কুয়াশা যখন
পর্ব ১২
বাসুদেব গুপ্ত
ভাগ্যের ভাগাভাগি
৫০ জনের ছোট্ট সভা। বকুল বাগানের মাঠ বললে এ তল্লাটে সবাই চেনে। অল ইন ওয়ান মাঠ, পুজোর প্যান্ডেল, রবিবারের ফুটবল ম্যাচ, দোলের দিন ক্লাবের ভোজ আর পার্টির ব্যানারে গণবিবাহ সব এখানে হয়। পুরনো রঙ চটা বসতবাড়ির সারির ফাঁক দিয়ে একটা সরু গলি মাঠের পাশ দিয়ে গিয়ে রাস্তায় মিশেছে। গলিটা অন্ধকার; একমাত্র বাল্বটা লাগালেই চুরি হয়ে যায়। কেউ তার কিনারা করে নি, লাগানোই বন্ধ হয়ে গেছেচ
একজন গান গাইছিল। দেয়ালে পোস্টার সাঁটা—“প্যালেস্টাইন জিন্দাবাদ, সাম্রাজ্যবাদীরা গাজা ছাড়ো”—আর একদিকে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের কবিদের কিছু উদ্ধৃতি। গানটা ভালো শোনা যাচ্ছিল না, হারমোনিয়ামের শব্দ পাতলা কালো মেয়েটির কণ্ঠকে ঢেকে দিচ্ছিল। লোকজন কেউ কেউ সামনের চেয়ারে ঠুকে ঠুকে তাল দিচ্ছিল, কেউ কেউ ফোন নিয়ে বুস্ত।
গানের পর শুরু হল কবিতা পাঠ। বিক্রম সিং স্বপনের পিঠে চিমটি কাটল, “লেকচার শুরু হয়েছে, কানুদা বলেছে নেতা উঠলেই কাজ করতে হবে।” বোমাগুলো যথেষ্ট শক্তিশালী, কিন্তু মানুষ মারার জন্য তৈরি নয়। স্প্লিন্টার বা লোহার টুকরো এসব নেই, কাউকে খুন করার উদ্দেশ্য নেই আজ। শুধু একটা বম বম আওয়াজ করে মিটিংটা ভাঙ্গার আদেশ দিয়েছে কানুদা।
একজন পঞ্চাশোরধ দীর্ঘ মানুষ উঠে দাঁড়ালেন, অগোছালো দাড়ি, গায়ে নতুন স্টাইলের ঝোলা পাঞ্জাবি আর জিন্স। হাতে কয়েকটা কাগজের পাতা। মাইকের কাছে এসে, মাইকটা ঘুরিয়ে নিলেন ওপরে, তারপর পড়তে শুরু করলেন:
“আমি গাজার শিশুদের স্মৃতিতে এই কবিতাটা লিখেছি, যাদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে গণহত্যাকারীরা। এই ছোট্ট মেয়েটিকে মেশিনগান আর ট্যাঙ্ক ঘিরে ধরেছিল পশুরা, তারপর ১৫৫ রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল এই ছোট্ট মেয়েটিকে মারতে। আমি কবিতাটা পড়ছি:
‘হিন্দ রাজব, হিন্দ রাজব…’”, মাইকে গম গম করে উঠল লেখকের আবেগতাড়িত গলার আওয়াজ।
“এখনই সময়”, ফিসফিস করল বিক্রম সিং। মঞ্চের পিছনে গলি, গলি ফাঁকা, কেউ নেই। এই সুযোগে স্বপন দুটো টেনিস বল বের করে দেয়ালের ওপরে হাত তুলে মঞ্চের কাছে ছুঁড়ে দিল।
আলোর একটা ঝলকানি হলো। তারপর শব্দ হল প্রচন্ড। আর স্বপন দেখল বৃদ্ধ মাটিতে পড়ে গেলেন। কবিতা ধরা হাতে রক্ত ঝরছে। পড়ে গিয়ে পাথরে মাথা ঠুকে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। বিক্রম ততক্ষণ অন্ধকার গলিপথে অদৃশ্য হয়ে গেছে। স্বপন পালাতে পালাতে দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটার মুখ দেখে। লোকটা কে? গৌতম স্যার না?
