ইতিহাসের ফাঁদ । অরিজিৎ লাহিড়ী
পর্ব ৭.
হেমাঙ্গ হাজরা কফির কাপটা টেবিলে রেখে বললেন—
‘বাবা, প্রেমে যেমন সাসপিশন রাখা উচিত, গবেষণায়ও তেমন।গাধামি তো মগজের ভ্যাকুয়াম থেকে আসে।’
নিজেই হেসে উঠলেন।
মহানির্বাণ এবার গলা একটু নামালেন—‘দেখুন, নো গড এক বিপথগামী গোষ্ঠী।ওরা যেকোনও বিপরীত ইতিহাসকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। আপনার গবেষণা ওদের জন্য বিপজ্জনক। আমরা জি ও ডি চাইছি— একটা অল্টারনেটিভ সিম্যুলেশন বানাতে।যেটা সত্যের অন্য মুখ দেখাবে।এবং সেটা আপনার সাহায্য ছাড়া সম্ভব নয়।’
ঋতব্রত আস্তে করে বললেন—‘কিন্তু… কী এমন আছে এই ইতিহাসে?’
হাজরা এবার চশমা খুলে বললেন—‘ইতিহাস মানে— কিছু মানুষ স্টোরি বানায়, বাকি মানুষ সেটা ডাউনলোড করে।যা ঘটে না, সেটাই বেশি ভাইরাল হয়।
এটা পুরোটাই ন্যারেটিভ গেম।’
ঋতব্রত নিচু গলায় বললেন—‘আমার গবেষণায় আমি দেখেছি— হয়তো যুদ্ধটা আসলে ঘটেনি। হয়তো এটা ছিল অশোকের পলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজি, যাতে বৌদ্ধ ধর্ম আর রাজনৈতিক ক্ষমতা দুটোই একসাথে ছড়িয়ে দেয়।
কিন্তু… আমি নিশ্চিত নই…’
মহানির্বাণ বললেন—‘আপনার সন্দেহটাই আমাদের দরকার। উদয়গিরি-খণ্ডগিরি অথবা কটকের ধবলগিরিতে আছে সেই শিলালিপি। কিন্তু আসল অবস্থান আমরা জানি না। নো গড জানে— আপনার মস্তিষ্কের মধ্যেই আছে সেই চাবিকাঠি।’
এই সময়ে হাজরা মুখ খুললেন। হাতে তাঁর সেই ভেপ, চোখে চশমা, মুখে বাঁকা হাসি।
🍂
—‘আমি তো বলেইছিলাম— ইতিহাস আর মানুষের মন একটা খেলার মাঠ। দুটোতেই কেউ না কেউ খেলে যাচ্ছে।’
ঋতব্রত বললেন—‘কী বলছেন স্যার?’
হাজরা গম্ভীর মুখে বললেন—‘আমি বলছি, এই গোটা ব্যাপারটাই ফিল্টারড রিয়ালিটি।তুমি যখন বললে— কলিঙ্গ যুদ্ধ হয়তো আদৌ ঘটেনি— আমি তখনই ধরেছিলাম, তুমি একটা জিনিস মিস করছো।ইতিহাস শুধু বিজয়ীর লেখা নয়,ইতিহাস যার লেখা পৃথিবীকে কেউ জানতে দেয়নি— তারও লেখা।’
মহানির্বাণ একটু চমকে গেল।
—‘আপনি কি বলতে চাইছেন— আমাদের পক্ষও ঠিক নয়?’
হাজরা একটু হাসলেন।
—‘তোমাদের কথায় ইনকনসিস্টেন্সি আছে।
আর আমার সন্দেহ বলছে— খেলোয়াড় আছে আরও। যারা এদের থেকেও বড়।’
ঋতব্রত এবার একটু উসখুস করলেন—‘ডাক্তারবাবু, আপনি কি বলছেন… আরেকটা পক্ষ আছে?’
