সাহিত্যিক সুবর্ণ বসুর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায়
অয়ন বন্দ্যোপাধ্যায় : আপনার সাহিত্য-প্রীতির প্রেক্ষিতটা একটু বলুন। ছেলেবেলা থেকেই কি বইপড়ার নেশা, সাহিত্য-সম্বন্ধে আগ্রহ?
সুবর্ণ বসু: আমার বাড়িতে সে ভাবে গল্পের বইপত্র পড়ার চল ছিল না। মায়ের মামার বাড়ির দিকে সকলেরই কম-বেশি গল্পের বই পড়ার ঝোঁক ছিল। গল্পের বইটা আমার জীবনের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন আমার মা। মায়ের একটা উদ্দেশ্য ছিল। আমার ছোটবেলাটা কেটেছে বেশ বড় যৌথ পরিবারে। জেঠতুতো ভাইবোনদের সঙ্গে। সকলে একজোট হলে তুমুল হইচই হত। মায়ের ভয় ছিল, ছেলে দুরন্ত না হয়ে যায়। তাই ঠিক করেছিলেন, ছেলেকে এমন একটা কিছু অভ্যেস করাতে হবে, যাতে সে শান্ত থাকে। পড়াশোনায় মনোযোগী হয়। সেই থেকেই পরিকল্পনা মাফিক আমার হাতে গল্পের বই তুলে দেওয়া। প্রথমে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, তারপর সুকুমার রায়, একটু বড় হতে সত্যজিৎ রায়। পত্রপত্রিকার মধ্যে আমি নিয়মিত পড়তাম আনন্দমেলা আর সন্দেশ। আনন্দমেলার সূত্রে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, বিমল কর, শৈলেন ঘোষ, ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়, আর সন্দেশের সূত্রে অজেয় রায়, মঞ্জিল সেন, রেবন্ত গোস্বামী, নলিনী দাশ, শিশিরকুমার মজুমদার— প্রধানত এঁরাই ছিলেন আমার ছোটবেলা জুড়ে। আর হ্যাঁ, যাঁর কথা না বললে এই সাহিত্যপ্রীতির সূচনাপর্ব সম্পূর্ণ হবে না, তিনি আমার বড়দিদু। মায়ের বড় মাইমা। তিনি আমার এক জন্মদিনে আমাকে উপহার দিয়েছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সমগ্র কিশোর সাহিত্য’ (প্রথম খণ্ড), শরদিন্দু অমনিবাস (চতুর্থ খণ্ড) এবং বিভূতি রচনাবলী (নবম খণ্ড)। আমার পরিচয় হল টেনিদা এবং চারমূর্তির সঙ্গে, সদাশিবের সঙ্গে, জেনারেল ন্যাপলা আর গিরীনদের সঙ্গে। পড়লাম চাঁদের পাহাড়, মিসমিদের কবচ, হীরামাণিক জ্বলে, মরণের ডঙ্কা বাজে। ব্যস! বাংলা সাহিত্যের প্রতি মুগ্ধতা আমায় আজীবনের জন্য গ্রাস করে ফেলল।
অয়ন: আপনি শিশু-কিশোরদের জন্য প্রচুর ভৌতিক, রহস্য ও রোমাঞ্চের গল্প লিখেছেন। কিন্তু বাংলা ভাষায় বহু যুগ ধরে প্রথিতযশা সাহিত্যিক, রথী-মহারথীরা ছোটদের জন্য সার্থক সব অলৌকিক ও রহস্য-কাহিনি লিখেছেন। সেইসব প্রবাদপ্রতিম সৃষ্টিগুলির পরে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ নতুন আইডিয়া নিয়ে এইসব গল্প লেখা কতটা শক্ত বা চ্যালেঞ্জের কাজ?
