জ্বলদর্চি

জঙ্গলমহলের লোকগল্প : আশ্চর্য গাছ ও রাজকুমারী /সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস /কথক- সীমা দাস

জঙ্গলমহলের লোকগল্প 
আশ্চর্য গাছ ও রাজকুমারী 

সংগ্ৰাহক- পূর্ণিমা দাস 

কথক- সীমা দাস, গ্ৰাম- ডুমুরিয়া, থানা- নয়াগ্ৰাম, জেলা- ঝাড়গ্ৰাম 

বীরপুর রাজ্যে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের একমাত্র কন্যা ছিল রাজকুমারী ইচ্ছামতী। সে যেমন সুন্দরী তেমনি খুব জেদী ও অহংকারী। সে এত সুন্দরী ছিল যে তার রূপ দেখার জন্য দেশ-দেশান্তর থেকে ছুটে আসত রাজা, রাজকুমার, বণিক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষেরা। কিন্তু রাজকুমারী এত অহংকারী ছিল যে সে মানুষকে মানুষ বলে মনে করত না।

দাসীরা এসে যখন তাকে বলত-“রাজকুমারী, চলো। সবাই তোমাকে দেখার জন্য অপেক্ষা করছে।”

তখন রাজকুমারী ইচ্ছামতী বলত-“করুক, তাতে আমার কী? সুন্দর চেহারা দেখার জন্য একটু সময় ব্যয় করতেই হয়। আর এই দেখ আমার চুলটা তোরা কীভাবে বেঁধেছিস? এই চুল নিয়ে কী বাইরে যাওয়া যায়? এখুনি ঠিক করে দে, তা নাহলে পিতাকে বলে তোদের সবাইকে এই প্রাসাদ থেকে বের করে দেব।”

দাসীরা তখন ভয় পেয়ে যায়। আর তারা বলে-“না না রাজকুমারী। তুমি এরকম করো না। আমরা এখুনি তোমার চুল ঠিক করে দিচ্ছি।”

তখন রাজকুমারী বলে-“ঠিক করতে হবে না। আবার নতুন করে চুল বেঁধে দে তোরা।”

এই কথা শুনে দাসীরা আর কিছু না করে চুপচাপ রাজকুমারীর চুল বেঁধে দেয়।
🍂

এ রাজ্যেই থাকত রতন নামের এক কাঠুরে। জঙ্গল থেকে কাঠ কুড়িয়ে গাছের যত্ন করে মহানন্দে তার দিন কেটে যেত। সে কাঠুরে হওয়া সত্ত্বেও কোনোদিন গাছের ডাল কাটত না। গাছেদের সে খুব ভালোবাসত। তাই সে তার লাগানো গাছ এমনকি জঙ্গলের প্রত্যেক গাছের একটা করে নাম দিয়েছিল আর ডাকতও সেই নামে। 

আর এদিকে রাজকুমারী ইচ্ছামতীর রূপ দেখে সবাই বলত-“আহা কী সুন্দর রূপ। এমন রূপবতী কন্যা কোনো রাজ্যে নেই। এ হল আমাদের রাজ্যের গর্ব।”

এছাড়া অন্যান্য দেশের রাজা, রাজকুমাররা অপেক্ষা করে থাকত রাজকুমারীকে দেখার জন্য। এইভাবে নানা রাজ্য থেকে রাজা, রাজকুমার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই আসে।

আর এদিকে রতনের যত্নে বেড়ে ওঠে এক আশ্চর্য গাছ। 

রতন প্রতিদিন গাছের যত্ন নেওয়ার সময় তাদের সঙ্গে কথা বলত। সে বলত-“কী রে বোধন, কী রে বেলা ভালো আছিস তো?”

এরপর সেই আশ্চর্য গাছটিকে দেখে রতন বলে-“তোর কী নাম দি বল তো? কারণ আমি তো জানি না তোর কী ফল হবে এবং কী ফুল হবে? আচ্ছা তবুও তোর একটা নাম দিচ্ছি। আজ থেকে তোর নাম হল-‘অজানা’। কারণ আমি তোর ব্যাপারে কিছু জানিই না। হা হা হা।”

এরকম করে সময় পেরিয়ে যায়। আর সেই গাছটিও ধীরে ধীরে বড়ো হতে থাকে। তার ফুল ফোটে আর সেই ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে সারা রাজ্যে। রাজ্যবাসীদের নাকে সেই গন্ধ লাগতেই তারা সবাই বলাবলি করতে থাকে যে এত সুন্দর গন্ধ আসছে কোথা থেকে। 

তখন তাদের মধ্যে একজন বলে-“কোথা থেকে এত সুন্দর গন্ধ ভেসে আসছে বল তো?”

