জ্বলদর্চি

গুচ্ছ কবিতা /বাসুদেব গুপ্ত

গুচ্ছ কবিতা
বাসুদেব গুপ্ত


নগণ্য

নীল মার্বেল গড়িয়ে চলেছে যেতে দাও 
আকাশ যেখানে শেষ হয়ে গেছে অজানায়, 
খেলছে বালক একলা এ মাঠে আনমনে, 
সময় মরলে সুরের জন্ম হোক না হোক। 

কথা হতে লাগে দুটি জীবন্ত প্রাণ
ঘর হতে লাগে কেউ জানে কতজন?
দেশ হতে লাগে কতজন প্রতিবেশি
কফিনের পাশে শববাহী কতজন?

যেন মাদুরের মত‍ কেউ এসে দেবে গুটিয়ে
সময় হলেই এই বসবাস সুখস্নান, 
যেন কেউ এসে খুলে দেবে নীল মশারি 
দেখা যাবে দূরে সিলিং ফ‍্যান আর ফাঁকা ছাদ। 

আমাদের চোখে দেওয়া হয়েছিল আঁশফল 
আমাদের ঠোঁটে আঁকা ছিল রসদ্রাক্ষা, 
আমাদের বুকে ছিল পারাবত হৃদয়ে 
আকাশে ওড়ার শিশুসম্ভব স্বপ্ন। 

খেলতে খেলতে বল গেল কেন হারিয়ে? 
দৌড়ে দৌড়ে হল শান্ত্রীও ক্লান্ত, 
দুপুরেই এলো গাঢ় মেঘ নিয়ে মিসাইল- 
কটি শিশু আর কবিতা কি যে নগণ‍্য।

 
ডাক

সে ডাকে আমায়।
বেলা পড়ে আসে, আলো যাই যাই করে; 
সমুদ্রে উত্তাল ঢেউ ক্লান্ত হয়ে বালুকাশয়ন পেতে চায়।
কারা যে নৌকো ছাড়ে? নোঙর বাঁধন ছেড়ে দিলে
যাবে কোন দূরে এক জান্জিবার দ্বীপে 
কিছু মোম জ্বলে নেবে অসহায় নির্দয় হাওয়ায়
চলে যায় চলে যায় খেলার সময় 
সে ডাকে আমায়। 

ডাক নিয়ে ছুটে যায় হাজার পিওন… 
ডাক ছোটে ডাকাতের মত রণপায় 
ডাক দেয় লাল লাল ডাকবাক্স ভরে যায় লন্ডন শহর
কোন এক নিরাময়বিজ্ঞানী ডাক্তারবাবুর মত
ক্লান্তির শেষে আরো অধ‍্যবসায়
সে ডাকে আমায়। 

জলের শরীরে মিশে আমি সেই ডাক শুনি ঝিনুকের কাছে
হাওয়ার কার্পেটে আমি স্থির শুনি সোনালী বৃষ্টিমাখা গাছে
ফিরোজা রঙের পাখি নীলিমায় ঠোঁট ছুঁয়ে ডাকে
দিন আর রাতের মাঝে লুকানো অন্ধকারে জোনাকিরা ডাকে 
ঘুমের সময় এসে যায়, আমার দেয়ালে কাঁপে অপরিচিতের ছায়া 
বুঝিনা দূরের থেকে সারাটা পৃথিবী কেন ডাকে 
কাকে?
দূর কোন গ্রামে এক অলস দীঘির ঘাটে বসে
একাকী পাখীর মত নারী এই অমোঘ বিনাশী সন্ধ্যায় 
সে ডাকে আমায়….

🍂


ধর্ষণের পরে

একটা বাঁকাচোরা শহর একটু কাটাকুটি 
খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়া 
পুরনো গলি ছেঁড়া হাওয়াই চটি 
একটা ঘণ্টাঘর, 
অন্ধকার দাঁড়িয়ে আছে অনিচ্ছুক সে স্বয়ংবরা 
সারাটা রাত নেচেছে কাল বস্ত্রহরণ পালায় 
শরীর কখন দোকান হলো 
খদ্দেরের ছুরির ফলা
খেয়েছে তার পুতুল বাড়ি 
ছিঁড়েছে তার ওড়ানো লাল ফিতে 
দাঁড়িয়ে এখন ভোরের খোলা পাটে 
দুহাত তুলে যীশুর অভিনয়ে 
ব‍্যস্ত তার ভাই তার বাড়ীর লোক 
ফটো ওঠার আগেই 
দুনিয়া তার সাজাতে গেছে চিতে। 

তাকে আপন বলে দাবী করার 
কোথাও কেউ নেই,
নানারকম ঘণ্টা দুলে ওঠে শব্দ গেল কই? 
শব্দ গেছে শবের দেশে একটা দাড়িওলা 
মানুষ দেখো যাচ্ছে হেঁটে লাশটা কাঁধে নিয়ে। 
ঘণ্টাঘরে দাঁড়িয়ে একা শ্রী ও কালো রাত
রক্ত গেছে শুকিয়ে আজ ঝিকিয়ে ওঠে
শিকড়ে তার প্রতিশোধের দাঁত।


 
পাথর

আমাদের আগে ছিলো এই পাথর।
আমাদের পরেও থাকবে এই পাথর 
না নিষ্ঠুর, না নির্লিপ্ত, না জীবিত না মৃত
শুধু পাথর।
আকাশে ঘুরছে লক্ষ লক্ষ পাথর 
গোল চৌকো, গরম, শীতল, শিল্পহীন, গীতহীন
তাদের হৃদয়ে শুধু ভরা আছে টনটন
ইলেক্ট্রন নিউট্রন প্রোটন যাকে আমরা পদার্থ বলে ডাকি। 

কে এসে ঝরিয়ে ছিল প্রথম চোখের জল 
সে কি প্রথম কবি?
কে প্রথম পাথরে চোখের জল মেখে 
নরম মাটিতে এঁকেছিল চোখ
পাখির, হরিণের, বাঘের, মানুষের 
কোরাল রীফের নীচে রঙিন রঙিন সব অবাক মাছের
চোখ?

