জ্বলদর্চি

পুজোর পাঁচ কাহন /তনুশ্রী ভট্টাচার্য্য

পুজোর পাঁচ কাহন

তনুশ্রী ভট্টাচার্য্য 


আনন্দধারা  বহিছে ভুবনে

মা এসেছেন ধরায়। দিন ক্ষণ তিথি নক্ষত্র লগ্ন  যোগ সময়ের সঠিক নির্ঘন্ট মেনে। ---সময়ের খাতায় যত ছক আছে ---সবগুলো মিলে গেলেই মৃন্ময়ী মূর্তি ধরে মা এসে পৌঁছন ধরার ধূলিতে। সাজিয়ে দেন প্রকৃতিকে  কাশ শিউলি পদ্ম শাপলা শালুকে । তবে এই বছরে মনে হয় ধূলি কথাটা মানাবে না। কারণ চারিদিক শুধু জল আর জল। বন্যা আর অতিবৃষ্টি।  বর্ষারাণী চলে গেলেও শরতের সঙ্গে তার ভাবভালোবাসা বেশ গভীর। আর তাই এই শরতের বহিরাকাশে তেমন করে অনাবিল নীলাভ রঙ চোখে পড়ছে না। মাঝে মাঝেই তা ঢেকে দিচ্ছে কালো মেঘের ভ্রুকুটি। আর মেঘভাঙা বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে গ্রাম শহর নগর এমনকি কলকাতা মহানগরী পর্যন্ত। তবুও  এই বিপর্যয় সামলে উঠেছি আমরা। মায়েরই কৃপায়। তার কাছেই তো সন্তানের আবদার আহ্লাদ প্রার্থনা কামনা। সেই প্রার্থনামন্ত্র দিয়েই আমাদের মহালয়ার ভোর এসেছে। পিতৃপক্ষের অবসানে দেবীপক্ষের শুরু।  পূর্ব পুরুষের তর্পণ। আর পূর্ব নারীর তর্পণ নয়? নিশ্চয়ই হয়। আসলে এই তর্পণ মানে তো শ্রদ্ধার্ঘ্য। মানে  আমাদের অতীতকে শ্রদ্ধা করা, স্মৃতি রোমন্থন করা। আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়ার আগে  একবার অগ্রজদের কাছে অনুমতি চাওয়া । তা যেমন জীবিতদের কাছেও চাইতে হয় তেমন স্বর্গতদের কাছেও চাইতে হয়। এটাই তো পারিবারিক  বন্ধন। মূল্যবান পরম্পরা।  দেবীপক্ষ এসে গেল আর তখন থেকেই শুরু প্রার্থনা----ত্রিনয়নী দেবীর কাছ---
আয়ূর্দেহি যশোদেহি ভাগ্যং ভগবতী দেহি মে--
পুত্রাং দেহি ধনং দেহি সর্বানকামাশ্চ দেহি মে।
🍂

তিনি জগৎজননী। তিনি মঙ্গলপ্রদায়িনী। তিনি একদিকে জগৎ পালিকা  আবার অন্যদিকে  তিনিই রূদ্ররূপা। সংহারিনী। জগতের অকল্যাণ অন্যায় অবিচার  সংহার করে জগতকে পাপমুক্ত করেন।  একদিকে তিনি বরাভয় মুদ্রায় থাকেন অন্যদিকে সিংহবাহিনী  ত্রিশূল ধারিনী হয়ে অসুর নিধনে মেতে ওঠেন। সেই  আদ্যাশক্তি মহামায়া আরাধিত হন।প্রতিপদ থেকে নবমী পর্যন্ত---নবদুর্গার আরাধনা হয়---------
প্রথমং শৈলপুত্রীতি,দ্বিতীয়ং ব্রহ্মচারিনী,
তৃতীয়ং চন্দ্রঘন্টেতি,  কুষ্মান্ডেতি চতুর্থকমং 
পঞ্চমং স্কন্দমাতেতি  ষষ্ঠং কাত্যায়নীতথা 
সপ্তমং কালরাত্রীতি মহাগৌরীতি চাষ্টমাং 
নবমং সিদ্ধিদাত্রীতি চ  নবদুর্গা প্রকীর্তিতা  ।
উক্তান্যেতানি নামানি ব্রহ্মনৈব  মহাত্মনা 
অগ্নিনা দাহ্যমানাস্তু  শত্রুমধ্যগতারণে 
বিষমে দুর্গমে চৈব ভয়ার্তা শরণংগতা:।

