জ্বলদর্চি

জঙ্গলমহলের লোকগল্প /দুষ্টু বাঘের শাস্তি /সংগ্ৰাহক-পূর্ণিমা দাস/কথক- চিত্তরঞ্জন দাস, গ্ৰাম- বেড়াজাল, থানা-নয়াগ্ৰাম, জেলা-ঝাড়গ্ৰাম

জঙ্গলমহলের লোকগল্প
  
     দুষ্টু বাঘের শাস্তি
 
   সংগ্ৰাহক-পূর্ণিমা দাস 

  কথক- চিত্তরঞ্জন দাস, গ্ৰাম- বেড়াজাল,   
  থানা-নয়াগ্ৰাম,জেলা-ঝাড়গ্ৰাম 

বহুকাল আগে এক জঙ্গলের ভেতর এক হরিণ তার বাচ্চাকে নিয়ে বসবাস করত। হরিণ বাচ্চার মাকে শিকারীরা মেরে ফেলেছিল, তাই সে তার বাবার সঙ্গে থাকত। হরিণ বাচ্চাটি খুব ছোটো থাকার জন্য বাবা হরিণ বাচ্চার অনেক খেয়াল রাখত। কোনো সময় বাচ্চাকে একা ছেড়ে কোথাও যেত না। বাচ্চার সমস্ত আবদার মেটাত। 

  একদিন এক দুষ্টু বাঘ হরিণ ও হরিণের বাচ্চাটিকে দেখতে পায়। বাঘ হরিণ ও হরিণের বাচ্চাটিকে দেখে বলতে লাগল-“ আঃ!কী মজা। অনেকদিন পর ভালো শিকারের দেখা পেলাম। কতদিন হল হরিণের নরম নরম মাংস খাইনি। আজ এই হরিণ ও তার বাচ্চার মাংস খাবে। আগে বাচ্চাটাকে খাব, তারপর বাবাটাকে। হা হা হা। মনে হচ্ছে‌ যেন আজ ভগবান আমার দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন।” 

  বাঘ মনে মনে এইসব ভাবতে লাগল। আর এদিকে হরিণ শাবকটি তার বাবাকে বলল-“বাবা আমার খুব খিদে পেয়েছে। তুমি আমাকে কিছু খাবার এনে দাও।” 
 
   তখন বাবা হরিণ বলে-“সোনা বাচ্চা আমার। তুমি এইখানে দাঁড়াও আমি এখুনি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি। আর হ্যাঁ আমি না আসা পর্যন্ত তুমি কিন্তু এইখানে থাকবে, কোথাও যাবে না।” 

  বাচ্চা হরিণ বলে-“ঠিক আছে বাবা। আমি এইখান থেকে কোথাও যাব না। তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।” 

  হরিণ ও হরিণের বাচ্চার সমস্ত কথা একটু দূরে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা দুষ্টু বাঘ শুনছিল। সে এইসব শুনে ভাবে-“এ তো সোনায় সোহাগা। এই তো সুবর্ন সুযোগ হরিণ বাচ্চাটিকে খাবার। হা হা হা।” 

  এরপর হরিণ তার বাচ্চার জন্য খাবার খুঁজতে বের হয়। কিন্তু অনেকক্ষণ জঙ্গলের মধ্যে ঘুরেও কোনো খাবার পেল না। এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে সে এক গাছের তলায় এসে দাঁড়াল। যে গাছের তলায় এসে সে দাঁড়াল সেই গাছে একটি বক বসে ছিল। সে হরিণকে দেখে বলল-“কী হয়েছে হরিণ ভাই। তোমাকে এত চিন্তিত লাগছে কেন?” 

  তখন হরিণ বলল-“আর বলো না বক ভাই। আমার ছোটো বাচ্চাটি না খেয়ে আছে। আমি তার জন্য খাবারের খোঁজে বের হয়েছিলাম। কিন্তু কোথাও কোনো খাবার খুঁজেই পেলাম না। এখন যে কী করব বুঝতে পারছি না।”

  তখন বক বলল-“হ্যাঁ হরিণ ভাই ঠিকই বলেছ। এই জঙ্গলে খাবারের প্রচুর অভাব। প্রচন্ড খরার কারণে জঙ্গলের সব ঘাস শুকিয়ে গেছে। বৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত আর কচি ঘাস জন্মাবে না।” 

   তখন হরিণ বলে-“বক ভাই তাহলে আমি এখন কী করব? আমার বাচ্চাটা যে খাবারের জন্য ছটপট করছে।”
 
   বক বলে-“তুমি চিন্তা করো না। আমি তোমাকে কিছু কচি ঘাস এনে দিচ্ছি। এই জঙ্গল থেকে দূরে এক গ্ৰামের পুকুর পাড়ে অনেক কচি ঘাস হয়েছে। তুমি একটু দাঁড়াও। আমি সেইখান থেকে কিছু ঘাস এনে দিচ্ছি।” হরিণ বলে-“ঠিক আছে বক ভাই।”

