সালের ১২ জুলাই থেকে প্রকাশিত হয় সান্ধ্য দৈনিকপত্র নবযুগ। পত্রিকাটির সম্পাদনায় ও লেখালেখিতে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন নজরুল এবং তাঁর অন্যতম সহযোগী লেখক মুজফ্ফর আহমদ। কিন্তু রাজরোষে পত্রিকাটি বন্ধহয়। নজরুল যেন জানতেন, যুগেযুগে অমোঘ কালবেলায় রুদ্রের আবাহনে বাঙালিমাত্রে শরণ নেবে তাঁর।
🍂
ad

তাঁর অজস্র রচনা সৃষ্টিতে  চরিতাদর্শনমূলক প্রবন্ধের মাধ্যমে নজরুল  বিশিষ্ট চরিত্র আলোচনার নিরিখে ভারতবাসীর দেশপ্রেমকে জাগ্রত করবার চেষ্টা করেছেন। সাহিত্য ও শিল্পভাবনা বিষয়ক প্রবন্ধ ‘বর্তমান বিশ্বসাহিত্য’ প্রবন্ধে নজরুল বিশ্বের শক্তিধর লেখকদের পরিচয় দেবার চেষ্টা করেছেন। তিনি বিশ্বসাহিত্যের দুটি রূপ দেখেছেন। তাঁর প্রবন্ধে যেমন পেয়েছি  নোগুচি, ইয়েটস, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ মহান ব্যক্তিত্বদের ,তেমনি  অন্যদিকে তিনি প্রবন্ধ লিখেছেন গোর্কি, যোহান, রোয়ার, বার্ণডশ, বেনাভাবে দের সম্বন্ধে।এ ছাড়া ও রিউনিদ, ন্যুটহামসুন, ওয়াদিশল, রেম’দ, আনাতোল ফ্রাঁস, টলস্টয়, দস্তয়ভস্কি, পুশকিন, বালজাক, জোলা, কিপলিং, কীটস, হুইটম্যান প্রভৃতি কবি সাহিত্যিকের কথাও  তাঁর আলোচনায়  বিসতৃত ভাবে পাওয়া গিয়েছে। মূলত তিনি বাঙালির একজন স্বনাম ধন্য প্রিয় কবি হলেও তিনি সাহিত্য কর্মে বহুমুখী প্রতিভার পরিচয় রেখেছেন। ঔপন্যাসিক নজরুলের  অতুলনীয় সৃষ্টি  মাত্র তিনটি  উপন্যাস বাঁধনহারা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা। এবং এই তিন উপন্যাসেই রণক্লান্ত বিদ্রোহীর সৃজনশক্তির অসীমত্বের সন্ধান পাওয়া যায় ।
 
তাঁর অসামান্য প্রতিভার বিশিষ্ট অবদান কথাসাহিত্যে দেখতে পাই বিভিন্ন সংস্কৃতির সমন্বয় সাধনায় ।   উপন্যাসগুলোর কাহিনি ও চরিত্র নির্মাণে তিনি যে দার্শনিক প্রজ্ঞার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন তা বৃহত্তর মানব জীবন কে নানারূপে আলোকিত ও সমৃদ্ধ করে। জীবন যুদ্ধে বিদ্ধস্থ রূঢ় বাস্তবের সংঘাতের টানাপোড়নে জটিল সমস্যাকে উন্মুক্ত আকাশ পানে টেনে নিয়ে যায়। নজরুলের উপন্যাস মৃত্যুক্ষুধা’ বাদ দিলে তাঁর ‘বাঁধনহারা’ ও ‘কুহেলিকা’রচিত হয়েছিল কবি হয়ে ওঠার আগেই। তাই বলা যায়,গল্প-উপন্যাস লেখক নজরুল কবি নজরুলের অগ্রজ। কবির সাম্যবাদ, বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তার প্রকাশ উপন্যাসগুলোর বিভিন্ন চরিত্রের মাঝে স্পষ্ট প্রকাশ পেয়েছে।  নিম্নবর্গের মানুষের জীবনসংগ্রাম উঠে এসেছে নজরুলের ‘মৃত্যুক্ষুধা’য়। বঞ্চিত দলিত ও প্রান্তবাসী জনগোষ্ঠীর কথা তীব্রভাবে সঞ্চারিত করেছে তাঁর আয়ুধকে। 

