দূর দেশের লোক গল্প-- ২৪৮
ড্রাগন মেরে রাজার জামাই
পোল্যাণ্ড (ইউরোপ)
চিন্ময় দাশ
পোল্যাণ্ডের একেবারে দক্ষিণের এলাকা। পুরো এলাকাটা ছোট-বড় পাহাড়ে ঘেরা। একটা পাহাড়ের তলায় ক্রাকোও নামে একটা গঞ্জ। ছোট ছোট গুটিকয়েক গ্রাম সেখানে। হাট-বাজার বলতে ঐ এক ক্রাকোও।
বেশ কিছুকাল হোল ভারি এক উৎপাত শুরু হয়েছে এলাকাটায়। কোথা থেকে এক ড্রাগন এসে হাজির হয়েছে পাহাড়ে। সারা রাত ধরে একটা কোনও গুহায় ঘুমায় ভোঁস ভোঁস করে। সকালের আলো ফুটলে খাবারের খোঁজে বের হয়।
মানুষজন তার ভয়ে এদিক ওদিক বেরোয় না। পাহাড়ের দিকটা তারা এড়িয়েই চলে। তবে কিনা, গেরস্তের পোষা জীবগুলোকে নিয়ে হয়েছে ঝামেলা। গরু-ভেড়াগুলো তো আর এসব বোঝে না। তারা চরতে চরতে চলেও যায় পাহাড়তলির দিকে। আর, ওদিকে যাওয়া মানেই, ঐ দানবটার পেটে যাওয়া।
গরু-ভেড়া পোষাই এখানের গরীব লোকেদের একমাত্র জীবিকা। সেসব এভাবে খোয়া গেলে, পেট চলবে কী করে? সবার মনেই ভয়। সবার মাথায় দুশ্চিন্তা।
গ্রামগুলোর একজন মোড়ল ছিল। সে বলল—এক কাজ করা যাক। চলো, সবাই মিলে দেশের রাজার কাছে যাই। তাঁকে গিয়ে বলব—আপনি দেশের রাজা। আপনি না দেখলে, প্রজাদের কে দেখবে? কিছু একটা বিহিত নিশ্চয় করবেন।
* * *
রাজামশাই সব শুনলেন মন দিয়ে। চিন্তিত হয়ে বললেন—তোমরা যাও। দেখছি কী করা যায়।
পরদিন রাজ্য জুড়ে ঢেঁড়া দিয়ে দেওয়া হোল। যে কেউ এই ড্রাগনকে নিকেশ করতে পারবে, তার সাথে রাজকন্যার বিয়ে দেওয়া হবে।
সাড়া পড়ে গেল সারা রাজ্যে। রাজার মেয়ের সাথে বিয়ে বলে কথা। চাট্টিখানি ব্যাপার না কি? এমন মওকা সহজে মেলে না। বহু যুবক ছেলে চেষ্টা করে দেখতে এগিয়ে এলো। তাদের কেউ সাহসী, কেউ বা বোকা। কিন্তু তারা কেউই ড্রাগনের গায়ে আঁচড়টিও কাটতে পারল না। দু’একজন মারাও পড়ল বেশি সাহস দেখাতে গিয়ে।
তা দেখে, আর কেউ এগিয়ে এলো না। মহা ভাবনায় পড়ে গেলেন রাজামশাই। বুড়ো মন্ত্রী বলল—শুধু বিয়ের লোভে হবে না, রাজামশাই। রাজ্যের লোভ দেখাতে হবে।
কথাটা মনে ধরল রাজার। আবার ঢ্যঁড়া পেটানো হোল—ড্রাগন নিকেশ করতে পারলে, রাজকন্যার সাথে, অর্ধেক রাজত্বও দেওয়া হবে।
লাভের লাভ কিছুই হোল না তাতেও। একজনও এল না সাহস দেখিয়ে। রাজা হাল ছেড়ে দিলেন হতাশ হয়ে।
রাজবাড়ির বাইরে ছিল এক মুচি। নাম—স্কুবা। বয়সে যুবক। ভারি অভাবী ছেলে। তবে, ছেলেটি বেশ বুদ্ধিমান। তার ভারি মনে ধরল ঘোষণাটা। অর্ধেক রাজত্ব বলে কথা। বুড়ো মা-বাবাকে নিয়ে তিনজনের সংসার তার। কারুরই দু’বেলা পেট ভরে না ভালো করে।
স্কুবা এসে হাজির হোল রাজবাড়িতে। দেউড়ির সেপাই তো হেসে বাঁচে না তাকে দেখে—কতো কতো বীর গেল। শেষে তোমার সাধ হয়েছে ড্রাগনের পেটে যেতে?
