জ্বলদর্চি

পুজোর পাঁচকাহন (চতুর্থ পর্ব )/তনুশ্রী ভট্টাচার্য্য

পুজোর পাঁচকাহন (চতুর্থ পর্ব )
তনুশ্রী ভট্টাচার্য্য 

দুর্গা পুজো মানে ইকোসিস্টেম রক্ষা



দেবীকে  মন্ডপে বসালেই পুজো হয়ে যায় ? হয় না । বৎসরের ঠিক এই মধ্যভাগে এসে মানুষের মনে  পড়ে গত পাঁচ মাসের জীবনটা একটু অগোছালো হয়ে গেছে।  তাকে একটু সৌষ্ঠবপূর্ণ  সুন্দর সুষমা মন্ডিত করতে হবে। সামনে আবার ছটা মাস পার হতে হবে। এলোমেলো দৈনন্দিনতাকে গুছিয়ে নেওয়ার নামই পুজো। আসলে দেবীকে সামনে রেখে এ আমাদের জীবনের আরাধনা। দেবী কত সুন্দর সেজে আসেন। পুত্র কন্যাকে নিয়ে।  আমরাও যদি আমাদের প্রতিদিনের সংসারকে  এমন সুন্দর করে যত্ন করে শীলিত করে তুলতে পারি তবে তা হয়ে যায় জীবনের অর্চনা।  বাঙালি তো তাকে মেয়ে কল্পনা করেই নিয়েছে। যদি আরো এক ধাপ এগিয়ে মনে করি আসলে এই দেবী আরাধনা সুন্দরের আরাধনা। সুন্দরের পাদপীঠ তলে যেখানে কল্যাণ দীপ জ্বলে। 
🍂

কিন্তু বাস্তবে দেখছি  মায়ের আরাধনার কোনো সুদূর প্রসারী না হোক কোনো সম্বৎসরীয় ইমপ্যাক্টও পড়ে  না  জনমানসে বা জীবন চর্যায়। সুন্দর বেশভূষার নকল চাকচিক্যের আড়ালে পুজোর আসল নির্যাস লুকিয়ে যাচ্ছে। মন্ডপে শুরু আর মন্ডপেই শেষ-- এ পুজোর আবেশ আবেগ। সারা বছরের জন্য সুন্দরের সঞ্চয় কোথায়? 
বড় কঠিন এ প্রশ্ন। ততোধিক কঠিন এর উত্তর ।

যুদ্ধ তো একদিন থামবে। থামছে কৈ? অসুন্দরকে সরিয়ে দিতে না জানলে, প্রত্যাখ্যান করতে না শিখলে  এ পুজোর মর্ম  কেবল নিস্ফল পাথরে মাথা ঠোকে, শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি হয়ে সব মন্ত্র ব্যর্থ হয়ে বিলাপ করবে। 

কিন্তু পুজো মানে ত তাই নয়।‌

         প্রকৃতি সুন্দর। পরিবার সুন্দর। সংসার সুন্দর।  জীবন শৈলী সুন্দর। এই দেবী অর্চনার অনেক পরত আছে। মা আসছেন । ছেলে মেয়েদের নিয়ে।  আসলে তো বিদ্যা ধন সাহস নিষ্ঠার প্রতীক চার ছেলে মেয়ে। মানুষের প্রতিদিন এগুলো লাগে। প্রত্যেকে এসেছে নিজস্ব বাহন নিয়ে।  হিংস্র বন্য ,  মৃদু বন্য,  ঘরে ঘোরাঘুরি করা সব পশুর  স্থান মায়ের চারপাশে।  বিরাটাকার সিংহ থেকে ক্ষুদ্রাকার ইঁদুর ---মেরুদন্ডী থেকে সরীসৃপ, নিশাচর থেকে  জলচর --সবাই হাজির। এতো একটা ইকোসিস্টেম।
নব পত্রিকা একটি শস্যপূর্ণা বসুন্ধরার গল্প বলে। কলা  মানকচু  বেল ডালিম  জয়ন্তী আদা হলুদ   --ফল সব্জি  মিলে একজন  গৃহস্থের অবশ্য প্রয়োজনীয় এই   জিনিসগুলি। অল্প খরচের জীবনযাপনের উপাদান। দেবীর আরাধনায় যা উপচার আমাদের  মাটির পৃথিবীতে তা উপাদান। এখানেও একটি বাস্তুতন্ত্র।
আর এইগুলির মাধ্যমে একটি  বৃহৎ‌ বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষার বার্তা দেয় এই দুর্গাপুজো। এই আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন না হলেও কিন্তু দেবী আরাধনার কোনো খামতি থাকবে না। কিন্তু খামতি থাকবে আমাদের জীবন সংসারে সমাজে যখন  এই বন্যজন্তুরা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আসলে বন্যজন্তুদের বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানোর  একটা বার্তা এই পুজো। পেঁচা প্রায় বিলুপ্তির পথে,  প্রকৃতির কোলে ময়ূরের চারণভূমি ক্রমশ কমছে।  সিংহের অরন্য আর তেমন ঘন নেই। শুধু এরা নয় এরা যদি প্রতিনিধি হয় তবে আমাদের পুরো বন্যজগতকে বাঁচাতে এগিয়ে আসতে হবে।  হাইব্রিড ফসল ফল থেকে আমাদের দেশীয়  শষ্য ফলমূলে ফিরতে হবে। তবেই আমরা রোগমুক্ত হবো। 


জীববিজ্ঞান বা আর্থসায়েন্সের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে এই পুজো এক বৃহৎ ইকোসিস্টেমকে লালন পালন করছে। মানুষের অন্তরের যেমন উন্নয়ন দরকার  তেমনি দরকার মিলেমিশে থাকার। মানুষ পশুপাখি অরন্য গাছপালা সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে বেঁচে থাকার নাম শারদীয়া দুর্গোৎসব।
পুজো নিয়ে গল্প যাই থাক আসলে  এটি বছরের মধ্যভাগে বাস্তুতন্ত্র  রক্ষা করার প্রয়াস।

Post a Comment

0 Comments