   এরপর বক কচি ঘাস আনতে চলে যায়। আর কিছুক্ষণ পর বক কিছু কচি ঘাস নিয়ে আসে। আর হরিণকে বলে-“এই নাও হরিণ ভাই। এই ঘাসগুলো তোমার বাচ্চার জন্য নিয়ে যাও।”

   হরিণ বলে-“ধন্যবাদ বক ভাই। তোমার এই উপকার আমি কখনো ভুলবো না।”

   এরপর হরিণ কচি ঘাস নিয়ে তার বাচ্চার কাছে আসে। কিন্তু যেখানে তার বাচ্চাকে রেখে গিয়েছিল, সেখানে তার বাচ্চা নেই। 

   হরিণ তখন বলে-“এ কী! আমার ছোটো সোনাকে তো আমি এইখানে রেখে গিয়েছিলাম। আমার বাচ্চা কোথায় গেল। তাহলে কী কেউ আমার বাচ্চাকে খেয়ে ফেললো।”

   এইসব চিন্তা করতে করতে হঠাৎ হরিণ তার সামনে বাঘকে দেখতে পেল। বাঘকে দেখে হরিণ বলল-“এই দুষ্টু বাঘ, নিশ্চয়ই তুই আমার বাচ্চাটিকে খেয়ে ফেলেছিস তাই না?” 
🍂
ad

    বাঘ বলল-“হা হা হা। না রে হরিণ আমি এখনো তোর বাচ্চাকে খাইনি। তবে আমার কথা না শুনলে তোর বাচ্চাটিকে আমি খেয়ে ফেলবো।”

    তখন হরিণ বলে-“তার মানে আমার বাচ্চা এখনো বেঁচে আছে।” 

   বাঘ বলে-“হ্যাঁ, তোর বাচ্চা এখন আমার কব্জায় আছে। আমি যা বলব তা যদি তুই না শুনিস তো আমি তোর বাচ্চাকে খেয়ে ফেলবো।”

    হরিণ বলে-“না না তুমি আমার বাচ্চাকে খেও না। তোমার কথায় আমি রাজি। তুমি যা বলবে আমি তাই করবো।”

   বাঘ বলে-“যদি তুই তোর বাচ্চাকে ফেরত পেতে চাস তাহলে প্রতিদিন তুই আমার জন্য খাবার নিয়ে আসবি। আর যেদিন খাবার আনতে পারবি না, সেইদিন আমি তোর বাচ্চাকে খেয়ে ফেলবো। বল এখন তুই আমার কথায় রাজি কিনা।” 

  হরিণ বলে-“হ্যাঁ আমি তোমার কথায় রাজি। বাঘ বলে-“তাহলে যা আজ থেকে কাজ শুরু করে দে।”

    এরপর হরিণ বাঘের জন্য খাবার খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। সারাদিন ঘুরে ঘুরে অবশেষে হরিণ কিছু খাবার খুঁজে পেল এবং সে সেই খাবার বাঘের কাছে নিয়ে আসে। 

    বাঘ বলে-“কী রে হরিণ, সারাদিন অপেক্ষা করিয়ে এই অল্প খাবার এনেছিস‌। এই খাবারে তো আমার পেটের এক কোণাও ভরবে না।” 

    তখন হরিণ বলে-“ জঙ্গলে খাবারের প্রচুর অভাব। সারা জঙ্গল খুঁজে এই খাবারের ব্যবস্থা করতে পেরেছি।”
   
    তখন বাঘ বলে-“ঠিক আছে, আজকের মতো আমি এই দিয়ে চালিয়ে নিচ্ছি। কিন্তু কাল থেকে যদি বেশি খাবার না এনেছিস তাহলে তোর বাচ্চাকে আমি খেয়ে ফেলবো।”

     হরিণ বলে-“না না বাঘ ভাই, আমি খাবার নিয়ে আসব। তুমি আমার বাচ্চাকে খেও না।”

      এইভাবে হরিণ প্রতিদিন বাঘের জন্য খাবার নিয়ে আসত। একদিন হরিণ বাঘকে বলে-“বাঘ ভাই আমার বাচ্চাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে, একবার আমার বাচ্চার সঙ্গে দেখা করতে দেবে।”

    বাঘ বলে-“শোন হরিণ তোর বাচ্চা আমার কাছে অনেক ভালো আছে। তবে এখন তুই তোর বাচ্চার সঙ্গে দেখা করতে পারবি না। একমাস পর দেখা করতে দেব।”

    তখন হরিণ বলে-“একমাস পর কেন?” বাঘ বলে-“আঃ এত প্রশ্ন করিস না। বেশি প্রশ্ন করলে তোর বাচ্চাকে আমি আজই খেয়ে ফেলবো।”

