জ্বলদর্চি

দূর দেশের লোকগল্প-- ২১৮/ যাদু পালঙ্ক ব্রহ্মদেশ (এশিয়া)/চিন্ময় দাশ

দূর দেশের লোকগল্প-- ২১৮  

যাদু পালঙ্ক 

ব্রহ্মদেশ (এশিয়া)

চিন্ময় দাশ


এক গাঁয়ে সাত ভাই বাস করত একটা বাড়িতে। কিন্তু একসাথে থাকলে কি হবে, সাতজনে তারা স্বভাবে সাত রকম। এক রকম ছিলই না। সংসার চালাবার জন্য তারা সবাই হাড়ভাঙ্গা খাটনি খাটতো সারাদিন। কিন্তু ছোট ভাইটি কুটোটিও নাড়াত না সংসারে। আসলে স্বভাবে সে ছিল অলস। বড় ভাইরা প্রায় দিনই তাকে কত বোঝাতো। পরামর্শ দিত। একটু কাজকর্ম কর। নইলে চলবে কী করে?

কিন্তু সেসব কথায় কানই দিত না ছেলেটা। সে শুধু খায়, ঘুমায় আর ঘুরে বেড়ায়। একদিন বড়ভাই তার বউকে ডেকে বলে দিল-- ছোট ঘরে ফিরলে বলে দিও, এখানে তার খাওয়া জুটবে না। 

সন্ধ্যা হলে যথারীতি ঘরে ফিরে ছোটভাই বলল—বৌদি, খেতে দাও। 

বৌদি বলল-- এ বাড়িতে তোমার আর ভাত নাই। 

একথা শুনে ছোটর তো মাথায় আগুন জ্বলে গেল। এমন কথা সে আগে কোনদিন শোনেনি। এ বাড়িতে আর নয়। এই ভেবে সে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। 

যেতে যেতে এক গাঁয়ে এসে হাজির। সেখানে এক পাড়াতে একজন ছুতোর মিস্ত্রি বসে কাজ করছিল। ছেলেটি তার কাছে কিছু খাওয়ার দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলো। সারাদিন কিছু পেটে পড়েনি তার। 

লোকটা ছিল দয়ালু। খেতে দিল তাই নয়, সব শুনে ছেলেটিকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিল ছুতোর। বাড়িতে তিনটি প্রাণী। তারা স্বামী-স্ত্রী আর তাদের একটি মেয়ে। 

ছেলেটিকে পেয়ে ছুতোরের বউও খুব খুশি। বাড়ির ছেলের মতই আদর যত্নে রইল সে। আর একটু একটু করে ছুতোরের কাজে হাত লাগাতে শুরু করল।

ঘরে মেয়ে ছিল ছুতোরের। ছেলেটির স্বভাব শুধরেছে দেখে, ছুতোর আর তার বউ ভারি খুশি। মেয়ের বিয়ে দিল ছেলেটির সাথে। 

🍂

একদিন ছুতোর বলল-- বাবু হে, এ বাড়িতে আর নয়। তোমরা নিজের পথ দেখো। তোমাদের এ কথা বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে। তবে কিনা তাতে আখেরে তোমাদের ভালই হবে ভেবে, বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে আমাকে। 

মেয়ে জামাই দুজনকেই ঘর থেকে রওণা করে দিল সে। আসলে ছুতোর কিন্তু অমানুষও নয়, অবিবেচকও নয়। একটা থলে ভর্তি যন্ত্র ছেলেটির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল-- এটা তোমাকে আমি মেয়ের বিয়ের পণ হিসাবে দিলাম। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি তো। কিছু পণ তো দিতেই হয়। এই যন্ত্রপাতি কাজে লাগালে, তুমি নিজের পায়ে ঠিক দাঁড়াতে পারবে। 

মেয়েটি ছিল বেশ বুদ্ধিমতী। সে বুঝলো, এবার তাকে কী করতে হবে। পথে যেতে যেতে, এক নদীর ধারে জঙ্গলের মুখে এসে পড়েছে তারা। মেয়েটি বলল—এসো, এখানেই আমরা ঘর বসাই। 

