তনুশ্রী ভট্টাচার্য্য
দুর্গাদালানে এ আই (A.I.)
মহালয়ার দেবীভোর না কি
চাররাত হূল্লোড়,
এক পলকের একটু দেখা না কি
নতুন জুতোয় ফোস্কা
সপ্তমীর অঞ্জলি সকাল না কি
নতুনপ্রেমে টালমাটাল।
পুজো মানে ওপরের সব কিছুই।
আমি তখন নবম শ্রেণী/ আমি তখন শাড়ি
আলতো পায়ে কিশোরী উঠোনে করি কাড়াকাড়ি--- শিউলি ফুলের ভাগ নিয়ে_--- ভাই বোনের সঙ্গে। খুব ভোরে উঠে কে কত ঝুড়ি শিউলি ফুল কুড়িয়ে নিয়ে বাড়ির দুগ্গা দালানে দিয়ে আসতে পারবে তাই নিয়েই কাড়াকাড়ি। পুজো আসবে গ্রামের শিউলিতলায়, স্থলপদ্মের বাগানে,দামোদরের চরে কাশ বনে, ঢলঢলে কালো দীঘির জলে-- আর চতুর্দশী কিশোরীর চোখ এড়িয়ে যাবে , মন ছুঁয়ে যাবে না তাও কি হয়! চঞ্চলা হরিণীর মতো নিরুদ্বেগ সে বালিকা ধীরগতিতে কখন যেন ছুঁয়ে ফেলছে কিশোরী বয়স। মর্ত্যের পারিজাতের মতো সাদাপাপড়ি আর হলুদবোঁটার আহ্লাদিনী রূপ --- টুপটুপ ঝরে আশ্বিনের ভোরে-----যার ডাক নাম শিউলিফুল । শিউলির শপথ নিচ্ছে কিশোরী অভিমান আর আগ্রহ। টিং টিং টপ, হিং টিং ছট। আর সেই আগ্রহের বারুদে তুবড়ি জ্বালিয়ে ফুলকি ছুটিয়ে ম ম কিশোরী সুবাস ছড়িয়ে পড়ে লেবুতলায় ছাতিম তলায় আর দুগ্গা মন্ডপে। কিশোরীর ঔৎসুক্য। সে বড় দুর্মর। চারখানা গ্রাম আর আশ্বিনের যৌবনবতী একটা নদী পেরিয়ে স্কুল যেতে আসতে অবশ্যই সাত আটটা ঠাকুরের দালান পড়ে। কোনটা বাড়ির, কোনটা ক্লাবের, কোনটা বা জমিদার বাড়ির। কোনটা রাস্তার ধারে মন্ডপ করে কোনটা বা একটু পাড়ার ভেতর।কোনটা বা এক জীর্ণ দালানে। সেই গ্রামে বাবুদের জমিদার বাড়ির পেল্লায় দালান। কথা প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে এত্ত বড় সে দালান । সেখানে চুপি চুপি পা টিপে টিপে ছুটির পরে ছয় বন্ধু মিলে প্রতিমার এক মেটে থেকেই ঢুঁ মারা। মাত্র ৫ মিনিট। কিন্তু যেতেই হবে নিয়ম করে। স্কুল ফেরত। জন্মাষ্টমীতে নদী থেকে মাটি ওঠে মা দুর্গার মুর্তি গড়ার জন্য। এরপর থেকে সব সব দেখা চাই পঞ্চমীর দিন সকালে পুজোর ছুটি না পড়া পর্যন্ত।স্টেপ বাই স্টেপ। প্রথমে শুধুই খড়ের কাঠামো। কবে একমেটে হবে,তারপর দোমেটে ,খড়ি,রঙ,রাংতা কাপড়পরানো মুকুট,চোখআঁকা, ডাকের সাজ ----সবসব দেখা চাই। ও:কী সে উৎসাহ! কী সে চাপা টেনশন! ত্রিনয়ন কি তখনও জানা হয় নি। জমিদার বাড়িতে কবে মা দুগ্গার গায়ে রঙ চাপবে তাই নিয়ে বাজি ধরা হোত বন্ধুদের সঙ্গে । জমিদার বাড়ির দালানের সামনে পেল্লাই ইজি চেয়ারে বসে থাকতেন ছোট বাবু (গত শতাব্দীর আটের দশক-- শেষ জমিদার।) উদগ্র কৌতূহল চাপতে না পেরে ছোট বাবুকেই সাহস করে প্রশ্ন করে ফেলত সে সাদা সবুজ স্কুল ইউনিফর্মের কন্যা। ফর্সা টকটকে ষাটোর্দ্ধ পক্বকেশ ছোট বাবুর সামনে কে প্রশ্ন রাখতে পারবে তার একটা মহড়া চলতো বন্ধুদের মধ্যে। সে কন্যাশ্রী আমি দুরন্ত এবং ভালো আবৃত্তি করতে পারতাম। তাই সুন্দর করে জিজ্ঞাসা করতাম ---ছোট বাবু, কবে মা দুর্গার গায়ে রং পড়বে ? "তুমি মাস্টারের মেয়ে না ?