কে এসে শিখিয়েছিল মাটিতে দুঃখ মেখে 
হাত হয়, হাতে ফোটে চাঁপার আন্গুল‍, 
আঙুলে আঙুলে কেমন শিকড়ের জন্ম হয়
শিকড় মাটির কাছে সারারাত ধারাপাত শেখে
বাঁচার সরসতা নদীতীরে সারসের মত উড়ে যায়
নিটোল চোখের মত জলে ছবি ফোটে ধবল পাখার
নির্বোধ অস্তিত্বে হয় অকাল বোধনে আসে 
প্রেম। 

আমরা থাকবোনা শুধু থেকে যাবে কঠিন পাথর।
পাথরে ফসিল হয়ে থেকে যাবে গোপন গুহায়
হরিণের চোখ 
সারসের ডানা
মানুষের হার না মানা 
নিকষিত হেম।

 

দুঃখ

দুঃখের কাছে তুমি যেতে গিয়ে
বারবার ফিরে আসো ঘরে 
নীলাভ অগ্নিতে জ্বলে তোমার বার্নার
আমি দেখতে পাই। 

ঝড় এলে তোমাকে ছাদের কিনারে 
পতাকার মত উত্তেজিত যুদ্ধরত দেখি 
জানলার ঘষা কাঁচে টলটল করে 
সারারাত ঝড়সেঁচা জলমুক্তাকণা
তুমি দেখেও দেখো না 
মোমের পর্দা সরিয়ে সরিয়ে তুমি খোঁজো
শরাবের মত এক শান্ত আকাশ 
দ্রাঘিমার হাত ছেড়ে চিঠির হলুদ দেশে যেতে যাও 
লাল নীল পোস্টবক্সে পড়ে থাকে 
তোমার কেরানী ছায়া
বাঙলা কবিতা লিখে রোজ রাতে হিসেব মেলানো 

হয় না। তাই তুমি দুঃখের দেশে যেতে গিয়ে 
বারবার ফিরে আসো 
বাংলার কবি তুমি বাংলায় ঠিকানা লিখে
গুগল ম‍্যাপের কোন 
সাহায্য পেলে না?
কবিতার দেশ চলে যায় গুগলের মুঠি খুলে দূরে
ছায়াছায়া আশ্বিন দুপুরে।


 
কথা

কথায় কথা বাড়ে
চলতে চলতে বাড়ে কবিতা 
একটু খুনসুটি আর একটু আদরে
বাড়ছে তরতরিয়ে আঙুরলতাটা। 

কখন কি যাদুতে
আঙুরে মধু জমে কে জানে
কখন গোপন ছোঁয়া জমায় সোমরস
শায়রী শোনায় কোলে শায়িতা সাকী। 

কখন কিভাবে হয় আকাশে রামধনু
কখন গোলাপ ফোটে অধরে
কখন ব‍্যস্তডানা ভোমরা বিবাগী 
মধুর কূপে ডুবে মরে?

আকাশে হাত মেলে কখন ছোঁয়া যায়
চাঁদের আলোয় ডোবা পরীকে
কখন পদ্ম ফোটে চোখের দীঘিতে
হাসিতে বিজলী লাজে নিভে যায়?

স্বপ্নে পৃথিবী যেন 
কবিতা লেখা খাতা সারারাত
অমৃত কলম থেকে ছন্দ ঝরে যায় 
ঘুমকে জড়ায় ভালেবাসা।

 

কবে

জানি তুমি কেন ধীরে ধীরে 
কালো গর্তের মধ‍্যে ঢুকে যাচ্ছো 
জানি তোমার মনে হয় অভিকর্ষ প্ল‍্যসেন্টা ছিঁড়ে
অক্সিজেন চলে গেছে ধূমকেতু চড়ে 
ফুসফুস ফুলে উঠছে 
খোলা বাতাস নেই। খোলা আকাশ নেই। 

জানি তোমার লজ্জায় নীল হয়ে আসে ঠোঁট
শুধু এই বিছানা তোষক রান্নাঘর এই চক্রব‍্যূহ 
ই এম আই দিয়ে যেতে হয়। 
যতক্ষণ না ঘামের রং হয় লাল 
যতক্ষণ না দড়ি পাকাতে পাকাতে পাকাতে 
আঙুল হয়ে যায় লাউডগা
একটা কাঁটাগাছে দিনগুলো কোনমতে ঝোলে। 

লজ্জার লতা নয় সলতে পাকাবে কবে নারী
কবে দশটা হাত দিয়ে অধিকারে নেবে দশমিক 
কবে বলবে হে মহাজন 
যে জমিতে চাষ করো সে জমি আমার
সেখানে পুঁতবো আমার নিজস্ব এক চারা 
ফুল ফল পাতা যাই হোক তাতে 
আমার নিজস্ব গাছ নিজস্ব জীবন। 
নারী তুমি কবে রানী হবে?

Post a Comment

1 Comments

  1. যেদিন মুকুট নামিয়ে রেখে,
    নিজের ঘামেই লিখব রাজকথা,
    যেদিন আঙুলের দড়ি ছিঁড়ে বলব
    “আমার জীবন আমারই উপাখ্যান”,
    সেদিন দূর নয়
    যখন নারী মনে লুকোনো রানী পেয়ে গেছে আকাশের ঠিকানা।

    ReplyDelete