জ্বলদর্চি

আন্তর্জাতিক সিনেমা দিবস/দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে

আন্তর্জাতিক সিনেমা দিবস
দোলনচাঁপা তেওয়ারী দে 

আজ ২৮শে ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক সিনেমা দিবস। সিনেমা কি, এটি আমাদের জীবনে কি প্রভাব ফেলে, এর গুরুত্বই বা কি, আসুন এই সব কিছুই জেনে নিই।

সিনেমা আধুনিক বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী ও প্রভাবশালী শিল্পমাধ্যম। এটি শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং মানুষের ভাবনা, অনুভূতি, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও সামাজিক বাস্তবতাকে তুলে ধরার এক অনন্য ভাষা। এই শিল্পমাধ্যমের গুরুত্ব ও ঐতিহাসিক যাত্রাকে স্মরণ করার জন্য প্রতি বছর ২৮শে ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক সিনেমা দিবস পালিত হয়। এই দিনটি সিনেমার জন্ম, বিকাশ এবং সমাজে এর প্রভাবকে সম্মান জানানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ।

আন্তর্জাতিক সিনেমা দিবস পালনের পেছনে রয়েছে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৮৯৫ সালের ২৮শে ডিসেম্বর ফ্রান্সের প্যারিসে লুমিয়ের ভ্রাতৃদ্বয়—অগুস্ত ও লুই লুমিয়ের প্রথমবারের মতো জনসাধারণের সামনে বাণিজ্যিকভাবে চলমান ছবি প্রদর্শন করেন। “Workers Leaving the Lumière Factory”, “Arrival of a Train at La Ciotat”–এর মতো স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে শুরু হয় সিনেমার যাত্রা। এই ঘটনাকেই আধুনিক চলচ্চিত্র শিল্পের জন্ম হিসেবে ধরা হয়। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তকে স্মরণ করতেই ২৮শে ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক সিনেমা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

সিনেমা কী? এর উত্তরে বলা যায়,সিনেমা হল,চিত্র, শব্দ, অভিনয়, সংগীত ও প্রযুক্তির সম্মিলিত শিল্পরূপ। এটি মানুষের অনুভূতিকে সরাসরি স্পর্শ করতে পারে। একটি ভালো সিনেমা হাসাতে পারে, কাঁদাতে পারে, চিন্তা করতে বাধ্য করতে পারে এবং কখনো কখনো সমাজ পরিবর্তনের অনুপ্রেরণাও জোগায়। ভাষা ও সংস্কৃতির সীমা অতিক্রম করে সিনেমা বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে।
🍂

সিনেমার বিবর্তন
শুরুর দিকে সিনেমা ছিল নির্বাক ও সাদাকালো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয় শব্দ, রং, উন্নত ক্যামেরা, বিশেষ প্রভাব (VFX), অ্যানিমেশন এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি। আজকের সিনেমা শুধু বড় পর্দাতেই সীমাবদ্ধ নয়; ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, মোবাইল ফোন ও অনলাইন মাধ্যমের মাধ্যমে সিনেমা পৌঁছে যাচ্ছে ঘরে ঘরে। এই বিবর্তন সিনেমাকে আরও গণমুখী ও শক্তিশালী করেছে।

সমাজ ও সংস্কৃতিতে সিনেমার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সিনেমা সমাজের দর্পণ। সমাজের ভালো-মন্দ, সমস্যা, বৈষম্য, প্রেম, প্রতিবাদ, দেশপ্রেম—সবকিছুই সিনেমায় প্রতিফলিত হয়। অনেক সময় সিনেমা সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে, মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করে। নারী অধিকার, শ্রমিক অধিকার, জাতিগত বৈষম্য, পরিবেশ সুরক্ষা—এমন নানা বিষয় সিনেমার মাধ্যমে মানুষের কাছে পৌঁছে গেছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সিনেমা
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশের সিনেমা নিজস্ব সংস্কৃতি ও জীবনধারাকে তুলে ধরে। বিভিন্ন আঞ্চলিক সিনেমা, হলিউড, বলিউড, ইউরোপীয় সিনেমা, ইরানি সিনেমা, কোরিয়ান সিনেমা—সব মিলিয়ে বিশ্ব সিনেমা এক বিশাল ভাণ্ডার। আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব যেমন কান, বার্লিন, ভেনিস, টরন্টো প্রভৃতি সিনেমাকে বৈশ্বিক মঞ্চে তুলে ধরতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বিশ্বের দরবারে ভারতীয় সিনেমার গুরুত্ব অসীম।
ভারতীয় সিনেমা বিশ্বে অন্যতম বৃহৎ চলচ্চিত্র শিল্প। হিন্দি, বাংলা, তামিল, তেলুগু, মালয়ালমসহ বিভিন্ন ভাষার সিনেমা ভারতের বৈচিত্র্যকে তুলে ধরে। বাংলা সিনেমার ইতিহাসও অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনের মতো চলচ্চিত্রকাররা আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতীয় সিনেমাকে গর্বের আসনে বসিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক সিনেমা দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হল,
সিনেমার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে স্মরণ করা
চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের সম্মান জানানো
তরুণ প্রজন্মকে সিনেমার শিল্পমূল্য সম্পর্কে সচেতন করা।ভালো ও অর্থবহ সিনেমা তৈরিতে অনুপ্রেরণা দেওয়া। এই দিনে বিভিন্ন দেশে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী, আলোচনা সভা, চলচ্চিত্র উৎসব, ওয়ার্কশপ ও সম্মাননা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

আজকের তরুণ প্রজন্মের চিন্তাভাবনা গঠনে সিনেমার বড় ভূমিকা রয়েছে। সিনেমা তাদের স্বপ্ন দেখতে শেখায়, নতুন ভাবনা দেয় এবং সৃজনশীল হতে অনুপ্রাণিত করে। আন্তর্জাতিক সিনেমা দিবস তরুণদের সিনেমাকে শুধু বিনোদন হিসেবে নয়, একটি শিল্প ও দায়িত্বশীল মাধ্যম হিসেবে দেখার বার্তা দেয়।

প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সিনেমার ভবিষ্যৎ আরও বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময় হচ্ছে। ভার্চুয়াল রিয়ালিটি (VR), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), উন্নত অ্যানিমেশন সিনেমার নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে। তবে প্রযুক্তির পাশাপাশি গল্প, মানবিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতাই সিনেমার আসল শক্তি হয়ে থাকবে।

আন্তর্জাতিক সিনেমা দিবস আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সিনেমা শুধু বিনোদন নয়, এটি একটি শক্তিশালী শিল্প ও সামাজিক মাধ্যম। ২৮শে ডিসেম্বর সিনেমার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে সম্মান জানানোর দিন। এই দিনে আমরা সেই সব মানুষকে কৃতজ্ঞতা জানাই, যাঁরা ক্যামেরার সামনে ও পেছনে থেকে আমাদের ভাবতে শিখিয়েছেন, অনুভব করতে শিখিয়েছেন এবং এক নতুন দৃষ্টিতে পৃথিবীকে দেখিয়েছেন। সিনেমা যেমন আমাদের আনন্দ দেয়, তেমনই আমাদের মানুষ হতে শেখায়—এই চেতনাই আন্তর্জাতিক সিনেমা দিবসের মূল বার্তা।

Post a Comment

0 Comments