আন্তর্জাতিক বয়স্ক দিবস শুধু পালনীয় নয়, হোক কার্যকরীও
প্রসেনজিৎ রায়
বয়স ৬০ বছর অতিক্রান্ত হলেই তাঁকে আমরা বয়স্ক নাগরিক হিসাবে বিবেচনা করি। তাঁদের সামাজিক সুরক্ষার জন্য রয়েছে আস্ত একটা দিবস। আজ ১লা অক্টোবর বিশ্বজুড়ে সেই দিন পালন করা হচ্ছে। কিন্তু সত্যই কি বয়স্ক সহ- নাগরিকদের প্রতি আমরা এতটা সংবেদনশীল? বয়সকালে মানসিক তথা সব ধরণের নিরাপত্তাও শান্তি কি পেয়েছেন বয়স্ক নাগরিকেরা !
বয়স্ক জনসংখ্যার সমাজে, বিভিন্ন ধরণের কার্যকরী ক্ষমতাসম্পন্ন বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার সাথে মানিয়ে নেওয়ার বিষয়টি অপরিহার্য হয়ে ওঠে। বিভিন্ন দরকারি কাজ সম্পাদন এবং দৈনন্দিন কার্যকলাপে অংশগ্রহণের ক্ষমতা কেবল একজন ব্যক্তির সহজাত ক্ষমতা দ্বারাই প্রভাবিত হয় না। যে সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষকে বাস করতে হয় তার দ্বারাও এই ক্ষমতা প্রভাবিত হয়। বয়স্ক ব্যক্তিদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের কার্যক্ষমতার মাত্রা এবং স্বাধীনতা বজায় রাখতে সহায়ক পরিবেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
🍂
৬০ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সের মানুষের সংখ্যা সারা বিশ্বে গত ৩০ বছরে দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। ১৯৯৫ সালে বিশ্বজুড়ে ষাটোর্ধদের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৫৪ কোটি ১০ লক্ষ। ২০২৫ সালে এই সংখ্যা ১২০ কোটি এবং ২০৫০ সালে ২১০ কোটিতে পৌঁছাবে বলে রাষ্ট্রসংঘের অনুমান। আবার ২০৮০ সাল নাগাদ, ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু-কিশোরদের চেয়ে বেশি হবে বলেই জনসংখ্যাবিদরা মনে করছেন। বয়স্ক মানুষের সংখ্যা (৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সীদের হিসাবে সংজ্ঞায়িত) ১৯৮০ সালে প্রায় ২৬ কোটি থেকে তিনগুণ বেড়ে ২০২১ সালে ৭৬ কোটি ১০ লাখে দাঁড়িয়েছে। ২০২১ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে, বিশ্বব্যাপী বয়স্ক জনসংখ্যার অংশ ১০% এর কিছু কম শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ১৭% হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সারা বিশ্বের হিসাবে ২০২৫ সালে মানুষের গড় আয়ু ৭৩.৫ বছর । ১৯৯৫ সালের তুলনায় এই পরিমাণ ৮.৬ বছর বেশি। ৮০ বছর বা তার বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা আরও অনেক দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ২০৩০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এই সংখ্যা সাড়ে ২৬ কোটিতে পৌঁছাবে বলে মনে করা হচ্ছে আর এই সংখ্যা হবে সেই সময়কার শিশুদের চেয়েও বেশি। বয়স্কদের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পুরো জীবনযাত্রা জুড়ে স্বাস্থ্য প্রচার, অসুস্থতা প্রতিরোধ এবং চিকিৎসার অগ্রগতিই তুলে ধরে।
জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে, স্বাস্থ্য পরিসেবা এবং সামাজিক সহায়তার চাহিদা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। ডিমেনশিয়ার মতো সমস্যা বয়স্কদের চলাফেরার অক্ষমতার একটি প্রধান কারণ। এর কারণে প্রাপ্তবয়স্কদের উপর নির্ভরতা অনেক বেড়ে যায় কারণ বয়স্ক মানুষের এই সমস্যায় দরকার বিশেষায়িত যত্ন। আবার সারা বিশ্বের ঘরে এবং বাইরে সমগ্র সেবাকার্যের ৭০% অবদান আমরা নারীদের কাছ থেকে পেলেও বৃদ্ধ বয়সে নারীরা দারিদ্র্যের ঝুঁকিতে বেশি পড়ছেন। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