 ঔপনিবেশিক শাসনামলের জটিল সময়ে বাংলার সাহিত্য-ও রাজনীতিতে তাঁর আপন ছন্দে আবির্ভাব   প্রবল পরাক্রমী সাহসী বীরের মত ‘বাঁধনহারা’র বিপ্লবের আকাঙ্খা  কিংবা ‘কুহেলিকা’র তীব্র রোমান্স-ঔপন্যাসিক নজরুলের সামর্থ্যকেই উজ্জ্বল করে তোলে। ভিন্নতার সাধনায়  অতিক্রম করেছেন দীর্ঘ-দুরূহ কঠিন বন্ধুর পথ। মহৎ স্রষ্টা-লেখক, কবি, শিল্পীরা মৃত্যুর পরে ও অমরত্ব লাভ করেন তাঁর সৃষ্টি সুখের মাঝে।  উত্তরসূরির মাধ্যমে । জনচিত্তে তাঁর স্থায়িত্ব নির্ণীত হয় সেই অনপনেয় চিহ্ন থেকেই। কালের সে বিচারে বাঙালির জীবনে, কাব্য সাহিত্যাকাশে কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি সমাজের ধর্ম বিভেদ হীন এক মিলিত সমন্বিত সংস্কৃতির কাণ্ডারী। তাই তিনি অনন্য,অবিস্মরনীয় প্রেমের প্রতীক হয়ে আজো বিরাজ করেন  বাঙালার হৃদয়ের গভীরে । অক্ষর শিল্পের প্রতি তাঁর অমোঘ আকর্ষণ তাকে নিখুঁত ভাবে উপস্থাপন করা এবং গুরুত্ব প্রদান করা যুবক নজরুল কে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে :এক  অনন্য জগতের  স্রষ্টা করে তুলেছিল । সাহিত্যে সাধারণ মানুষের কথা দ্রোহ-বিদ্রোহ প্রতিবাদ নিয়ে আসার কাজটি তিনি অত্যন্ত নিপুণতার সাথে করেছেন। ঔপনিবেশিক শাসনের রক্তচক্ষুর কোনো পরোয়া না করে মনুষ্যত্বের পতাকা অনায়াসে স্বগৌরবে উর্দ্ধে উত্তোলিত করে দুলিয়েছেন। কালের বিচারে দেখা যায় তার এ কাজ এ সংগ্রাম ও বিদ্রোহ বৃথা যায়নি। যে কোনো বিচারে তিনি যুগান্তকারী একজন মহান লেখক ও সাধক।  
 
কাজীনজরুল তার  চেতনার পূর্ণ প্রকাশের জন্য  বরাবরই সচেষ্ট ছিলেন এবং  নিজেও ‘লোকশিক্ষায়, সমাজের কল্যাণসাধনে, মানুষের নৈতিক-উন্নয়নে’ শিল্প-সাহিত্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। নজরুলের প্রথম উপন্যাস বাঁধনহারা   (১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ) মোসলেম ভারত পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল পরে   (জুন, ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দ) গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।‘বাঁধনহারা’  বাংলা সাহিত্যে প্রথম পত্রোপন্যাস, যেখানে সমাজের জটিলতা ও অতৃপ্ত প্রেম কাহিনী উপন্যাসটির প্রতিটি পর্বে প্রকাশ পেয়েছে  ।‘মৃত্যুক্ষুধা’ কে বলা যায় প্রথম সাম্যবাদী উপন্যাস, অন্যদিকে ‘কুহেলিকা’ উপন্যাসটি দেশমাতৃকার প্রেম ও বিল্পবী চেতনার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
 কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু তার "নজরুলের গদ্যে ভিন্ন উদ্ভাস"’ প্রবন্ধটিতে বলেছেন,, ‘‘নজরুলের তিনটি উপন্যাস এবং এই তিনটি উপন্যাসের তিনটি চরিত্র ‘বাঁধনহারার নুরুল হুদা,‘কুহেলিকা’র জাহাঙ্গীর ও ‘মৃত্যুক্ষুধা’র আনসার নজরুলের প্রতিকৃতি হিসেবে উন্মোচিত হয়েছে।  কবির  চরিত্রের যে রোমান্টিকতা-স্বদেশিকতা-মানবতাবোধ রয়েছে তা এই তিনটি চরিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে। ‘বাঁধনহারা’য় যে সৈনিক-জীবনের চিত্র লিপিবদ্ধ হয়েছে -তা উল্লেখযোগ্য এবং বিরল। ‘কুহেলিকার’ কাহিনি সন্ত্রাসবাদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। এসব উপন্যাসে আঙ্গিকগত দুর্বলতা থাকলেও  কিছু চরিত্র এবং সামাজিক অবস্থানকে যেভাবে উপন্যাসে উপস্থাপন করা হয়েছে-তা একেবারে মূল্যহীন নয়। কেননা যা কিছু বৈশিষ্ট্য এসব লেখায় রয়েছে তা সময় ও নজরুলের চেতনা মূল্যায়নে উল্লেখযোগ্য বলে মনে হয়। ’'
   ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত ‘বাঁধনহারা’ উপন্যাসে নায়ক চরিত্র নুরুল হুদা।কাহিনি তে বর্ণিত রবিয়ল স্নেহভরে পিতৃ-মাতৃহীন নুরুল হুদাকে বাড়িতে আশ্রয় দেয়। সেই সাথে নুরুল হুদার প্রতি রবিয়লের স্ত্রী রাবেয়ার স্নেহ-ভালোবাসা  , তার শ্যালক মনুর সঙ্গে তার গভীর সখ্য, তার ছোট বোন সোফিয়ার সই প্রতিবেশী মাহবুবার সঙ্গে নুরুল হুদার প্রণয় ও পূর্বরাগ, নুরুল হুদা ও সুন্দরী মাহবুবার প্রণয়দৃষ্টে ভাবীর ও রবিয়লের মধ্যস্থতায় এক সুন্দর পারিবারিক প্রেম প্রীতির সম্পর্ক গড়ে উঠলে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থির হলে তখন ই হঠাৎ রহস্যজনক ভাবে নুরুল হুদা সকলের অগোচরে দূর বিদেশে পাড়ি দিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিলে ,কাঙ্খিত বিয়ে ভেঙে যাওয়া, কন্যাটির বাবার মৃত্যু হয়। এবং অপরূপা সুন্দরী মাহবুবার এক বৃদ্ধ জমিদারের সাথে বিয়ে হয়। জমিদারের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মাহবুবা বৈধব্য জীবনে প্রবেশ করে ও উত্তরাধিকার সূত্রে জমিদারি লাভ করে। ওদিকে সেনাবাহিনীর জীবন শেষে বাঁধনহারা নুরুল হুদার ফিরে আসার ইঙ্গিতের মধ্যে উপন্যাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। সচেতন পাঠক খুব সহজেই বুঝতে পারে, নুরুল চরিত্র যে নজরুলেরই প্রতিচ্ছবি।উপন্যাসের নায়ক নুরুলহুদা আর ঔপন্যাসিক নজরুল যে একই মানুষ,সেটা সচেতন পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয় না।

 ‘বাঁধন-হারা’ উপন্যাসে মোট চরিত্রের সংখ্যা দশটি—নুরুল হুদা, মাহবুবা, রাবেয়া, সাহসিকা, আয়েশা, খুকি আনারকলি, মা রোকেয়া, মনুয়ার, রবিউল ও সোফিয়া। নজরুল গবেষকদের মতে  তিনি ‘বাঁধন-হারা’র মাধ্যমে বাঙালিদের প্রথম আধুনিক যুদ্ধ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জ্ঞাত করেছেন। উপন্যাসে নজরুলের সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতার ছাপ রয়েছে। চিঠিগুলো থেকে উ ঠে এসেছে চাপা কষ্ট ও বেদনার বাষ্প। সবকিছুর মূলে হারানো স্মৃতি দুঃখের প্রতিলিপি হয়ে উঠেছে।লেখক এখানে প্রচণ্ড আবেগ ও সংবেদনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন।  তবে উপন্যাসে বর্ণনার ভিড়ে কোথাও কোথাও অস্পষ্টতার ছাপ রয়েছে। যেন লেখক কোনো চরিত্রকেই শিল্পগুণে পূর্ণাঙ্গ করে তুলতে ইচ্ছুক নন। তবুও প্রেমের অপ্রাপ্তি পাঠক মনে ভাবনার ঢেউ তোলে।
     ( বাংলা সাহিত্যের প্রথম পত্রোপন্যাস ‘বাঁধন-হারা’। করাচিতে থাকাকালীন তিনি রচনা শুরু করেছিলেন। প্রকাশক ডিম.এম লাইব্রেরি ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে। মূল্য  দুই টাকা।)
