জ্বলদর্চি

ড. হরিসাধন গোস্বামী (অধ্যাপক, গ্রন্থকার, পাঁশকুড়া) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৮২
ড. হরিসাধন গোস্বামী (অধ্যাপক, গ্রন্থকার, পাঁশকুড়া) 

ভাস্করব্রত পতি

'শুশনি কলমি গিমা শাক
গেড়ি গুগলি কাঁকড়া কুচো মাছ
মাঝে মাঝে হরিমটর
নিষ্ফলা নির্জলা সারা দিনমান
রাত্রির বাতাস কী ভীষণ ভারী
জানালার ওপারে প্রতিবেশী চোখ যেন ধুন্দুল
এই দেশে এই রকম হয়!'
    -- ড. হরিসাধন গোস্বামী

কবির কলমে উচ্চারিত হয়েছে 'আমি সমুদ্রকে সূর্যকে অন্ধকারকে বেঁধে রাখি একই ছন্দিমায়।' আবার তিনি লিখেছেন, 'ক্ষুধার্ত কালের বুকে নক্ষত্রের চোখ নিয়ে জেগে থাকি রাত্রির আকাশে।' কবির কাছে জীবন মানে অনন্ত আকাশে বিচরণ। তাই তিনি কবিতায় এনেছেন 'জীবন মানে শুধু শিকড় ছুঁয়ে রেখে আকাশ ধরা'। 

ড. হরিসাধন গোস্বামী ১৯২৮ এর ১ লা মার্চ জন্মগ্রহণ করেন পাঁশকুড়ার মধুসূদনবাড় গ্রামে। আদ্যন্ত শিক্ষিত ভদ্রলোক এই মানুষটি জীবনের শেষ সময়গুলি কাটিয়েছেন অত্যন্ত যন্ত্রনাময় পরিবেশে। স্বজন হারানোর বেদনা আর নিদারুণ কষ্ট বুকে চেপে রেখে সাহিত্যচর্চা করে গিয়েছেন নীরবে। যে সম্মান তিনি পেতে পারতেন, সেই সম্মান তাঁকে কেউ দিতে পারেনি। অত্যন্ত ব্যাথাতুর হৃদয়ে তিনি সকলকে ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন অচিরেই। 

এহেন মানুষটি এম এ পাশ করে বিভিন্ন হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেছেন প্রথমে। পাঁশকুড়ার ব্র্যাডলি বার্ট হাইস্কুলে শিক্ষকপদে যোগ দিয়েছিলেন। এই স্কুলে পাঁশকুড়ার প্রোথিতযশা ব্যক্তিত্ব বাসুদেব মাইতি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ১৯৪৭ এর ১ লা সেপ্টেম্বর। তিনি এই স্কুলের স্মৃতি লিখতে গিয়ে ড. হরিসাধন গোস্বামীর প্রসঙ্গ টেনে লিখেছেন, "প্রধানশিক্ষক ছিলেন শ্রীহেমেন্দ্রনাথ মিত্র, এম. এ. বি. টি. এবং সম্পাদক হলেন প্রয়াত জ্যোতিষচন্দ্র মাইতি এম. এ. বি. এল.। আমি পড়াতাম সপ্তম, অষ্টম শ্রেণীর ইংরাজী, ইতিহাস এবং দশম শ্রেণীর ইতিহাস, বাংলা ইত্যাদি। আসার কয়েকমাস পরে আসেন ড. হরিসাধন গোস্বামী। তিনি বি. এ. পরীক্ষা দিয়ে এই স্কুলে শিক্ষকরূপে যোগদান কারন। তবে তিনি কয়েকমাস পরেই বি. টি. পড়ার জন্য স্কুল ত্যাগ করেন।" 