আমরা সেই আদ্যাশক্তির শরণাগত হই।  মানুষের জীবন ত নিরঙ্কুশ বিপদমুক্ত হতে পারে না। তাই সেই পরমা প্রকৃতির আশীর্বাদ নিয়েই চলতে হয়  অসহায় মানুষকে।  বিপদবাধা কেটে যাবার জন্যই এই নিবিড় প্রার্থনা।   দুর্গাদুর্গতিনাশিনী রূপে তিনি মর্ত্যে আবির্ভূতা। তিনিই শষ্যলক্ষ্মী বসুন্ধরা। আবার তিনিই জ্ঞানদায়িনী। অজ্ঞানতার আঁধার ঘুচিয়ে জ্ঞানের সুষমায় ভরিয়ে দেন সন্তানদের। তিনি যেমন দশপ্রহরণধারিনী তেমন তিনিই আবার বীনাবাদিনী। তিনি ই অতসীবরণা দুর্গা আবার তিনিই শ্বেতশুভ্রা সরস্বতী। তিনিই ধান্যলক্ষ্মী। তিনিই অপরাজিতা সৌভাগ্যলক্ষ্মী।  তিনি একদিকে যুদ্ধবিদ্যা শেখান পুত্র কার্তিকের মাধ্যমে অন্যদিকে বিনয় আনুগত্য  একাগ্রতা শেখান পুত্র গণেশের মাধ্যমে। নবপত্রিকার সজ্জায়  জীবন জীবিকার সন্ধান দেন।
আনন্দময়ী  মা এলে আমরা শুধু আনন্দ করতেই চাই। সব বেদনা ব্যথা অভাব কষ্ট ভুলে যাই আমরা। কত দিকে যে সে আনন্দ ধারা বয়ে যায় তার  ঠিক নেই। দিনরজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্ত গগনে----আনন্দধারা বহিছে ভুবনে।
আগামী চারদিন পুজো কাটুক  উচ্ছ্বাসে আনন্দে, আবেগে। দেবীর প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি , উপবাস, অঞ্জলী,‌ প্রণাম, প্রসাদ, নতুন জামা, নতুন জুতো, হালফ্যাশনের সাজ ,প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে ঠাকুর দেখা, পায়ে ফোস্কা, প্যান্ডেলের আড়ম্বরে মাতোয়ারা,সেল্ফি তোলা, গ্রুপফি তোলা, ফাস্টফুড খাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা,---পুজোর অন্য নাম। আবার দুয়ারে কোনো কাঙিলিনী দেখে তার  সমব্যথী হয়ে‌ তার হাতে নতুন জামা তুলে দেওয়ার আনন্দই পুজোর আসল মানে।   অনাথ কিশোর ছেলেটিকে একটা  নতুন টুপি আর গেঞ্জি পরিয়ে  তার হাসিমুখের সঙ্গে একটা সেল্ফি তোলার আনন্দটাই ত পুজোর ভেতর পুজো, অথবা  কোনো এক কচিবালিকার মাথায় ফুলকাটা প্রজাপতি হেয়ার ব্যান্ড আর  হাতে  রঙিন কাঁচের চুড়ি পরিয়ে দিলে  তার ঝনঝনানি ঢাকের বাদ্যির মতোই  অকালবোধনের পুজোর উপচার হয়ে ওঠে ----সব মিলে এই পুজোয় সকলের মন থাকুক ভরপুর। আনন্দ  চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ুক---এক কড়ি, দুগন্ডা,  তিন ডজন,  চার কাঠা, পাঁচকাহন।

Post a Comment

0 Comments