বেশ সাহস তো তোমার, একটা কবিতা শোনাও তোমার কথার উত্তর দেবো---মিষ্টি গলায় বলতেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে আমি "সেদিন শারদ দিবা অবসান / শ্রীমতি নামে সে দাসী/ পুণ্য শীতল সলিলে নাহিয়া পুস্প প্রদীপ থালায় বাহিয়া রাজমহিষীর চরণে চাহিয়া নীরবে দাঁড়ালো আসি"---, শুরু করে দিতাম রবীন্দ্রনাথের "পূজারিণী। শুনে তিনি খুশি হয়ে বলতেন "যাও ওই ঠাকুরগড়ার ভাস্কর কে জিজ্ঞাসা করে নাও।" যে ঠাকুর গড়ে তাকে যে ভাস্কর বলে তা ওই ছোট বাবুর কাছ থেকেই শিখেছিলাম।
পঞ্চমীর দিন সকাল স্কুল। পুজাবকাশে পরীক্ষার পড়া বুঝে নেওয়া আর ছুটির পরে আর
একবার বন্ধুদের সঙ্গে মন্ডপে উঁকি দেওয়ার পর্ব। দিতেই হবে ।
সেবার দেখলাম জমিদারদের পুজা মন্ডপ সাজানো হচ্ছে। তদারকি করছেন এক যুবক। ঝকমকে। ব্রিলিয়ান্ট। ইন্টেলিজেন্সে দীপ্ত মুখমন্ডল। গ্ল্যামারাস। শুরু হল নিজেদের মধ্যে ফিসফাস। ছোট বাবু বললেন "ও আমার ছোট ছেলে মাল্যবান । শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে সদ্য বিটেক পাস করে এসেছে। পুজোয় ওর খুব আগ্রহ। ওকে দেখে আমাদেরও আগ্রহ বেড়ে গেল। চাপা টেনশন। সদ্য নবম শ্রেণীর কিশোরীর কৌতূহল পৃথিবী কেমন করে মোকাবিলা করে জানা নেই। মনে হলো জানতে হবে, জানতে হবে-- যেমন করে অঙ্ক বইয়ে উপপাদ্য জানি, ইতিহাস বইয়ে ভারতছাড় আন্দোলন জানি তেমন করে এই মনের ঘুর্ণি কে জানতে হবে, জানতে হবে হৃদয়ের আন্দোলন। কেমন মানুষ, কবে এলো, কতদিন থাকবে, কোথায় চাকরি করে, কেমন করে কথা বলে, কেমন তার কন্ঠস্বর। ভয়ে কেঁপে যাচ্ছে হাতপা তবু আগ্রহ কমে নি এতটুকু। দুর্গাঠাকুর যত না দেখি ততদেখি সে ইন্দ্রপুরুষকে।
তারপর? তারপর কখন যেন আগ্রহ মিলিয়ে গেল ভেজা বারুদের মতো। কে কোথায় ভেসে গেল, চলে গেল, দৌড়ল, পথ হারালো, পথ খুঁজে পেল-- সে কেবল মা দুগ্গাই জানল। আমার আর জানা হল না। নিজের পায়ে দাঁড়ানো, উচ্চ শিক্ষা পেশা সংসার সব মিলিয়ে সেই জমিদার বাড়ি থেকে আজ অনেক দূরে। মনের ফাঁকে যদি বা অবসর মেলে সেই স্কুল বেলায় ফিরে যাওয়া,সেই দুগ্গা মন্ডপ ,মায়ের ত্রিনয়ন দর্শন আর সেই দালান আলো করা শিবপুরের ইঞ্জিনিয়ার। শিউলির টুপটাপ আজও চোখে ভাসে। ভাসবেই । দুগ্গা মায়ের অমোঘ টান । চুলের রুপালি রেখায় বয়স ছোটে।, ফি বছর মা আসেন মন্ডপে। মায়ের তো চুল পাকে না, শরীরে মেদ জমে না, কপালে বলিরেখা পড়ে না--- তিনি যে অনন্তযৌবনা।! কিন্তু মানুষের ত সে উপায় নেই!
