যাত্রা দেখা : স্মৃতির সরণি বেয়ে
অমর সাহা
মৌপাল দেশপ্রাণ বিদ্যাপীঠ ( অষ্টম শ্রেণি) পর্যন্ত গ্রামের স্কুলে পড়াশুনো করে চলে গেলাম খসলা ইন্দুমতী উচ্চবিদ্যালয় পড়তে। সেই ঘরের গণ্ডি পেরানো আমার। আজকের মতে এত গাড়ি ঘোড়া ছিল না; রাস্তাঘাট ছিল অনুন্নত। মানুষের মন ছিল উদার। শালবনি বাসস্ট্যান্ড থেকে সাইকেল কিংবা হেঁটে যেতে হোত ভাউদি গ্রাম। বর্ধিষ্ণু গ্ৰাম। অনেক মানুষের বসবাস। ১৯৮৩-৮৪-৮৫ খ্রিস্টাব্দের দিকেই ভাউদি হাই স্কুলের দুটি কিংবা তিনটি বুথে ভোট হতো। ভাউদি গ্রামের স্কুলটি এইট পর্যন্ত হয় ওখানে ভর্তি না হয়ে ভর্তি হয়েছিলাম খসলা হিন্দুমতী হাইস্কুলে। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন চাঁদাবিলা গ্রামের রবীন্দ্রনাথ ঘোষ। চাঁদাবিলা গ্রাম ভাউদি গ্রাম থেকে পাঁচশো মিটার পূর্বে। ভাউদি ছিল আমার মামার বাড়ির দেশ। ভাউদি ও চাঁদাবিলা গ্রামের মাঝেই ছিল সাতবউনী গরম দেবতার থান। লোকে ওই দেবতার স্থান পেরিয়ে যাওয়ার সময় এক পয়সা, দু’পয়সা, তিন পয়সা ছুঁড়ে দিত দেবতার দিকে। এই গ্রামের দক্ষিণ দিকে ছিল জঙ্গলে ভরা। এখন অবশ্য জঙ্গল কেটে অনেকে বসবাস করছে। এই দেবতা স্থান সব সময় গমগম্ করতো পৌষসংক্রান্তির সময়, অমাবস্যা ও পূর্ণিমাতে, শনি ও মঙ্গলবার দিন। দিদিমাকে দেখতাম প্রতি সংক্রান্তিতে পুজো দিতে।
ভাউদি মৌজার প্রাপ্ত সীমায় মোরাম রাস্তার দক্ষিণ পাশে দুটি চলতা ও মহুয়া গাছের তলায় সাতবইনি দেবতার থান। সাতবইনি শব্দে একক দেবীর নাম বোঝায় না। এখানকার দেবীর একটিই মূর্তি। তাছাড়া দেবীর স্থানে পাথর খন্ড একটি বা হাতি ঘোড়া সাতটি নয় - অনেক বড়ো বড়ো হাতি ঘোড়া আছে। তবে প্রাচীন ভারতীয় হিন্দুসমাজে সপ্তমাতৃকা দেবীদের পুজো হোত। এদের নাম ইন্দ্রানী, কৌশরী, চামুন্ডা,বারাহী, ব্রাহ্মণী, বৈষ্ণবী এবং মহেশ্বরী। ওড়িশার ভুবনেশ্বরের পরশুরাম মন্দিরে জগমোহনে এই সপ্তমাতৃকার মূর্তি খোদিত আছে। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরে জোড়বাংলা মন্দিরের টেরাকোটা শিল্পরূপে যুদ্ধরত সাতনারীর প্রতিকৃতি আছে। এই সপ্তমাতৃকা থেকেই সাতবইনী বা সাতচৌনীর উদ্ভব হতে পারে। এ বিষয়ে গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসুর অভিম, মনে হয় পল্লীর অনুন্নত সমাজ যখন শাস্ত্রীয় দেবতা পূজায় বঞ্চিত ছিল, সেই সময় সপ্তমাতৃকার অনুকরণে তাদের কল্পনা অনুযায়ী তারা সেই সাতদেবী ভগ্নির সৃষ্টি করেছিল। এই দেবীরা কালক্রমে কোন কোন স্থানে ‘সাতবোন’, কোথাও ‘সাতবউনী' হয়েছেন। আবার ইসলামযুগে দু'এক ক্ষেত্রে এরা ‘সাতবিবি’তে পরিণত হয়েছেন। এই ‘সাতবইনী' তলায় কতবার যে পয়সা ছুড়ে দিয়েছে তা ইয়ত্তা নেই।