সুবর্ণ : আমি সবসময় মনে করি, ছোটদের জন্য লেখা সবচেয়ে শক্ত কাজ। তার অনেকগুলো কারণ আছে। একটা অন্যতম কারণ হল, প্রথমেই অনেক বারণ অবচেতনে ভেসে ওঠে। এটা লেখা যাবে না, সেটা লেখা যাবে না, তা হলে শিশু ও কিশোর মনে খারাপ প্রভাব পড়তে পারে ইত্যাদি। যে কারণে আমার ছোটদের জন্য লেখা গোয়েন্দা গল্পে এখনও পর্যন্ত ট্রেজ়ার হান্ট ছাড়া আমি কিছুই রাখিনি, খুন-জখম, চুরি-ডাকাতিও নয়। আমি এমনিতেই একটু শুদ্ধতাবাদী মানুষ, আমার বড়দের গল্পেও নিতান্ত প্রয়োজন না হলে শারীরিক বিষয় থাকে না, নেশাভাঙ, অশ্লীল ভাষাও সে ভাবে নয়। কিন্তু ছোটদের লেখার ক্ষেত্রে আমি মনের নানা বারণ মেনে নিয়ে শেষমেশ যখন লিখতে বসি, তখন দেখি হাতে রয়েছে শুধুই পেনসিল! তার কারণ হল, ছোটরা আর আমাদের শৈশব-কৈশোরের মতো ছোট নেই। তাদের মনোজগৎ, পছন্দ-অপছন্দ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়েই জটিল হয়েছে। যা আমার বারো বয়সে আমাকে মুগ্ধ করেছে, তা তিন দশক উজান বেয়ে আসার পর এখনকার শিশু-কিশোরদের একই ভাবে মুগ্ধ করে কি? ফলে ছোটদের জন্য লিখতে গিয়ে বারবার দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ি। তবু যে কথা সবসময় মাথায় রাখি, তা হল ছোটদের জন্য আমি সহজ সরল বিষয় এবং সহজ সরল চলনেরই আশ্রয় নেব, মোটেই প্যাঁচ কষব না এবং চমক দেওয়ার লোভে অনর্থক গিঁট পাকাব না। এটুকু মাথায় রেখেই যাবতীয় চেষ্টা চরিত্র করা আর কী! কতটুকু পেরেছি, সে তো ছোট্ট বন্ধুরাই বলতে পারবে।
অয়ন: কীভাবে নতুন আইডিয়া উপস্থাপন করেন? মানে, এইসব লেখা লিখতে বসার পূর্বের মানসিক অবস্থা বা প্রক্রিয়াটা সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।
সুবর্ণ: আমার একটা ছোট্ট পুরনো ডায়েরি আছে। তাতে আমার যখন যা মাথায় আসে, লিখে রাখি। কোনও যে পোক্ত বা নির্দিষ্ট লেখার ভাবনা সবসময় থাকে, তা কিন্তু নয়। আবার অনেক বার লেখার সময় ওই ডায়েরিটা খুঁজে না পেয়ে কত ভাবনাচিন্তা হারিয়েই ফেলেছি, যা আর পরে কখনও মনেও পড়েনি। কিছু লিখতে হলে ওই ডায়েরিটা থেকে টুকরোটাকরা, ছেঁড়াখোঁড়া ভাবনাগুলো পড়ি, যদি কোনওটা পূর্ণাঙ্গ কাহিনিতে রূপ দেওয়া সম্ভব হয়। কিছু একটা মাথায় এলে সেটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করি। যখন অনেকটা দেখতে পাই, তখন ভাবি এই বার লিখব। কিন্তু তখনও লিখি না। পুরো কাহিনি ভাবা ছেড়ে দিয়ে তখন আমি শেষ অনুচ্ছেদটা ভাবতে শুরু করি। শেষ অনুচ্ছেদটা তৈরি হলেই সেটা দ্রুত লিখে ফেলি। ওয়ার্ড ফাইলে সেটা লেখা হয়ে গেলে তার শুরুতে এসে পট পট করে কয়েকবার এন্টার বাটন প্রেস করে সেটাকে অনেকটা নীচে নামিয়ে চোখের আড়ালে পাঠিয়ে দিই। এবার লিখি শুরুটা। শুরুটা আর শেষটা ঠিকমতো লেখা হয়ে যায় যখন, তখনও কিন্তু পুরো কাহিনি ভাবা নেই। এইবার শুরু হয় প্রথম অনুচ্ছেদ আর শেষ অনুচ্ছেদের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ। মানে কোথা থেকে শুরু করছি আর কোথায় যাব, এটুকুই জানা থাকে। রাস্তা চলতে চলতেই ঠিক হয়ে যায়। শিল্পী সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় আমাকে একবার বলেছিলেন, ‘কোনও কাজ সত্তর শতাংশ ভাবা হয়ে গেলেই শুরু করে দিতে হয়, পুরোটা ভাবা হলে শুরু করব, এই ভেবে বসে থাকতে নেই। বাকিটা করতে করতেই হয়ে যায়।’ আমি কথাটার সত্যতা বারবার উপলব্ধি করেছি। রাস্তায় নেমে রাস্তা চিনতে হয়, বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখা হয়, রাস্তা চেনা হয় না। আমার সমস্ত লেখার শুরু শেষ অনুচ্ছেদটা দিয়েই।