হাজরা জানালার দিকে তাকিয়ে বললেন—‘এই দুনিয়ায় দুরকমের মানুষ আছে— যারা গল্প বানায়, আর যারা গল্পে বাঁচে। আমি প্রথম দলের।তুমি, ঋতব্রত, তুমিও। কিন্তু ওরা—’ (হাতে ইশারা করলেন মহানির্বাণ আর বাকিদের দিকে) ‘ওরা দ্বিতীয় দলের। ওদের প্রয়োজন তোমার মগজ। কিন্তু মনে রেখো— মগজে লাগাম না থাকলে তুমি মেমরি কার্ড হয়ে যাবে। ডিলিট করলেই শেষ।’
হেমাঙ্গ হাজরা আবার হাসলেন।
—‘আরে ভাই, কেউ আসছে। ডেলিভারি বয় নয় তো? ওদের মুখে হাসি নেই, হাতে বুলেট আছে।’
মহানির্বাণ গম্ভীর মুখে বললেন—‘নো গড। ওরা আমাদের পেছনে।’
হাজরা দাঁত বার করে বললেন—‘চলো, তাহলে এক কাজ করা যাক— ফার্স্ট মুভ নিতে হবে।কারণ, ওরা এলে, গল্পটা আর আমাদের হাতে থাকবে না।তবে হ্যাঁ—এই গল্পের শেষে কেউ মরবে, সেটা আমি গ্যারান্টি দিতে পারি।’
ঋতব্রত কাঁপা গলায় বলল—‘কিন্তু… আমার কী করা উচিত?’
হাজরা চশমা খুলে বললেন—‘তুমি শুধু নিজের ওপর লোডিং বন্ধ করো।যখন সময় আসবে, অটো আপডেট হয়ে যাবে।আর আমি আছি, বাকি সিস্টেম হ্যাকিং আমিই দেখব।’
ঋতব্রতর গলা শুকিয়ে গেল।
—‘ডাক্তারবাবু… এখন?’
—‘এখন? এখন দাঁতে দাঁত চেপে খেলা দেখতে হবে। বলেছিলাম না ভাই, দুনিয়া একটা মেটা-সিম্যুলেশন।’
ক্যারাভানটা তখন সাঁই সাঁই করে এগিয়ে চলেছে পুরী-ভুবনেশ্বর বাইপাস ধরে। চারপাশে ফাঁকা রাস্তা, দূরে ধোঁয়ায় ঢাকা ছোট ছোট গ্রাম, সাদা রঙের পুরনো ঘরবাড়ি। ভেতরে মহানির্বাণ কিছু বলতে যাচ্ছেন, ঠিক তখনই—কাঁচের জানালায় ঝাঁকুনি। ক্যারাভান ব্রেক কষল।
ঋতব্রত আর হাজরা দুজনেই সামনের দিকে ছিটকে গেলেন। হাজরার মুখে ভেপ, সেই চিরন্তন বিরক্তি।
‘কী হলো রে? অটো পাইলট হয়ে গেছিলো নাকি?’ — হাজরা ঝাঁকুনি সামলে বললেন।
চালক আতঙ্কিত গলায় জানাল—‘স্যার… রাস্তার মাঝে একটা কালো এস ইউ ভি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে… আর সামনে কয়েকজন লোকজন দাঁড়িয়ে!’