প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে আমি বড় হয়েছি। চারপাশে জঙ্গল শিয়ালের সমস্বর, হায়নার আক্রমণ যে কোন সময় ঘটে যেতে পারে। ভাউদি যাওয়া পথে আগে ভাঙ্গা বাঁধ এলাকায় আগে খুব চুরি-রাহাজানি হোত। তখন ছিল মোরাম রাস্তা - লাল ধুলোয় ভরা আর এখন পিচের রাস্তা-বাস চলে দু’একটা। বাড়ির বাইরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম। চারিপাশের জঙ্গল ঘেরা এলাকায় মহুয়ার মাদকতা ছড়াতো বাতাসে। ক্লাস নাইন পর্যন্ত আমি হোস্টেলে থেকেছি। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় মামার বাড়িতে চলে আসি। বড়োমামা ছেলে স্কুল শিক্ষক। ফলে সকালে ভাত খেয়ে দেড় মাইল হেঁটে স্কুলে গেছি। বর্ষাকালে গামছা পড়ে তমাল নদী পেরাতাম হই হই রই রই করতে করতে যেতাম দলবদ্ধ ভাবে। আমার হোস্টেল জীবনের বড় কীর্তি হোস্টেল সুপারকে জব্দ করা। হোস্টেল সুপার ছিলেন কমলাকান্ত বাবু। পদবি মনে নেই। উনি বাঁকুড়া জেলার মানুষ ছিলেন। স্কুল ছুটির পর উনি উনার ঘুম ঢুকে নাক ডেকে ঘুমাতেন। ঠিক ন’টা বাজলেই উনার ঘুম ভেঙ্গে যেতো। একাই থাকতেন। আগে ছেলে থাকতো। ছেলে মাধ্যমিকে ভালো ফল করে দেশে ফিরে গেছে। শনিবার উনি বাড়ি যেতেন।
আমার হোস্টেলের পাঁচজন দশম শ্রেণির ছাত্র শুক্রবার ছ'পিরিয়ড ক্লাস করে গোপনে বেরিয়ে পড়ি যাত্রা দেখতে। ওখান থেকে চন্দ্রকোনা রোড আধঘন্টার রাস্তা হেঁটে। ছ’টা থেকে যাত্রা শুরু সাড়ে আটটায় শেষ। ন’টায় খাওয়া-দাওয়া হতো হোস্টেলে। কমলাকান্তবাবু কিছুই জানতে পারবে না। উনি জানতেন না। ঘর শত্রু বিভীষণের মতো পঞ্চম শ্রেণির একজন ছাত্র জানতে পেরে কমলাকান্ত বাবুকে বলে দেয়। কিন্তু পরের দিন শনিবার বলে উনি প্রথম দিকে ক্লাস নিয়ে চলে যান; প্রধান শিক্ষকের নালিশ করার মতো উনার সময় নেই। ওখান থেকে হেঁটে নয়াবসত ওনাকে বাস করতে হয়। ফলে সে যাত্রায় আমরা পাঁচজন তরুণ- তুর্কি দুষ্ঠু বুদ্ধি করেও শান্তির হাত থেকে বেঁচে গেলাম।
সোমবার কমলাকান্ত বাবুকে খুব তোয়াজ করলাম সকালেই আসতে। টুক করে সবাই প্রণাম করে নিই। কমলাকান্তবাবু বলেন - সবই বুঝি, বয়সের ধর্ম। তবে এ যাত্রায় বেঁচে গেলি, আমি হেড স্যারকে নালিশ করছি না। আর এবার টুক করে স্যারের পা ছুঁয়ে প্রণাম করে সমাস করে বললাম - এ ধরনের কাজ আর করবো না।
তারপর থেকে মামা আমাকে হোস্টেলে থাকতে দেয়নি।
0 Comments