এরপর ১৯৬৭ সালে যোগ দেন দাঁতন ভট্টর কলেজে অধ্যক্ষ পদে। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই ছাত্র আন্দোলনের ফলে উদ্ভুত ডামাডোলে তিনি এক গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের শিকার হন। তাঁর নামে মামলা রুজু হয়। শুরু হয় এক অন্ধকার পরিস্থিতি। তাঁর চাকরি জীবনে নেমে আসে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি। তখন থেকেই অনিয়মিত হতে থাকে তাঁর বেতন। আর যেটুকু পেতেন, তার বেশিরভাগটাই বেরিয়ে যেত এই মামলা লড়ার জন্য। অবশেষে ১৯৮৯ সালে তিনি অবসর নিলেন। কিন্তু তখনও তাঁর পিছু ছাড়েনি কুচক্রীর দল। তাঁর চাকরিজীবনের যাবতীয় কাগজপত্র নষ্ট করে দিয়েছিল পরিকল্পনা করে। ফলে উপযুক্ত কাগজের অভাবে এবং আইনি জটিলতায় তাঁর অবসরকালীন ভাতা এবং পেনশনের সবরকম পথ বন্ধ হয়ে যায়। তিনি হয়ে ওঠেন কপর্দকশূন্য এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। 

ইতিমধ্যে তাঁর স্ত্রী বিয়োগ ঘটে। দুই ছেলের একজন ট্রেন দুর্ঘটনায় ও অন্যজন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ফলে স্বজন হারানোর বেদনা এবং যন্ত্রনা তিনি উপলব্ধি করেছেন মরমে মরমে। ১৯৭৬ সালে ছাত্র আন্দোলনের সময় তিনি গুরুতর আহত হয়েছিলেন। এরফলে তিনি তাঁর বাম কানের শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। সাহিত্যের প্রতি চূড়ান্ত ভালোবাসা তাঁর আজন্ম লালিত দিনযাপন। তাঁর কলমে উঠে এসেছে শিক্ষা, লোকসাহিত্য, সমাজতত্ত্ব, সংস্কৃতি, মনস্তত্ব, সমালোচনা সাহিত্য, গল্প, কবিতা, উপন্যাস, অনুবাদ সাহিত্য ইত্যাদি।

তাঁর লেখা মোট ২৩ টি প্রবন্ধের বই রয়েছে। ড. হরিসাধন গোস্বামীর লেখা ব ইহুদি হল শিক্ষা ও সমাজ (১৯৫৪), যুগের অভিব্যক্তি ও শিক্ষা (১৯৬১), মাধ্যমিক শিক্ষার পুনর্গঠন (১৯৬১), শিক্ষার নতুন দিগন্ত (১ খণ্ড, ১৯৬২, ২য় খণ্ড ১৯৬৩), শিক্ষা সাধনায় পূর্বসূরী (১৯৬৩), বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা (১৯৬৩), বাংলা সাহিত্যের উপাখ্যান (১৯৬৩), শিক্ষার পটভূমি (১৯৭৩), ভারতে মাধ্যমিক শিক্ষার ক্রমবিকাশ (১৯৮০), মধ্যযুগের সাহিত্য ও সংস্কৃতি (১৯৮২), শিক্ষা বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি (১৯৮৪), মার্কসীয় দৃষ্টিতে মানুষ (১৯৮৬), লেনিনের দৃষ্টিতে মানুষ (১৯৬৬), ভারতীয় প্রাথমিক শিক্ষার মূল্যায়ন (১৯৮৭), শিক্ষা ভাবনার নতুন দিগন্ত (১৯৮৭), মার্কসীয় দৃষ্টিতে বিদ্যাসাগর (১৯৮৮), শিক্ষা চিন্তা ও মনোবিজ্ঞান (১৯৮৯), ভারতের শিক্ষা ইতিহাস (১৯৮৮), প্রবন্ধের ধর্ম ও মর্ম (২০০২), শিক্ষাবিজ্ঞান (২০০৪), বিশ্ব ও প্রকৃতি (২০০৮), মেধাবী মনের রং (২০০৪), মানুষের ধর্ম মানুষের বিজ্ঞান (২০০৫)। কবিতা আলগোছ (১৯৫৯), উদাসী তিস্তার কান্না (১৯৬৬), পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে দাঁড়িয়ে (১৯৮০), দগ্ধ এই দিন আমার (১৯৮৩), রক্তে আছো, সমুদ্রেও আছো (১৯৯২), জ্যোৎস্নার অ্যালবামে (১৯৯৭), মুকুরে আমার ছবি (১৯৯৯), মানুষের ঠিকানা খুঁজেছি (১৯৯৯) চলমান প্রতিবিম্ব (২০০১), সময়ের কান্না (২০০৪), হৃদয় অনাবৃত রাখো (২০০৬), স্থাননামের অন্তরালে' (২০১১) এবং দাহ করো সমবেত কান্নায় (২০১২)। A Poet's Muse হল ড. হরিসাধন গোস্বামীর একমাত্র ইংরেজি কাব্য। তাঁর লেখা উপন্যাস হল জাগরণ (১৯৬৯) এবং আগামীকাল (১৯৮৯)।