 নজরুলের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা’ প্রকাশ পায় ১৯৩০ সালে (বৈশাখ ১৩৩৭)। মৃত্যুক্ষুধা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের নিদারুণ দৈন্য, অর্থসংকট, সমাজ ও শ্রেণিবৈষম্য প্রভৃতি বিষয়ে উপলব্ধির প্রকাশ। এ উপন্যাসকে বলা যায় সাম্যবাদী চেতনাসম্পন্ন বাস্তুবাদী আখ্যান। শিল্পগুণ ও জীবনবোধের বিচারে খুঁজে পাওয়া যায় ভিন্ন রূপরেখায় ।  শৃঙ্খলে আবদ্ধ সমাজের প্রকৃত চিত্র বিন্যাসে নজরুল অপূর্ব দক্ষতায় মৃত্যু ও ক্ষুধা কে একই তুলির আঁচড়ে দৃশ্যমান দেখিয়েছেন এবং তার সাথে প্রেমের চিত্র আঁকতে তিনি মোটেই বিস্মৃত হননি।কাহিনির ক্যানভাস পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরের চাঁদ সড়কের দলিত জনগোষ্ঠীকে ঘিরে আরম্ভ হয়েছে। ধ্বনিত হয়েছে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সবার দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে চলমান জীবন সংগ্রাম, বেঁচে থাকার আকুতি।
  ঘটনার প্রথম পর্বে কলতলায় দরিদ্র দুই মহিলার মধ্যে প্রচণ্ড ঝগড়া দেখা যায়। ঝগড়াটা হিন্দু হিড়িম্বার সাথে মুসলিম গজালের মায়ের। গজালের বৃদ্ধমায়ের সংসারে তিন বিধবা যুবতী পুত্রবধূসহ ডজনখানেক বাচ্চাকাচ্চা ও পুত্র প্যাঁকালে। এত বড় সংসারের ভার ১৮-১৯ বছরের রাজমিস্ত্রি কর্মী প্যাঁকালের ওপর ন্যস্ত। দারিদ্র্যপীড়িত সংসারের মুখগুলো ক্ষুধার যন্ত্রণার জন্য আহারের অপেক্ষায় থাকে। সেখানে এসে যুক্ত হয় স্বামীর ঘর ছেড়ে আসা প্যাঁকালের প্রসব বেদনাতুর বোন। জন্ম নেয় নতুন মুখ, নতুন স্বপ্ন-আশা। দুঃখ-আনন্দে ঘটনা এগোতে থাকে। একসময় রুগ্ন সেজো বউয়ের মৃত্যু এসে কাঁদিয়ে যায় পাঠক হৃদয়।
উপন্যাসে পাওয়া যায় কুর্শি নামের এক খ্রিস্টান তরুণীকে, যার সাথে প্যাঁকালের প্রেমের সম্পর্ক। অপরূপা সুন্দরী বিধবা মেজো বউকে তার বড় বোনের স্বামী বিয়ে করতে আগ্রহী হয়। অনটন-দুর্দশার পাশাপাশি খ্রিস্টান মিশনারিরা সাহায্যের ছলনায় দারিদ্র্য পীড়িতদের ধর্মান্তরিত করার নানা চেষ্টা চালায়। বিধবা সুন্দরী মেজো বউয়ের খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণে নতুন নাম হয় হেলেন। বিপ্লবী নেতা আনসারের সাথে প্রেমের মাধ্যমে হেলেন আবার মুসলিম হয়। বিপ্লবী চেতনা ও দেশমাতৃকার কর্মকাণ্ডের জন্য আনসারের কারাবরণের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটে। উপন্যাসের গাঁথুনিতে কোথাও কোথাও সামঞ্জস্যের দুর্বলতা মনে হলেও জীবন-মৃত্যু-ক্ষুধা-আনন্দ-বেদনার মাঝে প্রেম, বিপ্লব ও সাম্যের সুরে এক অপূর্ব সৃষ্টিকর্ম ‘মৃত্যুক্ষুধা’।
 কবির সর্বশেষ উপন্যাস স্বদেশী বিপ্লবী চেতনার অপূর্ব আখ্যান ‘কুহেলিকা’ গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায় ১৯৩১ সালে। এবং  ১৩৩৪ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক নওরোজ পত্রিকায় প্রথম অংশ প্রকাশিত হয়। এবং ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দে এটি প্রথম বই আকারে প্রকাশিত হয়। 

