শিল্পী অনুপ রায়-এর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অমিত মণ্ডল
অমিত মণ্ডল: নমস্কার। প্রথমেই আপনাকে আন্তরিক শুভকামনা জানাই জ্বলদর্চি পত্রিকার তরফ থেকে। আমরা সরাসরি কথাবার্তায় প্রবেশ করি। আপনার জীবনে শিল্পী হয়ে ওঠার পথটি কেমন ছিল তা যদি সংক্ষেপে বলেন?
অনুপ রায়: আমি চিত্রশিল্পী হব সেটা আমি কোনোদিন ভাবিনি। কিন্তু আমার বাবা ছিলেন আর্ট কলেজের অধ্যাপক। বাবার ইচ্ছেতে আর নিজের অনিচ্ছাতেই গভর্মেন্ট আর্ট কলেজের অ্যাডমিশন টেস্টে বসি আর ভর্তি হবার সুযোগও পেয়ে যাই। কিন্তু সেই সময় আমি বিদ্যাসাগর কলেজে ইকনোমিক্স নিয়ে বি এ পড়ছিলাম। তাই কোনোমত দুটোকলেজেই ক্লাস করছিলাম। তবে মিথ্যে বলব না, আর্ট কলেজ খুব একটা ভালো লাগছিল না। তার ফলে আর্ট কলেজের প্রথম বর্ষের পরীক্ষার ফল খুব একটা ভালো হয়নি। সেই সময় একদিন অধ্যাপক শ্রী সুনীল পাল মহাশয় আমাকে ডেকে বলেন যে, যদি মন দিয়ে ক্লাস করতে পারো তবেই কলেজে থেকো, না হলে কলেজ ছেড়ে দাও। তোমার বাবাকে অসম্মান করার কোনোরকম অধিকার তোমার নেই। অধ্যাপক মহাশয়ের কথাগুলো আমাকে মানসিকভাবে খুব ধাক্কা দেয়। তখন থেকেই আমি অপরাধবোধে ভুগতে থাকি আর মনে মনে নিজেকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করতে থাকি। এই চেষ্টার ফল স্বরূপ আমি দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষায় প্রথম পাঁচজনের মধ্যে একজন হই। তৃতীয় বর্ষ থেকে আমি প্রথম স্থান পেয়ে পাশ করে বেরোই।
আমি যখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র তখন ‘ALL INDIA RECORD COVER COMPITITION’ হয়েছিল। আমি সেই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করি ও তাতে প্রথম হই। কলেজের শেষ বর্ষে আমি ক্লাস করার সাথে সাথে একটা এজেন্সিতে কাজ করতাম। সাতাত্তর সালে কলেজ শেষ করে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে এজেন্সিতে কাজ করতে শুরু করি ও সাথে নানান জায়গায় ইন্টারভিউ দিতে থাকি। এইভাবেই একদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় ডাক পেলাম। আনন্দবাজারে চাকরি পাওয়ার খবরটা জানালাম ধৃতিমানদাকে। উনি শুনে বললেন ‘তুমি যাও, ভালো না লাগলে ফিরে এসো’। এরপর আমি আনন্দবাজারে যোগ দিলাম। একবছর পরে আমাকে দিল্লীতে বদলি করে দিল। দুই বছর দিল্লীতে খুব আনন্দের সাথে কাজ করছিলাম। কিন্তু আবার আমাকে প্রমোশন দিয়ে কলকাতায় নিয়ে এল আনন্দবাজার। এর কিছুদিনের মধ্যেই ‘THE TELEGRAPH’ প্রকাশ হওয়া শুরু হল। এরপর ১৯৯০ সালে Assistent Art Director হলাম। এর কয়েক বছর বাদে Art Director হলাম। এই সব কাজ করতে করতে দর্শককুলের মনে ভালোবাসার জায়গা আমাকে শিল্পী করে তুলেছে।
অমিত: ছেলেবেলার এমন কোনো স্মৃতি মনে পড়ে যার মধ্যে ভবিষ্যতে শিল্পী হওয়ার সম্ভাবনা খুঁজে পান?