অয়ন: আপনি মূলত একজন গদ্য-সাহিত্যিক। ইদানীং প্রায় প্রতিবছর একটা করে উপন্যাস লিখছেন। উপন্যাসের বিষয়বস্তু বা লেখনশৈলীতে কি নিজেকে বারবার ভাঙেন? রিপিটেশন বর্জন করে চলেন? একটু খুলে বলুন।
সুবর্ণ : পুনরাবৃত্তি বর্জন করার চেষ্টা সবসময় করি। দু’-একটা সামাজিক উপন্যাস লেখার পর চেষ্টা করি একটা রহস্য উপন্যাস লেখার। কিংবা বড়দের জন্য কয়েকটা লেখা হয়ে গেলে চলে যাই ছোটদের লেখায়। তবে নিজেকে বারবার ভাঙি, তা বোধ হয় নয়। আমার গল্প বলার ধরন আমি বদলাই না। যাঁরা ছবি আঁকেন, যাঁরা মূর্তি গড়েন, তাঁদেরও কাজের শৈলীতে একটা নিজস্বতা থাকে। এই নিজস্বতা বহু পরিশ্রমে তাঁরা তৈরি করেন। সেটাই তাঁদের বারবার শনাক্ত করিয়ে দেয়। আমি মনে করি, সব সৃজনশিল্পীরই নিজস্বতা তৈরির একটা চেষ্টা থাকা উচিত। আমি এখনও তৈরি করতে পেরেছি কি না জানি না, তবে চেষ্টা করছি তো বটেই। বিষয়ের পুনরাবৃত্তি এড়ানোর জন্য আমি মাঝে মাঝেই নিজের পুরনো লেখাগুলো পড়ি। যাতে ভুল করেও যা আগে লিখেছি, তা ফের লিখে না ফেলি।
অয়ন: শোনা যায়, বাংলা সাহিত্যের পাঠক ক্রমশই কমে যাচ্ছে। চার পাশে অগুন্তি বিনোদনের মাধ্যম ও তার মনভোলানো হাতছানি। এই পরিস্থিতিতে একজন সৃষ্টিশীল লেখক কী উপায়ে নিজেকে নিরন্তর মোটিভেট করে রাখবেন?
সুবর্ণ: বাংলা সাহিত্যের পাঠক কমে যাচ্ছে, এ কথাটা ভুল নয়। পেশার খাতিরে বিভিন্ন সময়ে পাঠকদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ আমার হয়েছে। তাতে আমার পর্যবেক্ষণ হল, বাংলা সাহিত্যের পাঠক শহরে কমলেও, গ্রামে বা মফস্ সলে কিন্তু কমেনি। যাঁরা পড়েন, তাঁরা খুব মন দিয়ে পড়েন, ভালবেসে পড়েন, মনোজ্ঞ আলোচনাও করেন। তাঁদের কাছে আমি ঋণী। তাঁরাই আমার অনুপ্রেরণা। আমার প্রতিটি লেখা লেখা হয়ে গেলেই মনে হয়, ব্যস, মাথা ফাঁকা হয়ে গেল। আর কিছু লেখার নেই। কিন্তু ফেসবুকে, মেসেঞ্জারে, হোয়াটস্যাপে অজস্র মানুষের প্রতিক্রিয়া, ভালবাসা, নতুন লেখার দাবি আমাকে আবার লেখার টেবিলে ফেরার উৎসাহ দেয়। লেখার মাধ্যমে পাঠককে যতটা ভাল লাগা উপহার দিতে পেরেছি, তার চেয়ে অনেক বেশি ভালবাসা মানুষ আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আমি ভাগ্যবান। আমার পাঠকের সংখ্যা বেশি নয় হয়তো, কিন্তু তাঁদের অকৃত্রিম উৎসাহ আমাকে প্রেরণা দেয়। তাঁরা যে অন্য সমস্ত বিনোদনের মাধ্যম, তুমুল আকর্ষণের ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ওয়েব-সিরিজ সরিয়ে রেখে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আমার লেখা সাদা-কালো অক্ষরে মনোযোগ দিয়েছেন, এই কৃতজ্ঞতাই আমাকে দিয়ে আরও লেখার চেষ্টা করাবে।
অয়ন: আপনি একটি প্রখ্যাত দৈনিক সংবাদপত্রের রবিবাসরীয়-বিভাগের সম্পাদনা-কর্মে ব্যাপৃত। পেশাগত ব্যস্ততার চাপ সামলে নিজের মৌলিক লেখালিখিকে বহমান রাখেন কীভাবে?