এই শুনে আর একজন বলে-“কে জানে, আমরা সবাই তো তাই ভাবছি।”

তখন প্রথমজন বলে-“আহা গন্ধটা পাওয়ার পর থেকেই মনটা একেবারে ভালো হয়ে গেল গো। শুনেছি জঙ্গলে একটা গাছের ফুল থেকে নাকি এই গন্ধটা ভেসে আসছে।”

দ্বিতীয়জন তখন বলে-“হ্যাঁ গো কাকা। তুমি তো জানো আমার বউ অসুস্থ। কাল এই গন্ধটা পাওয়ার পর থেকেই ও বলছে ওর শরীরটা কেমন যেন সুস্থ সুস্থ লাগছে।”

তখন প্রথমজন বলে-“কী বলছ কী! তার মানে এ যে সে গাছ নয় গো। এ কোনো ঔষধি গাছ মনে হচ্ছে। যার গন্ধে মন, শরীর একেবারে ভালো হয়ে যাচ্ছে।” 

এইভাবেই ওই গাছের কথা সমস্ত জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। নানা রাজ্য থেকে লোক আসতে থাকে এই গাছের শোভা ও ফুলের গন্ধ উপভোগ করতে। 

এদিকে রাজকুমারীর অহংকার আগের থেকে আরো বাড়তে থাকে‌। সে রাজামশাইকে এসে বলে-“পিতা, তুমি এখুনি এইসব দাসীদের তাড়িয়ে নতুন দাসী রাখ। এরা আমার ঠিকঠাক যত্ন নিতে পারে না।”

তখন রাজামশাই বলেন-“এরকম করে বলতে নেই মা। ওরা খুব গরীব। তুমি হলে এ রাজ্যের আগামী উত্তরাধিকারী। তোমাকে তো প্রজাদের ভালোমন্দ দেখতে হবে তাই না।”

রাজকুমারী তখন বলে-“আমি এসব কিছু জানি না। তোমাকে এর একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।” 

ঠিক সেইসময় সেখানে মন্ত্রী আসে। সে বলে-“মহারাজ, একজন ভিনদেশী এসেছে।”

তখন রাজকুমারী বলে-“না না আমি এখন কারোর সামনে যেতে পারব না।”

মন্ত্রী তখন বলে-“না না রাজকুমারী। ও তোমাকে দেখতে আসেনি। এ রাজ্যের জঙ্গলে একটি গাছ হয়েছে। যার ফুলের গন্ধে সবাই মেতে উঠেছে। ও সেই গাছ দেখতে এসেছে।”

এই শুনে রাজকুমারী বলে-“কী এমন গাছ, যে কেউ আমাকে না দেখে ওই গাছকে দেখতে চেয়েছে?” 

রাজামশাই বলেন-“আমিও দেখব কী সেই গাছ। মন্ত্রী তুমি ব্যবস্থা করো। তুমি যাবে মা?”

রাজকুমারী বলে-“না পিতা, আমি যাব না। জঙ্গলে যাওয়ার মতো কোনো ইচ্ছাই আমার নেই।”

রাজামশাই বলেন-“আচ্ছা ঠিক আছে। চলো মন্ত্রী আমরা যাই।”

এই বলে রাজামশাই সেখান থেকে চলে যান।

একে একে রাজ্যের সমস্ত মানুষ উপস্থিত হয় সেই আশ্চর্য গাছ দেখতে এবং তার ফুলের গন্ধ নিতে। 

সবাই তখন রতনকে বলে-“রতন তুই এই গাছ কোথায় পেয়েছিস? আর লাগিয়েছিসবা কবে?”

তখন রতন বলে-“আমি এই গাছ লাগাইনি গো। এই গাছ এমনি এমনি হয়েছে। আমি শুধু জল দিয়ে বড়ো করেছি।”

তখন একজন বলে-“জানিস রতন, এই গাছের জন্য আমার বউ সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে গেছে। যেমন সুন্দর ফুল তেমন সুন্দর তার গন্ধ। এবার থেকে আমরা রোজ আসব এই গাছের কাছে কেমন।”

গাছকে দেখার জন্য সবাই জঙ্গলে চলে যাওয়ায় এদিকে রাজকুমারীর রূপ দেখতে কেউ প্রাসাদে আসে না।

এই দেখে রাজকুমারী তার দাসীকে বলে-“কী হল রে দাসী? আজ কেউ আমাকে দেখতে এল না কেন রে?”