হরিসাধন গোস্বামীর অনুবাদ গ্রন্থগুলিও অত্যন্ত প্রাঞ্জল এবং সহজ সরল। তাঁর অনুবাদ গ্রন্থগুলি হল -- A Signal in the Viking Star (নিজের লেখা 'পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে দাঁড়িয়ে'), Blood, Ocean and Sparks (নিজের লেখা 'রক্তে আছো, সমুদ্রেও আছো'), The Cosmic Antena (শ্যামল রক্ষিতের কবিতার অনুবাদ, ২০০২), The Eyes Xrayed (হরপ্রসাদ সাহুর কবিতার অনুবাদ, ২০০২), The Typhoonic Harpoon (মোহিনীমোহন গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার অনুবাদ, ২০০৪), Pictorial Tune (সুনীল মাজির কবিতার অনুবাদ, ২০০৭) এবং A Graphic Change of Perspective (স্বপন বাগের কবিতার অনুবাদ, ২০০৫)। 

কবি হিসেবেও তিনি প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। সাহিত্যিক মহলে তাঁর অবস্থান ছিল অত্যন্ত উঁচু আসনে। নানা বিষয়ে তাঁর লেখা আজও গবেষকদের কাছে আলোচনার বিষয়। কবিতার ভাষা সম্পর্কে স্বয়ং কবি হরিসাধন গোস্বামীর অভিমত, "কবি যে ভাষায় কথা বলেন তা যেন কবিতার ভাষা হয়। সে ভাষা কবি পায় চারিদিকের আত্মীকরণ দ্বারা, ভাষা যেন ধার করা না হয়।" কবির কবিতা নিয়ে আরেক কবি স্বপন বাগের উপলব্ধি, "পাঁচের দশকের এই কবি, কবিতার বিবর্তন, ছন্দ, আঙ্গিক, বিষয় ভাবনার সঙ্গে সহমত পোষণ করলেও, উত্তর আধুনিকতা নিয়ে তাঁর ঘোরতর আপত্তি। উত্তর আধুনিক বলে কিছু নেই। এ্যাসিক্যাল লেখায় যদি প্রাসঙ্গিকতা ও লাবণ্য থাকে তবে তা পুরাতন হলেও আধুনিক। উত্তর আধুনিকতার চেয়ে চির আধুনিক। বিশ্বজনীনতা শব্দগুলিকে মান্যতা দিই।"

কবি, প্রাবন্ধিক ও বহু গ্রন্থপ্রণেতা ড. হরিসাধন গোস্বামী সারা জীবনে কিছুই পাননি বলা চলে। রাজনৈতিক দলাদলির বলি হয়েছেন তিনি। অথচ মেদিনীপুরের এই মানুষটি একজন অন্যতম কিংবদন্তি মানুষ ছিলেন। যেটুকু সম্মান পেয়েছেন, তা কেবল জেলার সাহিত্য সংগঠন থেকেই। অথচ তাঁর প্রাপ্তির ভাণ্ডার আরও বড় হতে পারতো। তাঁকে হাউর বেদুইন সংঘ, মেদিনীপুর জেলা নজরুল জন্মশতবর্ষ উদযাপন কমিটি, মেচেদা সাহিত্য একাদেমি, মেচেদা মহামায়া সংঘ ইত্যাদি সংগঠন থেকে সম্মাননা জানিয়েছে। এর বাইরে তেমন কিছুই পাননি তিনি।
🍂

Post a Comment

1 Comments

  1. নয়নের দশকে হরিবাবুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। উনি আমার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে। উনার কয়েকটি বই আমার কাছে আছে। অমায়িক নিরহঙ্কার এই মানুষটি সুভাষ চন্দ্র, গান্ধীজী প্রমুখ মনীষীর সান্নিধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। যেখানেই থাকুন,ভালো থাকুন।প্রণাম।

    ReplyDelete