সুবর্ণ : লেখালিখি সে ভাবে বহমান রাখতে পারি না বলেই তো আমার লেখালিখির সংখ্যা এত কম। শুধু অফিসের কাজ নয়, আমি যেহেতু এক জন সংসারী মানুষ, ফলে বাড়িরও কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য থাকে। আমি কোথাও ফাঁকি দিই না। এ সবের মধ্যেই কোনও কোনও লেখা মাথায় জন্ম নেয়, বেড়ে ওঠে। একটা লেখা তৈরি করতে গেলে প্রচুর কাটাকুটির প্রয়োজন হয়, সেটা খাতাতেও হতে পারে, মাথাতেও হতে পারে। আমার বেশির ভাগ কাটাকুটিটাই মাথায় হয়, সেই কারণে লিখতে বসে আর বেশি কাটাকুটির প্রয়োজন হয় না। ফলে কম সময়ে কাজ সেরে নিতে পারি। এও এক ধরনের অনুশীলন বলতে পারেন। তবে এমনিতেও আমি বেশি লিখতে চাই না, বরং প্রতিটি লেখার প্রতি সুবিচার করতে চাই। আসলে আমি ‘ফার্স্ট ইমপ্রেশন’ জিনিসটায় খুব বিশ্বাস করি— নিজেকে সব সময় বলি, ‘ইউ উইল নেভার গেট আ সেকেন্ড চান্স টু মেক ইয়োর ফার্স্ট ইমপ্রেশন’। কারণ আমার কোন লেখাটা পাঠক প্রথম পড়ছেন, তা তো আমি জানি না। সেটা খারাপ লাগলে তো সেই পাঠক আমার সম্বন্ধে স্থায়ী ভাবেই খারাপ ধারণা করে নেবেন। পরবর্তী কালে আমার নামটা দেখলেই পাতা উল্টে চলে যাবেন। সেটা কি আমি জেনেশুনে চাইতে পারি! তাই আমার গুটিকয়েক লেখাই ভাল।
অয়ন: দেশ-বিদেশ নির্বিশেষে প্রিয় পাঁচজন সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব ও প্রিয় পাঁচটি গ্রন্থের নাম— ক্রমানুসারে বলুন।
সুবর্ণ : বাংলা সাহিত্যই আমার প্রথম এবং প্রধান পছন্দ। বেছে নিতে হলে আমি সেখান থেকেই নেব। ক্রমানুসারে বলা একটু শক্ত। কারণ যাঁদের লেখার প্রতি মুগ্ধতা আমাকেও লেখালিখির প্রচেষ্টায় টেনে এনেছে, তাঁদের ক্রম নির্ধারণ করা আমার পক্ষে অসম্ভব। যে লেখাগুলোর কাছে বারবার ফিরে আসি, সেগুলো হল, বিমল মিত্রের ‘সাহেব বিবি গোলাম’, ‘আসামী হাজির’; শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তুঙ্গভদ্রার তীরে’, ‘কালের মন্দিরা’; বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’, ‘আরণ্যক’; তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’, ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘কালিন্দী’, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘দূরবীন’, ‘যাও পাখি’, ‘উজান’, ‘পারাপার’। অনেক বেশি বলে ফেললাম। ও, আরও এক জনের কথা না বললে অন্যায় হবে, তিনি গজেন্দ্রকুমার মিত্র। তাঁর ‘বহ্নিবন্যা’, ‘আমি কান পেতে রই’, ‘পাঞ্চজন্য’, ‘কান্তাপ্রেম’ আমার খুব প্রিয়। অলৌকিক এবং অতিপ্রাকৃতিক আমার খুব প্রিয় বিষয়। আমার মতে, এই ধারায় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং গজেন্দ্রকুমার মিত্রের মতো ক্ষমতাসম্পন্ন কলম সব যুগেই বিরল।
অয়ন: কখনও ‘রাইটার্স ব্লক’ চর্চা অনিয়মিত করে দিয়েছে কি? কীভাবে কাটিয়ে উঠেছেন?