অনুপ: বেশ কিছু বছর ধরে একটা প্রচলন হয়েছে যে বাবা মায়েরা তাদের সন্তানদের ছবি আঁকা শেখানোর ক্লাসে ভর্তি করে। আমাদের সময় এই প্রচলন ছিল না। কিন্তু আমরা দুই ভাই ছোট থেকে বাবাকে ছবি আঁকতে দেখে বড় হয়েছি। তাই একটু-আধটু আমরাও আঁকতে পারতাম। আমরা বড় হয়েছি বাগমারী অঞ্চলে। সোনালী শিবির নামে তখন একটা ক্লাব ছিল, ক্লাবটা এখনও বিদ্যমান। এই ক্লাবের তরফ থেকে অনেক পত্র পত্রিকা প্রকাশিত হত। সেগুলোর প্রচ্ছদ আমিই এঁকে দিতাম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শতবার্ষিকী উপলক্ষে যে পত্রিকাটা প্রকাশিত হয়েছিল সেখানে অনেক ছোটরা কবিগুরুর ছবি এঁকেছিল। আমি ও আমার দাদা এই পত্রিকাতে কবিগুরুর ছবি এঁকে দিয়েছিলাম। দাদার ছবি প্রথম ও আমি দ্বিতীয় হয়েছিলাম। তারপর থেকেই মাঝেমধ্যে ছবি আঁকা চলছিল। ওই বয়সে শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন আমি কখনো দেখিনি। আমার বাবা হয়তো আমার মধ্যে সেই সম্ভাবনা দেখেছিলেন তাই একপ্রকার জোর করেই আমাকে আর্ট কলেজে ভর্তি করেছিলেন।
অমিত: শিল্পজীবনে আপনার অনুপ্রেরণা কী? শিল্পের রসদ আপনি কোথা থেকে পান?
অনুপ: শিল্পজীবনের আমার প্রথম ও প্রধান অনুপ্রেরণা পেয়েছি বাবার কাছ থেকে। শিল্পের রসদ আমি পাই আমার বাবার কাজ, অধ্যাপক বিকাশ বাবু, অধ্যাপক গণেশ হালুই মহাশয়ের কাজ থেকে। এছাড়া এম এফ হুসেন, গণেশ পাইন মহাশয়ের কাজ আমাকে ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করেছে। বিদেশী Victor Amburs আমার খুব পছন্দের।
অমিত: একজন চিত্রশিল্পী ও একজন প্রচ্ছদশিল্পীর মধ্যে কী কী সাদৃশ্য কিংবা বৈসাদৃশ্য আপনি দেখতে পান?
অনুপ: আমি একজন চিত্রশিল্পী ও একজন প্রচ্ছদশিল্পীর মধ্যে কোনোরকম সাদৃশ্য কিংবা বৈসাদৃশ্য দেখতে পাই না।
অমিত: বড় সংবাদপত্রে কাজ করলে শিল্পীসত্তার কোনো সমস্যা হয় বলে আপনি মনে করেন?
অনুপ: না, আমি কোনো রকম সমস্যা হয় বলে আমি মনে করি না।
অমিত: আপনি যখন কোনো বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকেন, তখন কী কী বিষয় মাথায় রাখেন?
অনুপ: বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকার আগে আমাদের প্রত্যেককেই বইয়ের বিষয়বস্তুটা জানতে হয়, চরিত্রগুলোর বিশ্লেষণ করেই প্রচ্ছদ আঁকাতে হয়।
অমিত: আপনি তো অনেক কার্টুন এঁকেছেন। কার্টুন আঁকার জন্য কি আলাদা একটি মনের দরকার? আপনার প্রিয় কার্টুনিস্ট কে?