--সে আমি বুঝব। তোমাকে ভাবতে হবে না।
সেপাই নাছোড়বান্দা। কিছুতেই ভেতরে যতে দেবে না। ছেলেটা বলল—কটা মাথা তোমার ঘাড়ে?
--কেন, কেন? মাথার হিসাবে দিয়ে কী হবে।
--আমাকে ফিরিয়ে দিলে, রাজামশাই তোমার মুণ্ডু কেটে নেবে, সেটা জানো না?
ঘাবড়ে গিয়েছে সেপাই। কী দরকার ঝামেলায় গিয়ে! দরজা ছেড়ে দাঁড়াল। স্কুবা ভেতরে গিয়ে লম্বা করে একটা সেলাম ঠুকল রাজাকে। বিনয় করে বলল—আমাকে একটা সুযোগ দিন। আমি পারবো কাজটা করতে।
দরবার শুদ্ধ সবাই হেসে উঠল হো-হো করে। কিন্তু রাজা তখন নিরূপায়। খড়কুটো পেলেও, তাই ধরে বাঁচতে চান। ভাবলেন, দেখাই যাক না, পারে কি না। সাধারণ বলে কাউকে হেলাফেলা করতে নাই।
রাজামশাই বললেন—ড্রাগন মারা বলে কথা। বলো, কী অস্ত্র চাই তোমার? যা চাইবে, তাই দেওয়া হবে তোমাকে।
স্কুবা বলল—বিশেষ কিছু নয়। একটা ভেড়ার চামড়া। এক থলে বন্দুকের বারুদ। আর, এক পুঁটলি সরষের দানা।
শুনে রাজামশাই থ। এই দিয়ে তুমি ভয়াণক ড্রাগনকে মারবে?
--হুজুর, বলবানের সাথে গায়ের জোরে জেতা যাবে না। লড়তে হবে মগজ দিয়ে। স্কুবার গলায় বিশ্বাসের ছোঁয়া।
--আর কোনও অস্ত্র লাগবে না তোমার?
--আমার নিজের অস্ত্র তো আছেই আমার সাথে। একটা সূঁচ আর খানিকটা সূতো।
রাজামশাই কথা বাড়ালেন না। চাহিদা মতো তিনটি জিনিষ দিয়ে দিলেন ছেলেটিকে। ভেড়ার চামড়াকে সেলাই করে, তাতে ঠেসে ঠেসে বারুদ ভরে দিল স্কুবা। সরষের পুঁটলিটা উপুড় করে ঢেলে দিল ওপরে। রাজাকে সেলাম ঠুকে বেরিয়ে গেল রাজবাড়ি থেকে।
ভোর হতে খানিকটা দেরি। ড্রাগনের পাহাড়ে এসে হাজির হোল স্কুবা। সেলাই করা চামড়াটা দেখতে হয়েছে অবিকল একটা ভেড়ার মতো। গুহার মুখে সেটাকে রেখে দিয়ে, নিজে একটা ঝোপের আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে রইল।
খানিক বাদে সকাল হোল। সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ে পাহাড়ে। গুহা থেকে বেরিয়েছে ড্রাগন। সবে একটু আড়মোড়া ভেঙেছে, চোখের সামনে আস্ত একটা ভেড়া। মনে ভারি আনন্দ। সক্কাল না হতেই জলখাবার হাজির। আহা, কী সৌভাগ্য!