🍂
স্বপনের এক মুহূর্তও আর ভাবার সময় ছিল না। সে ছোট দেয়ালটা হাতের চাপে টপকে গৌতমের কাছে গিয়ে কাঁদতে শুরু করল, “স্যার, একি হল স্যার, কে এমন করল?” তার কষ্ট টাও সত্যি, আবার মিথ্যেটাও সত্যি,
= স্যারকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কেউ সাহায্য করতে চাইলে এগিয়ে আসুন প্লীজ।”
চারপাশে ঘিরে দাঁড়িয়ে এলোমেলো দাড়িওয়ালা কিছু বুদ্ধিজীবী, তারা কী করবে বুঝতে পারছিল না। ওরা রাজনীতির জগতকে চেনে না, স্বপন কে তাও কেউ জানে না।
—“এই ভ্যানটা, এখানে এসো, তাড়াতাড়ি, হাসপাতালে যেতে হবে,” স্বপন চিৎকার করল। পাশে একটা সাইকেল ভ্যান ছিল, পোস্টার আর চেয়ার আর মাইক রাখার টেবিল এসব নিয়ে এসেছিল। সেই ভ্যানের কাঠের মেঝের ওপর কাঠের ওপর ব্যানার বিছানো, বালিশ বানানো হল বিতরণের জন্য আনা লিফলেট দিয়ে। স্বপন আর কয়েকজন হাত ধরাধরি করে গৌতমকে তুলে সেখানে শুইয়ে দিল।
—“চলো, যত জলদি পারো চালাও,” স্বপন আবার চিৎকার করল। পিছনে একবার তাকিয়ে দেখল, বিক্রম সিংহ হাওয়া, নিশ্চয়ই অন্ধকার গলির মধ্যে গা ঢাকা দিয়েছে। ভ্যানটা এদিকে নড়ছেই না প্রায়। সাইকেল ভ্যান চলে পায়ের জোরে খটর খটর করে। খুব ধীরে চলছিল। স্বপন একটা চলতি অটোকে থামাল, সামনে গিয়ে হাত ওপরে তুলে, অটো ওলা ওকে চেনে। বুঝল কিছু একটা হয়েছে।
“সরি স্যার একটু তো নামতে হবে। এমারজেন্সী। আমরা আরেকটা অটো ঠিক করব, দয়া করে নেমে যান।” এক সত্তর পার বুড়ো বাজার করে ফিরছিল, ব্যাগে শাক-সবজি, পালং শাকের ডাঁটা বেরিয়ে আছে। স্বপন তাকে প্রায় টেনে নামাল। তিনি একটু গজগজ করটে গেলেন, কিন্তু গৌতমকে অজ্ঞান দেখে নিম রাজি হয়ে নামলেন এই শর্তে, যে ওনাকে আর একটা অটো কিন্তু ডেকে দিতে হবে।
অটোরিকশাকে ভ্যানের সঙ্গে বাঁধা হল। স্বপন পকেট থেকে একটা চকচকে ছুরি বের করে, মিটিংয়ের বাঁশ বাঁধার দড়িটা কেটে ফেলে ভ্যান আর অটোতে বেঁধে দিল, আদেশ দিল, —“হেই চল, চল, সোজা সেবামন্দির হাসপাতালে।”
স্বপন জানত হাসপাতালে কানুদার নাম করলেই ভর্তি হয়ে যাবে। ওকে কেউ এখানে চেনেও না, এই হাস্পতাল ওর এরিয়ার বাইরে। তাই ভর্তি করার সময় নিজের নাম দিল “দূরসম্পর্কের ভাই”, নাম লিখতে বলল ‘সঞ্জিত দাস’। গৌতমকে এমারজেন্সী থেকে সোজা ICU-তে নিয়ে যাওয়া হল। স্বপনের চোখ তখন আগুনের মতো লাল। সিঁড়ির কাছে বড় আয়নায় নিজেকে দেখল, নিজেকে একদম খুনি খুনি লাগছে। প্যান্টে রক্তের দাগ, হাত ময়লা আর ফুলে গেছে, চোখ রক্তবর্ণ। “মা কালী, এ আমি কী হয়ে গেলাম?”