এই বলে, সে স্বামীকে বলল—যাও, জঙ্গলে কাঠ-কুটো কেটে আনো। 

ঘর বানানো হলো। দুটো একটা দিন কাটল বনের ফলমূল খেয়ে। তৃতীয় দিনে মেয়েটি বলল—চুপ করে বসে থাকলে, অনাহারে মরতে হবে। আমার বাপু অনাহার সইবে না পেটে। কাজ হাত লাগাও তুমি। 

বনের কাঠ কেটে আনা হোল। যন্ত্রপাতি তো শ্বশুর দিয়েছিলই। ছেলেটা কাজে লেগে গেল। দিন কয়েক বাদে কাজ সারা হোল যখন, দারুণ সুন্দর একটা পালঙ্ক তৈরি হয়েছে। 

পালঙ্ক দেখে তার বউ তো যার পর নাই খুশি। মুগ্ধ হয়ে গেল একেবারে। বলল—ওগো, একে তুমি আজই হাটে নিয়ে যাও। নিশ্চয়ই ভালো দাম পাওয়া যাবে বিক্রি করলে। 

ছেলেটি পালঙ্ক নিয়ে হাটে এসে হাজির হলো। কাঠের কাজ যে দেখে, সেই মুগ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ভয়ে কেউ তারা দাম জিজ্ঞাসা করে না। তারা গরীবগুরবো মানুষ। নিশ্চয়ই এ খাটের দাম অনেক বেশি হবে। সবাই খাট দেখে, আর প্রশংসা করতে করতে সরে চলে যায়।

হাট ভাঙার সময় হল যখন, রাজার কর্মচারীরা হাটে এসে হাজির। এদেশের নিয়ম হলো, হাটে যা কিছু জিনিষ বিক্রি হবে না, দেশের রাজা সব কিনে নেবেন। রাজার কর্মচারীরা এমন খাট এর আগে কখনো এখানে দেখেনি। তারাও খুশি। সাথে সাথে তারা রাজার জন্য খাটটি কিনে নিল। খাটের সাথে তার কারিকরকেও সাথে নিয়ে চলল তারা।

পালঙ্ক দেখে, শোরগোল পড়ে গেছে রাজধানীতে। রাজবাড়ীতে ঢুকতে সবাই অবাক। রাজার মুখে আলো ফুটে উঠল। রানিকে বললেন-- প্রথম দিন।  আজ তুমি প্রথমে পালঙ্কে ঘুমাও। 

রানি বাঁকা হেঁসে বললেন—আরে, তাই কি হয়! তুমি হলে দেশের রাজা। সব জিনিষেই তোমার সবার আগে অধিকার। তুমি ঘুমাও।

রাজামশাই শুয়েছেন পালঙ্কে। রাত নিঝুম। হঠাৎ পালঙ্ক নড়ে উঠেছে। রাজার ঘুম গেল ভেঙে। শুনলেন, খাটের পায়ারা কথা বলছে। দুটো পায়া বলছে—নতুন জায়গা। রাজবাড়িটা এই সময় একবার ঘুরে দেখে আসি আমরা। 

বাকি দুটো বলল—তাড়াতাড়ি এসো। তোমরা ফিরলে, আমরা দু’জন একবার বেরোব।

খানিক বাদে ফিরে এলো দুজন। রাজামশাই তো জেগেই আছেন। পায়া দুটো বলছ—কী ভয়ানক কাণ্ড। খুন করার চক্রান্ত চলছে রাজবাড়িতে।

বাকি দুজন বলল—সে কী হে? কে কাকে খুন করবে?

--কে আবার? স্বয়ং রানি। সেনাপতির সাথে সট করেছে। বিষ খাইয়ে মারবেন রাজামশাইকে। 

অন্য দুজন বলল—এবার আমরা একবার ঘুরে আসি। কিছু জানা যায় কি না। 

কথা সরছে না রাজার মুখে। চুপ করে শুয়ে আছেন। কিছুক্ষণ বাদে পায়া দুটো ফির এল। তারা বলল—বিষ খেয়ে মরতে হবে না রাজামশাইকে। তার আগেই মারা পড়বেন তিনি।

--কীভাবে মরবেন গো?