সুবর্ণ: শুধু রাইটার্স ব্লককে দোষ দিলে হবে না, আমার লেখালিখিটাই খুব অনিয়মিত। কোথাও লেখা দেওয়ার থাকলে লিখি, না হলে নিয়ম করে রোজ লিখতে বসা হয়ে ওঠে না। কুঁড়ে হলে যা হয় আর কী! আর রাইটার্স ব্লক খুব চেষ্টা করে কাটিয়ে উঠিনি কখনও। নিজে নিজে এসেছে, নিজে নিজেই চলে গেছে। আমার ধারণা, এই ধরনের কিছু নিয়ে বেশি চিন্তা করে লাভ হয় না। বরং খারাপ জিনিসকে পাত্তা দিলেই আরও গেঁড়ে বসে। কিচ্ছু লেখা মাথায় না এলে, যা মনে হচ্ছে তাই লিখে যাই মাথামুণ্ডুহীন, মন যেমন ডিকটেশন দেয়। মনে হয়ে লেখা থাকুক, কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই কাজে লেগে যাবে— জীবনের ধন কিছুই যায় না ফেলা।
অয়ন: পাঠকই যখন ক্রম-হ্রাসমান, তখন লিটল ম্যাগাজিনের ভবিষ্যৎ কি এখনও কিছু রয়েছে বলে মনে হয়?
সুবর্ণ : পাঠক কমলেও লিটল ম্যাগাজিনের আভিজাত্য এবং আপসহীনতা কিন্তু কমেনি। প্রতিটি লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশিত হওয়ার পিছনে অনেক মানুষের আত্মত্যাগ থাকে। তাঁরা যে শামিয়ানার তলায় জড়ো হন, সেই শামিয়ানার নাম ‘সাহিত্যের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালবাসা’। আমি মন থেকে বিশ্বাস করি, ভালবেসে কোনও কিছু করতে পারলে কখনও তা ব্যর্থ হয় না। মানুষ যত দিন সাহিত্য পড়বেন, লিটল ম্যাগাজিনও থাকবে। পায়ে হেঁটে, টিফিন না খেয়ে একটু একটু করে টাকা জমিয়ে লিটল ম্যাগাজিন কেনার রোমাঞ্চ চিরকালই অন্যরকম। যাঁরা পড়তে ভালবাসেন এই রোমাঞ্চের স্বাদ তাঁদের কাছে কখনও পুরনো হবে না।
অয়ন: একসময় ‘লিটল ম্যাগাজিন’ ছিল একটা সম্ভ্রমের নাম। আজকের এই পণ্যাভিমুখী সময়ে তার চরিত্র কতটা বদলেছে?
সুবর্ণ : পরিবর্তন জীবনের ধর্ম। কিন্তু একটু আগেই যে বললাম আপসহীনতা, আমার মনে হয় সেটা কিন্তু বদলায়নি। যুগের প্রয়োজনে, উদ্বর্তনের লক্ষ্যে যে কোনও অস্তিত্বেরই অভিযোজনের প্রয়োজন হয়। কোথাও হয়তো কিছুটা নমনীয় হতে হয় হয়তো, কিন্তু তাতে মৌলিক আদর্শের বিচ্যুতি ঘটে না। যাঁরা দীর্ঘ দিন ধরে সৎভাবে, নিষ্ঠার সঙ্গে এই লিটল ম্যাগাজিন করে চলেছেন, তাঁরা কিন্তু তাঁদের জায়গা ধরে রাখতে পেরেছেন। এরকম বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত যোগাযোগ আছে, সেই কারণে আলাদা করে কারও নাম বলতে পারছি না। তবে তাদের কাজ, গবেষণা, অধ্যবসায় আমাকে বারবার বিস্মিত করেছে। শ্রদ্ধায় মাথা নিচু হয়ে এসেছে নিজে থেকেই। অন্তর থেকে বারবার দীর্ঘায়ু কামনা করি তাদের। তবে একথা ঠিক যে, কিছু অবক্ষয়ের কথা কানে আসে। দুর্নীতি কিংবা প্রতারণা, স্বার্থসিদ্ধি অথবা অসততার কথাও জানতে পারি। কষ্ট হয়। তবু মনে হয়, এ তো সব সময়েই ছিল। আছে। থাকবেও। কিন্তু কালের কষ্টিপাথরে যাচাই হওয়ার পর থেকে যাবে ভালটাই।
🍂
0 Comments