   তখন হরিণ আর কোনো প্রশ্ন করে না। চুপচাপ বাঘের জন্য খাবার খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। এইভাবে একমাস কেটে যায়। 

   একমাস পর হরিণ বাঘকে বলে-“বাঘ ভাই, একমাস তো হয়েই গেল। এবার আমাকে আমার বাচ্চার সঙ্গে দেখা করতে দাও।”

   বাঘ বলে-“ আরও একমাস পরে তুই তোর বাচ্চাকে দেখতে পাবি। চিন্তা করিস না তোর বাচ্চা আমার কাছে খুবই ভালো আছে।”

    হরিণ বলে-“কিন্তু তুমি তো একমাস পর দেখা করতে দেবে বলেছিলে।”

    তখন বাঘ বলে-“বেশি কথা বলিস না। যা আমার জন্য খাবার নিয়ে আয়। আর বেশি কথা বললে জানিস তো আমি কী করব।”
       
     তখন হরিণ আর কোনো কথা বলে না। বাঘের জন্য খাবার খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু সারাদিন খাবার খুঁজেও কোনো খাবারের খোঁজ পায় না। তখন সে চিন্তায় পড়ে যায়। সেইসময় সেখানে বকের সঙ্গে হরিণের দেখা হয়। 

    বক হরিণকে দেখে বলে-“কী হয়েছে হরিণ ভাই, তোমাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?” তখন হরিণ বককে সব কথা খুলে বলে। 

     সব শুনে বক বলল-“হরিণ ভাই, ওই দুষ্টু বাঘ মিথ্যাবাদী। ওই বাঘ আমার সঙ্গেও এমন কাজ করেছে। আমাকে দিয়ে মাসের পর মাস খাবার আনিয়েছে। বলেছে আমার বাচ্চা ওর কাছে ভালো আছে। কিন্তু আমি পরে জানতে পারি ও আমার বাচ্চাকে অনেক আগেই খেয়ে ফেলেছে। আর মিথ্যা কথা বলে আমাকে দিয়ে খাবারের বন্দোবস্ত করিয়েছে।” 

    তখন হরিণ বলে-“তাহলে কী ও আমার বাচ্চাকেও খেয়ে ফেলেছে।”
     
     বক বলে-“হ্যাঁ হরিণ ভাই, ওই বাঘ মিথ্যাবাদী। বাঘ আমার মতো তোমাকেও মিথ্যা কথা বলেছে।” হরিণ তখন কাঁদতে থাকে।

    বক বলে-“কান্না করো না হরিণ ভাই। ওই দুষ্টু বাঘকে এবার একটা উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।” 

    হরিণ বলে-“কী বুদ্ধি?” তখন বক তার বুদ্ধির কথা হরিণকে বলে-“বলে হরিণ ভাই তুমি যেন তেন প্রকারে বাঘকে বনের উত্তরদিকে থাকা কাঁঠাল গাছটার নিচে শুধু নিয়ে আসবে, তারপর যা করার আমি করব।”

   হরিণ বকের কথায় রাজি হয়। এরপর হরিণ বাঘের কাছে যায়। বাঘ হরিণকে বলে-“কী রে হরিণ আজ খাবার কোথায়?”

    হরিণ বলে-“তোমার খাবার আজ আমি অন্য জায়গায় রেখেছি। আসলে আজ অনেক খাবার পেয়েছি তো তাই বয়ে আনতে পারিনি। তুমি যদি সেখানে যেতে তাহলে খুব ভালো হতো।”

   বাঘ হরিণের কথায় রাজি হয়ে হরিণের সঙ্গে সঙ্গে যায়। হরিণ সেই কাঁঠাল গাছের নিচে বাঘকে নিয়ে যায়।

  বাঘ বলে-“কী রে হরিণ খাবার কোথায়?” তখন হরিণ বলে-“দুষ্টু বাঘ তুই আমার বাচ্চাকে খেয়ে ফেলে আমাকে মিথ্যা কথা বলেছিস। তোকে আমি আজ ছাড়ব না। এই জঙ্গলে আজই তোর শেষদিন।”

  বাঘ বলে-“ও তাহলে তুই সব জেনে গেছিস। এবার আমি তোকেও খেয়ে নেব।”

   তখন হরিণ বলে-“বক ভাই, এবার তোমার কাজ শুরু করো।”

   বক তখন কাঁঠাল গাছের একটা কাঁঠাল কেটে বাঘের মাথায় ফেলে।আর কাঁঠাল মাথায় পড়ায় বাঘের মাথা ফেটে যায়। মাথা ফেটে যাওয়ায় বাঘ যন্ত্রণায় ছটপট করতে করতে ওইখানেই মারা যায়। এই দেখে বক আর হরিণ খুবই খুশি হয়। কারণ বাঘ তার কর্মের উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে।

Post a Comment

0 Comments