 উপন্যাসটিতে  নজরুলের রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রতিফলিত হয়ে স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীর প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। স্বদেশ মন্ত্রে দীক্ষিত বিপ্লবী জাহাঙ্গীরের মধ্য দিয়ে লেখক সমসাময়িক স্বদেশ চেতনা বোধ, সমাজনীতি, রাজনীতি, ধর্মনীতি প্রভৃতির সফল প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। সেই সাথে ব্যঙ্গ, হাস্যরস ও মিথকথনের মাধ্যমে অনন্যপ্রবাহ সঞ্চারিত করেছেন। ঘটনার সূত্রপাত তরুণ কবি হারুনের মেসে নারীকে কুহেলিকা বলে রসাত্মক কথোপকথনের মাধ্যমে। জাহাঙ্গীরের জীবনে দাগ এঁকে যাওয়া নারীদের ঘিরে এগোতে থাকে সময়। সে নারীদের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে চম্পা ও ভূণী চরিত্র। বিপ্লবী জাহাঙ্গীরের দ্বীপান্তরের মাধ্যমে উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটে। জাহাঙ্গীরের পারিবারিক জীবন থেকে জানা যায় মা-বাবার বিবাহবন্ধন ছাড়াই তার জন্ম হয়েছে। মা-বাবার দূরত্ব তার মধ্যে কিছুটা হলেও ভিন্নতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। নজরুল তার সমসাময়িক জাহাঙ্গীরের মতো চরিত্র সৃষ্টি করে সত্যিই সাহসের পরিচয় দিয়েছেন, যা এ সমাজকে পাল্টে দিয়ে প্রত্যয় ঘোষণা করে।
  ''নজরুলের সাহিত্যকর্ম ও তার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, ‘অদম্য স্বতঃস্ফূর্ততা নজরুলের রচনার প্রধান গুণ – এবং প্রধান দোষ।’ বলেছিলেন যে, ''নজরুল শুধু ‘হু-হু করে লিখেছেন; ভাবতে বুঝতে মাজা-ঘষা করতে কখনো থামেননি, কোথায় থামতে হবে দিশে পাননি।’ 
 এটা  অস্বীকার্য নয় যে  নজরুলের সাহিত্যকর্মে  আবেগের প্রাবল্য রয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে এ-ও  মনে রাখতে হবে যে, নজরুলের সেই আবেগ বেপথুমান নয়, বরং আবেগের সঞ্চারমান বৈশিষ্ট্য তাঁর সাহিত্যকর্মকে বিশিষ্টতা দান করেছে। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ  বলেছিলেন , ' আবেগকে প্রকাশ করতে হলে কথার মধ্যে আবেগের ধর্ম সঞ্চার করতে হবে।’ কেন করতে হবে?  ‘আবেগের ধর্ম হচ্ছে বেগ; সে চলে, চালায়। কথা যখন সেই বেগ গ্রহণ করে, তখন স্পন্দিত হৃদয়ভাবের সঙ্গে তার সাধর্ম্য ঘটে।’'
 নজরুলের প্রবন্ধে আমরা আবেগের সেই সাধর্ম্যরে শৈল্পিক প্রকাশ দেখি। মানুষের ‘মানুষ’ পরিচয়টাকেই তিনি বড় করে দেখিয়েছেন। শুধুই তাঁর সাহিত্যকর্মে নয়, নজরুলের ব্যক্তিগত জীবনেও তার নানা নমুনা দেখতে পাওয়া গিয়েছে। জীবনটাকে তিনি না-জাত, না-ধর্ম – কোনোদিক থেকেই খণ্ড-বিখণ্ড করতে চাননি।
তথ্য সূত্র
১). কাজী নজরুল ইসলাম, ২০০৬। নজরুল-রচনাবলী (জন্মশতবর্ষ সংস্করণ), (সম্পাদনা-পরিষদ : রফিকুল ইসলাম), বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
২) কাজী নজরুল ইসলাম, ২০১৬। প্রবন্ধ-সমগ্র (প্রথম সংস্করণ : ১৯৯৭), নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
৩) বিশ্বজিৎ ঘোষ/ নজরুল জীবন ও সাহিত্য।
           ক্রমশঃ

Post a Comment

0 Comments