ইয়াব্বড় হাঁ ড্রাগনের। আর পুঁচকে একটা ভেড়া। এক গ্রাসেই গিলে ফেলেছে ভেড়াটাকে। সবে পেটে চালান হয়েছে সেটা, গলা কেমন জ্বালা করতে লেগেছে ড্রাগনের।
পেটের ভেতরেও শুরু হয়ে গেল বেদম গোলমাল। রাগে গরগর করে উঠল দৈত্যটা। ভয়াণক রাগে আগুনের হল্কা বেরুতে লাগল মুখ দিয়ে। আর সেই আগুনের ছোঁয়া প্রথমে লেগে গেল থলের ওপরে রাখা সরষের দানায়। তার পরে? তার পরে আগুন লেগে বারুদে। পেটের ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছে ড্রাগনের।
পাশেই ছিল ভিস্তুলা নামের নদীটা। জলে ঝাঁপাবে বলে, সেদিকে দৌড় লাগিয়েছে ড্রাগন। কিন্তু নদীতে পৌঁছুবার আগেই বিপদ। বিকট এক আওয়াজ। পেট ফেটে চিৎপটাং হয়ে গেল ড্রাগন বাবাজী।
আড়াল থেকে বেরিয়ে এল স্কুবা। মনে ভারি আনন্দ। বুদ্ধির খেলায় জিতে গেছে সে। ড্রাগনের জিভটা কেটে, নিজের জোব্বার পকেটে ভরে নিল। জিভ তো নয়। এখন এটাই তার কাছে অর্ধেক রাজত্ব।
পাহাড় থেকে নেমে, হাঁটতে হাঁটতে রাজবাড়ি চলেছে স্কুবা। আনন্দে নাচতে নাচতে গাঁয়ের লোকেরা চলেছে তার পিছন পিছন। রাজবাড়িতে যখন পৌঁছল, তখন দূপুর।
ভরা দরবার। জোব্বার পকেট থেকে জিভটা বের করে, রাজার পায়ের কাছে নামিয়ে দিল স্কুবা। ইয়াব্বড় জিভখানা দেখে, আনন্দে বুক ভরে গেল রাজার। ধন্য ধন্য করে উঠল গোটা দরবার।
রাজার মেয়ের বিয়ে বলে কথা! তার আয়োজন তো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। বুড়ো মন্ত্রী বলল—তুমি এখন যাও, বাছা। সাতদিন বাদে রাজামশাই গাড়ি পাঠাবেন তোমার বাড়ি। সেই গাড়ি চেপে তুমি আসবে। রাজকুমারির সাথে বিয়ে হবে তোমার।
বিয়ের আয়োজন শুরু হয়েছে। রাজ্যশুদ্ধ ঢেঁড়া পিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিয়ের ভোজসভায় রাজ্যের সব প্রজার নেমন্তন্ন।
সব কাজ চলছে। কিন্তু রাজার মুখ গোমড়া। শেষ পর্যন্ত একজন মুচি ছেলের সাথে বিয়ে হবে মেয়ের! মন্ত্রী বলল—ঢেঁড়া পিটিয়ে শর্ত দেওয়া হয়েছে, রাজামশাই। কথার খেলাপ করা, রাজার ধর্ম নয়।
অগত্যা রাজাও মাথা নেড়ে দিলেন।
এদিকে হয়েছে আর এক কাণ্ড। কেউ কিছু জানল না। আবার পাহাড়ে চড়েছে স্কুবা। ড্রাগনের শরীরটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে এদিক ওদিক। খুঁজে খুঁজে চামড়ার দুটো বড় টুকরো তুলে ঘরে ফিরে এলো সে।
সাতদিন বাদে রাজবাড়ির গাড়ি এসে দাঁড়াল স্কুবার কুঁড়েঘরের সামনে। কী তাগড়াই চেহারা ঘোড়া দুটোর। চোখ ধাঁধিয়ে যায় তাদের জেল্লায়। গাড়িটাও কী সুন্দর ঝলমলে করে সাজানো।
ভারি যত্ন করে, সাতদিন ধরে এক জোড়া জুতো বানিয়েছিল স্কুবা। জুতো জোড়া সাথে নিয়ে, চেপে বসল গাড়িতে। মুচির ছেলে চলেছে রাজার জামাই হতে।
বিয়ের আসরে নিজের হাতে রাজকুমারির পায়ে জুতো দুটো পরিয়ে দিল স্কুবা। রাজামশাই চেয়ে আছেন ফ্যালফ্যাল করে।
স্কুবা বলল—ড্রাগনের চামড়ায় বানানো জুতো পায়ে পরেছে, এমন রাজকুমারি আর আছে না কি দুনিয়ায়?
আনন্দে হই হই করে উঠল সকলে। ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল মুচির ছেলের।
0 Comments