তখন দাসী বলে-“আজ্ঞে রাজকুমারী, সবাই ওই আশ্চর্য গাছ দেখতে গেছে। তাই এখানে কেউ আসেনি।”

রাজকুমারী তখন বলে-“তাই বুঝি, তাহলে তো ওই গাছ কাটতে হবে দেখছি। দাসী, খবর দে ওই রতন কাঠুরে কে এখুনি গিয়ে ডেকে আন।”

এরপর প্রাসাদে ডাক পড়ে রতনের। সব শুনে রতন বলে-“ক্ষমা করবেন রাজকুমারী। আমি কাঠুরে হতে পারি কিন্তু আমি গাছ কাটি না। আর ওই গাছ আমি কিছুতেই কাটতে দেব না।”

এমনকি রাজামশাইও বলেন-“না মা এই ভাবে বলো না ওটা ঔষধি গাছ। আমিও তোমাকে ওই গাছ কাটতে দেব না।”

তখন রাজকুমারী বলে-“বেশ, তাহলে আমি নিজেই ওই গাছ নষ্ট করে দেব।”

রতন গাছ কাটতে রাজি না হওয়ায় একদিন রাজকুমারী মালীর কাছ থেকে লুকিয়ে আগাছা মারার ওষুধ নিয়ে পৌঁছে যায় জঙ্গলে ওই গাছের কাছে। ওষুধ ছড়িয়ে দেয় ওই গাছের চারপাশে। 

আর হাসতে হাসতে বলে-“এবারে দেখব এই গাছ কেমন করে বাঁচে। আর মানুষ এবার থেকে কাকে দেখতে আসে, হা হা হা।”

এরপর রাজকুমারী সেখান থেকে চলে আসে। পরেরদিন সকাল হতে না হতেই রাজকুমারী দাসীদের ডাকতে থাকে। 

রাজকুমারীর ডাক শুনে এক দাসী সেখানে আসে। আর সে রাজকুমারীকে চিনতে না পেরে বলে-“এ কী কে তুমি?”

দাসীরা এরকম বলার কারণ হল রাজকুমারীর সুন্দর রূপ একেবারে অসুন্দর, কুৎসিত হয়ে গেছে।

দাসীর এই কথা শুনে রাজকুমারী বলে-“কে মানে, আমি এ রাজ্যের রাজকুমারী।”

দাসী বলে-“না না এ হতে পারে না, এ হতে পারে না। রাজামশাই রাজামশাই……”

রাজামশাইকে ডাকতে ডাকতে দাসী সেখান থেকে চলে যায়। তখন রাজকুমারী বলে-“দাসীর আবার হল কী।” 

এই বলে রাজকুমারী যেই না আয়নায় তার মুখ দেখেছে তখনই সে ভয় পেয়ে গেছে। 

সে তখন বলে-“এ কী, এ কী এ আমার হল কী করে?”

ঠিক সেইসময় রাজামশাই সেখানে আসেন। তিনি রাজকুমারীর এই রূপ দেখে বলেন-“এ কী, এ কী হল? তুমি কী সত্যি আমার কন্যা?”

রাজকুমারী তখন বলে-“হ্যাঁ পিতা, আমি তোমার কন্যা।”

রাজামশাই বলেন-“কিন্তু তোমার এই অবস্থা হল কী করে? তোমার এই কুৎসিত চেহারা হঠাৎ হল কী করে? আমি এখুনি বৈদ্যকে ডাকছি। বৈদ্য বৈদ্য।”

এরপর বৈদ্য সেখানে আসে। বৈদ্য এসে রাজকুমারীকে দেখে কিন্তু সে কিছু বুঝতে পারে না। 

এরপর রাজজ্যোতিষী সেখানে আসে। সে এসে বলে-“রাজকুমারী কিছু মনে করো না। একটু ভেবে দেখ তো তুমি অজান্তে কী কারোর কোনো ক্ষতি করেছে বা কাউকে কোনোভাবে নষ্ট করতে চেয়েছ, যার অভিশাপে তুমি এরকম হতে পার?”

তখন রাজকুমারী বলে-“না, আমি কারোর কোনো ক্ষতি করিনি।”

রাজামশাই তখন বলেন-“তুমি সত্যি কথা বলছ তো মা?”

