বাংলার ঘাস পাতা ফুল ফল, পর্ব -- ৯১
ঝুমকোলতা
ভাস্করব্রত পতি
"হঠাৎ কিসের মন্ত্র এসে
ভুলিয়ে দিলে এক নিমেষে
বাদল বেলার কথা।
হারিয়ে পাওয়া আলোটিরে
নাচায় ডালে ফিরে ফিরে
ঝুমকো ফুলের লতা।।"
-- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ঝুমকোলতা। মহিলাদের কানের ঝুমকোর মতো ফুলগুলি দেখতে বলেই এদের এরকম নামকরণ। ইংরেজিতে বলে Passion Flower। কবি Alfred Tennyson এর কবিতাতেও উঠে এসেছে এই ফুলের কথা --
"There has fallen a splendid tear
From the passion-flower at the gate.
She is coming, my dove, my dear;
হাতে ধরা বুনো ঝুমকোলতা
এছাড়াও এই ফুলকে বলা হয় ওয়াইল্ড ম্যারাকুজা, ওয়াইল্ড ওয়াটার লেমন, ক্লক ফ্লাওয়ার, ফয়েটিড প্যাশন ফ্লাওয়ার, স্টিঙ্কিং প্যাশন ফ্লাওয়ার, বুশ প্যাশন ফ্রুট, মাদার অফ গড'স স্টার, ক্রিস্টস ক্রাউন, ক্রিস্টস থর্ণ, মারয়া মারয়া, রানিং পপ, লাভ ইন এ মিস্ট ইত্যাদি। হিন্দিতে ঝুমকালতা, রাখী ফুল, কৌরব পাণ্ডব ফুল, পঞ্চপাণ্ডব ফুল, কৃষ্ণ ফুল, কন্নড়ে কুক্কিবাল্লি, মালায়ালামে তেজুকি, টেজুমি, মারাঠীতে বেল ধানি বলে। কবি সুনির্মল বসুর কবিতাতেও এসেছে এই ঝুমকোলতা ফুলের কথা --
"আসর জমায় পাখীর দলে কূজন তুলে তুলে।
বন-মালতীর বাস ছুটেছে,
ঝুমকো-লতায় ফুল ফুটেছে,
তারই লতায় প্রজাপতি নাচছে ঝুলে ঝুলে।
কোন্ সে মহান্ শিল্পী-কবি
ফুটিয়ে তোলেন সোনার ছবি?
ফল
ঝুমকোলতা বিজ্ঞানসম্মত নাম Passiflora foetida। যা Passifloraceae পরিবারের অন্তর্গত। এছাড়াও বেগুনি ঝুমকোলতা Passiflora incarnata, গোলাপী ঝুমকোলতা Passiflora kermesina, নীল ঝুমকোলতা Passiflora caerulea, রক্তাভ লাল ঝুমকোলতা Passiflora coccinea এবং লাল ঝুমকোলতার বিজ্ঞানসম্মত নাম Passiflora racemosa।
আসলে ল্যাটিন শব্দ Foetida এর মাধ্যমে দুর্গন্ধ বোঝানো হয়। এর শুকনো পাতায় তীব্র গন্ধের আভাস মেলে। তাই এরকম নামকরণ। এই গাছ মূলত অ্যারিজোনা, টেক্সাস সহ ক্যারাবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ, মেক্সিকো এবং মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বাসিন্দা। আমাদের দেশেও জন্মায়। পোড়ো মন্দির, ছোট জঙ্গল, ঝোপঝাড়ে বন্য ঝুমকোলতা খুব জন্মায়। লতানো গাছটি জড়িয়ে জড়িয়ে উঠে সর্বত্র একটা ঝোপের সৃষ্টি করে। কোনওরকম যত্নআত্তি ছাড়াই বেড়ে ওঠে। প্রায় ১৫-২০ মিটার লম্বা হয়।
ফুল ও ফল