বয়স্কদের সুরক্ষার বিষয়টি বহুদিন ধরেই আন্তর্জাতিক চর্চার পরিসরে রয়েছে। ১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ১ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক বয়স্ক ব্যক্তি দিবস হিসেবে বেছে নেয়। এর আগে ভিয়েনাতে আন্তর্জাতিক স্তরে বয়স্ক- -ব্যক্তিদের কর্মপরিকল্পনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ১৯৮২ সালে এই উদ্যোগ "বিশ্ব বয়স্ক ব্যক্তি পরিষদ" কর্তৃক গৃহীত হয় আর সেই বছরের শেষের দিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অনুমোদন লাভ করে।
১৯৯১ সালে, রাষ্ট্রসংঘ-এর
সাধারণ পরিষদ বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য নীতিগুচ্ছ গ্রহণ করে। ২০০২ সালে, দ্বিতীয় বিশ্ব বয়স্ক ব্যক্তি পরিষদ একবিংশ শতাব্দীতে বয়স্ক জনসংখ্যার ব্যক্তিত্বের সুযোগ এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং সকল বয়সের জন্য এক উপযোগী সমাজের উন্নয়নের লক্ষ্যকে সামনে রেখে "মাদ্রিদ আন্তর্জাতিক বয়স্কব্যক্তি কর্ম পরিকল্পনা" গ্রহণ করে। ২০০২ সালে স্পেনের মাদ্রিদ শহরে গৃহীত এই "আন্তর্জাতিক বার্ধক্য সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা" বিশ্বব্যাপী বার্ধক্য নীতির পথিকৃৎ হিসেবে চিহ্নিত। সুসংহত উন্নয়ন, স্বাস্থ্য এবং সহায়ক পরিবেশের উপর কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে সকল বয়সের জন্য একটি বাসযোগ্য সমাজ গড়ে তোলার অঙ্গীকার সেখানে করা হয়েছিল।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক স্তরে বয়স্ক নাগরিকদের সুরক্ষার কথাটি অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ২০২৫ সালের এপ্রিলে মাসে রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার পরিষদের ৮১টি সদস্য রাষ্ট্র বয়স্ক ব্যক্তিদের মানবাধিকার সংক্রান্ত প্রচার এবং সুরক্ষার জন্য উপযুক্ত বাধ্যতামূলক আইনি সংস্থান তৈরির প্রচেষ্টা নেয়। স্থানীয় এবং বিশ্বব্যাপী উভয় স্তরেই বয়স্ক ব্যক্তিদের অগ্রগতির চালিকাশক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা এই নীতিগুলিতে বলা হয়।
জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের ফলেই এই পদক্ষেপ আগের চেয়েও অনেক বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বয়স্ক ব্যক্তিরা সমাজের দ্রুত বর্ধনশীল অংশ। এই বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্যসেবা এবং সামাজিক সুরক্ষার ন্যায্য প্রাপ্যতা নিশ্চিত করে এবং বৈষম্য দূরীকরণ সুনিশ্চিত করার নীতিই পারবে এই বার্ধক্যপূর্ণ বিশ্বে সুসংহত
উন্নয়ন সুনিশ্চিত করতে । বয়স্ক ব্যক্তিদের কণ্ঠস্বরকে জোরদার করে এবং তাদের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে, আজকের এই আন্তর্জাতিক দিবস বয়স্ক ব্যক্তি- -দের তাদের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করার, তাদের অধিকারের পক্ষে কথা বলার এবং তাদের মর্যাদা ও সুস্থতা নিশ্চিত করুক- আমাদের এটাই প্রার্থনা। প্রকৃত অর্থেই চলতি দশক যেন হয়ে ওঠে, "স্বাস্থ্যকর বার্ধক্যের দশক"।।
0 Comments