রাজকুমারী বলে-“হ্যাঁ পিতা, আমি সত্যি কথাই বলছি।”

ঠিক সেইসময় মন্ত্রী সেখানে এসে রাজামশাইকে খবর দেয় জঙ্গলের সেই আশ্চর্য গাছটি শুকিয়ে গেছে।

এই শুনে রাজকুমারী বলে-“হ্যাঁ হ্যাঁ পিতা, এবার আমার মনে পড়েছে। আমি ক্ষতি করেছি। ওই আশ্চর্য গাছের ক্ষতি আমিই করেছি। কিন্তু ওই গাছ আমাকে অভিশাপ দেবে কী করে ও তো আর মানুষ নয়।”

তখন রাজজ্যোতিষী বলে-“রাজকুমারী ভুলে যেও না গাছেরও প্রাণ আছে, তারও বাঁচার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। সেও যেমন অন্যের ক্ষতি করে না বরং উপকার করে। ঠিক তেমনি সেও চায় না কেউ তার ক্ষতি করুক। আর শুনেছি গাছটি নাকি ঔষধি গাছ। তাই তুমি যখন ওই গাছে ওষুধ দিচ্ছিলে তখন হয়তো তার বাতাস কোনো ভাবে তোমার গায়ে লেগেছে।”

রাজকুমারী তখন বলে-“তাহলে এবার আমি কী করব?”

তখন রাজজ্যোতিষী বলে-“যেভাবে হোক তোমাকে ওই গাছটিকে বাঁচিয়ে তুলতে হবে। তবেই হয়তো তুমি তোমার আগের রূপ ফিরে পেতে পার।”

রাজকুমারী তখন রাজামশাইকে বলে-“পিতা, পিতা তুমি ওই গাছটির পাশে আমাকে একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে দাও। যতদিন না আমি ওই গাছে ফুল ফোটাতে পারছি ততদিন ওই কুঁড়েঘরই হবে আমার ঘর।”

এই শুনে রাজামশাই বলেন-“তোমার এমন ভাবনা দেখে আমি সত্যিই খুব খুশি হয়েছি। আমি আজই সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আর তোমার সঙ্গে আমি মালীকেও পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

তখন রাজকুমারী বলে-“না পিতা দোষ আমি করেছি, তাই তার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যা করার তা আমি একাই করব।”

রাজামশাই বলেন-“বেশ বেশ, মন্ত্রী আজ থেকে কাজ শুরু করতে বলো।”

শুরু হয় ঘর বাঁধা। সেখানে যথাসময়ে পৌঁছে যায় রাজকুমারী, শুরু হয় গাছের যত্ন নেওয়ার কাজ। গাছে জল দেওয়া, মাটি খুঁড়ে পুরোনো মাটি ফেলে নতুন মাটি দেওয়া, শুকনো পাতা, ফুল পরিষ্কার করা। ধীরে ধীরে গাছ প্রাণ ফিরে পায়। গাছে নতুন পাতা গজায়, পাখিরা এসে গাছে বসতে শুরু করে। আর তার সাথে রাজকুমারীও ধীরে ধীরে ফিরে পায় তার রূপ।

এইভাবেই কয়েকদিন কেটে যায়। গাছ তার আগের রূপ আবার ফিরে পায়। আবার সেই গাছের ফুলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে সারা রাজ্যে। 

এই দেখে রাজ্যবাসীরা বলে-“বা বাবা বাঃ আগের থেকে গাছও যেমন সুন্দর হয়েছে তেমনি আমাদের রাজকুমারীও আগের থেকে আরও সুন্দর হয়ে উঠেছে। আহা রাজকুমারীর মুখের কী মায়া খেলেছে দেখ।”

তখন রাজামশাইও বলেন-“মা ইচ্ছামতী, দেখ দেখ দূর দূর থেকে কত মানুষ তোমাকে দেখতে এসেছে।”

রাজকুমারী তখন রাজামশাইকে বলে-“পিতা, পিতা আমি কী আবার আগের মতো সুন্দর হয়ে উঠেছি?”

রাজামশাই বলেন-“হ্যাঁ মা, তুমি আগের থেকে আরও বেশি সুন্দর হয়ে উঠেছ।”

এরপর রাজ্যবাসী সবাই রাজকুমারীর জয় জয়কার শুরু করে।

Post a Comment

0 Comments