ছোট ছোট আঠালো হলুদ লোমে ঢাকা এদের কান্ড বেশ পাতলা এবং সূক্ষ্ম। পাতাগুলি ৩-৫ টি লোব বিশিষ্ট। ত্রিকোণাকার পাতাতেও লোম থাকে। ৫-৬ সেন্টিমিটার ব্যাসার্ধের ঝুমকোলতা ফুলের রং হয় সাদা কিংবা ক্রিম। কখনও কখনও এই দুই রঙের মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়। বেগুনি রঙেরও পাওয়া যায়। এই ফুল নিয়েই গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন --
"ঝুমকোলতার বনে দোল্ দোল্ দখিনায়
গুন্ গুন্ ভ্রমরা যে ফুলেদের গান শোনায়
'তুমি আমার, শুধু আমি তোমার।"
ফুলের ওপর সূর্যের আলো পড়লে ফুলের মাঝখানের কাঁটাটি ধীরে ধীরে ঘুরতে থাকে। তাই একে অনেক এলাকায় "ঘড়িয়াঘণ্টা" ফুলও (গোপালগঞ্জ, বাংলাদেশ) বলে।
জালের মতো ঘিরে থাকা মঞ্জরিপত্রের মধ্যে ফুল থাকে। এই মঞ্জরিপত্রের সাহায্যে ঝুমকোলতা ফাঁদে আটকে ফেলে পোকামাকড়দের। ফুলটির মঞ্জরিপত্র থেকে এক ধরনের আঠালো পদার্থ বের হয়। যা পোকামাকড়দের আটকে রাখতে সাহায্য করে। কবি শহীদ উদ্দীন আহমেদ তাঁর 'ঝুমকোলতা' ছড়ায় সুন্দরভাবে উল্লেখ করেছেন ঝুমকোলতার গঠন এবং বৈশিষ্ট্য।
"মেঘের পরে মেঘ জমেছে
বৃষ্টি এবার নামবে,
হঠাৎ আসা দমকা হাওয়ায়
ঝুমকোলতা নাচবে।
বনের ধারে গাছের পরে
এলোকেশী চুল,
ঝুমকোলতায় ফুল ফুটেছে
যেন কানের দুল।
ঝুমকোলতার নাম দিয়েছে
কৃষ্ণকমল ফুল।
রাধীকা নাচন বলছে কেউ
বলছে রাখী ফুল।
ঝুমকোলতার বাহারী রঙ
চোখ জুড়িয়ে যায়,
বৃষ্টি ভেজা পাতার ফাঁকে
গুচ্ছাকারে ফুটে আছে ঝুমকোলতার ফল
এদের ফলগুলি বেশ অন্যরকম গঠনশৈলীর। বেশ মজাদার। গোলাকার ফলগুলির ব্যাসার্ধ ২-৩ সেন্টিমিটার হয়। পেকে গেলে হলদে কমলা থেকে লাল রঙে পরিবর্তিত হয়। এই ফল অনেকেই খায়। একটু টক টক লাগে। গোলাকার বা ডিম্বাকার ফলের চারদিকে জালের মতো ঘিরে থাকে সবুজ এবং ঘন মঞ্জরীপত্র। অনেক বীজ থাকে ফলের মধ্যে।
ভিয়েতনামের মানুষ লোকচিকিৎসার উপাদান হিসেবে নিদ্রাহীনতার নিরাময়ে, কাশি ও চুলকানি নিরাময়ে এর শুকনো পাতা চায়ের সাথে ব্যবহার করে থাকে। ঝুমকোলতার কচি নরম পাতাও খাওয়া যায়। 'বসন্ত বিলাপ' সিনেমায় আরতি মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গানটিও যেন ঝুমকোলতার পরশ খু্ঁজতে থাকে সুরে সুরে --
"যদি নাইবা থাকি কাছে, ওগো বকুল তুমি ফোটো,
মৌমাছি গো গুণগুণিয়ে, সুর ভরিয়ে দিও
ওগো বকুল তুমি ফোটো।
রামধনু গো উঠো,
নীলাঞ্জনা আকাশ পারে, রঙ ছড়িয়ে যেও। মৌমাছি গো গুণগুণিয়ে,
সুর ভরিয়ে দিও
ওগো বকুল তুমি ফোটো।
ওগো, ঝুমকোলতা চরণ আমার
জড়িয়ে ধরো না,
তোমায় ছেড়ে যেতে আমায় বারণ করো না।"
0 Comments