শুনেছি তিনি বিদেশে মস্ত ব্যবসায়ী। মহাকাশ গবেষণার সরঞ্জামের ব্যবসা। তিনিও ফি বছর মন্ডপে আসেন তবে সশরীরে নয়---ভার্চুয়াল।
🍂
এবছর হঠাৎই যেন কোনো হংসবলাকার ঠোঁটে এল আমার আমন্ত্রণ। সেই জমিদার বাড়ি থেকে। পুজো দেখতে যাওয়ার। কী আশ্চর্য। এও কি সম্ভব?
এ ডাক কি সেই তরুণের? কিন্তু সে তো এতদিনে পক্ককেশ বা ইন্দ্রলুপ্ত ষাটোর্ধ্ব প্রৌঢ়? সেই ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে দেখা হবে দুর্গাদালানে? মনটা অনচান করে উঠল।
কিন্তু না। সশরীরে নয়।
এ আই প্রযুক্তিতে দেখব তাকে। কৃত্রিম মেধার ছটায়।
দেখলাম তাঁকে। ঠিক সেইরকম --- চল্লিশ বছর আগে যেমন দেখেছিলাম। ঝকঝকে। মেধাদীপ্ত অবয়ব। নেই কোনো প্রৌঢ়ত্বের ছাপ, ষাটোর্ধ্ব তরুণ। মন দিয়ে দেখছিলাম তাঁকে আমার পুঁচকে নাতনীর সাহচর্যে। ও বাড়ির আদর আপ্যায়নে এখনো আভিজাত্য আষ্টেপৃষ্ঠে মিশে আছে। দার্জিলিং চায়ের সুগন্ধী পেয়ালায় চুমুক দিতে যাচ্ছি হঠাৎই চমকে উঠলাম। চলকে পড়ল চা আমার তসরের শাড়িতে। এ কী ! এ কে? চিনি মনে হচ্ছে! ভারী পাওয়ারের চশমাটা খুলে মুছে আবার পরে দেখলাম আমাকেই------- হ্যাঁ নিজেকেই দেখলাম কোনো ভুল হচ্ছেনা --অনস্ক্রীন দেখছি নিজেকে ---- নবম শ্রেণীর ছটফটে কিশোরী সেই 'আমিকে'। দুর্গাদালানে এ আই---A I.
শুধু আমি নয় ---হাজির সেই বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর সাদাসবুজ শাড়ীর কিশোরী দল,তেমনই পানপাতার মতো তাদের মুখগুলি ঢলঢলে , পরিপাটি তেলমসৃণ চুলবিনুনী --কী আশ্চর্য ! ঐ তো রুনাই ঝুনাই মণিমালা কাজল কৃষ্ণা!!! ঐ তো সেই পক্ককেশ রাজসিক ছোটোজমিদার সোনাবাবু। এখনো তেমনটাই টানটান রোদপিছলানো উজ্জ্বল ত্বক নিয়ে ইজিচেয়ারে বসে মুচকি হাসছেন আমাদের দেখে---সব্বাই এখন বাবুদের দুগ্গাদালানে ---এ আই য়ের দৌলতে ---
চোখ থেকে একফোঁটা জল নেমে এল বাম চিবুক বেয়ে। সপ্তমীর সন্ধ্যারতির প্রদীপ শিখাতে মিলিয়ে যাচ্ছে লুকিয়ে রাখা অশ্রু রেখা। অবশ্য এ আই এটা ধরতে পারেনি।
0 Comments