অনুপ: কার্টুন আঁকার আগে কী বিষয়ের উপর কার্টুন আঁকতে হবে সেটা ভালো করে অনুধাবন করতে হয়। আমার প্রিয় কার্টুনিস্ট হলেন R K Laxman।
অমিত: আজকের ডিজিটালের যুগে হাতে আঁকার পাশাপাশি ডিজিটালে আঁকা সমান তালে চলছে। এই সহাবস্থানকে আপনি কীভাবে দেখেন?
অনুপ: আমি ডিজিটালি ছবি আঁকতে পারি না। তাই আমার সেটা নিয়ে সমালোচনা করার অধিকার আছে বলে আমি মনে করি না। আমার বেশ কিছু ছাত্র আমার কাছে ছবি আঁকা শিখেও সুন্দর ছবি আঁকছে ডিজিটালি।
অমিত: AI -কে এখন বর্ণনা দিয়ে দিলে সে যেকোনো আর্ট ফর্মে আপনার সামনে হাজির করবে একটি ছবি প্রায় কোনো পরিশ্রম বা ভাবনার গভীরতা ছাড়াই৷ আপনি এ নিয়ে কিছু ভেবেছেন কখনো?
অনুপ: না, আমি এই নিয়ে কখনো কিছু ভাবিনি।
অমিত: আপনার আঁকার নিজস্ব মৌলিক ঘরানা নিয়ে আপনি যদি কিছু বলেন।
অনুপ: ছবি আঁকতে আঁকতে সকলের মতো হয়তো আমারও একটা ঘরানা তৈরী হয়েছে, যেটার জন্যে লোকে হয়তো আমাকে অল্পবিস্তর চেনে এখন। আমার ঘরানা নিয়ে আমার কোনো কথা বলা মানায় না, সেটা বলবে আমার ছবির দর্শকেরা।
অমিত : লিটল ম্যাগাজিনের অনেক প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন। আজকের দিনের লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে আপনার কোনো পরামর্শ আছে?
অনুপ : আমাকে যে যখন ছবি এঁকে দিতে বলেছেন আমি যতটা সম্ভব এঁকে দিয়েছি। কিন্তু আজকের লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে কোনো রকম পরামর্শ আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না।
অমিত: বাম হাতে কেন কীভাবে আঁকা শুরু করলেন?
অনুপ: ২০১৮ সালের ১২ মার্চ মাসে আমার cerebral attack হয় ও আমার ডান পাশটা অসাড় হয়ে যায়। ৫ এপ্রিল বাড়ি ফিরে আসি হাসপাতাল থেকে ঠিকই তবে তারপরেও একটা মাস আমি ছবি আঁকতে পারিনি। তারপর ২০১৮ সালের ৯ মে আমি আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম কাগজ পেনসিল দিতে। হাতে কাগজ পেনসিল পাওয়ার পর বাম হাত দিয়ে ছবি আঁকার চেষ্টা করলাম, প্রথমে একটা ফিগার আঁকতে পারলাম তারপর আরেকটাও আঁকলাম। এইভাবে একটা গোটা ছবি এঁকে ফেলতে পেরেছিলাম। তারপর থেকে রোজই আঁকা অভ্যাস করতে শুরু করেছিলাম।
অমিত: আপনার আগামীতে কোনও পরিকল্পনা আছে আপনার কাজ নিয়ে? বা অতীতে এমন কোনো পরিকল্পনা ছিল যা হয়ে ওঠেনি কোনো কারণে?
অনুপ: যখন সুস্থ ছিলাম তখন আমার অনেক পরিকল্পনা ছিল আমার কাজ নিয়ে। সেসব করে উঠতে পারিনি। আর বর্তমানে এই শরীরে আর কোনোরকম পরিকল্পনা করতে পারি না।
অমিত: সবশেষে জানতে চাই, শিল্প আপনার কাছে কী?
অনুপ: শিল্প আমার কাছে সাধনা। সাধনা ছাড়া জীবনে কেউ কিছু করতে পারে না।।
অমিত: ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকবেন।
অনুপ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
0 Comments