জ্বলদর্চি

কাশফুল/ ভাস্করব্রত পতি

বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৩৮
কাশফুল
                           
ভাস্করব্রত পতি

'আমাদের ছোটো নদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গোরু, পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার, ঢালু তার পাড়ি।
চিক্ চিক্ করে বালি, কোথা নাই কাদা,
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।
কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,
রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক'। 
কবিগুরুর লেখা 'আমাদের ছোট নদী' কবিতা আমরা সকলেই পড়েছি। সেই ছবি আজও দেখা যায় বাংলার অনেক নদীর চরে। যা দেখলে ভরে ওঠে মনপ্রাণ। শরত আসার আগমন বার্তা দিয়ে যায় এই কাশফুল। নয়নাভিরাম রূপ নিয়ে যখন আলতো বাতাসে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে আহ্বান করে, তখন কার সাধ্যি যে তাঁকে উপেক্ষা করে!! 
ক্ষীরাই নদীর পাড়ে কাশবন

কাশ হল শরতের এক অতি জনপ্রিয় ফুল। সংস্কৃতে একে শারদ, সিতপুষ্পক বলে। উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছে SACCHARUM SPONTANEUM। গ্রামিণী বা ছন গােত্রের এই গাছটির সাথে কাশতলা, কাশমিলি গ্রামনামের অনুসঙ্গ যুক্ত। পােটগল, কাশী, কাশা, কাস, ইক্ষুগন্ধা, দর্ভপত্র, কাণ্ডকাণ্ডক, বায়সেক্ষু, কাকেক্ষু, অমরপুষ্পক, কচ্ছুলকারক, লেখন, কাসক, নাদেয়, ইক্ষ্বারি, কাণ্ডেক্ষু নামেও পরিচিত কাশফুল। 

'আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা / নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা। / এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে, / এসো নির্মল নীলপথে, / এসো ধৌত শ্যামল আলো ঝলমল বনগিরিপর্বতে / এসো মুকুটে পরিয়া শ্বেতশতদল শীতল শিশির ঢালা'। এভাবেই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শরতের কাশকে সংবর্ধনা জানিয়েছেন। কাশফুল হল শরত ঋতুর উপহার। কিন্তু সেই কাশফুল ক্রমশঃ কমছে প্রকৃতি থেকে। আগের চেয়ে অনেক নিষ্প্রভ কাশের অবাধ বিচরণ।
শরতের আকাশ ছোঁয়ার অপেক্ষায় কাশের ঝোপ

আসলে পরিবেশ দূষনের পাশাপাশি দ্রুত নগরায়ন বৃদ্ধি কাশফুলের মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে দিচ্ছে। নদীর ধার, জলাভূমি, চরাঞ্চল, শুকনো এলাকা, পাহাড় কিংবা গ্রামের কোনো উঁচু জায়গায় কাশের ঝাড় বেড়ে ওঠে। তবে নদীর তীরেই এঁদের বেশি দেখা যায়। কবি টিঙ্কু রঞ্জন মিত্র যথার্থই  লিখেছেন, 'স্রোতস্বিনীর স্রোতের কল্ কল্ শব্দ / ভেসে চলছে বায়ুর আলিঙ্গনে। / দুই তীরে কাশফুলেরা মাথা উঁচিয়ে / হেলে দুলে স্বাগত জানায় / আগমনীর বার্তা'। কিন্তু আদৌ কি আগের মতো কাশফুলের রমরমা লক্ষ্য করা যাচ্ছে? প্রশ্ন তুলেছেন পরিবেশপ্রেমীরা।

একসময় কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাইয়ের ওপর ব্যাপক পরিমাণে কাশ গাছ জন্মাতে দেখা যেতো। গত কয়েক বছর তা কমেছে ভালো মতোই। আসল কারণটা কি? বিশিষ্ট প্রকৃতিপ্রেমীদের বক্তব্য, চারিদিকে পার্থেনিয়াম গাছে ছেয়ে যাচ্ছে। কাশফুল ফোটার যায়গা অপ্রতুল। কাশফুল ফুটতে দেখলেই মনে আসে দেবীর বোধনের সময় আসন্ন। স্বপ্না বিশ্বাসের গলায় শোনা যায় সেই অনুরণন --
'কাশফুলের নরম ছোঁয়ায়
সাদা পেঁজা মেঘের ভেলায়
আসছেন মা..... আসছেন মা...'! 

কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর 'কাশফুলের কাব্য'তে লিখেছেন, 'ভেবেছিলাম প্রথম যেদিন ফুটবে তোমায় দেখব, / তোমার পুষ্প বনের গাঁথা মনের মত লেখব / তখন কালো কাজল মেঘ তো ব্যস্ত ছিল ছুটতে, / ভেবেছিলাম আরো ক’দিন যাবে তোমার ফুটতে / সবে তো এই বর্ষা গেল শরত এলো মাত্র, / এরই মধ্যে শুভ্র কাশে ভরলো তোমার গাত্র। / ক্ষেতের আলে নদীর কূলে পুকুরের ওই পাড়টায়, / হঠাৎ দেখি কাশ ফুটেছে বাঁশ বনের ওই ধারটায়। /  আকাশ থাকে মুখ নামিয়ে মাটির দিকে নুয়ে, / দেখি ভোরের বাতাসে কাশ দুলছে মাটি ছুঁয়ে'। সরকারি বনসৃজন প্রকল্পের দরুনও কোপ পড়েছে কাশের বনে। অথচ কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘কাশফুল মনে সাদা শিহরণ জাগায়, মন বলে কত সুন্দর প্রকৃতি, স্রষ্টার কি অপার সৃষ্টি'। 
সাদা কাশফুলের সাথে নীল মেঘ

কাশফুলের সেই শিহরণ আজ আর রোমাঞ্চকর হচ্ছেনা। কাশের বনে আজ কান্নার রোল যেন! চারিদিকে গজিয়ে উঠছে ঘরবাড়ি। বেঘর হয়ে পড়ছে শরতের পরিচায়ক কাশফুল। তাই হয়তো বহু আগেই কবিগুরু লিখে ফেলেছিলেন 'শূন্য এখন ফুলের বাগান, / দোয়েল কোকিল গাহে না গান / কাশ ঝরে যায় নদীর তীরে / যাক অবসাদ বিষাদ কালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো / জ্বালাও আলো, আপন আলো, শুনাও আলোর জয়বাণীরে'। 

এই গাছটির আদি নিবাস সুদূর রোমানিয়া। সাধারনত উচ্চতায় ৩ মিটার পর্যন্ত হয়। এর চিরল চিরল পাতার দুই পাশ বেশ ধারালো। গবাদি পশুদের খাদ্য। তাছাড়া ভালো জ্বালানি হিসেবে গ্রামবাংলার লোকজন ব্যবহার করে। অরন্ধন উৎসবের দিন উনুন জ্বলবেইনা। এদিন উনুনের চারপাশে আবারও ভালো করে নিকোনো হয় গোবর মাটি দিয়ে। শুকিয়ে গেলে সেখানে চালবাটা দিয়ে নানা ধরনের আলপনা আঁকা হয়। উনুনের সামনে মনসার ঘট বসিয়ে তাতে একটি মনসার ডাল রাখা হয়। তাতে কাশফুল, শালুকের মালা, চাঁদমালা, ফুলের মালা দেওয়া হয়। আর ঘট সহ মনসা তথা সিজগাছের পাতায় সিঁদুর লাগানো হয়। কাশগাছ কেটে শুকনো করে উনুনের সঙ্গী করা হয়। এছাড়া কাশফুলের আরও অনেক উপকারী গুণ আছে। পিত্তথলিতে পাথর হলে নিয়মিত গাছের মূল খেলে তা দূর হয়। কাশমূল বেটে চন্দনের মতো নিয়মিত গায়ে মাখলে গায়ের দুর্গন্ধ দূর হয়। এছাড়াও শরীরে ব্যথানাশক ফোঁড়ার চিকিৎসায় কাশের মূল কাজে লাগে। সম্প্রতি বাংলাদেশের বুকে কাশফুল নিয়ে একটা ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে সে দেশের মৌলবাদীরা। সাদা কাশফুলের জঙ্গলে ছবি তোলেন অনেকেই। কিন্তু তা নাকি হারাম। গুনাহ। কাশফুল হিন্দুদের ফুল। হিন্দুয়ানী ফুল! শরতকালে দুর্গাপূজার সময় ফোটে। তাই এই ফুল পরিত্যাগ করা উচিত বলে ঐ দেশের কিছু উগ্র ধর্মীয় মুরব্বীদের ফতোয়া। ফলে পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কাশফুলের বন! যা ইতিমধ্যেই সমাজ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। 
এই সেই ছবি যেখানে কাশফুলের বনকে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে

সুপ্রাচীন গ্রন্থ ‘কুশজাতক’ এর কাহিনি অবলম্বন করে ‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্য রচনা করেছেন কবিগুরু। রূপক তরফদার লিখেছেন, 'শরতের মিঠে রোদ আর কাশফুল দেখে করি, / পূজোর আনন্দ খোঁজার বৃথা চেষ্টা, / শিশুমন হয়েছে যুবক, সোশ্যাল মিডিয়ায় গিলেছে সময়, / এখন Like Share মেটায় মনের তেষ্টা'। একদিকে আকাশে সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, আর ঠিক নিচে দুধসাদা কাশের মাথা দুলুনি। এসব দেখেই কবির কল্পনায় শরৎ হয়ে উঠেছে কল্পনার রঙে রঙিন। কবি রিয়াজুল জান্নাত তাই সেই দৃশ্য এঁকেছেন এভাবেই, 'কাশের বনে লেগেছে দোলা, / শুভ্র মেঘেরা ভাসিয়েছে ভেলা। / শরৎ মেঘের আকাশটা নীল, / কবিতারাও পেয়েছে অন্ত্যমিল। / মন পবনের নাও ভাসিয়েছি, / স্মৃতির জোয়ারে হয়েছি বানভাসি। / তোর আর আমার, যত মিষ্টি ভুল; / জানুক শুধু, ভুবনডাঙার কাশের ফুল'। কবি গোবিন্দ দে লিখেছেন কাশফুলের রঙের সঙ্গে তাঁর প্রেমিকার হারিয়ে যাওয়ার বেদনাতুর কাহিনী। কবির কলমে রয়েছে -- 'যেদিন একগুচ্ছ শুভ্র কাশফুল নিয়ে / হাঁটুগেড়ে বসে তোমায় বলেছিলাম / এই সিধুটাকে তোমার মনের মন্দিরে / একটু স্থান দেবে.. / জবাবে পেয়েছিলাম ঠোঁটের কোণে / লেগে থাকা মুচকি হাসি। / কিন্তু আজ তুমি নেই। / তুমি ঐ শুভ্র কাশফুলের রঙ্গে / নিজেকে সাজিয়ে চলে গেছো / এক না ফেরার দেশে'।

যে করেই হোক, কাশের বন বাঁচাতেই হবে। উদ্ভিদবিজ্ঞানের এই অতি পরিচিত গাছটি আসলে প্রকৃতির সৌন্দর্যের 'রূপোর কাঠি সোনার কাঠি'। গ্রামবাংলার খোলতাই রূপ প্রকাশে কাশফুল যেন 'হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা'! বাঙালির শরতের অলঙ্কার। আগমনীর বার্তা বয়ে আনতে কাশের জুড়ি মেলা ভার। কবি চন্দ্রকান্ত দত্তর লেখায় পাই, 'আগমনীর সুর বেজে উঠেছে, / সাদা কাশফুল উড়ছে আকাশে / মনটা খোঁজে তোমার ছোঁয়া, / এই শরৎ এর আশ্বিন মাসে'। তেমনি ব্রততী ব্যানার্জীর লেখনিতে ফুটে ওঠে, 'ভোরের আকাশে শুনি আগমনীর গান / কাশ ফুলেরা করছে খেলা, উচ্ছ্বসিত প্রাণ! / শিউলি ফুলের মিষ্টি গন্ধে মনটা দুলে ওঠে / মা আসছে হেঁটে হেঁটে মোদের মেঠো মাঠে'।

কিন্তু, কাশফুল নিজেও জানেনা যে তাঁর অস্তিত্ব ক্রমশঃ সঙ্গীন হয়ে আসছে। ফিকে হয়ে আসছে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনপথ। এক শ্রেনীর অবিবেচকদের স্বার্থপর আচরণে আজকের অপু দুর্গার চোখে খোঁজ মেলেনা শ্বেতশুভ্র কাশ। যদিও কবি দীপশিখা লিখেছেন, 'কাশফুল এর বনে অপু দুর্গার লুকোচুরি, / দুর থেকে ট্রেন দেখার খামখেয়ালী, / ট্রেনে চড়া তাঁর ভাগ্যে জোটেনি, / এরই নাম পথের পাঁচালী'। কবি নির্মলেন্দু গুণও শরত ও কাশের বনের হাহাকার তুলে ধরেছেন এভাবে -- 'শরত রানী যেন কাশের বোরখা খানি খুলে, / কাশ বনের ওই আড়াল থেকে নাচছে দুলে দুলে। / প্রথম কবে ফুটেছে কাশ সেই শুধুরা জানে, / তাইতো সেটা সবার আগে খোঁপায় বেঁধে আনে। / ইচ্ছে করে ডেকে বলি, 'ওগো কাশের মেয়ে― / আজকে আমার চোখ জুড়ালো তোমার দেখা পেয়ে / তোমার হাতে বন্দী আমার ভালোবাসার কাশ। / তাইতো আমি এই শরতে তোমার কৃতদাস। / ভালোবাসার কাব্য শুনে কাশ ঝরেছে যেই / দেখি আমার শরত রানী কাশবনে আর নেই'। কিন্তু পরিশেষে বলা যায়, পরিনত বয়সেও সেই কাশফুল কারো কারো জীবনে নস্টালজিক দ্যোতনা তৈরি করে। কবি অপর্ণার উপলব্ধি অনুযায়ী, 'দামী জিনিস ছাড়া নাকি কমানো যায়না বয়স / রাস্তার ধারের কাশফুল মনে করিয়ে দেয় / ছেলেবেলাটা এখন necessity / বড় হওয়াটা ছিল choice'।

🍂

Post a Comment

0 Comments