--নাগরা জুতো খুলে শুয়েছেন তিনি। সেই জুতোর ভেতরেই তো কালনাগিনী ঢুকে বসে আছে। পালঙ্ক থেকে নেমে জুতোয় পা গলাবেন। সাথে সাথেই মৃত্যু।

ভয়ে বুক কাঁপছে রাজার। পাহারাদার সেপাই ছিল দরজার বাইরে। তাকে বললেন—আমার নাগরা জোড়া নাড়িয়ে দ্যাখ তো।

বল্লমের খোঁচা খেয়ে, সত্যি সত্যিই ফোঁস করে একটা সাপ বেরিয়ে এলো। 

রাজামশাই এক সেপাইকে বললেন-- এক্ষুনি যা। যে অবস্থায় আছে, রানিকে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে আসবি।

রানিকে ধরে আনা হলো। সেনাপতিকেও। রাজামশাই নিজে রানীর পালঙ্ক তুলে দেখলেন, সেখানে আস্ত একটা বিষের শিশি।

রানী ঠক ঠক করে কাঁপছে ভয়ে। রাজামশাই বললেন—হায়, হায়। এ সংসারে বিশ্বাসের কোন মূল্য নাই। 

রানি আর সেনাপতি সাফাই গাইতে শুরু করেছিল। বিষের শিশি দেখে, মুখ শুকিয়ে গেছে দুজনের। রাজা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন-- তোমাদের বিষ দিয়ে মারব না আমি। মরণ কূয়ায় ফেলে দে দুটোকে। তিলে তিলে দগ্ধে মরবে এরা।

এবার ডাক পড়ল ছেলেটার। রাজামশাই বললেন-- তোমার এই পালঙ্কের দৌলতে প্রাণ বেঁচেছে আমার। মান বেঁচেছে, রাজ্যও বেঁচেছে। আমি পুরস্কার দেব তোমাকে।

ছেলেটি চুপ করে আছে। দামটুকু পেলেই সে খুশি। অন্য লোভ নাই তার। রাজা বললেন-- তুমি নিজের মুখে না চাইলে, আমি যা দেব, তাই নেবে? মুখে কী বলবে ছেলেটি? ভয়ে ভয়ে মাথা নেড়ে দিয়েছে। 

রাজা হাসি মুখে বললেন-- ছেলেপুলে নেই আমার। একটি মেয়ে। বড়টি হয়ে উঠেছে এতদিনে। তুমি আমার মেয়েকে বিয়ে করো। দু’দিন বাদে, তুমিই এই রাজ্যের মালিক হবে।

খুশি হবে কী, বেমালুম ঘাবড়ে গেছে ছেলেটি। হাতজোড় করে বলল—রাজামশাই, আমার নিজের একটি বউ আছে। একটা কুঁড়েঘরে আমরা সুখেই থাকি। তাছাড়া, এই রাজবাড়িতে থাকলে, বেমালুম অলস হয়ে যাব আমি।

শুনে রাজামশাই ভারি খুশি হলেন। বললেন-- ঠিক আছে। তবে, কিছু উপহার দিচ্ছি তোমাকে। সেটা না কোর না।  

ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, ছেলেটিকে তার গাঁয়ে পৌঁছে দেওয়া হোল। সঙ্গে অঢেল উপহারও। রাজামশাই বললেন-- যখনই দরকার পড়বে, যে কোন প্রয়োজনে, সোজা আমার কাছে চলে এসো। এ বাড়ির দরজা তোমার জন্য সারা জীবন খোলা থাকবে। 

--অবশ্যই আসবো, রাজামশাই। এই বলে লম্বা একটা সেলাম ঠুকে চলে গেল ছেলেটি।


Post a Comment

0 Comments