ভর্তির কাউন্টারে নার্সের কাছে ছুটে গেল পাগলের মত, “বেঁচে যাবেন তো?” নার্স বলল, “ভাববেন না। ওয়াশরুমে হাত ধুয়ে অপেক্ষা করুন। শ্বাস নিচ্ছেন । আশা করি বাঁচানো যাবে।”
তারপর তিন দিন কেটে গেল। গৌতম ICU-তে, স্কিন গ্রাফট করা হয়েছে। ছোট আঙুলটা উড়ে গেছে, ডাক্তাররা আফসোস করলেন, নিয়ে এলে জোড়ার চেষ্টা করা যেত। এখন মেরামত করে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে, গৌতমকে ছোট আঙুল ছাড়াই থাকতে হবে।
স্বপন প্রথম দুদিন দিন-রাত হাসপাতালে ছিল। গৌতম আই সি ইউতে, তদন্ত করতে পুলিশ আসবে জ্ঞান ফিরলে। নার্সরা যখন ব্যান্ডেজের রোল চাইত, সে এনে দিত। অ্যান্টিবায়োটিক চাইলে, কিনে দিত। দুবেলা ভিসিটর হয়ে ওয়ার্ডে যেত, নার্সদের কাছে রোগীর খবর নিত। অক্সিজেন লেভেল, ব্লাড প্রেসার, হার্ট রেট—সব শিখে নিল। কীভাবে এমন রোগীকে খাওয়ানো হয়, তাও দেখে দেখে শিখল। স্বপন সবসময় শেখার আগ্রহী, অফিসে ছিল সবচেয়ে অশিক্ষিত টেকনিক্যাল এক্সপার্ট, এখন দ্রুত নার্সিং এক্সপার্ট হয়ে উঠছে। নার্সরা তাকে ‘সঞ্জিতদা’ বলে ডাকত। কখনো কাজ না থাকলে, টেবিলে বসতে দিত, নিজেদের চাকরি আর বাড়ির সমস্যা নিয়ে গল্প করত।
এরপর গৌতম একটু একটু করে সুস্থ হল। কর্তৃপক্ষের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হল। স্বপন পুলিশ আসার আগেই হঠাৎ উধাও হয়ে গেল।
ঘটনার পরে পনেরো দিন কেটে গেছে, গৌতম বাড়ি ফিরেছে। হাসপাতাল অ্যাম্বুলেন্স দিয়েছে বাড়ি পৌঁছাতে। হাসপাতালের চিকিৎসা বিনামূল্যেই হয়েছে, কোনো ইনস্যুরেন্স ছাড়াই। গৌতম চিরকাল সরকারি হাসপাতালকে ঘৃণা করত—নোংরা, দুর্নীতিগ্রস্ত, দালাল আর অব্যবহৃত মেডিকেল সামগ্রী পাচার করার চক্র। মধ্যবিত্তের জন্য নরক। কিন্তু ফিরে আসার পর মনে করতে পারল না, ঠিক কোন কোন ব্যাপারে এই হাসপাতালের নামে অভিযোগ করা যায়। নার্স মেয়েটির যত্ন ওর চিরকাল মনে থাকবে। আর সব চেয়ে বড় কথা একটা পয়সাও দিতে হয় নি।
হাসপাতাল থেকে তাকে দুই শিফটে দুই আয়া ঠিক করে দিয়েছে, যতদিন না একা থাকতে পারে। পয়সা অবশ্য নিজের। গৌতমের প্রতিবেশী তাকে সিঁড়ি দিয়ে স্ট্রেচারে উঠতে দেখে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিল। গৌতম হালকা হাসল, বিখ্যাত কবিতার লাইন মৃদুস্বরে আবৃত্তি করল, “এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না। আমি আমার দেশকে ফিরে কেড়ে নেব বুকের মধ্যে টেনে নেব কুয়াশায় ভেজা কাশ বিকেল”
অ্যাম্বুলেন্সের লোকেরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল, “ইনি কি কবি?” অন্যজন বলল, “না রে, মাথায় শক লেগেছে, এখনও নরমাল হয়নি।”
-ক্রমশঃ-
বাড়িতে বসেই সংগ্রহ করতে পারেন 👇
1 Comments
হ্যাঁ কবি!❤️
ReplyDelete