দাঁড়িয়ে একদল লোক। কালো পোশাক, হাতে ছোট ব্যাকপ্যাক, কোমরে ঝলমলে পিস্তল। ওদের দুটো কালো এস ইউ ভি রাস্তা পুরো জ্যাম করে দাঁড়ানো। দুপাশের সাইডবারিকেডের ফাঁকেও বেরোনো যাবে না।
হাজরা ঠান্ডা। ঠোঁটে বাঁকা হাসি।
—‘দাঁড়িয়ে গেছি তো? এখন দেখি ওয়েলকাম ড্রিংকস দেয় নাকি।’
ক্যারাভানের চারপাশ ঘিরে ফেলল ওরা। একজন গাড়ির জানালায় ধাক্কা মারল। মুখটা একেবারে সাদা, ঠোঁট ফাটানো হাসি—‘প্রফেসর গুহ, দরজা খুলুন। কষ্ট করে নামবেন একটু।’
চালক কাঁপতে কাঁপতে পেছনে তাকাল। হাজরা সামনে এগিয়ে বললেন—‘দরজা খুলে দে ভাই। আমি দেখি।’
মহানির্বাণ বললেন—‘ওরা কিছু করবে না… প্ল্যান এটাই ছিল… কিন্তু…’
হাজরা বললেন—‘ভাই, প্ল্যান বলে কিছু থাকে না। সব ইম্প্রোভাইজ।’
দরজা খুলতেই এক লাফে দুজন টেনে নামাল ঋতব্রত আর মহানির্বাণকে। ততক্ষণে হাজরা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালেন। পকেট থেকে ধোঁয়া ওঠা ভেপ বার করে ঠোঁটে রাখলেন।
‘শোনো ভাই, এই ভোরবেলা রাস্তা আটকে সিনেমা করার ইচ্ছে থাকলে… একটু স্ক্রিপ্ট ভালো লেখা উচিত ছিল।’
ভোম্বল দাস ঠান্ডা গলায় বলল—‘ডাক্তার, প্লিজ মজা করবেন না। এবার কিন্তু গুলি চালাতে বাধ্য হব।’
তখনই হঠাৎ, একটা চাপা ক্লিকের শব্দ।একজন লাফিয়ে মহানির্বাণের গলা চেপে ধরল। আর আরেকজন গিয়ে ঋতব্রতর হাত মুচড়ে ধরল।
হাজরা কিন্তু দাঁড়িয়ে। ঠাণ্ডা। চোখে সেই অদ্ভুত শূন্য দৃষ্টি।ভেপের ধোঁয়া ছেড়ে বললেন—‘ভাই, তোমাদের কি সত্যি বুঝতে বাকি আছে আমি কে?তোমরা এতোটাই গাধা যে, মনস্তত্ত্বের সবচেয়ে প্রাচীন খেলা বোঝো না?
ভয় হলো তোমাদের প্রথম ভুল।’
ততক্ষণে পিস্তলের নল উঠে গেছে হাজরার দিকে। ভোম্বল দাস লোকটা চিৎকার করে বলল—‘চুপ! আর একটা কথা বললে এখানেই গুলি করে দেব তোকে পাগল বুড়ো।’
—হাজরা তখনও ঠাণ্ডা। চোখ সরু করে বললেন—‘ঠিক আছে ভাই, মেরে ফেল।কিন্তু জানবি— আজ আমি মরলে, কাল তোদের মাথা ছিঁড়ে খাবে সেই ইতিহাস, যেটা তোরা বিকৃত করছিস।’
তখনই— কর্কশ ব্রেকের শব্দ! রাস্তায় ঘুরে এসে দাঁড়াল তিনটে কালো বাইক। গড-এর আসল লোকজন।
নো গডের লোকেরা চমকে গেল। কয়েক সেকেন্ডের চুপচাপ— তারপর হুলুস্থুল! একজনের হাতে ধাক্কা, আরেকজনের পিস্তল উড়ে গেল। ধস্তাধস্তি।
এই সুযোগে হাজরা এক লাফে ঋতব্রতকে সরিয়ে নিলেন।
—‘ভাই, বলেছিলাম না? এই জগতে ফার্স্ট মুভ যাদের, তারাই জেতে। এবার প্লট টুইস্ট।’
কেউ একজন ফিসফিস করে বলল—‘ডাক্তার হাজরা, চলুন।’
হাজরা হাসলেন।
—‘চল ভাই। আজকালকার দিনে হ্যাকিং আর ধামাকা সমান জনপ্রিয়।’
ঋতব্রত স্তব্ধ। ততক্ষণে ক্যারাভান আবার গতি পেয়েছে। জানালার বাইরে অন্ধকার ছুটে যাচ্ছে। ভোর এখন প্রায় চারটে।
0 Comments